এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩৫.

0
208

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৫.

নির্জন রুমে হাত পা বাধা অবস্থায় বসে আছে এক আহত পুরুষ। তরতাজা শরীরটা রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। গায়ের পাঞ্জাবিটায় লেগে থাকা রক্ত শুকিয়ে বিশ্রী গন্ধ বেড়িয়েছে। সেই পাঞ্জাবির চারিপাশে ভীড় জমিয়েছে নোংরা মাছির দল। আচমকা কারো আগমনের আভাস পেতেই শমসের মজুমদার চোখ তুলে তাকায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখে হাসে। অত:পর মুখ বিকৃত করে বলে,

“ তুই হচ্ছিস সেই কুকুর যার লেজ আজীবন বাকাই থাকবে। কখনো সোজা হবে না। সুযোগ পেতেই কামড়ে দিয়েছিস, শালা অকৃতজ্ঞ। “

হিরণ নীরবে কথাটুকু শুনে হেসে শমসেরের বরাবর একটা চেয়ারে বসে। করুণার সুরে বলে,

“ আ’ম শিওর আমার থেকে বড় হারামজাদা তুই এই জগতে দ্বিতীয়টা খুঁজে পাবি না। “

“ আমাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবি না হিরণ। শীঘ্রই আমার খোঁজ পড়বে। আমি এই মিশনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আমাকে ছাড়া কোনো ডিল হওয়া অসম্ভব। “

হিরণ শমসেরের কথা শুনতে শুনতে হাতে থাকা ব্র্যান্ডের নিষিদ্ধ পানীয় বোতলটার ছিপি খুলে। অত:পর ডগডগ করে কিছুটা সাবাড় করে সে হেসে বলে,

“ আমার জন্য অসম্ভব বলে কোনো বিষয় নেই। তাই মিশনের চিন্তা তুই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। তোকে ছাড়া এই মিশন পরিচালনা করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না আমার। আফটার অল তোর পোষ্য কুকুর গুলোকে টাকা দিয়ে পোষ মানিয়েছি। সারাদিন এখন এরা আমার পা চাটবে। “

শমসের ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে বলে,

“ নিজেকে খুব বড় কিছু মনে করিস, তাই না? “

“ মনে করার কিন্তু নেই। আমি খুব বড় কিছুই। “

শমসের একদলা থুথু মেঝেতে ফেলে বলে উঠে,

“ এতো বড় মানুষ হয়ে লাভ কি যদি নিজের বউকে নিজের করে না রাখতে পারিস? “

হিরণ চোখ মুখ শক্ত করে বলে,

“ বাণীকে কোথা থেকে উদ্ধার করেছিস তা জানিয়ে দে। দয়া দেখাবো তোর প্রতি কিছুটা। “

“ মিথ্যা আশ্বাস দিবি না হিরণ। তুই আর দয়া শব্দ এক বাক্যে ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। “

“ ইউ হ্যাভ নো আদার অপশন। “

“ আমি কখনোই বলবো না। তোর কি মনে হয় তুই সত্যটা জেনে আমাকে শেষ করে দিবি আর পরে নিজে শান্তিতে জীবন পাড় করবি? আমি কখনোই তোকে শান্তিতে থাকতে দিবো না। ঠিক এই কারণে আমি ওই সাহায্যকারীর পরিচয় গোপন রাখবো। যাতে আমি না থাকলেও কেউ একজন গর্ত খুড়ে তোকে খুঁজে বের করে। তোর তিলে তিলে গড়ে তোলা সবকিছু ধূলিসাৎ করে দেয়। “

কথাটুকু বলেই শমসের বিশ্রী হাসি দেয়। হিরণ হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয়। তার কিছু কাজ আছে। এই হায়েনার সাথে কথা বলে আপাতত সময় নষ্ট করতে আগ্রহী না সে। এর পেট থেকে কথা বের করার ব্যবস্থা সে পরে করবে। এই ভেবেই হিরণ উঠে দাঁড়ায়। প্রস্থানের জন্য পা বাড়াতেই শমসের পিছন থেকে গা জ্বালানে হাসি দিয়ে বলে উঠে,

