এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৭.
নীরব হোটেল রুমটায় প্রবেশ করতেই সর্ব প্রথম লাইট জ্বেলে দেয় এক অজ্ঞাত নারী। দরজাটা লক করেই সে ধীরে ধীরে বিছানার ধারে এগিয়ে যায়। হাতের ক্যামেরাটা সাবধানে রেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। অত:পর সন্তর্পণে গায়ের জ্যাকেট এবং ভেতরে পড়ে থাকা শার্টটা খুলে ফেলে। আপাতত তার গায়ে কেবল একটা স্লিভলেস টি শার্ট রয়েছে। চিকন ফিতের ন্যায় হাতার নিচেই সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কাধের সাদা রঙা ব্যান্ডেজটা। নিজের বিরক্তিমাখা দৃষ্টিটা ক্ষতের পট্টির দিকে স্থির করে রাখে সে।
ভাগ্যিস! ভাগ্যিস বুলেটটা তার কাধের চামড়া ঘেঁষে গিয়েছে কেবল। নাহয় এই ভিনদেশের মাটিতে আহত হাত নিয়ে কি ঝামেলাটাই না পোহাতে হতো তার! অবশ্য ওই সৈন্যের নিশানা খুব নিখুঁত ছিলো। এ তো দৃশানের সাত কপালের ভাগ্য যে সে ওই মুহুর্তে স্থির দিকে না দৌড়ে বারবার দিক পরিবর্তন করে দৌড়াচ্ছিলো। যেনো পিছন থেকে কেউ গুলি ছুড়লেও নিশানা জায়গা মতো না লাগে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিঙ্গেল আলমারিটা খুলে সেখানে ঝুলানো তিনটা টি শার্ট থেকে একটা ঢিলেঢালা টি শার্ট হাতে নিয়ে নেয় দৃশান। সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত টাওয়ালটাও নিয়ে নেয়। মূলত সে শাওয়ার নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ওয়াশরুমে যাওয়ার সময়ই তার ফোনটা আচমকা শব্দ তুলে বেজে উঠে। দৃশান দ্রুত কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপর পাশ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ নিজস্ব মাতৃভাষায় বলে উঠে,
“ প্লিজ, আমি কোনো ভালো খবর প্রত্যাশা করছি তোমার থেকে মিস নামরা। বলো যে তুমি ওই স্ক্রাউন্ডেলকে খুঁজে পেয়েছো। “
দৃশান নামরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠে,
“ ইয়েস স্যার। ফাইনালি খুঁজে পেয়েছি। আই’ল সেন্ড ইউ হিজ পিকচার্স। “
কলটা কেটেই দৃশান সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা থেকে আগে ল্যাপটপে জীবন ঝুঁকি নিয়ে তোলা ছবি গুলো নিয়ে নেয়। অত:পর তা মেইল করে নির্দিষ্ট এড্রেসে পাঠিয়ে দেয়। কাজটুকু করে দৃশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের এলোমেলো লাগেজের পানে তাকায়। গোসল সেরে এসে তার দ্রুত এসব গুছিয়ে নিতে হবে। কেবল কালকের অপেক্ষা এখন। একবার ক্যামেরাবন্দীকৃত মানুষটাকে আটক করে নিজের দেশে ফিরতে পারলেই স্বস্তি পাবে সে। এই দৌড় ঝাপের জীবনের মধ্যে নিজের পরিবারকে কিছুটা মিস করছে সে। মা, বাবা, বড় ভাইয়া, ভাবী, আপু সবাইকে কতদিন ধরে দেখার সুযোগ পাচ্ছে না সে!
