তবু_সুর_ফিরে_আসে ১৯তম পর্ব

0
164

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

১৯তম পর্ব

হেরা দোতলায় নিজের রুমে উঠে এলো ! ন‌ওশাদের রুমের পাশেই নিশালের রুম ! প্রতিদিন পারুল সেই ঘর পরিস্কার করে রাখে ! আজ সকাল থেকেই ঘর গুছিয়ে, পরিস্কার করে রেখেছে দেখা যাচ্ছে ! ন‌ওশাদ রাতে তাকে কিছু বলেনি ! অবশ্য রাতে ডিনারের পর সে আর ন‌ওশাদের রুমে গিয়ে বেশিক্ষণ থাকেনি! সে কালকে রাতে একবার ভেবেছিল ন‌ওশাদ তাকে ওর রুমে থেকে যেতে বলবে ! ঘুমানোর আগে প্রতিদিনের মত গিয়েছিল রুমে ! কিন্তু ন‌ওশাদ কিছু বললো না চলে আসার সময়। শুধু বলল, ঠান্ডা পড়েছে কমফোর্টার নিয়ে ঘুমিও ! তারপর ল্যাপটপে যে কাজ করছিল তাতেই মনোযোগ দিল ! হেরাও রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল ! যেদিন রাত জেগে ব‌ই পড়ে সেদিন উঠতে তার দেরি হয় কিন্তু গতকাল রাতে ব‌ই পড়েনি তবে ঠান্ডার ওষুধ খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে আজ দেরি করে উঠেছে ! মানুষটাকে দেখে খুব ভালো লাগছে , ছেলে আসবে বলে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে!
হেরা নিজের ঘরে এসে একটা সেলোয়ার কামিজ বের করে পড়ে নিলো ! চুল ঠিক করল ব্যস এতটুকুই ! আর সামান্য কিছু গয়না তো সে ইদানিং সব সময় পড়ে থাকে ! ছোট্ট একটা টিপ ও লাগালো কপালে । ও খেয়াল করেছে ন‌ওশাদ টিপ খুব পছন্দ করে ! বাঁকা হলে নিজেই ঠিক করে দেয় ! ওর খুব ভালো লাগে ন‌ওশাদ যখন টিপটা ঠিক করে দেয় ! কত যত্ন করে কাজটা করে!
হেরা ইচ্ছে করেই নিচে নামলো না ! বাবা আর ছেলে আগে সময় কাটাক তার সঙ্গে পরিচয় হ‌ওয়ার অনেক টাইম পড়ে আছে !
ন‌ওশাদ নিশাল যেদিন ছুটিতে আসে সেদিন বাসায় নিশাল ফিরলে তারপর অফিসে যায় ! নিশাল ফিরে এলে দুজন এক সঙ্গে চা নাস্তা করে দুই একটা কথা বলে তারপর নিশাল রুমে যায় ন‌ওশাদ তার কাজে চলে যায় !
আজ ওর একটা জরুরী মিটিং ছিল তাও সে যায়নি ছেলের চেয়ে বড় জরুরি আজ আর কিছু নেই ! এমনিতেই ছেলে তার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে সেটা আরো বেড়ে যাক সেটা সে চায় না। আজকে বেশি টেনশন হচ্ছে নিশাল আজ‌ই প্রথম হেরা কে দেখবে ! কিভাবে নিবে হেরা কে নিশাল সেটা নিয়ে ন‌ওশাদ কিছুটা টেনশন করছে !
গাড়ির আওয়াজে ন‌ওশাদ উঠে দাঁড়ালো ! শোয়েব যায় সব সময় নিশাল কে আনতে ! কলেজের বাসে ঢাকায় আসে তারপর বাসায় শোয়েব গিয়ে নিয়ে আসে ওকে !
লিভিং রুম থেকে ই দেখা যাচ্ছে নিশালের গাড়ি বাসায় ঢুকেছে।
নিশাল গাড়ি থেকে নামতেই ন‌ওশাদ কাছে এগিয়ে গেল !
কেমন আছো পাপা ?
ন‌ওশাদ ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো ! খাকি ইউনিফর্ম এ কত বড় লাগে ছেলেটাকে !
আমি ভালো আছি ! তোমার শরীর কেমন এখন !
ভালো পাপা ! অফিসে যাওনি !
তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম !
তাহলে তো তোমার অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেল !
কোন ব্যাপার না ! নিশাল লিভিং রুমের মাছ গুলোর কাছে গিয়ে বসলো !
আনারের মা দৌড়ে রান্না ঘর থেকে চলে এলো ! ভাইয়া কেমন আছো গো ?
আমি ভালো আছি তোমার কি খবর ?
ভালো ! শরীর তো শুকায় গেছে ভাইয়া কলেজের স্যার রা খাইতে দেয় না !
প্রতিবার তুমি এক কথা বলো, আমি শুকিয়ে যাই নাই ঠিক আছি !
মাছ কম মনে হচ্ছে কেন ?
