এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৮.
আরো ছয়টা দিন পেরিয়ে গিয়েছে। এই নিরাপত্তার বেড়াজালে আবদ্ধ বাড়িটায় বাণীর প্রায়ই দমবন্ধ অনুভব হয়। নিজের মেয়েকে ছাড়া প্রতিটা মুহুর্ত তার ছটফট করে পাড় হয়। তার খুব ইচ্ছে নিজের মেয়েকে নিয়ে এই শহরটা ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না একটা মানুষের জন্য কেবল। শাহরিয়ার দূর্জয়।
দূর্জয় সেদিন রাতে এই বাড়ি থেকে প্রস্থান করার পর আর এই বাড়ির মুখো হয় নি। প্রথমে বাণীর এ নিয়ে খুব অস্বস্তি কাজ করছিলো। কিন্তু ইলিয়াস কাঞ্চন নামক লোকটার মাধ্যমে দূর্জয় একদিন কলে তার সঙ্গে কথা বলেছিলো। সেই কথোপকথনে দূর্জয় জানায় যে, সে খুব জরুরী একটা কাজে আটকে আছে। ব্যস্ততাটা কিছুটা কমলেই সে আসবে। বাণী যেনো ধৈর্য্য ধরে কেবল অপেক্ষা করে। নিজে যেনো ভুল করেও দূর্জয়ের কথার বাইরে গিয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বহ্নিকে উদ্ধারের চেষ্টা না করে। দূর্জয়ের উপরে আস্থা রেখে যেনো একটু স্থির থাকে।
বাণী দূর্জয়ের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা পায় না। সে নিজেও ভালো করে জানে, কোনো ধরনের সাহায্য ব্যতীত বহ্নিকে ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মায়ের মন এতো যুক্তি মানতে চায় না। ইচ্ছে হয় ছুটে নিজের মেয়ের কাছে চলে যেতে।
এই কয়েক দিনে আরেকটা ব্যাপারে বাণী না চাইতেও খুব আগ্রহ অনুভব করে। তা হলো এই বাড়ির লক করা বেডরুমটা। কেনো যেনো তার মনে হয় ওই বেডরুমের ভিতরে দূর্জয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু লুকিয়ে রেখেছে। অবশ্য তা অবাক করার মতো বিষয় নয়। দূর্জয়ের পেশা অনুযায়ী এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তবুও কেনো জানি ঘুরে ফিরে বাণীর ওই রুমটা একদফা ঘুরে দেখার খুব ইচ্ছে জাগে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে নিজেকে এ বলে শাসায় যে, দূর্জয় তাকে সাহায্য করে কেবল এখানে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। অনেকটা শরনার্থীর ন্যায়। এই সামান্য সাহায্যের মানে এই নয় যে দূর্জয় তাকে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি আগ্রহ দেখানোর এক্সেসও দিয়েছে।
ইউটিউবে বিবিসি নিউজের একটা ইংরেজি প্রতিবেদন দেখতে দেখতে এসব আকাশ কুসুম ভাবনায় মশগুল ছিলো বাণী। আচমকা গুলি বর্ষণের তীক্ষ্ণ শব্দে তার ভাবনার জগতে ভাটা পড়ে। ভীত দৃষ্টি মেলে সে টিভির স্ক্রিনের পানে তাকায়। রঙিন পর্দায় দেখাচ্ছে চট্টগ্রামের সেই ভয়ংকর টেরোরিস্ট অ্যাটাকের ঝলক। কলেজ ভবনের থেকে দূরে রাস্তায় সাংবাদিকদের উপচে পড়া ভীড়। দূর হতে কলেজ ভবনের ভিতর থেকে ভেসে আসছে গুলি বর্ষণের শব্দ।