__________
সূর্যের প্রখর আঁচটা এসে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতেই বাণী পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। মাথা তুলে চাইতে নিলেই অনুভব করে মাথাটা এখনো গত রাতের সেই বিশ্রী ব্যাথার শিকার হয়ে আছে। বাণী মলিন মুখে নিজের পাশে তাকায়। একপাশ ফিরে একটা ছোট সফট টয় বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে বহ্নি। বাণীর মনে পড়ে যায় মধ্যরাতের দিকে সে নিজেই উঠে বহ্নিকে সহ বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছিলো। তখনও বহ্নি বারবার বলছিলো ও পাপাকে হেট করে। আর কখনো পাপার সাথে কথা বলবে না সে। বাণী তখন চোখ বুজে নীরবে সবটা শুনছিলো। কোনো জবাব দেয় নি।
বহ্নির এই ঘৃণা যেমন তাকে এক প্রকার প্রশান্তি দিচ্ছে তেমনই তার নিজের মেয়ের জন্য মায়াও হচ্ছে। পিতা নামক মানুষটা একটা মেয়ের কাছে সবথেকে ভরসার স্থান হয়। সেই মানুষটাই যখন ভরসা ভাঙে, নিজের নিকৃষ্টতম রূপটা জাহির করে তখন একটা মেয়ের মনের কি অবস্থা হয় তা বাণী ভালো করেই জানে। বহু বছর আগে সে-ও এরকমই এক ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো নিজের পিতার আসল রূপ সম্পর্কে জেনেছিলো। এতো বছর পর তার মেয়ের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটলো।
ভাবনাটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই বাণী সোজা হয়ে উঠে বসে। উঁহু। সে নিজের ভাগ্যের পুনরাবৃত্তি বহ্নির সাথে ঘটতেতে দিবে না। ভালো হয়েছে বহ্নি সত্যটা জেনেছে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে সবটা বহ্নিকে জানতে হবে। এই বাস্তবতাটুকু ফেস করতে হবে তার। কারণ নাহয় যেই পরিবেশের ভেতর তাদের আটক করে রাখা হয়েছে সেই পরিবেশের ভেতর চোখে কাঠের চশমা পড়ে থাকলে বহ্নি কখনো ভালো খারাপের পার্থক্য করতে শিখবে না। কখনো সে বুঝতে শিখবে না যে রিয়েল লাইফটা মারভেল স্টুডিওজের মুভির মতো নয়। এখানে হ্যারি ওসবর্নের মতো খলনায়ক চরিত্র অগণিত থাকলেও, পিটার পার্কারের মতো একটা সুপারহিরোর খুব অভাব। রিয়েল লাইফে অন্ধকার জগত থেকে মুক্তি দিতে কোনো সুপারহিরোর আগমন হয় না। নিজের ইচ্ছাশক্তি আর চেষ্টার মাধ্যমেই কেবল মুক্তি মিলতে পারে।
__________
হিরণের মুখোমুখি হয় বাণী যখন সে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার জন্য নিচে নামে। খাবার টেবিলের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে সে ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে হিরণকে একবার দেখে নেয়। হিরণ অনেকটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নাস্তা করতে ব্যস্ত তখন। যেনো গতকাল রাতে কিছুই হয় নি। বাণী আর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে যায়। খিদে পেয়েছে খুব তার। হেল্পিং হ্যান্ডরাও বাসায় উপস্থিত নেই। রান্না বান্নায় সে বরাবরই অপটু। যখন মা ছিলো তখন কখনোই তার রান্না শেখার ইচ্ছে জাগে নি, আর যখন মনে হলো বেসিক লাইফ স্কিল হিসেবে রান্নাটা জানা প্রয়োজন তখন হাতে ধরে শেখানোর জন্য মা’ই রইলো না।