আরে না ওরা লুকায় থাকে দেখবা আইব খাওয়া দিলেই !
ন‌ওশাদ ছেলেকে দেখছে ! তার বুকটা জুড়িয়ে যায় নিশাল কে দেখলে !
নিশাল সোফায় বসে ওর বুট গুলো খুলতে খুলতে আনারের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল ,
আমি একটু পর সুইমিং করব পুলের পানি চেন্জ করা আছে ?
ন‌ওশাদ বলল,নিশাল সব ঠিক করা আছে ওয়ার্মার চালু আছে পানি ও কালকে চেন্জ করেছে ওরা তুমি চলো কিছু খাবে আগে !
ও ইয়েস চলো পাপা আমার খিদে পেয়েছে !
নিশাল তার আগে তোমাকে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই !
কে পাপা ?
আনারের মা তোমার নতুন আম্মা কে আসতে বলো !
নিশাল বুঝতে পেরেছে পাপা কার কথা বলছে ! ডাইনিং টেবিলে সে সব সময় ন‌ওশাদের ডান দিকে বসে । হাত মুখ ধুয়ে সেই চেয়ারে বসে সে আশেপাশে তাকালো !
ন‌ওশাদ নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, তোমাদের পরীক্ষার ডেট দিয়েছে ?
ফেব্রুয়ারির শুরুতে !
আজকের প্ল্যান কি ?
খাওয়ার পর একটু রেস্ট নিব তারপর সুইমিং করব ! বিকেলে ফ্রেন্ডের বাসায় যাব !
কলেজের ফ্রেন্ড ?
না স্কুলের ফ্রেন্ড , গুলশানে বাসা । থাকব না বেশিক্ষণ চলে আসব। পড়া আছে আমার !
এত পড়ে কি করবে ?
তুমি এই কথা বলছো পাপা ! চাচ্চুরা তো বলে তুমি রাত দিন পড়তে !
আমি তো গাধা টাইপ স্টুডেন্ট ছিলাম তুমি তো ভালো স্টুডেন্ট নিশাল !
তুমি গাধা টাইপ ছিলে হাসলো নিশাল !
সে রকম কিছু না পাপা আমার পড়তে ভালো লাগে !
ওদের কথার মাঝখানে ই হেরা এসে দাঁড়ালো !
নিশাল ও হচ্ছে হেরা ওর কথাই তোমাকে বলেছিলাম!
নিশাল উঠে দাঁড়িয়ে হেরাকে সালাম দিল !
হেরা হেসে বলল,দাঁড়ালে কেন বসো ! ভালো আছো তুমি ?
জ্বি !
ন‌ওশাদ খেয়াল করছে নিশাল হেরার দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে !
হেরা তুমিও বসো আমাদের সঙ্গে !
জ্বি বসছি !
হেরা তার চেয়ারে গিয়ে বসলো !
মুখোমুখি বসাতে এই প্রথম নিশাল হেরাকে দেখলো ! তারপর চোখ নামিয়ে ফেলল !
বাকি সময় টুকু চুপচাপ দুই একটা কথা বলেই খাওয়া শেষ করলো !
হেরার খুব মায়া হচ্ছে নিশাল কে দেখে ! মিষ্টি একটা চেহারা ওর মায়ের সঙ্গে মিল আছে ! কিন্তু ন‌ওশাদের মত চশমা পড়ে !
চা কোথায় আনারের মা ? ন‌ওশাদ ডেকে উঠলো!
আমি আনছি বলে হেরা উঠে গেল কিচেনের দিকে !
পাপা দাদাভাই কোথায় ?
রুমে , যাও সারপ্রাইজ হবে তুমি আসছো বলিনি !
দাদাভাই এবারো আমাকে তুমি ভাববে !
কলেজের ইউনিফর্ম পড়ে গেলে তাই ভাববে ! তোমার দাদা ভাই এখন আরো কথা ভুলে যায় ! ইদানিং হেরাকে তোমার মাম্মা ভাবে !
উনার চোখ গুলো কিছুটা মাম্মার মত তাই হয়তো !
ন‌ওশাদ অবাক হয়ে গেল ছেলের অবজারভেশন দেখে , যে ব্যাপারটা বুঝতে তার বেশ অনেকটা সময় লেগেছিল এক নজরে নিশাল ধরে ফেলল !
হেরা চা নিয়ে আসছে !
ন‌ওশাদ চা খেয়ে উঠে পড়লো ! নিশাল আমি বের হচ্ছি তুমি তোমার ভেকেশন এনজয় করো ! শুধু একটা রিকোয়েস্ট, বাচ্চা আমার তুমি ড্রাইভ করবে না যেখানেই যাও ড্রাইভার নিয়ে যাবে !
তুমি টেনশন করো না পাপা , আমি সবুজ ভাই কে সঙ্গে নিয়ে যাব !
থেঙ্কস ! ন‌ওশাদ স্যুট টা হাতে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে হেরা গাড়ি পর্যন্ত যায় সব সময় ন‌ওশাদের !
