এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৫.
রইস দিলদার ধরা পড়েছে বেশ কিছুদিন হলো। অথচ তার মুখ দিয়ে একটা কোনো তথ্য বের করতে সক্ষম হলো না সামরিক বাহিনী। এমন কোনো টর্চার বাকি নেই যা করা হয় নি তার উপর। তবুও শয়তানটা মুখ ফসকে একটা শব্দও উচ্চারণ করে নি। উল্টো প্রতিবারই শয়তানদের মতো বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে বলে উঠে,
“ আবার শুরু হবে ধ্বংসলীলা। “
সামরিক বাহিনীর তখন দিশেহারা অবস্থা। তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। আরেকটা ধ্বংসযজ্ঞ যে অতি সন্নিকটে তা সকলেই আঁচ করতে পারছে। কিন্তু তারা চাইলেই এই বিষয়টা এলান করে সাধারণ মানুষদের জানাতে পারছে না। উপর মহল হতে সেই অনুমতি তাদের মিলে নি। মিলবেই বা কি করে? পুরো ঘটনা না জেনে এমন তথ্য ঘোষণা করলে সাধারণ জনগণ আতংকিত হয়ে পড়বে। শয়তানের দল সতর্ক হয়ে পড়বে। আরো বহু অনিশ্চিত আশংকা রয়েছে।
এক লক্ষ আটচল্লিশ হাজার চারশো ছেষট্টি কিলোমিটার আয়তনের এই দেশে রয়েছে মোট চৌষট্টিটি জেলা। যেকোনো জেলায়ই ঘটতে পারে সেই ধ্বংসযজ্ঞ। সম্পূর্ণ সামরিক বাহিনী নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। নিজেদের জীবন দিবে তবুও সিভিলিয়ানদের নিরাপত্তাই তাদের সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি।
__________
সারারাত জ্বরে তড়পানো বাণীর পুরোপুরি সম্বিত ফিরে পরদিন বিকাল বেলা। কেবিনের জানালা ভেদ করে প্রবেশ করা বিকেলের নরম আলোয় সে দেখতে পায় একজন নার্স অদূরে দাঁড়িয়ে একটা টেবিলের উপর ফাইলে কিছু একটা লিখছে। বাণীকে নড়েচড়ে উঠতে দেখেই সে দ্রুত বাহিরে চলে যায়।
বাণী অদ্ভুৎ দৃষ্টি মেলে চারিদিকটা একবার দেখে বোঝার চেষ্টা করে সে এখানে কি করছে। মুহুর্তেই তার মনে পরে যায় গত পরশু রাতের সেই বিভৎসকর ঘটনা। মনে মনে ছক কষে সবটা মেলাতেই বাণী বুঝতে পারে তার এই হসপিটালে আসার কারণ কি।
ডক্টর হুমায়রা তড়িঘড়ি করে কেবিনে প্রবেশ করেই বাণীকে দেখে হাস্যজ্বল মুখে বলে উঠে,
“ বাণী! আমাকে চিনতে পারছো? কেমন আছো এখন? “
ডক্টর হুমায়রার মুখপানে তাকাতেই বাণীর মনে পড়ে যায় ২০১৮ সালের ২০ই মে মাসের ঘটনা। বহ্নি যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলো। বাণী তখন হাড়ভাঙা মরণ যন্ত্রণায় তড়পাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরটা তখন কালবৈশাখীর প্রভাবে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অন্ধকারে তলিয়ে। বজ্রপাতের তুলনায়ও অধিক উচ্চস্বরে বাণী চিৎকার করছিলো। তার প্রতিটা চিৎকারে হয়তো হিরণের বাড়ির প্রতিটা ইট নিজেদের কান চেপে ধরেছিলো।
জীবন মৃত্যুর সেই রাতে এই মহিলাটা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় মা ও সন্তানকে বাঁচানোর। যেখানে বাণী নিজেই গর্ভের শিশু সহ নিজের মৃত্যু কামনা করছিলো সেখানে এই মহিলা যেন কোনো দেবদূতের ন্যায় সেদিন বাঁচিয়ে নেয় দুটো প্রাণ।