বাণী অসহায় চোখে একবার চারিদিকে তাকায়। অত:পর নীরবে একটা নুডুলসের প্যাকেট নিয়ে তা সিদ্ধ বসিয়ে দেয়। দু তিন মিনিট পরেই সে সঙ্গে থাকা মশলার প্যাকেট হতে মশলাও দিয়ে দেয়। রান্না শেষে চুলো বন্ধ করে সে আবার অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে সস প্যানের দিকে। পানির পরিমাণ বেশি দিয়ে ফেলেছে সে। এই এক গামলা পানির ভেতর নুডুলস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হিরণ তখন নিজের প্লেট রাখতে রান্নাঘরে এসেছিলো। এই দৃশ্য দেখে সে সাহস করে বলে,
“ ওটস বানিয়েছিলাম। টেবিলে এখনো আছে কিছুটা। খেয়ে নাও। “
বাণী শান্ত গলায় প্রতিবাদ করে,
“ ঠেকায় পড়ে বিষ খেতে রাজি না আমি। “
বলেই বাণী একটা আপেল হাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে হিরণ বলে উঠে,
“ সন্ধ্যার পরে রেডি থেকো। হসপিটাল যাবো। “
বাণী সামান্য হেসে বলে,
“ আগেও তো বহুবার গায়ে হাত তুলেছেন। আজ এতো আদিখ্যেতা কেনো? “
হিরণ শীতল গলায় বলে,
“ আই ওয়াজ নট ইন মাই সেন বাণী এন্ড আ’ম সরি ফর দ্যাট। “
“ ইউ নো হোয়াট? গো টু হেল উইথ ইউর সেন। আমার আর আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকবেন শুধু। “
কথাটুকু বলেই বাণী আবার বলে উঠে,
“ বাই দ্যা ওয়ে গতকালের জন্য ধন্যবাদ। আপনার সন্দেহই প্রমাণ করে আপনার সো কলড ভালোবাসার দাবীটা আসলেই মিথ্যা। আর এই ঘটনার উছিলায় আমার মেয়ের সামনে আপনার মুখোশটাও উন্মোচন হয়ে গেলো। “
__________
সন্ধ্যা পাড় হয়ে রাতের আগমনী বার্তা হিসেবে নিঝুম অন্ধকারটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তেই তিন সৈন্য সকলের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে নীরবে বেরিয়ে আসে। ক্যাম্পিং এরিয়া ছেড়ে কিছুটা দূরে চলে আসতেই রাফি বলে,
“ জারিয়াহ আমাদের সাথে যাবে না? “
রিদওয়ান চোখ গরম করে ফিসফিসিয়ে বলে,
“ রাস্তা তো আমাদের খেয়ালই আছে। ওইটুকু মেয়েকে এমন সামান্য বিষয়ের জন্য বিপদে ফেলার মানে হয়? “
রাফি বলে,
“ আমি ওটা মিন করি নি। ও নিজেই তো কাল বারবার করে বলছিলো যেনো ওকে ছাড়া আমরা না যাই। সেজন্যই বললাম। “
প্রত্যয় সতর্ক দৃষ্টি মেলে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,
“ চুপচাপ হাঁটবি তোরা? “
বাকিটা পথ নীরবে পাড় করে তিন সৈন্য পৌঁছে যায় গতকালের নির্দিষ্ট সেই ঠিকানায়। অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ। বিচক্ষণ চোখে চারিদিকটা পরখ করে। ভেতর থেকে ক’জন মুখ লুকোনো ব্যক্তি বেরিয়ে আসে। সংখ্যায় হাতে গোণা ক’জন। রিদওয়ান তাদের উপর নজর রাখতে ব্যস্ত যখন, সেই সময়টুকুতে প্রত্যয় ও রাফি চারিদিকটা একবার আড়াল হতে টহল দিয়ে আসে। পাছে এখানে আরো লোক আছে নাকি!