“ তবে একটা বিষয় তোকে জানাতে পারি। তোর বউ এতদিন এক ব্যাচেলর ছেলের সঙ্গে একা এক বাসায় ছিলো। সারারাতও কাটিয়েছে ওই ছেলের সাথে। সাহায্য করার বিনিময়ে নিশ্চয়ই ওই ছেলে তোর বউকে এভাবেই ঘরে সাজিয়ে রাখে নি? যা আর কেউ পারে নি তা তোর বউ পেরেছে। তোর একদম জায়গামতো আঘাত করেছে। তোর পুরুষত্বে চুনকালি মেখে দিয়েছে। “

হিরণের কপালের পাশের রগটা রাগে তখন দপদপ করছে। সে সাপের ন্যায় ফোসফাস করতে করতে এলোমেলো দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে সে রুমের এক কোণে মেঝের উপর একটা হাতুড়ি দেখতে পায়। হিরণ এক দন্ড অপেক্ষা না করে সেই হাতুড়িটা হাতে তুলে উল্টো ফিরে ক্ষিপ্র গতিতে সেটার সাহায্যে শমসেরের মাথায় আঘাত করে। কেবল একটি আঘাত দ্বারাই সে শমসের নামক অধ্যায়ের ইতি ঘটায়।
__________

একটা সিকুয়েন্স মেইনটেইন করে হাঁটছে চারজন মানুষ। সবার সামনে টর্চ হাতে যেই রমণী হেঁটে চলেছে তার কদম অনুসরণ করছে বলিষ্ঠ তিনজন যুবক। রাতের আঁধার চিড়ে সবথেকে নিরাপদ রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তারা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। রিদওয়ান ক্ষানিকের জন্য জারিয়াহর পানে তাকায়। মেয়েটার বয়স কম। তবে বিচক্ষণ খুব। নাহয় এখন পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারতো না। তার মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ পূর্বে জারিয়াহর অকপটে বলা কিছু সত্য বুলি।

“ আমি স্বার্থহীন ভাবে আপনাদের সাহায্য করতে চাইছি না। আবার অনৈতিক কাজেও আপনাদের সাহায্য করবো না আমি। আমি জানি আপনারা আমাদের মিত্র। নাহয় কখনো আমার ভূখন্ডের অভুক্ত মানুষদের ক্ষুধা মিটাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন না। আমার একটা ছোট বোন আছে। ওকে নিয়ে যেনো কিছুদিন খাবারের অভাবে আমার দিন কাটাতে না হয় সেজন্য আমি আপনাদের সাহায্য করবো। বিনিময়ে আপনারা শুধু আমাকে খাবারের ব্যবস্থা করে দিবেন। “

জারিয়াহর ভাঙা ইংরেজিতে বলা কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে তিনজন সৈন্যই নীরব বনে যায়। রিদওয়ান নীরবতা ভেঙে বলে উঠে,

“ তোমার খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা সেই ব্যবস্থা করে দিবো। এখন ফিরে যাও। আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। “

জারিয়াহ দৃঢ় গলায় বলে,

“ না। আমি এভাবেই আপনাদের সাহায্য নিয়ে ঋণী হতে পারবো না। আমার বাবা বলতেন কেউ আমাকে সাহায্য করলে, আমিও যেনো সুযোগ বুঝে সেই সাহায্য ফিরিয়ে দেই। “

প্রত্যয় শুধায়,

“ তোমার বাবা ভালো কথা বলতেন জারিয়াহ। কিন্তু সত্যি আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। “