বাণী অতীত হতে ফিরে এসে মলিন মুখে মৃদু মাথা নেড়ে বুঝায় যে সে হুমায়রাকে চিনতে পেরেছে। হুমায়রা এগিয়ে এসে বাণীর কপালে হাত রেখে নিজের পিছু পিছু আসা নার্সকে প্রশ্ন করে,
“ লাস্ট কখন টেম্পারেচার চেক করেছো? “
“ পনেরো মিনিট আগে ম্যাডাম। “
“ কত ডিগ্রী? “
“ ১০২° এখন। “
হুমায়রা বাণীর দিকে তাকিয়ে হেসে শুধায়,
“ তোমার যেই অবস্থা ছিলো আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। লক্ষ্মণ গুলো নিউমোনিয়ার সাথে মিলে যাওয়ায় সেই অনুযায়ী টেস্ট করানো হয়। আল্লাহর শুকরিয়া যে রিপোর্টে সেরকম কিছু আসে নি। কি একটা কাণ্ড ঘটিয়েছো বলো তো! এই সিজনে এতক্ষণ বৃষ্টিতে কেউ ভিজে নাকি? “
কথাটুকু শেষ করেই হুমায়রা স্যালাইনের ড্রিপটা চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাণী নীরবে হুমায়রার দিকে তাকিয়ে রয়। কি অদ্ভুত! মহিলা নিজের কথা দ্বারা কি বুঝাতে চাইছেন? বাণীর এই অবস্থার জন্য সম্পূর্ণভাবে বাণী নিজেই দায়ী? দোষটা সম্পূর্ণ বাণীর?
বাণীর তরফ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে হুমায়রা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
“ হিরণ সাহেব বাহিরেই আছেন। ডেকে দিবো? “
হিরণের নামটা শুনতেই বাণীর মরে যেতে ইচ্ছে হলো। এই লোকের মুখোমুখি সে হতে চায় না। সে মোটেও প্রস্তুত নয়। হিরণের মুখোমুখি হলে বাণী নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হিমশিম খাবে। উন্মাদের ন্যায় আচরণ শুরু করবে। অত:পর হয়তো হিরণ রেগে গিয়ে আরো একবার, এই হসপিটালেই…
না। আর কিছু ভাবতে পারে না বাণী। সে ভাঙা গলায় শুধায়,
“ বহ্নি কোথায়? “
ডক্টর হুমায়রা মিষ্টি হেসে বলে,
“ ও বাসায় আছে। “
“ আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই। “
বাণীর এক বাক্যের আবদার শুনতেই হুমায়রা নার্স সহ বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর হিরণের ফোন হাতে একা ভিতরে প্রবেশ করে। ফোনটা বাণীর দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করে। অর্থাৎ বহ্নি লাইনেই আছে। বাণী নিজের দূর্বল হাতে ফোনটা নিয়ে কানে চেপে ধরে নরম স্বরে শুধায়,
“ মা। “
বহ্নি অপর পাশ হতে প্রফুল্ল গলায় চিৎকার করে উঠে,
“ মাম্মা! “
“ বহ্নি, মা আমার। তুমি খেয়েছো? “
“ হ্যাঁ মাম্মা। ইবাত চাচ্চু আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। আমার সাথে মুভিও দেখেছে। আমরা অনেকক্ষণ প্লে করেছি। “
বাণী চোখ বুজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। অবশ্য এটা হওয়ারই ছিলো। তার অনুপস্থিতিতেও ওই বাড়িতে তার মেয়ের কোনো অযত্ন হওয়ার সুযোগ নেই। কারো সেই সাহস নেইও। বহ্নি প্রশ্ন করে,
“ তুমি এখন ঠিক আছো মাম্মা? “