ন‌ওশাদ পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,কেমন দেখলে আমার ছেলেকে ?
খুব শান্ত !
হুম !
আমি খুব নার্ভাস হচ্ছিলাম কিন্তু ও খুব সুন্দর করে কথা বলল তো আমার সঙ্গে।
ন‌ওশাদ হাসলো ! টেনশন করো না আমার ছেলে খুব ভালো !
আপনার মতো !
তাই বুঝি ?আসি হেরা ! নিশালের খেয়াল রেখো !
জ্বি !
ন‌ওশাদ জানে নিশাল তার মত‌ই কাউকে অপছন্দ করলেও খারাপ আচরণ করে না ! তাই অনেক খেয়াল রাখতে হয় ছেলেকে বোঝার জন্য!

নিশাল দোতলায় উঠে এলো, দাদা ভাইয়ের রুমের দরজা খোলা ! সে কাছে যেতেই দাদা ভাই পেপার রেখে চোখ তুলে তাকালো !
বাবু কলেজ ছুটি তোর !
দাদা ভাই আমি কে বলো তো ?
ও আমার নিশাল দাদু ভাই , আমি ভেবেছি আমার বাবু ও তো ক্যাডেটে পড়তো !
হ্যাঁ !
কখন এসেছো তুমি এরা কেউ আমাকে বলেনি তুমি আসবে !
তোমাকে সারপ্রাইজ দিলাম !
কয়দিন থাকবে তুমি ?
দশদিন !
মাত্র !
হুম!
আমরা একসঙ্গে কার্টুন দেখব ঠিক আছে !
ঠিক আছে দাদা ভাই ! আমি এখন উঠি ?
হুম , তোমার মা কে বলো আমাদের জন্য স্প্যাশল রান্না করতে আজকে !
নিশাল অবাক হয়ে বলল,কাকে বলব ?
বড় বৌমা কে ! আমার কাছে আসতে বলো তো ওকে !
ও আচ্ছা !
নিশাল দাদার রুম থেকে বের হয়ে এলো ! নিজের ঘরে ঢুকতে যাবে তখন হেরার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল !
স্পষ্ট বোঝা যায় পাপার থেকে অনেক বয়স কম ! নিশালের খুব আন‌ইজি লাগছে ! আচ্ছা সে ডাকবে কি উনাকে ? স্টেপ মম কে অনেকেই মা ডাকে কিন্তু এত কম বয়সী একজন মেয়েকে সে মা ডাকলে খুব বেমানান দেখাবে ! আর তার ও খুব একটা ইচ্ছে নেই মা ডাকার তার চেয়ে আন্টি বেটার !
কিছু লাগবে নিশাল ?
না ! আপনাকে দাদা ভাই ডাকছে !
নিশাল নিজের রুমে ঢুকে গেল!
হেরা নিশালের ঘরের বন্ধ দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর শ্বশুরের রুমে এসে ঢুকলো !
আব্বা কি করেন ?
বড় বৌমা তোমার ছেলে আসবে আজকে আমাকে কেউ বলেনি তুমিও বললে না !
সরি আব্বা ভুলে গেছি !
আমার খুব আনন্দ হচ্ছে ওকে দেখে ! তোমার শ্বাশুড়ি কে খবর দাও নাতী এসেছে এখন বাসায় আসুক।
জ্বি আব্বা খবর দিচ্ছি !

নিশাল আগে কলেজ থেকে বাসায় এলে মাম্মা কে খুব মিস করতো একটা সময় সব স্মৃতি ই ফিকে হয়ে আসে। তবে মাম্মা কে ঈদের দিন খুব মিস করে সে ! মাম্মা থাকতে ঈদ আসার আগে থেকেই বাসায় উৎসব শুরু হয়ে যেত ! আত্মীয়-স্বজন ওর কাজিন, মাম্মার ফ্রেন্ড ,পাপার ফ্রেন্ড সবার জন্য গিফট কিনতে মাম্মা প্রতিদিন শপিং এ যেত ! সব কিছু আবার ওকে আর পাপাকে দেখাতো আয়োজন করে। ওর আর পাপার জন্য এক রকম পাঞ্জাবী তৈরি করে আনতো মাম্মা ! ঈদের দিন সকালে দুজনকে ঘুম থেকে তুলে নামাজের জন্য তৈরি করে দিত ! দাদা ভাই ,আর পাপার সঙ্গে সে নামাজে যেত ।পাপা তো কিছুই খেয়াল রাখতো না। মাম্মা যাওয়ার পর ঈদ গুলো আর ঈদ মনে হয় না। খুব একটা কেউ আসে না বাসায় ঈদে ! খালামনিরা ঈদে নিজেদের বাসায় ব্যস্ত থাকে তারাও সেদিন আসতে পারে না।
সে, পাপা আর দাদা ভাই একা ঈদ করে ! তিন জন‌ই একা ! সন্ধ্যায় চাচ্চুরা আসে ! দাদা ভাই ভাবে দাদু এখনো বেঁচে আছে ! কত সুখেই আছে দাদা আমি আর পাপা যদি ভাবতে পারতাম মাম্মা বেঁচে আছে কত ভালো হতো !