“ প্রয়োজন আছে। আপনারা যেই রাস্তা ধরে এগোচ্ছেন তা নিরাপদ নয়। “

জারিয়াহর মুখে এতটুকু শুনেই তিনজন সৈন্যের মুখে মৃদু চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। জারিয়াহ তাদের আশ্বস্ত করে বলে,

“ চিন্তা করবেন না। এই শহরের প্রতিটা অলিগলি চিনি আমি। আপনাদের নিরাপদ রাস্তা ধরে গন্তব্যে পৌঁছে দিবো। বিশ্বাস রাখুন। “

প্রত্যয়, রিদওয়ান এবং রাফি কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই জারিয়াহ প্রশ্ন ছুড়ে,

“ এখন বলুন আপনাদের গন্তব্য কোথায়? “

আচমকা প্রত্যয়ের ডাকে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা চক্রের স্মৃতিচারণ হতে বেরিয়ে আসে রিদওয়ান। সামনে লক্ষ্য করে দেখে জারিয়াহ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রিদওয়ান কিছু বলতে নিবে তার আগেই জারিয়াহ ঠোঁটে আঙুল চেপে সবাইকে চুপ থাকার ইশারা করে। সবাই সঙ্গে সঙ্গে পিনপতন নীরবতার ইশারাটুকু মেনে নেয়। জারিয়াহ যথেষ্ট সাবধানে হাতের টর্চটা নিভিয়ে একটা বাড়ির পিছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। তাকে অনুসরণ করে বাকি তিনজনও আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যয় হাতের গুগল ম্যাপে চেক করে দেখে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের পিস্তলটা বের করে হাতে চেপে ধরে। রাফি আর রিদওয়ানও একই কাজ করে। জারিয়াহ আড়াল হতে উঁকি দিয়ে সামনের বাড়ির দিকে দৃষ্টি স্থির করে। কিছুক্ষণ সময় গড়াতেই বাড়ির ভেতর হতে দু’জন লোক বেরিয়ে আসে। তাদের দেখতেই জারিয়াহ চাপাস্বরে বলে,

“ আমাদের এখুনি এখান থেকে যেতে হবে। “

__________

ফ্লাক্সে করে গরম পানি ভরে রান্নাঘর থেকে বের হয় বাণী। পরিবেশটা কেমন শীতল শীতল। এই আবহাওয়ায় বহ্নির না আবার ঠান্ডা লেগে যায় সেই চিন্তা করেই বাণী ফ্লাক্সে করে মেয়ের জন্য আলাদা করে গরম পানি নিতে নিচে এসেছিলো। রাতও খুব হয়েছে। রুমে ফিরেই বহ্নিকে ঘুম পাড়াতে হবে তার।

সিঁড়ির কাছাকাছি যেতেই বাহির থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে আসে। বাণী একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির পানে তাকায়। রাত ১১ টা বেজে ৪৫ মিনিট। হিরণ ফিরেছে নিশ্চয়ই? বাণী আর সেদিকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।

হিরণ ঘরে প্রবেশ করতেই একজন হেল্পিং হ্যান্ড দৌড়ে এসে প্রশ্ন করে,

“ স্যার খাবার সার্ভ করবো? “

হিরণ শীতল গলায় বললো,

“ কিছুর প্রয়োজন নেই। বেরিয়ে যাও সবাই। “

মহিলাটা সাহস করে বলে,

“ স্যার কিছুর প্রয়োজন হলে… “

হিরণের হুংকারে তার বাকি কথা অসম্পূর্ণই রয়ে যায়,

“ বললাম না কিছুর প্রয়োজন নেই? সবাই বেরিয়ে যাও। নাহয় খুব খারাপ হয়ে যাবে। “

হিরণের হুংকারে উক্ত মহিলা ভয়ে কেঁপে উঠে। মুহুর্তেই তিনি সহ বাকি হেল্পিং হ্যান্ডরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় যত দ্রুত সম্ভব। সম্পূর্ণ বাড়ি বাহিরের মানুষ শূন্য হতেই হিরণ দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। সঙ্গে সঙ্গেই বহ্নির রুমের দরজার বাহিরে সে বাণীকে ফ্লাক্স হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