বাণী ভীত দৃষ্টি মেলে দেখে ভয়ংকর সেই দৃশ্য। দূর্জয় কিছুদিন পূর্বে এই বাড়ির টিভিটায় ওয়াই-ফাই সংযোগের ব্যবস্থা করতে একজন লোককে পাঠিয়েছিলো। হয়তো বাণীর একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য নতুবা বাণীর সময় কাটানোর জন্য। ওয়াই-ফাই সংযোগ দিয়ে যাওয়ার পর থেকে বাণী বহি বিশ্বের বিভিন্ন ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ডকুমেন্টারি দেখে যাচ্ছে একের পর এক। আজ কতগুলো বছর ধরে সে বাহিরের পৃথিবী সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। সে তো ভেবেছিলো হিরণের ওই চার দেয়ালে ঘেরা প্রাসাদের ভেতরটাই কেবল ভয়ংকর। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে বাহিরের দুনিয়াটাও ভালো নেই। কেমন একটা অসুস্থ পরিবেশ চারপাশ ঘিরে। মানুষ রূপী একদল জানোয়ার পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যারা কিনা নিরপরাধ মানুষদের উপর অমানবিক ভাবে গণ হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। আর এই জানোয়ার গুলো এতোটা শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে যে এখন কেউই এদের দমাতে পারছি না। বাণী জানে না এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়। কিন্তু সে মনে মনে দোয়া করে যেনো পৃথিবীটা সুস্থ হয়। এই গোলাগুলি যেনো শেষ হয়, নিরপরাধ মানুষ এবং নিষ্পাপ শিশুরা যেনো মুক্তি পায়।
__________
ব্যক্তিগত একটা ফোন পেতেই প্রত্যয় যতদ্রুত সম্ভব চট্টগ্রামের নামি-দামি একটা কফিশপে এসে উপস্থিত হয়। মুখভঙ্গি তার এজ ইউজুয়াল তেতো রকমের। টেবিলের অপরপ্রান্তে বসে থাকা মধ্য বয়সের দুই ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা সতর্ক দৃষ্টি মেলে দেখে প্রত্যয়কে। বোঝার চেষ্টা করছে ছেলে রেগে আছে নাকি না। প্রত্যয় সেই দৃষ্টি উপেক্ষা ভদ্রমহিলার উদ্দেশ্যে সরাসরি বলে,
“ তোমরা উইদাউট এনি নোটিশ হঠাৎ চট্টগ্রাম এসেছো কি আমার চেহারা খুটিয়ে দেখতে? “
ভদ্রমহিলা নরম গলায় প্রতুত্তর করে,
“ তিনমাস ধরে তুমি বাড়ি আসো না। আমাদের কি ইচ্ছে করে না তোমাকে একটু দেখার? “
প্রত্যয় টেবিলের উপর থাকা গরম কফি কাপটার পাশে হাত ছুঁইয়ে উত্তর দেয়,
“ ভিডিও কলে তো দেখোই। “
এবার ভদ্রলোক সামান্য কেশে বলে উঠে,
“ শুনলাম তুমি নাকি আগামীকাল দেশের বাহিরে যাচ্ছো। “
প্রত্যয়ের ভ্রু এবার কুচকে আসে। সে বলে,
“ তুমি আমার পিছনে কি গোয়েন্দা লাগিয়েছো? “
ভদ্রলোক প্রত্যয়ের মতোই মুখ কালো করে জবাব দেয়,
“ তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো তোমার পেশার উপরের পদের বেশ কিছু জনের সঙ্গে আমার ভালোই সখ্যতা রয়েছে। তুমি আমাকে নিজের জীবনের ব্যাপারে কিছু জানাবে না দেখে যে, আমি কিছু জানতে পারবো না সেটা তোমার ভুল ধারণা। “
প্রত্যয় এবার গরম কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলে,
“ চট্টগ্রাম যেহেতু এসেছোই, আম্মুকে নিয়ে তাহলে কক্সবাজার ঘুরে যেও কিছুদিন। যান্ত্রিক কোলাহলমুক্ত সমুদ্রের বিশুদ্ধ হাওয়ায় প্রশান্তি খুঁজে পাবে। “
ছেলের এমন আউট অফ টপিক জবাবে মতিউর আরাফাত খুব বিরক্ত হয়। তিনি রাগ সংবরণ করে ফিসফিসিয়ে শুধায়,
“ তুমি ফিলিস্তিন যাচ্ছো ত্রাণ বিতরণ করতে। মাথা ঠিক আছে তোমার? “
প্রত্যয় সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে তাকায় সতর্ক দৃষ্টিতে। পরখ করে কেউ তাদের কথা শুনলো কিনা। নিশ্চিত হয়ে নিচু গলায় জবাব দেয়,
“ এই বিষয়ে এখানে আমি কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। আর আমি যাবো এটা ফাইনাল। “