“ হ্যাঁ মা। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো তোমার কাছে। তুমি ইবাত চাচ্চুকে বিরক্ত করো না। গুড গার্ল হয়ে থেকো। “
বহ্নির সঙ্গে কথা শেষ হতেই বাণী হুমায়রাকে প্রশ্ন করে,
“ কখন ডিসচার্জ করা হবে আমাকে? “
“ আগামীকাল সকালেই ডিসচার্জ করে দিবো। “
বাণী ফোনটা হুমায়রার হাতে দিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
“ আমি যত দ্রুত সম্ভব নিজের মেয়ের কাছে ফিরতে চাই। “
হুমায়রা আর কোনো টু শব্দ করে না। সে নীরবে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে হিরণের মুখোমুখি দাঁড়ায়। হিরণ নিজের ফোনটা পকেটে ভরে নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কি বললো? “
“ যত দ্রুত সম্ভব বহ্নির কাছে যেতে চায় ও। “
হিরণ ম্লান হাসে। সে ইচ্ছে করেই বাণীর জ্ঞান ফেরা সত্ত্বেও তার সামনে যায় নি। অবশ্য যাওয়ার মুখও নেই তার। পাছে আবার বাণী রেগে কিছু একটা করে বসে! বাণীর আপাতত সবথেকে বড় মেডিসিনই হচ্ছে বহ্নি। মেয়েকে বুকে নিলেই কেবল সে শান্ত হবে।
হিরণের ভাবনার মধ্যেই তার ফোনের নোটিফিকেশন টুংটাং শব্দ করে বেজে উঠে। হিরণ ফোন বের করে ম্যাসেজটা ওপেন করতেই দেখে গোটা ইংরেজি শব্দে লেখা একটি বাক্য।
“ Meet me at 8 pm in my house. “
ম্যাসেজের উপর শমসের মজুমদারের নামটা দেখে কিছুক্ষণ সেই পানে তাকিয়ে রয় হিরণ। গতকাল তার শমসের মজুমদারের সাথে দেখা করার কথা ছিলো। কিন্তু আচানক বাণীর শারীরিক অবস্থার অবনতির ফলে সে যাওয়ার সুযোগ পায় নি। কিন্তু আজ অবশ্যই যেতে হবে।
হিরণ ফোনটা পকেটে চালান করে দিয়ে হুমায়রার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“ আমার লোকরা এখানে আছে। কোনো প্রয়োজন পড়লে জাস্ট গিভ মি এ কল। এন্ড টেক এ গুড কেয়ার অফ বাণী। “
__________
নরম বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে বাণী। শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তার রুমে অবস্থানরত নার্সের দিকে। মেয়েটাকে যে তার পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এখানে রাখা হয়েছে তা নিয়ে বাণীর কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার মাথায় চলছে অন্য পরিকল্পনা। এটাই এক মোক্ষম সুযোগ। হসপিটালের মতো একটা জনমানব পূর্ণ জায়গা, তার উপর আবার হিরণ নাকি বাসায় গিয়েছে। রাতে ফিরবে বলে জানিয়েছে। সব মিলিয়ে উপরওয়ালা যেনো স্বয়ং বাণীর জন্য পথ খুলে দিলেন।
ভাগ্যিস বাণী তখন বলেছিলো যে সে দ্রুত বহ্নির কাছে ফিরতে চায়। হিরণের কান পর্যন্ত নিশ্চয়ই এই কথা পৌঁছেছে? হিরণ তারমানে এখন এই ব্যাপারে আশ্বস্ত যে বাণীর ইচ্ছা হলো ঘরে ফিরে যাওয়া। তা ভেবে হিরণ এখন এইদিকে তেমন একটা মাথা ঘামাবে না। আর সেই সুযোগটাই বাণীর কাজে লাগাতে হবে। তবে তার পূর্বে বাণীর এই কেবিনের বাহিরের পরিস্থিতি পরখ করতে হবে। কিন্তু তা কিভাবে করবে সে?