নিশাল বারান্দায় গিয়ে বসলো ! বারান্দা থেকেই দেখা যাচ্ছে কবুতর গুলো উড়ছে । মাম্মা যাওয়ার পর এরাই তার সঙ্গী হয়ে ছিল এই বাসায় !
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিশাল সুইমিং করলো বেশ অনেক্ষণ ! বাসায় এলে প্রতিদিন সে সুইমিং করে ! শুক্রবারে পাপাও ওর সঙ্গে পুলে নামে ! পাপা চেষ্টা করে ওকে সময় দিতে কিন্তু পারে না ! পাপার জীবনটাই অন্যরকম ইচ্ছা থাকলেও বাসার জন্য কিছু করতে পারে না !
সুইমিং করার সময় ই পারুল কডলেস নিয়ে দৌড়ে পুলের কাছে এলো ! ভাইয়া বীথি খালাম্মা ফোন দিসে !
নিশাল হাত বাড়িয়ে কডলেস টা নিলো !
হ্যালো খালামনি !
নিশু বেবি কখন এসেছো ?
এগারোটা নাগাদ বাসায় চলে এসেছি! তুমি কেমন আছো?
পাপা ছিল তখন বাসায় ?
হ্যাঁ পাপা তো আমি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে !
না ভাবলাম এখন তোমার পাপার লাইফ চেন্জ হয়ে গেছে তাই ওসব আর খেয়াল নেই হয়তো ! দেখা হয়েছে ঐ মেয়ের সঙ্গে তোমার ?
হুম !
কেমন দেখলে ?
কি দেখব ?
কেমন লাগলো তোমার ?
ভালোই তো কম বয়সী একটা মেয়ে !
আগুনের মত সুন্দর আর দেখবে এই সুন্দরী তোমার আর তোমার পাপাকে হাড় হাড্ডি ভাজা ভাজা যদি না করে আমাকে বলো তখন!
খালামনি আমি পুলে দাঁড়িয়ে কথা বলছি ঠান্ডা লাগছে পরে কথা বলি তোমার সঙ্গে !
একটা কথা নিশু ঐ মেয়েকে আবার মা ডাকতে বললে তোমার পাপা , তুমি কিন্তু খবরদার ডাকবে না !
খালামনি পরে কথা বলি ! বাই ! নিশাল ফোন নামিয়ে রাখলো ! আরো কিছুক্ষণ পুলে থেকে উঠে এলো নিশাল !
দোতলায় নিজের রুমে যাওয়ার সময় নিশাল খেয়াল করলো হেরা গেস্ট রুমে আনারের মায়ের সঙ্গে কথা বলছে !
ওকে দেখে আনারের মা দৌড়ে কাছে এসে দাঁড়ালো !
ভাইয়া কফি দেই ?
না এখন কিছু খাব না ! সবুজ ভাই কে বলবে আমি বিকেলে বের হব !
আইচ্ছা !
নিশাল তাকিয়ে দেখে হেরা গেস্ট রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ! খালামনি ভুল বলেনি অনেক সুন্দর তিনি ! পাপার সঙ্গে ভালোই মানিয়ে যাবে !
নিশাল নিজের ঘরে এসে‌ গোসল করলো তারপর ঘুমিয়ে গেল!

নিশাল হাঁসের মাংস পছন্দ করে বলে জরিনা বুয়া রান্না করতে নিয়েছে । হেরা বুয়ার কাছ থেকে নিয়ে নিজেই রান্না করলো ! নিশাল বাসায় আসলে সব ওর পছন্দের রান্না করা হয় ! আলু ভাজি খুব পছন্দ করে বুয়া বেশি করে তেল দিয়ে ছোট ছোট আলু ভাজি করেছে ! এটা আবার ওদের স্যার খাবে না কারণ তেল বেশি ! নিশাল মাছ খাবে না ! কিন্তু শ্বশুরের জন্য মাছ রান্না হয়েছে ! রান্নাঘরে আজ বিশাল আয়োজন এক একজনের জন্য এক এক রান্না ! হেরা বসে বসে তাই দেখছে ! কাজের লোকজনের জন্য বিশাল বড় পাতিলে তড়কাড়ি রান্না হয় প্রতিদিন এবং এই তড়কাড়ি বসাতে দুই রান্নার লোকের ভিশন অনিহা । নিজেদের জন্য রান্না করতে তাদের খুব কষ্ট ! হেরা কে দেখলে খুব নরম গলায় তর্ক করে তারা কিন্তু হেরা বের হয়ে এলেই শোনা যায় দুজন যুদ্ধ করছে!