মতিউর আরাফাত স্ত্রী ফিজার উদ্দেশ্যে বলে,
“ তোমার ছেলের মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে ফিজা। ওকে বুঝাও। “
স্বামীর কথা শুনতেই ফিজা উঠে এসে ছেলের পাশের চেয়ারটায় বসে। ছেলের দুইহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠে,
“ বাবা সময় আছে। তুমি মানা করে দাও। তোমার বাবা ব্যবস্থা করে নিবে একটা। তোমার জায়গায় যেনো অন্য কাউকে পাঠানো হয় সেই ব্যাপারে কথা বলবে। “
প্রত্যয় নিজের মায়ের সেন্টিমেন্ট উপলব্ধি করে। তবুও সে নরম হয় না। বরং কাটকাট গলায় জবাব দেয়,
“ সরি আম্মু। তোমার এই আবদারটা রাখতে পারলাম না। “
মতিউর আরাফাত এবার রেগে বলে উঠে,
“ তুমি জানো কোথায় যাচ্ছো তুমি? একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে। ওইখানে লাইফের কি গ্যারান্টি আছে? নিজের ভাইয়ের পথে হাঁটা বন্ধ করো। এসব দেশপ্রেম ওকে কি দিয়েছিলো মনে আছে? যুদ্ধের ময়দানে মরেছে। আর যাদের নিজের ভাই ভেবেছিলো তারা কি করেছে তোমার ভাইয়ের সাথে? তারা নিজেদের বাঁচাতে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। তোমার ভাইয়ের লাশটাও শত্রুর ঘাটি থেকে নিয়ে ফিরে নি। তুমিও একই পরিণতি চাও? “
প্রত্যয় শুনে সবটা। পাশে বসা নিজের মায়ের নীরব অশ্রু সে টের পায়। কিন্তু মা’য়ের চোখের জল না মুছে সে নিজের আব্বুর দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলে,
“ যুদ্ধের ময়দানে কেউ মরে না আব্বু। শহীদ হয়। ভাইয়া ইজ এ মার্টার। “
কথাটুকু বলেই প্রত্যয় উঠে দাঁড়ায় প্রস্থানের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে ফের বলে,
“ আর ছোটবেলায় তোমরাই সবসময় বলতে বড় ভাইয়ার থেকে যেনো ভালো কিছু শিখে সেই অনুসারে লাইফ লিড করি। এখন যখন ভাইয়ার পথ অনুসরণ করে ভালো কিছু করছি তখন তোমাদের এতো সমস্যা হচ্ছে কেনো? “
উত্তরের অপেক্ষায় আর দাঁড়ায় না প্রত্যয়। সেখান থেকে প্রস্থান করে। মতিউর আরাফাত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ এক ছেলের জানাজা পড়েছি ফিজা। নিজের জীবন দশায় আরেক ছেলের জানাজা পড়ার মতো সাহস আমার নেই। ওকে এই পথ থেকে ফেরানোর জন্য যা যা প্রয়োজন হয় আমি করবো। ওকে বুঝতে হবে ওর কিছু হলে এই দেশের কিছু যায় আসবে না। কিন্তু ওর পরিবার শেষ হয়ে যাবে। “
“ কি করবেন আপনি? “
“ পুরুষ মানুষকে ঘর মুখো করার ক্ষমতা আল্লাহ শুধু নারীদের দিয়েছে। “
ক্ষীণ ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে ফিজা চুপ হয়ে যান। উনি আর এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান না। উনি শুধু নিজের ছেলের জীবিত ফিরে আসাটুকুই কামনা করেন।
__________
পড়ন্ত সন্ধ্যায় দরজার কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছে দূর্জয়। মিনিট গড়ানোর আগেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় শাড়ি পরিহিতা এক রুগ্ন নারী। দূর্জয় একপলক তাকে দেখে চোখ নামিয়ে ফেলে। বহুবছর পূর্বে দেখা এক টমবয়কে এতো বছর পর এই বাঙালী নারী রূপে দেখে সে প্রায়ই অজানা কারণে অস্বস্তি অনুভব করে। বাণীও দূর্জয়কে দেখে চোখ নামিয়ে নেয়। সেদিন রাতের পর আজ তাদের প্রথম দেখা। অস্বস্তি বাণীও অনুভব করছে। তার ব্যাপারে আর কোনো কিছুই এই মানুষটার অজানা নয় ভেবেই সেই অস্বস্তি কাজ করছে।