হিরণের চেঁচামেচি শুনে বাণী কৌতূহল বশত এখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু এই মুহুর্তে হিরণের এই ভয়ংকর রূপ দেখে তার মনে হচ্ছে সে খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছে। তার উচিত ছিলো হিরণের হুংকার শুনতেই রুমের ভেতর গিয়ে দরজা লক করে ফেলা। নিজের ভুলের জন্য যখন বাণী আফসোস করতে ব্যস্ত সেই সময়টুকুতে হিরণ ত্রস্ত পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসে। শক্ত হাতের থাবায় বাণীর বাহু চেপে ধরে তাকে বহ্নির রুম হতে কিছুটা দূরে নিয়ে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে। ছোট করে সাপের ন্যায় হিসহিসিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কোন পুরুষের বাসায় উঠেছিলে তুমি? “

হিরণের চোখের দৃষ্টি আর তার গলার স্বর শুনে বাণীকে আবার ভয় জেকে ধরে। সে মৃদু গলায় বলে,

“ বহ্নি পানি চেয়েছিলো। ওকে পানি খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, রুমে এসে পরে কথা বলছি। “

বাণীর উত্তর হিরণের মনপুত হয় না। সে একহাতে বাণীর হাতের ফ্লাক্সটা কেড়ে নিয়ে অন্য হাতে বাণীর গলা চেপে ধরে বলে,

“ পরে না এখনই কথা হবে। কার বাসায় ছিলে তুমি? কোন ব্যাচেলর তোমার প্রতি এতো মেহেরবান হয়েছে? “

বাণী ঢোক গিলে গলা সামান্য ভিজিয়ে বলে,

“ কোনো ব্যাচেলরের বাসায় ছিলাম না। ওই লোক শমসের মিথ্যা বলেছে। “

হিরণের ধৈর্য্য বাঁধ ভাঙে। তার বিধ্বংসী রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সে বাণীর গলা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে অপর হাতের ফ্লাক্সটা দ্বারা দেয়ালে সজোরে আঘাত করতে করতে চেঁচিয়ে উঠে,

“ মিথ্যা বললে খুন করে ফেলবো। একদম মিথ্যা বলবে না। আমাকে দেখলে খুব ঘৃণা লাগে? অন্য পুরুষকে দেখলে ঘৃণা কাজ করে না?… “

বাণীর নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম পায়। তার উপর মাথার কাছে দেয়ালে ফ্লাক্সের এই আঘাতের শব্দ তার মস্তিষ্কে গিয়ে খুব তীক্ষ্ণ ঠেকছে। এরকম একটা পরিস্থিতেও বাণীর নিজেকে ছেড়ে বহ্নিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। বাচ্চাটা ঘুমায় নি এখনো। ও যদি এখন এখানে চলে আসে? কি বিভৎসকর এক মানসিক আঘাত পাবে তার মেয়েটা!

বাণীর ভাবনার মাঝেই হিরণ ফ্লাক্সটা ছুড়ে ফেলে বাণীর গলা আরো জোরে চেপে ধরে তার মাথা দেয়ালের সঙ্গে আঘাত করতে করতে চেঁচিয়ে উঠে,

“ কার জন্য? কার জন্য শাড়ি পড়েছিলে? কোন শু*রের বাচ্চার সাথে এতোগুলো দিন কাটিয়ে এসেছো নাম বলো। “

হিরণের লাগাতার আঘাতের ফলে বাণীর মাথার পিছনের দিকটা বারবার দেয়ালের সঙ্গে বারি খাচ্ছে। অপরদিকে নিঃশ্বাস স্বল্পতায় মনে হচ্ছে এই বুঝি চোখ উল্টে দমটা ফুরিয়ে যাবে। নিজের হয়ে সাফাই গাওয়ার পরিস্থিতেও নেই সে। হিরণের হিংস্র চেঁচামেচি থেমে যায় একটা দৃঢ় কোমল স্বরের পিঠে।