তাদের গোণা মতে এখানে বারো থেকে তেরো জন মুখ লুকানো মূর্তি উপস্থিত আছে। জায়গাটা বড্ড শুনসান এবং নীরব। জনমানবশূন্য। চারিদিকে যেই কয়েকটা বাড়ি আছে তা-ও পরিত্যক্ত। এই বারো তেরো জনকে একা হাতে সামলানো বলিষ্ঠ দেহের তিন সৈন্যের জন্য বড়ো কোনো ব্যাপার না। তাই তারা পকেট হতে সাইলেন্সার বসানো পিস্তল বের করে তিন দিক দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে সেই অসভ্যদের উপর। আচমকা আক্রমণে প্রথমে সেই মুখোশধারী দল বিস্মিত হলেও মুহুর্তেই তারা নিজেদের সামলে নেয়। পাল্টা ঘাতের প্রয়াস চালায়। তিনজন সৈন্য তিনজন মুখোশধারীকে গলা পেচিয়ে পেশিবহুল এক হাতের বাধনে চেপে ধরে অন্য হাতের সাহায্যে বাকিদের দিকে পিস্তল তাক করে। প্রত্যয় কড়া গলায় শাসায়,
“ গেট অন ইউর নিলস আদারওয়াইজ আই’ল শুট। “
মুখোশধারী গুলো ভয় পেলো বলে মনে হলো না। উল্টো তাদের চোখে হায়নার মতো হিংস্রতা ফুটে উঠে। তারাও নিজেদের গোপন আস্তানা হতে পিস্তল বের করে হাতে তুলে নেয়। তাক করে প্রত্যয়, রিদওয়ান ও রাফির বরাবর। শো ডাউনের শুরুটা ঘটে রিদওয়ানের ছোড়া গুলির মাধ্যমে। মুখোশধারীরাও পাল্টা গুলি ছুড়ে। তাদের পিস্তলে সাইলেন্সার না থাকায় গুলি ছোড়ার তীক্ষ্ণ শব্দ হয়। সেই শব্দে আঁধার রাতে গাছে বসে বিশ্রাম নেওয়া পাখির দল ভীত হয়। তারা এলোমেলো ডানা ঝাপটায়, কিচিরমিচির শুরু করে। কিন্তু সেই গুলি গিয়ে লাগে তিন সৈন্যের বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ অমানুষ গুলোর গায়ে যাদের কি-না সৈন্যরা নিজেদের সেফটি শেলড হিসেবে ব্যবহার করেছে। ইতিমধ্যে ছয়জন মুখোশধারী বর্ষিত গুলি দ্বারা কাবু হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। বাকি ছয়জনকে কাবু করতে যখন ব্যস্ত সৈন্যরা তখনই একজন আহত মুখোশধারী উঠে পিছন থেকে রিদওয়ানকে আঘাত করতে দেয়। কিন্তু একটা শক্ত পাথরের আঘাতে সে আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রিদওয়ানের কানে পৌঁছায় সেই শব্দ। সে সামান্য সময়ের জন্য পিছু ফিরে তাকাতেই দেখে এক একতলা পরিত্যক্ত বাড়ির ছাদে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে আছে জারিয়াহ।
রিদওয়ান অবাক হয়, বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়। এই মেয়ে এখানে কখন এলো? আর এলো তো এলো, এই বাড়ির ছাদে কিভাবে উঠলো? রিদওয়ান ফায়ার করতে করতে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
“ এখানে কি করছো জারিয়াহ? “
জারিয়াহ নিজের কাধে ঝুলে থাকা কাপড়ের থলে থেকে মাঝারি আকারের পাথর নিয়ে অমানুষ গুলোর দিকে ছুড়ে মারার মাঝে জবাব দেয়,
“ আমাকে ছাড়া আসতে নিষেধ করেছিলাম আপনাদের। বিপদে পড়লেন তো? “