দুপুরের খাবার নিয়ে হেরা নিশালের জন্য অপেক্ষা করছে ! সে বুঝতে পারছে না নিশাল ওর সঙ্গে বসে খাবে কিনা ! তাও সে অপেক্ষা করছে!
আনারের মা নিশাল কে ডেকে নিয়ে আসো !
আম্মা ভাইয়া ঘুমায় এখন ডাক দেয়া যাবে না !
কিন্তু অনেক বেলা হয়ে গেছে খাবে না ?
এখন ডাক দিলে মাথা ব্যথা করবে ! হঠাৎ করে ঘুম ভাঙলে ভাইয়ার মাথা ব্যথা করে!
ও !
হেরাও না খেয়ে অপেক্ষা করছে ! এলিন আর নাহিন এখনও ভার্সিটি থেকে ফিরেনি ! হেরা নিজের ঘরে ব‌ই নিয়ে বসলো !
কিছুক্ষণ পর পারুল ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে ঢুকলো !
আম্মা স্যার ফোন দিসে ! হেরা কডলেস টা হাতে নিয়ে পারুলের দিকে তাকাতেই পারুল বের হয়ে গেল !
হ্যালো
কি করছো হেরা ?
ব‌ই পড়ছিলাম!
নিশাল কি করে ?
অনেকক্ষণ সুইমিং করেছে এখন ঘুমাচ্ছে !
লাঞ্চ করেছে ?
না এত বেলা হয়ে গেছে আমি আনারের মা কে ডাকতে বললাম কিন্তু ডাকলে নাকি মাথা ব্যথা হয় ওর !
থাক ডাকার দরকার নেই ওর মত থাকতে দাও ওকে। তুমি খেয়েছো ?
নিশাল উঠুক ওকে রেখে কিভাবে খাই ?
ও লজ্জা পেতে পারে তোমার সঙ্গে খেতে !
সমস্যা নেই । আপনি লাঞ্চ করেছেন ?
হ্যাঁ !
হেরা তুমি একটা জিনিস খেয়াল রেখো নিশাল যেন একা বাসার বাহিরে না যায় ! ও বের হয় যদি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে !
একা বের হলে ?
হুম ! ও বাসায় এলে আমি ওকে নিয়ে বেশি টেনশনে থাকি ! আমার মোবাইল টা রিং হলেই আতকে উঠি !
কেন?
বুঝবে না তুমি ! দীর্ঘ শ্বাস ফেলল ন‌ওশাদ ! রাখলাম হেরা !
হেরা ফোন টা রেখে নিশালের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ! একবার ভাবলো ঢুকে খাওয়ার জন্য ডাকবে ! তারপর সিদ্ধান্ত চেন্জ করে ফিরে এলো!
কিছুক্ষণ পর আনারের মা ঘরে ঢুকে মেঝেতে বসলো !
খেয়েছো তুমি ?
কেমনে খাই আপনারা না খেয়ে আছেন !
তোমরা খেয়ে নাও !
আমি খাই নাই বাকি সবাই খাইছে ! আমি ভাইয়া আর আপনে খাওয়ার পর খাব !
তুমি অনেক আদর করো নিশাল কে তাই না আনারের মা ?
আম্মা ভাইয়া আমার সামনে হ‌ইছে এতটুকু আছিল ! রাইতে ঘুমাইতো না । স্যার কোলে নিয়া হাটতো আমি কোলে নিয়ে হাটতাম । আম্মা রাত জাগতে পারতো না ! আমি রাইতে রাখতাম ! যখন হাঁটা শিখলো সারাক্ষণ পাহারা দিয়া রাখতে হ‌ইতো সব জিনিস নিয়া মুখে দিত ! একদিন একটা বোতাম গিলে ফেলছে চিন্তায় ঘুমাইতে পারি নাই আমরা ! কারো হাতে ভাত খাইতো না আমি আর আম্মা মুখে তুইলা খাওয়াই দিতাম। সারা বাড়ি ঘুইরা ঘুইরা খাইতো ! কম বয়সে মা মরা ছেলে কি যে মায়া লাগে দেখলে !
কলেজে চ‌ইলা যাওয়ার পর আমি খাইতে পারতাম না, ঘুমাইতে পারতাম না কোলে পিঠে মানুষ করছি তো ছাইড়া থাকতে কি যে কষ্ট হ‌ইছে গো আম্মা ! নিজের মাইয়া রে রাইখা যখন কাম করতে আসছিলাম তখন যেমন কষ্ট হ‌ইছিল তারচেয়েও বেশি কষ্ট হ‌ইছে ! মাইয়া তো নানির কাছে ছিল কিন্তু ভাইয়া তো একা অচেনা জায়গায় থাকতে গেছে ! আনারের মা চোখের পানি শাড়ির আঁচলে মুছলো ! জানেন আম্মা ভাইয়া যাওয়ার পর এক রাতে খুব বৃষ্টি নামছে , ভাবলাম কোন জানালা যদি খোলা থাইকা যায় ঘর তো ভিজবো ! উপরে উইঠা দেখি স্যার ভাইয়ার রুমে বিছানায় ব‌ইসা কানতাছে !