_________
শমসের মজুমদারের আলিসান বাড়ির লিভিং রুমের বিশাল ঝাড়বাতির নিচে পায়ের উপর পা তুলে বসে রয়েছে হিরণ। তার পড়নে এখন ফর্মাল প্যান্ট, শার্ট ও কোট। তার মুখোমুখিই ঠিক অপর পাশের সোফাটায় বসে রয়েছে শমসের মজুমদার। যিনি আপাতত বেশ আয়েশ করে নিজের হাতের কাপে থাকা মালাই চায়ে চুমুক বসাতে ব্যস্ত।
হিরণ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,
“ আব্রাহামের সাথে কথা হয়েছিলো? “
শমসের মজুমদার হাতের চায়ের কাপটা কাচের টি টেবিলের উপর রেখে বলে,
“ কথা হয়েছে। কালকের মিটিংয়ে তোমারও উপস্থিত থাকার কথা ছিলো প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ। সেই অস্ত্রগুলো ওদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা তোমার ছিলো। যা পালন করতে তুমি ব্যর্থ হয়েছো। “
হিরণ নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। বোঝার চেষ্টা করে শমসের মজুমদারের কথার দিক। অত:পর শান্ত গলায় বলে,
“ আমি অস্ত্র সাথে করে নিয়ে এসেছি। আপনি এগুলো আব্রাহামদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন। বাকিটা আমি ওকে ফোনে বুঝিয়ে দিবো। “
কথাটা বলে হিরণ চোখের ইশারা দিতেই তার অধিনভূত একজন একটা বিশাল সুটক্যাস এনে টি টেবিলের উপর রাখে। ব্যাগের চেইন খুলতেই দেখা যায় ব্যাগ ভর্তি অসংখ্য বিদেশি অস্ত্র। এই অস্ত্রগুলো হিরণের কোম্পানির তৈরী নয়। সে খাসভাবে বিদেশ হতে আনিয়েছে এগুলো। এগুলো আনাতে তার কম কাঠখড় পোহাতে হয় নি!
অস্ত্রগুলো দেখতেই শমসের মজুমদারের চোখ চিকচিক করে উঠে। সেই দৃশ্য দেখে হিরণ বাকা হাসে। তার আর এখানে কোনো কাজ নেই আপাতত। তাই সে নীরবে উঠে আসছি বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ঠিক সেই মুহুর্তে শমসের মজুমদার বলে উঠে,
“ শুনলাম বৌ মা নাকি অসুস্থ। গুরুতর কিছু না আশা করি। “
হিরণের পা থেমে যায়। শয়তানটা তবে তার উপর নজর রাখিয়েছে। মনের রাগটা চেপে গিয়ে হিরণ পিছনে ফিরে স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ সামান্য জ্বর শুধু। “
শমসের হেসে চায়ের কাপে ফের চুমুক দেওয়ার আগে বলে উঠে,
“ দেখে রেখো বৌ মা’কে। কারণ যেই হসপিটালে বৌ মা’কে এডমিট করিয়েছো সেই হসপিটালেরই অষ্টম তলায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার মেয়েও রয়েছে। “
অপ্রত্যাশিত খবরটা শুনতে পেয়ে হিরণ অবাক হয়। জুলফিকার মুজতবার মেয়ে মানে? হসপিটালটায় সামরিক বাহিনীর আনাগোনা রয়েছে তাহলে? এতো বড় তথ্যটা শমসের মজুমদার জেনেও চুপ করে ছিলো? আর হিরণের লোকেরা? তারা কি অন্ধ নাকি? একজনেরও চোখে পড়ে নি বিষয়টা। প্রশ্নগুলো ভাবতে ভাবতেই হিরণ দ্রুত পা চালায়। তার এই মুহুর্তে হসপিটালে পৌঁছাতে হবে। ভেবেছিলো আজকের রাতটা বাণীকে হসপিটালে রাখবে। কিন্তু না। আর সম্ভব নয়।
হিরণ বেরিয়ে যেতেই শমসের মজুমদার একা একাই কুটিল হাসে। বেশ মজার খেলা তো! পোষ্য কুকুরের সাথে খেলারও অন্য এক মজা আছে।
__________
তীব্র উৎকন্ঠায় ঢোক গিললো বাণী। অন্ধকার কেবিন রুমে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দেহটা যেনো নড়তেও ভুলে গেছে। দরজার বাহিরে এক ঝাঁক পায়ের দৌড়ের শব্দ কানে পৌঁছাতেই সে নিজের নিঃশ্বাসটুকুও আটকে ফেললো। যদি তার নিঃশ্বাসের শব্দ কেউ টের পেয়ে যায়?