প্রত্যয়, রাফি, রিদওয়ান তিনজনই অবাক হয়। কিন্তু তারা আর প্রশ্ন করার সুযোগ পায় না। দ্রুত নিজেদের মনযোগ স্থির করে প্রতিপক্ষের পানে। একজন মুখোশধারী সুযোগ বুঝে জারিয়াহর দিকে বন্দুক তাক করতেই জারিয়াহ দ্রুত হেড ডাউন করে অন্যপাশে সরে যায়। ঠিক ২৫ মিনিটের চলমান এই গুলি বর্ষণের ইতি ঘটে সু কায়দায় মুখোশধারীদের দমনের মধ্য দিয়ে। রিদওয়ান দ্রুত পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে এগিয়ে গিয়ে নিচ থেকে জারিয়াহর নাম ধরে ডাকতেই জারিয়াহ মাথা বের করে তাকায়। রিদওয়ান সামান্য ধমকে বলে দ্রুত নিচে নামতে। সাত ফুটের থেকে কিছুটা উঁচু এই একতলা বাসার ছাদে একটা উঁচু ড্রাম এবং জানালার গ্রিলের সাহায্যে উঠেছিলো জারিয়াহ। এখনো একইভাবে নামতে নেয় সে। কিন্তু ড্রামে পা রাখতেই তার লম্বা বোরকার ন্যায় কাপড়টা পায়ে ফেসে সোজা মাটিতে পড়ে সে। রিদওয়ান তখন এক এক করে সকল মুখোশধারীদের নিকট হতে অস্ত্র সড়াতে ব্যস্ত ছিলো। পিছনে কারো ধপাস করে পড়ে যাওয়ার শব্দ হতেই সে ফিরে তাকায়। অত:পর দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বলে,
“ সব জায়গায় বড় সেজে নিজে নিজে ডিসিশন নেওয়াটা বাজে অভ্যাস জারিয়াহ। “
জারিয়াহ তখন হাতের ব্যথায় কুঁকড়ে ছিলো। হয়তো চামড়া সামান্য ছিলে গিয়েছে। এই চিনচিনে জ্বালায় তো তাই মনে হচ্ছে! রিদওয়ান এবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“ উঠে এসো। মোটেও সময় নষ্ট করা যাবে না। কাজ আছে আমাদের। “
জারিয়াহ অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ায়। প্রত্যয় ততক্ষণে সেই লোকেশনে ট্র্যাক করা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছে। রাফি নিহত মুখোশধারীদের মুখের কাপড় সরাতে ব্যস্ত ছিলো। জারিয়াহ ও রিদওয়ানও তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই জারিয়াহ সেই মুখোশধারীদের মুখ থেকে আঁতকে উঠে। সে ভীত স্বরে বলে উঠে,
“ ইয়া রাব! “
রিদওয়ান ও রাফি তার ভীত মুখশ্রী দেখে। রাফি ছোট করে প্রশ্ন করে,
“ কি হয়েছে জারিয়াহ? “
জারিয়াহ কাঁপা গলায় বলে,
“ এরা আমার দেশের নয়। “
‘আমার দেশের নয়’ কথাটা দ্বারা জারিয়াহ কি বুঝাতে চেয়েছে বুঝতে পেরেই রিদওয়ান এবং রাফিও অবাক হয়। রাফি আরো একবার মুখোশধারীদের বেশভূষা দেখে অবাক গলায় প্রশ্ন করে,
“ তুমি কিভাবে নিশ্চিত জারিয়াহ? ওদের বেশভূষা দেখেছো? গলায় তাবিজও আছে। “
জারিয়াহ ফুসে উঠে,
“ তাবিজ আমাদের ধর্মকে রিপ্রেজেন্ট করে না। “
কথাটুকু বলেই জারিয়াহ একজন নিহতের পাশে বসে তার ফুল স্লিভসের টি শার্টের হাতা কিছুটা উপরে তুলে দেখিয়ে বলে,
“ দেখুন প্রমাণ। এটা ওই অমানুষগুলোর চিহ্ন। ওরা বেশভূষা বদলে মুসলিম সেজে ছিলো। “