কি কান্দন যে কানছে স্যার আম্মা গো আমি দূর থেকে দেখলাম ! আম্মা যাওয়ার পর স্যার ভাইয়ার রুমে গিয়ে রাইতে ব‌ইসা থাকতো । আমি তখন ভাইয়ার রুমে নিচে বিছানা পাইতা থাকতাম। স্যার আসলে আমি নিজের ঘরে চ‌ইলা আসতাম ! সারা রাত স্যার ভাইয়ার মাথার কাছে ব‌ইসা থাকতো !
হেরার চোখ দিয়েও পানি পড়ছে !
জানেন আম্মা ঐ যে সামনের বাসা টা দেখতেছেন ঐ টাতে আমার গ্রামের একটা মাইয়া কাম করে ঐ বাসার স্যার ব‌উ বাসার বাহিরে বেড়াইতে গেলে নতুন নতুন মাইয়া নিয়া আসে ফুর্তি করে ! ডরায়ে ঐ মাইয়া রাতে আমার কাছে চ‌ইলা আসে ! আর আমরার স্যার আম্মা মরলো ছয় বছর আজ‌ও আম্মার জন্য কান্দে ! বয়স তো কম হয় নাই আমার, এমন পুরুষ মানুষ দেখি নাই ! বিশ্বাস করবেন, আম্মা যখন ছিল আম্মার সাথে ঝগড়া করতে দেখি নাই । আম্মা চিল্লাচিল্লি করতো কিন্তু স্যার আম্মার মনে কোন কষ্ট দেয় নাই কোন দিন ! উদাসীন ছিল সংসারে র খবর রাখে নাই তাই আম্মা যা ক‌ইতো এই বাসায় তাই হ‌ইতো !
আম্মা মারা যাওয়ার পর স্যার আমারে ডাইকা ক‌ইলো, আনারের মা বাসা টা তোমার আম্মা চালাতো আমি তো কিছুই জানি না । তুমি ছিলে সঙ্গে, তোমার আম্মা যেভাবে যা করতো তুমি সেভাবেই সব করো !
তারপর ?
তারপর আর কি খালাম্মা রা একটা ক‌ইতো , স্যারের ভাইয়ের বউ রা আরেক টা ক‌ইতো । এখনো ফোন দেয় আমারে আপনে কি করেন সব জানতে চায় !
তুমি কি বলো ?
বলি আপনে চালান আপনার সংসার ! আর কি বলব বলেন !
হেরা মনে মনে হাসলো আমার সংসার !
নিশালের রুমের দরজা খোলার শব্দ হতেই আনারের মা উঠে দৌড় দিল !

নিশাল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ! আনারের মা দৌড়ে কাছে এলো!
আমাকে ডাকবে না কত বেলা হয়েছে?
ওমা ঘুম থেকে ডাকলে ভাইয়া তোমার মাথা ব্যথা করে যে !
খুব খিদে পেয়েছে কি রান্না করেছো ?
আসো তোমার সব পছন্দের খাবার রেডি করছি !
গেস্ট রুমে কে ?
নতুন আম্মা ঐ ঘরে থাকে উনার সঙ্গে কথা বলতেছিলাম !
গেস্ট রুমে থাকে !
হ! তোমার জন্য না খাইয়া ব‌ইসা আছে !
কেন, কি আশ্চর্য !
আমি খাওয়া দিচ্ছি তুমি আসো ভাইয়া ! আনারের মা নিচে চলে গেল!
ডাইনিং টেবিলে এসে দেখে নিশাল ,হেরা দাঁড়িয়ে আছে ওর জন্য ! ওর খুব লজ্জা লাগছে !
বসো !
আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন কেন ?
হেরা কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা ! প্লেটে ভাত তুলে দিল !
আমি নিজে নিয়ে খাই ।
হেরা নিজের চেয়ারে বসলো !
নিশাল নিজেই প্লেটে খাবার তুলে নিলো ! চুপচাপ মাথা নিচু করে খাচ্ছে ! লজ্জা পাচ্ছে দেখে হেরা আর কোন কথা বলল না !
তুমি কি এখন বের হবে ?
জ্বি !
রান্না ঠিক আছে ?
আপনি করেছেন ?
শুধু হাঁস রান্না করেছি !
ভালো হয়েছে থ্যাঙ্কস !
নিশাল খাওয়া শেষ করে উঠে গেল ! হেরার ভালো লাগছে খুব ও ভেবেছিল ওর সঙ্গে খেতেই বসবে না হয়তো!
এলিন আর নাহিন ঠিক তখনই বাসায় এসে হাজির হলো!
কি ব্যাপার বৌমনি এত বেলা করে খাচ্ছো ?
নাহিন কে এসেছে জানো , নিশাল !
ও আচ্ছা ! কখন ?
সকালে!
তোমাদের সঙ্গে আগে কখনো দেখা হয়েছে ওর ?