“ মাম্মা ব্যথা পাচ্ছে। “

হিরণের হাতের বাধন আলগা হয়ে আসে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে নিজের ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুমের দরজার বাহিরে দাঁড়ানো ছোট বাচ্চা মেয়েটার পানে। বহ্নির চোখে তখন কিছুটা ভয়, কিছুটা বিস্ময় এবং এক আকাশ সমান ঘৃণা। মেয়ের চোখে সেই অবিশ্বাস্যকর ঘৃণার সাক্ষী হতেই হিরণের দৃষ্টি হতে হিংস্রতা উবে যায়। নরম ও কোমল হয়ে আসে তার দৃষ্টি। বাণী তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়েছে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টায় মত্ত সে। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে রেখেছে। মাথা মনে হচ্ছে এখনই ফেটে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ দপদপ করছে। মস্তিষ্ক ব্ল্যাংক এবং চোখের সামনে সবটা ঝাপসা হয়ে আছে তার।

হিরণ একপল বহ্নির ঘৃণা ভরা দৃষ্টি দেখে নিয়ে ফের বাণীর দিকে তাকায়। বাণীর অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্রেইনের বিবেক সিস্টেম টার্ন অন হয়। সে হাঁটু গেড়ে বাণীর সামনে বসে তার গাল ছুঁয়ে প্রশ্ন করে,

“ বাণী? আ’ম সরি। আমি তোমাকে হার্ট করতে চাই নি। “

বাণী তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেই হিরণের হাত নিজের গাল থেকে সরিয়ে দেয়। হিরণ অসহায় অনুভব করে। কাকে আগে সামলাবে? বাণীকে নাকি বহ্নিকে? এরই মাঝে সে লক্ষ্য করে বাণীর নাক দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। হিরণ ভীত হয়ে যায়। রক্ত আসছে কেন? মাথায় আঘাত পাওয়ার ফলে? সে দ্রুত নিজের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে বাণীর দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই ছোট ছোট দুটো হাতের ধাক্কায় পিছিয়ে যায়। বহ্নি কণ্ঠে সবটুকু ঘৃণা ঢেলে দিয়ে বলে,

“ মাম্মার কাছে আসবে না তুমি। তুমি মাম্মাকে হার্ট করেছো। আই হেইট ইউ। “

হিরণ হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে রয় মেয়ের পানে। বহ্নির চোখে তখন পানি টলমল করছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না। নিজের সামনের এই হিংস্র লোকটা তার পাপা এই সহজ সত্যিটা তার ছোট্ট মস্তিষ্ক মানতে চাইছে না। কিন্তু নিজের মাম্মার অবস্থা দেখে এই সত্যিটা মানতে বাধ্য হয় সে। আরো একবার জোর গলায় উচ্চারণ করে,

“ আই হেইট ইউ। তুমি আমার পাপা না। “

কথাটুকু বলেই বহ্নি দ্রুত বাণীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। এতক্ষণ শক্ত থাকলেও রক্ত দেখে সে ঘাবড়ে গিয়েছে বেশ। বাণীকে আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। বাণী মেয়ের অবস্থা দেখে সাময়িক সময়ের জন্য নিজের যন্ত্রণাটুকু ভুলে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। একহাতের পিঠে নাকের রক্তটুকু মুছে মেয়েকে বুকে মিশিয়ে নিয়ে শান্ত করার সুরে বলে,