রাফি এবং রিদওয়ান বিচক্ষণী দৃষ্টি মেলে দেখে নিহতের হাতে সেই ট্যাটু জাতীয় জিনিসটা। কালো খোদাই করা ট্যাটু দিয়ে একটা সুনিপুণ নকশা আঁকা হাতের কব্জির একটু নিচে। এই নকশাটা রিদওয়ান চেনে। দ্যা স্টার অফ ডেভিডের নকশা। অর্থাৎ ইহুদীদের। জারিয়াহ ক্ষোভ মিশ্রিত গলায় বলে উঠে,
“ এরা কখনোই আমার দেশের কিংবা আমার ধর্মের মানুষ না। আমরা নিরস্ত্র। আমাদের কাছে অস্ত্র থাকলে এভাবে মরতে হতো না আমাদের। প্রতিরোধ করতাম। প্রতিরক্ষা করতাম। “
রিদওয়ান কিছু বলার পূর্বেই বাড়ির ভেতর থেকে একটা ল্যাপটপ হাতে প্রত্যয় ত্রস্ত্র পায়ে বেরিয়ে আসে। চাপাস্বরে চিৎকার করে বলে,
“ আই ফাউন্ড দিজ। “
রাফি প্রশ্ন করে,
“ সন্দেহজনক আর কিছু পাস নি? “
“ না। কিন্তু এই ল্যাপটপ থেকেই সব পরিচালনা করা হতো। দিজ ইজ এ বিগ থিং। “
রিদওয়ান তখন মনে মনে কিছু একটা হিসাব মিলাতে ব্যস্ত ছিলো। আচমকা সে চেঁচিয়ে উঠে,
“ শিট! আমাদের এখান থেকে যেতে হবে এখনি। “
প্রত্যয় অবাক গলায় প্রশ্ন করে,
“ কি হয়েছে রিদওয়ান? “
“ প্রত্যয় দেই ডোন্ট বিলং ফ্রম দিজ কান্ট্রি। খুব বড় একটা নকশা এঁকেছে এই বেজন্মারা। উই এট্যাকড দেম। এনিটাইম এদের ব্যাক আপ এখানে পৌঁছাতে পারে। উই হ্যাভ টু গেট আউট অফ হেয়ার রাইট নাও। “
কথাটুকু বলেই রিদওয়ান দ্রুত সামনের দিকে দৌড়ানো শুরু করে। কথার ভাবমূর্তি বুঝতে পেরে রাফিও ছুটে। প্রত্যয় কিছু একটা ভেবে দ্রুত নিহতদের পকেট হাতড়ে একটা ফোন বের করে সেটা থেকে সিম কার্ড এবং মেমোরি কার্ড খুলে নিজের পকেটে ভরে সেও ছুটে। বোকার ন্যায় কেবল বসে রয় জারিয়াহ। তিন সৈন্য এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলছিলো। যেই কথার একাংশও জারিয়াহর বোধগম্য হয় নি। সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো।
বিশ পঁচিশ হাত দূরে যেতেই রিদওয়ানের খেয়াল হয় জারিয়াহ সাথে নেই। সে থেমে পিছনে ফিরে দেখে জারিয়াহ বোকার মতো তাদের পানে তাকিয়ে আছে দূর হতে। রিদওয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড়িয়ে বলে,
“ ড্যাম! দিজ গার্ল ইজ গোয়িং টু বি দ্যা ডেথ অফ মি। “
বলেই সে উল্টো ছুটে। জারিয়াহর কাছে গিয়ে বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে তার হাত চেপে ধরে ইংরেজিতে বলে উঠে,
“ কাম উইথ মি। “
অজান্তে রিদওয়ান জারিয়াহর ব্যথা পাওয়া হাতটাই চেপে ধরেছে। তবুও জারিয়াহ বিন্দুমাত্র শব্দ করে না। সে ছোট থেকেই কেবল একধরণের ভীনদেশী দেখে বড়ো হয়েছে। যারা কিনা জারিয়াহর গভীর রাতের অনিদ্রার কারণ, যারা কিনা জারিয়াহর ছোট বোন জুবেদার আতঙ্কের কারণ। কিন্তু এই ভীনদেশী ভিন্ন। এই ভীনদেশীর আশেপাশে নিজেকে নিরাপদ অনুভব করছে সে। আর কোনো কথা না বলে জারিয়াহ নিঃশব্দে উঠে রিদওয়ানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ভয়ংকর আস্তানা থেকে ছুটে পালানোর জন্য পা বাড়ায়।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]