নীরবতার পালা ভেঙে দূর্জয় বলে,
“ সারাদিন বাড়ির ভেতরই থাকো? উঠোনে বের হও না? “
বাণী কেবল মাথা নেড়ে না জানায়। দূর্জয় গলা ঝাড়ি দিয়ে বলে,
“ ভেতরে আসবো না। বাহিরে বের হও। উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে কথা হবে। “
বাণী আর কথা বাড়ায় না। শাড়ির আঁচলটা টেনে অপর পাশের কাধে চেপে দূর্জয়ের পিছু পিছু বের হয়। উঠোনের একপাশে ইলিয়াস কাঞ্চন সহ আরেকজন টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের এদিকে কোনো ধ্যানই নেই। দূর্জয় হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠে,
“ তোমার বাবা আই মিন আনিসুজ্জামান তালুকদার বর্তমানে কি অবস্থায় আছে সেই সম্পর্কে কোনো আইডিয়া আছে? “
“ উনার ব্যাপারে কিছু জানতে আমি আগ্রহী নই। “
দৃঢ় গলায় কথাটুকু বলে বাণী। দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ আনিসুজ্জামান তালুকদার ছয় বছর আগে মারা গিয়েছে বাণী। হি ইজ নো মোর। “
বাণী চকিতে দূর্জয়ের পানে তাকায়। অবাক সে। তবে দুঃখ অনুভব করছে না বিন্দু পরিমাণ। সে মাথা নত করে বলে,
“ ওহ। “
“ জানতে চাইবে না কিভাবে মারা গেলো? “
“ উনি কখনো জানতে চেয়েছিলেন একটা আগুন্তকঃ লোকের বাড়িতে আমি কিভাবে বেঁচে আছি? “
বাণীর চাপা ক্ষোভ তার কণ্ঠে স্পষ্ট ফুটে উঠে। দূর্জয় নিজেই বলে উঠে,
“ তোমাদের বাড়িতে ডাকাত হামলা হয়েছিলো। ডাকাতেরা কয়েক কোপে উনাকে খুন করেছেন। “
বাণী আগ্রহ পায় না এই ব্যাপারে কিছু না শোনার। লোকটাকে সে চরম ঘৃণা করে। সেই ঘৃণার মাঝে মায়ার কোনো স্থান নেই। এরকম নিকৃষ্ট একটা লোক পৃথিবী থেকে চলে গেলে পৃথিবীর নিশ্চয়ই খুব বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না?
দূর্জয় এবার হাঁটা থামিয়ে বাণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
“ আমার মনে হয় খুনটার সাথে হিরণ জড়িত। যেনো আর কেউ তোমার ভাইয়ের মতো আনিসুজ্জামানকে ফলো করে তোমার পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে। “
বাণী এতে অবাক হয় না। হিরণের জন্য এটা অসম্ভব বিষয় নয়। সে এসব কথা বাদ দিয়ে সরাসরি বলে,
“ আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট দেম দূর্জয়। আই অনলি কেয়ার এবাউট মাই ডটার। আজকে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে ও আমাকে ছাড়া থাকছে। ও এখনো অনেক ছোট। শি নিডস মি। “
দূর্জয় বুঝতে পারে বাণী আনিসুজ্জামান তালুকদার কিংবা হিরণ কারো ব্যাপারেই কথা বলতে আগ্রহী নয়। তাই সে বলে,
“ ট্রাস্ট মি। খুব দ্রুতই বহ্নি তোমার কাছে থাকবে। “
তাদের অগোচরে উঠোন সীমানার বাহিরে ঝোপঝাড়ের আড়াল হতে একজোড়া চোখ তাদের ভালো করে দেখে নেয়। খুবই সাবধানে নিজের ফোনে নিঃশব্দে ধারণ করে তাদের ছবি। মুখে লেপ্টে থাকা ক্রুর হাসিটা দীর্ঘায়িত করে সে ফের তাকায় দূর্জয় ও বাণীর পানে।