“ মা ঠিক আছি। ভয় পেও না। কিচ্ছু হয় নি মায়ের। “

বহ্নি শান্ত হয় না। বাণী মেয়ের অবস্থা দেখে ঝাপসা চোখ মেলে হিরণের দিকে তাকায় একবার। হিরণ তখন নিশ্চল ভঙ্গিতে তাদের পানেই তাকিয়ে ছিলো। সে বুঝতে পারছে না নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! বাণী ওই অবস্থায়ই আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে মেয়েকে তুলে দ্রুত বহ্নির রুমের ভেতর গিয়ে দরজা লক করে দেয়। শুধু লোক করেই ক্ষান্ত হয় না বরং ছিটকিনিটাও তুলে দেয়। অত:পর মেয়েকে বুকে মিশিয়ে সে দরজার সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। অবশেষে সেই দিন এসেই পড়লো! বহ্নি তার পাপার হিংস্র রূপটা দেখেই ফেললো। বহ্নির উপর দিয়ে কি ঝড় বইছে তা আন্দাজ করতে পেরেই বাণীর কান্না পায়। সে মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বলে,

“ চুপ থেকো না মা। কেমন লাগছে মাম্মাকে বলো। চেপে রেখে যন্ত্রণা বাড়িও না। “

বহ্নি অস্ফুটে কেবল আওড়ায়,

“ আই হেইট হিম। আই হেইট হিম। আই… “

দরজার অপর পাশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকা হিরণের কানে পৌঁছায় প্রতিটা শব্দ। শরীর থেকে রুহ বেরিয়ে যাওয়ার কষ্ট কতটা তীব্র হয় সেই সম্পর্কে হিরণের ধারণা নেই। কিন্তু এখন সে যেই ধরনের কষ্ট অনুভব করছে তা কোনোভাবেই রুহ বেরিয়ে যাওয়ার কষ্টের তুলনায় কম নয়। তার নিয়তি এমন কেন!

দরজার নিচে সামান্য ফাঁক দিয়ে বাণীর গায়ের ওড়নার কিছুটা অংশ বেরিয়ে আছে। হিরণ অসহায়ের ন্যায় সেই ওড়নার অংশটুকু দুই হাতের মুঠোয় পুড়ে নেয়। দূর্বল গলায় বলে,

“ মাফ করে দাও বাণী। “

ওড়নায় মৃদু টান পড়তেই এবং হিরণের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই বাণী তড়িৎ গতিতে বহ্নিকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটানে ওড়নার অংশটুকু হিরণের আওতা থেকে ছাড়িয়ে নেয়। এতক্ষণে দমিয়ে রাখা কান্নাটা এবার চোখ ছাপিয়ে জল হয়ে বেরিয়ে আসে। আচমকা ফের তার মাথায় কিছুক্ষণ আগের আঘাতের ফলে তীক্ষ্ণ ব্যথাটুকু জাগ্রত হয়। বাণী দুইহাতে মাথার চুল টেনে ধরে আর্তনাদ করে উঠে। তার আর্তনাদ দেখে বহ্নি ভীত হয়ে পড়ে। সে বিছানার সঙ্গে গুটিসুটি মেরে সাক্ষী হতে থাকে নিজের মাম্মার এই করুণ অবস্থার।

দরজার অপর পাশে বসে থাকা হিরণের কানেও পৌঁছায় বাণীর আর্তনাদ। বাণীর সেই আর্তনাদ তার অন্তরের স্বত্তা কাঁপিয়ে তুলে। দিকদিশা শূন্যের ন্যায় সে হাসফাস করতে থাকে। এলোমেলো হাতে শার্টের গলার কাছের দুটো বোতাম খুলে ফেলে সে। হুট করে নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকে সে নিজের মৃত্যুকামনা করে বসে। রুমের ভেতরে উপস্থিত এই দু’জন মানুষের কষ্টের কারণ হওয়ার থেকে মৃত্যু শ্রেয়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

[ বহুদিন পর আজ একই দিনে দুটো পর্ব দিয়েছি। চটপট পড়ে নিজেদের মূল্যবান মন্তব্য পেশ করুন। আমি আপনাদের মন্তব্য পড়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করবো। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here