একবার নানু বাসায় শোয়েব মামার সঙ্গে গিয়েছিল তখন দেখা হয়েছিল !
কোথায় ও ?
রুমে !
তোমরা খাও আমি উপর থেকে আসি !
যাও!

নিশাল বের হয়ে যাওয়ার সময় হেরা খেয়াল করলো ও ড্রাইভারের সঙ্গে যাচ্ছে কিনা ! তারপর আনারের মা কে বলল ন‌ওশাদ কে জানানোর জন্য!
আনারের মা ফোন করে ন‌ওশাদকে জানিয়ে দিল নিশাল বের হয়েছে ।
সন্ধ্যায় ন‌ওশাদ গলফ খেলে বাসায় এসে দেখে নিশাল তখনো আসেনি !
দোতলার সিঁড়ির কাছেই হেরার সঙ্গে দেখা হলো ওর ! ন‌ওশাদ খুব সুন্দর করে একটা হাসি দিল হেরা কে দেখে ! হেরা এই হাসিটা দেখার জন্য প্রতিদিন ন‌ওশাদ অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকে ! যত ক্লান্ত থাকুক ন‌ওশাদ এভাবেই হাসবে !
কি অবস্থা তোমার হেরা ?
ভালো !
নিশাল এসেছে ?
এখনো আসেনি ! চলে আসবে আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন !
ন‌ওশাদ নিজের ঘরে চলে গেল।
হেরা প্রতিদিন চা নিয়ে ন‌ওশাদের রুমে যায় তাই চা বানাতে কিচেনে চলে গেল!
পনের মিনিট পর চা নিয়ে ন‌ওশাদের রুমে ঢুকে দেখে ন‌ওশাদ ফোনে কথা বলছে বড় বোনের সঙ্গে!
কিছুক্ষণ পর ফোন রেখে হেরার দিকে তাকিয়ে বলল, আসছে কালকে ?
কে ?
আমার বড় বোন আর দুলাভাই!
আমেরিকা থেকে ?
হুম!
এয়ার পোর্টে ঢুকে ফোন দিলো আমাকে । এই বাসায়ই থাকবে । আনারের মা কে বলে রুম টা রেডি করে রেখো প্লিজ!
হুম !
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ন‌ওশাদ বলল,
নিশালের সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?
আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করেছি !
গুড শুনে খুব ভালো লাগছে!
আপনি ওকে নিয়ে এত টেনশন কেন করেন ও তো অনেক শান্ত একটা ছেলে ?
ন‌ওশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল , হেরা মানুষ যে কত খারাপ তুমি জানোই না ! আমার এক পরিচিত বিজনেস ম্যানের ছেলে কে কিছুদিন আগে কিডন্যাপ করে। পুলিশ, রেব সবাই মিলে খুঁজে আধ মরা অবস্থায় উদ্ধার করে । কাজটা করেছে ছেলের বন্ধুরাই। চিনে ফেলবে তাই মেরে ফেলতে নেয় ভাগ্য ভালো তাই বেঁচে গেছে কিন্তু এখনো ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ! আমার বেঁচে থাকার একটাই কারণ এখন নিশাল ওর সঙ্গে খারাপ কিছু হলে আমি বাঁচতে পারবো না হেরা ! তাই ও ছুটিতে এলে আমি আতংকে থাকি ইদানিং! ওকে যদিও আমি বলি ক্যাডেট কলেজ থেকে চলে আসতে কিন্তু এখন মনে হয় ভালোই হয়েছে একটা নিরাপদ জায়গায় আছে থাকুক। অনন্ত আমি নিশ্চিন্তে থাকি সারাদিন।
জানো হেরা টাকা থাকাও যন্ত্রণার ! শুধু শত্রু বাড়ায় !
আপনার কি শত্রু আছে ?
কে যে আমাকে শত্রু ভাবে সেটা তো আমি জানি না ! তাই নিজেকে না ছেলেকে নিয়ে ভয়ে থাকি !
মোবাইলে রিয়াজের ফোন দেখে রিসিভ করলো ন‌ওশাদ !
হ্যাঁ বলো !
ভাইয়া আসছে স্যার !
ঠিক আছে !
ফোন রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ন‌ওশাদ! বাসায় এসেছে আমার রাজপুত্র !
আপনার চেহারা দেখেই বুঝেছি আমি ! আপনি ওকে খুব ভালোবাসেন !
ও আমার জান হেরা সবচেয়ে বড় কি জানো ও গীতির আমানত আমার কাছে ! ও কষ্ট পেলে গীতিকে গিয়ে কি জবাব দেব বলো ?
হেরা ন‌ওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে!
দরজা টা খুলে দাও দরজা খোলা দেখলে আসবে এদিকে !
হেরা দরজা খুলে দিল ! আমি চলে যাব ?
কেন ? বসো ! আচ্ছা তুমি তো ছবি গুলো দেখালে না আমাকে !
কোন ছবি ?
রেজোয়ান যেগুলো পাঠালো !