__________
ফোনে একটা ম্যাসেজ পেতেই অন্যা দ্রুত ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে রুম ছেড়ে বের হয়। রাত সাড়ে বারোটার এসময় তার বাড়ির প্রত্যেকেই গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। তবুও সবাই ঘুমিয়েছে কিনা নিশ্চিত হয়ে সে বিড়ালের মতো কদম ফেলে ঘর ছেড়ে বের হয়। অত:পর দ্রুত বাড়ির বাহিরে রাস্তায় বের হতেই দেখে একটা বাইক নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে রাফি। কেবল রাফি একা হলে অন্যা এই মুহুর্তেই ছুটে গিয়ে তার বুকে আছড়ে পড়তো। কিন্তু রাফির সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফ এবং প্রত্যয়কে দেখে সে নিজের সেই ইচ্ছায় বালিচাপা দিয়ে শান্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায়। সাইফ অন্যাকে দেখেই একগাল হেসে বলে,
“ আসসালামু আলাইকুম ভাবী৷ “
অন্যাও সামান্য হেসে সালামের জবাব দেয়। প্রত্যয় অবশ্য এতো ফর্মালিটিস না করে হেসে বলে,
“ হাই অন্যা। “
সাইফ সঙ্গে সঙ্গে বাগড়া দিয়ে বলে,
“ শালা ভাইয়ের বউকে ভাবী বলে। এতটুকু কমন সেন্স নাই? “
প্রত্যয় ভ্রু কুচকে বলে,
“ এখনো রাফির বউ তো হয় নি। “
“ এনগেজমেন্ট তো হইসে। মানে ফিফটি পার্সেন্ট বউ অলরেডি হয়ে গেসে। বাকি ফিফটি পার্সেন্ট কবুল বললেই হয়ে যাবে। “
সাইফের যুক্তির পিঠে প্রত্যয় আর কিছু বলে না। এই ছেলেকে একটা কিছু বললে সে এটার পিঠে দশটা যুক্তি হাজির করে দিবে। রাফি বন্ধুদের দিকে আহত দৃষ্টি মেলে কিছু একটা ইশারা করে। সাইফ এবং প্রত্যয় সেই ইশারা দেখে বেশ মজা পায়। বেচারাকে কি অসহায় দেখাচ্ছে! সাইফ শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলে,
“ আজকে প্রত্যয় গার্ড দিবি। অন্যার হিটলার বাপকে দেখলেই সাথে সাথে সিগনাল দিবি। “
নিজের আব্বুকে এরকম হিটলার ডাকায় অন্যা সামান্য মুখ লটকে বলে,
“ ভাইয়া পৃথিবীর সব প্রেমিকার বাপই হিটলার হয়। বিশ্বাস না হলে একটা প্রেম করে দেখুন। প্রেমিকার সঙ্গে হিটলার শশুর বাই ওয়ান গেট ওয়ান অফারের মতো পেয়ে যাবেন। “
__________
সাইফ আর প্রত্যয় দু’জন দু’দিকে পাহারা দেওয়ার জন্য প্রস্থান করতেই অন্যা মুখ কালো করে প্রশ্ন করে,
“ কবে নাগাদ ফিরবে তুমি? “
“ জলদিই ফিরবো। “
অন্যা আর কোনো কথা বলে না। মুখ কালো করে রাফির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার রাফির এই ফিলিস্তিনে যাওয়ার বিষয়টা মোটেও ভালো লাগছে না। কিন্তু কিছু করার নেই তার। রাফির পেশাকে সে সম্মান করে। সে এই বিষয়টা মাথায় রেখেই সম্পর্কে জড়িয়েছিলো যে, রাফির কাছে সবসময় তার চাকরিই ফার্স্ট প্রায়োরিটি থাকবে। রাফির কাছে যেমন তার জব ফার্স্ট প্রায়োরিটি, তেমনই অন্যার কাছে রাফি তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি।
রাফি এক মুহুর্ত অন্যার মলিন মুখ দেখে হেসে বলে,
“ মলিন মুখে বিদায় জানাবে? “
অন্যা আর অপেক্ষা না করে এবার ধীরে সুস্থে রাফিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ দ্রুত ফিরবে। অপেক্ষায় থাকবো। “
__________
“ ভাইয়া, আজ এখনও জেগে? “
ম্যাসেজটা পেতেই সাইফের আচমকা মেজাজ একই সঙ্গে ফুরফুরে এবং গরম হয়ে যায়। দিন দিন এই মেয়ের ভাইয়া ডাকটা বেড়েই চলেছে। আর অপরদিকে এই গা জ্বলানো ডাক শুনে সাইফের মেজাজ থার্মোমিটারের পারদের মতো বেড়ে যায়। তবুও সে ভদ্র ভঙ্গিতে টাইপ করে জবাব দেয়,