পদধ্বনি ক্ষীণ হয়ে আসতে আসতে একটা সময় দরজার বাহিরে জায়গাটা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ শোনা যায়। বাণী তখন পরিকল্পনা অনুযায়ী ধীরে ধীরে দরজার নব ঘুরিয়ে কেবিনের বাহিরে উঁকি মারে। সম্পূর্ণ করিডর শূন্য। কিছুক্ষণ আগের শক্ত নিরাপত্তার টিকিটুকুও এখন নেই। কি করতে চলেছে ভেবেই ভয়ে বাণীর শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাম চুইয়ে পড়ে। আকাশটাও কেমন গুমোট স্বরে ডাকছে। বাণী আর অপেক্ষা করে না। দ্রুত পা চালিয়ে সে চলে যায় ইমারজেন্সি ফায়ার এক্সিট ওয়েরের দিকে। ইচ্ছে করেই নিজের গায়ের জামা বদলে সে একটা হসপিটাল গাউন পড়ে নিয়েছে। যেনো সহজে কারো নজরে না পরে। শুকনো চুলগুলো দিয়ে যথাসম্ভব নিজের মুখ আড়াল করে রাখার চেষ্টা করছে সে। ইমারজেন্সি ফায়ার এক্সিট ওয়ের দরজা পেরিয়ে সিড়ির কাছাকাছি গিয়েই সে যতদ্রুত সম্ভব পা চালায়।
তেরো তলা হতে নামাটা যদিও বাণীর মতো হালকা দেহের মানুষের জন্য তেমন একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার না। কিন্তু বাঁধ সেধে দাঁড়িয়েছে তার শরীরের দূর্বলতা। এই শরীর নিয়ে নয় তলায় নামতেই সে হাঁপিয়ে উঠে। কিন্তু থামলে চলবে না। তার দ্রুত নামতে হবে। হিরণের লোকেরা প্রধান স্টেরওয়ে এবং লিফট গুলো খুঁজে বাণীকে না পেলে নিশ্চয়ই এই সিঁড়ি পথ এসে খুঁজবে? ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই বাণী একটা বড় নিঃশ্বাস টেনে ফের সিঁড়ি ভেঙে নামা শুরু করে।
প্রায় পনেরো মিনিটের মাথায় বাণী গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে নামে। কিন্তু বের হয়ে মেইন এন্টারেন্সের দিকে যেতে নিয়েই বাণী দ্রুত ফিরে আসে। হিরণের লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাধারণ মানুষের ভীড়ে। এদের টেক্কা দিয়ে এখান থেকে পালানো মোটেও সম্ভব নয়।
বাণী মুহুর্তেই অস্থির হয়ে পড়ে। এবারও কি ব্যর্থ হবে সে? হিরণ? তার কাছে কি খবর পৌঁছে গিয়েছে? ধরা পড়লে হিরণ আবারও কি তার সাথে একই কাজ করবে? সম্ভাবনা গুলো মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই বাণী দূর্বল হয়ে পড়ে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। তখনই আচমকা তার দৃষ্টি পড়ে নিচের দিকে চলে যাওয়া সিঁড়ির দিকে। নিচে বেসমেন্টে আবার কি আছে? বের হওয়ার কি কোনো রাস্তা রয়েছে?
প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই বাণী দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সিঁড়ি ভেঙে বেসমেন্টে নামতেই সে দেখে নীরব বিশাল এরিয়া জুড়ে রয়েছে গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা। বাণী চারিদিকটা একবার পরখ করে। সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় রয়েছে এই বেসমেন্টটা। বাণী আরো একবার চারিদিকে তাকায়। অদূরে সে একটি কালো রঙের জিপ গাড়ি দেখতে পাচ্ছে। গাড়িটা যেই পজিশনে রাখা সেই পজিশনে সিসিটিভিতে কেবল গাড়ির সামনের অংশ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ গাড়ির পেছনের নাম্বার প্লেট দেখার কোনো সুযোগ নেই।
বাণী আর অপেক্ষা করে না। সে আরো একবার ভালো করে নিজের চুলগুলো যত সম্ভব মুখের সামনে ফেলে চেহারাটা আড়াল করে ফেলে নিজের অত:পর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় সেই গাড়ির পিছনের দিকে। দ্রুততার সহিত সবার আগে সে টেনে হিচড়ে গাড়ির নাম্বার প্লেটটা খুলে নিজের হাতে নিয়ে নেয়। অত:পর গাড়ির রেয়ার বোনাট খোলার চেষ্টা করে সে। কিন্তু আফসোস! গাড়ি লকড থাকায় বোনাট খোলার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
বাণী আরো কয়েকবার চেষ্টা করতে নিলেই তখনই কারো পদধ্বনির শব্দ ভেসে আসে। বাণী ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নত করে গাড়ির পিছনে লুকিয়ে পড়ে। পদধ্বনি ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে। বাণীর বুক তখন ঢিপঢিপ করে লাফাচ্ছে। হিরণের লোকেরা না তো?
গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে বাণী যখন আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত ঠিক সেই মুহুর্তেই সামনে থেকে গাড়ির দরজা খোলার শব্দ হয়। বাণী চকিতে উঁকি মারে আড়াল হতে। কিন্তু গাড়ির মালিক ততক্ষণে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছে। বাণীর চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠে। সে মনে মনে আল্লাহর দরবারে লাখ কোটি শুকরিয়া জানিয়ে অতি সাবধানে এবং নিঃশব্দে গাড়ির রেয়ার বোনাট খুলে ভেতরে উঠে বসে। সঙ্গে করে সেই নাম্বার প্লেট নিতেও ভুলে না সে। বোনাটের দরজাটা লাগিয়েই বাণী মনে মনে গাড়ির মালিককে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়। নিশ্চিত আল্লাহই এই মানুষকে পাঠিয়েছে তার সাহায্যের জন্য। মুক্ত পাখির চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে আনন্দ অশ্রু।
__________
পথিমধ্যে অবাধ্য আকাশ হতে টুপটুপ করে বৃষ্টির বর্ষণ শুরু হয়। কালো শার্ট পরিহিত পুরুষ গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাতটা নিবদ্ধ রেখে একবার জানালা ভেদ করে আকাশ পানে তাকায়। চট্টগ্রামের বৃষ্টি এরকমই হয়। কোনো আগাম বার্তা ছাড়া অসময়ের মেহমানের ন্যায় হুটহাট হাজির হয়।
আকাশ পান হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ফের পথে দৃষ্টি স্থির করে সেই চোখ জোড়া। আচমকা নিস্তব্ধ গাড়ির ভেতর শোনা যায় অদ্ভুত এক শব্দ। মুহুর্তেই প্রশস্ত হাইওয়ের মাঝে থেমে যায় কালো জিপটি। গাড়ির মালিক বিস্ময় ভরা দৃষ্টি মেলে লুকিং মিরর দিয়ে গাড়ির পেছনের দিকে তাকায়। না। কেউ নেই। তবে কি সে ভুল শুনলো? উঁহু। কোনো সম্ভাবনাই নেই।
গাড়ির মালিক বেশ সচেতন। সে অতি সাবধানে তার পাশের ফ্রন্ট সিটে থাকা কালো রঙা রেইনকোটটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। অত:পর সামান্য ঝুঁকে প্যান্ট সামান্য উঁচু করে পায়ের মোজার কাছের জায়গাটা হতে একটা কালো রঙা রিভলবার বের করে সে। বিনা শব্দ ব্যয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গাড়ি হতে নেমে ধীরে ধীরে গাড়ির পেছনের দিকে এগিয়ে যায় সে। গাড়ির পিছন দিকটায় এসে দাঁড়াতেই তার ভ্রু যুগল কুচকে আসে। তার গাড়ির পরিচয়পত্র অর্থাৎ তথাকথিত আইডি কার্ড কোথায়?
প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই সে এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে গাড়ির রেয়ার বোনাটটা তুলে। সঙ্গে সঙ্গে সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। রেয়ার বোনাটের ভেতর আশ্রয় নেওয়া এক জোড়া চোখও তাকে দেখে চমকে উঠে। কিন্তু সেই চমকানো বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। তার পূর্বেই সে মাথা নত করে চিকন স্বরে ফের উচ্চারণ করে,
“ হাচ্চি! “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]