“ জ্বি মিস ইয়াসমিন। একটা কাজে এলাম। “
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিশা জবাব দেয়,
“ আপনারা এডাল্টরা বেশ অদ্ভুৎ। রাত বিরাতেও আপনাদের কাজ থাকে। অথচ এটা ঘুমানোর সময়। “
ম্যাসেজটা পড়ে সাইফের ভ্রু কুচকে আসে। সে অন্যাদের বাসার গলির মশার কামড় খেতে খেতে লিখে পাঠায়,
“ আপনার বয়স কতো? “
“ ব্যাড ম্যানার্স ভাইয়া। মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করা উচিত না। ডোন্ট ইউ নো দ্যাট? “
সাইফ চোখ সরু করে ম্যাসেজটা কয়েকবার পড়ে। এখন এই ভীতু মেয়ে তাকে ম্যানার্স শিখাবে? সাইফ ম্যানার্স শিখতে মোটেও ইচ্ছুক নয়। তাই সে লিখে,
“ ঘুমান মিস ইয়াসমিন। গুড নাইট। “
নিশা ম্যাসেজটা পড়ে অবাক হয়। হুট করে কথার মধ্যপথে বিদায় নেওয়া কি এই লোকের স্বভাব? এই স্বভাবটা মোটেও পছন্দ নয় নিশার। সে বিড়বিড়িয়ে বলে,
“ এগেইন ব্যাড ম্যানার্স। “
নিশা ফোন রেখে মন খারাপ করে শুয়ে রয়। অদ্ভুত বদভ্যাস হয়েছে তার। এই অতি ব্যস্ত ম্যানারলেস লোকটার সঙ্গে কথা বলতে কেনো যেনো তার ভালো লাগছে তার হঠাৎ করে। হয়তো একাকিত্বের জন্য। আম্মু নেই। আব্বুও প্রায় সারাদিন বাহিরেই কাটায়। রুহী নেই। এমন অবস্থায় তার অবচেতন মন কথা বলার জন্য একজন সঙ্গী খুঁজলেই সে এই সাপ বিচ্ছু প্রেমী লোকটাকে ম্যাসেজ দেয়। লোকটা দু চারটা অদ্ভুৎ কথা বলে কথার মাঝখানেই সবসময় উধাও হয়ে যায়।
__________
এক রুমের আলিশান হোটেল রুমটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। সেই অন্ধকারের মাঝেই ল্যাপটপের স্ক্রিনটা রুমটাকে মৃদু আলোকিত করার প্রচেষ্টায় মত্ত। বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে বসে কি বোর্ডে দ্রুত ভঙ্গিতে হাত চালাচ্ছে এক রমণী। গভীর মনযোগ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে নিবদ্ধ। আচমকা ফোনের রিংটোনের শব্দে তার মনযোগ ভঙ্গ হয়। ফোনটা হাতে নিতেই দেখে একটা ফরেন নাম্বার থেকে ইনকামিং কল। রমণী অপেক্ষা না করে কল রিসিভ করে এরাবিক ভাষায় বলে উঠে,
“ হ্যালো স্যার। “
ফোনের অপর পাশ থেকে একটা পুরুষালী স্বর একই ভাষায় বলে উঠে,
“ মিস দৃশান নামরা। নতুন কোনো আপডেট? “
“ আ’ম স্টিল ওয়ার্কিং অন ইট স্যার। “
“ এতো সময় আপনাকে দেওয়া সম্ভব নয় দৃশান। বিষয়টা মাথায় রাখবেন। যত দ্রুত সম্ভব ওই র্যাস্কেলকে খুঁজে বের করে সঙ্গে নিয়ে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরুন। “
“ স্যার আই’ল বি ব্যাক সুন। “
ফোনটা রাখতেই সেই নারী জ্বলজ্বল দৃষ্টি মেলে ল্যাপটপের স্ক্রিনের পানে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্টিকেল তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ইয়েমেনে আরো একটা টেরোরিস্ট অ্যাটাক। দৃশান চোখ বুজে নেয় সঙ্গে সঙ্গে। হচ্ছে টা কি? তার মাতৃভূমির বর্তমান অবস্থা এভাবেই খুব করুণ। তার উপর পরপর কয়েকমাসের ব্যবধানে তিনবার এই টেরোরিস্ট অ্যাটাক। এর শেষ কোথায়?
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]