হেরা হাসতে হাসতে বলল, ঠিক আছে দেখাব !
দেখব শালা কি ছবি তুলিয়েছে । তারপর ওর ঘাড় মটকাবো !
দুজনেই হাসছে !

নিশাল সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসতেই দেখে পাপার রুমের দরজা খোলা । দরজার সামনে এসে দাড়াতেই ন‌ওশাদ ডাকলো ! নিশাল এসো ভেতরে !
নিশাল ঘরে ঢুকলো ! হেরা কে দেখে সে একটু আন‌ইজি ফীল করছে !
কালকে তোমার ফুপি আসছে !
তাই অনেক দিন পর দেখা হবে !
হ্যাঁ !
ফ্রেন্ডদের সঙ্গে দেখা হলো ?
হ্যাঁ !
বসো আমার কাছে !
তুমি রেস্ট নিচ্ছিলে পাপা আমি পরেও আসতে পারি !
আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম !
হেরা বলে উঠলো আমি আমার ঘরে যাই আপনারা কথা বলুন !
সবার মত নিশাল ও অবাক হলো হেরা গেস্ট রুমে থাকে দেখে !
হেরা যাওয়ার সময় দরজা চাপিয়ে দিয়ে গেল !
ন‌ওশাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,কি করলে সারাদিন ?
সুইমিং করলাম তারপর ঘুমালাম উঠে লাঞ্চ করে বের হয়ে ছিলাম!
নিশাল তুমি কি খুব বেশি রাগ করে আছো আমার উপর ?
কেন পাপা রাগ করে থাকব কেন ? নিশাল অবাক হয়ে তাকালো!
আমি বিয়ে করেছি তাই !
আমি তোমাকে কলেজেই বলেছি যেদিন তুমি বললে বিয়ের কথা আমি রাগ করে নেই তোমার উপর।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিশাল বলা শুরু করলো,
পাপা আমি সেদিন তুমি চলে আসার পর অনেক কষ্ট পাচ্ছিলাম মিথ্যা বলব না বারবার মাম্মার কথা মনে হচ্ছিল। মাম্মা তোমাকে রেখে চলে না গেলে তো এমন হতো না ! আমি বিয়ের কথা শুনে কষ্ট পাচ্ছিলাম ।‌ অনেক দিন পর খুব কেঁদেছি সেদিন ! তখনই আমাকে দেখতে আমার রুমমেট সোহাম ভাইয়া আসেন । উনি আমাকে খুব আদর করেন সব সময় ! উনি বুঝে ফেললেন কেঁদেছি । বারবার কারণ জানতে চাইলেন, আমি উনাকে বলে ফেলি তোমার বিয়ের কথাটা ! ভাইয়া কিছুক্ষণ আমার পাশে বসে র‌ইলেন । তারপর
ভাইয়া আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, আমার আব্বু নেই তো জানিস তুই! আমার যখন তিন বছর আব্বু মারা যান তখন ! আপু তখন ক্লাস ফোরে পড়ে ! আম্মু একটা স্কুলের টিচার। আব্বু ডাক্তার ছিলেন টাকার অভাব কখনো ছিল না আমাদের ! আমি ক্যাডেটে চলে আসার দুই বছর পর আপুর বিয়ে হয়ে যায় । আপু কানাডা চলে যায় ! আম্মু বাসায় একা হয়ে গেল ! একা জীবনটা খুব কষ্টের রে ! আম্মু স্কুল থেকে এসে শূন্য বাসাটায় একা থাকে । অসুস্থ হলেও নিজের কষ্ট নিজের সঙ্গে শেয়ার করে । আমরা আমাদের লাইফে মেতে আছি কিন্তু সঙ্গী ছাড়া জীবনটা যে কত কষ্টের সেটা আমি আম্মুকে দেখে বুঝেছি ! আম্মু চলে যাবে আপুর কাছে ।‌ মেয়ের সঙ্গে মায়ের যে বন্ধন টা হয় একটা ছেলের সঙ্গে বাবা মায়ের হয় না সেই বন্ধন টা ! হাজার ইচ্ছা বা চেষ্টা থাকলেও হয় না রে ! তোর তো খুশি হ‌ওয়া উচিত আংকেলের যত্ন করার , আংকেলের একাকীত্ব দূর করার একজন মানুষ এসেছে । বুড়ো বয়সে আংকেল কে কেউ একজন তো যত্ন করবে । আংকেলের মনের কথা গুলো বুঝবে ! যার সঙ্গে আংকেল সুখ, দুঃখ শেয়ার করতে পারবেন ! তোর আম্মু মারা গেছে এত বছরে আংকেল কতটা একা ছিল তুই কি সেই খবর রাখতে পেরেছিস কখনো ? ভবিষ্যতে ও পারবি না ! তাহলে কেন কষ্ট পাচ্ছিস ? আন্টির উপস্থিতিতে তো আংকেল বিয়ে করে নিয়ে আসেনি তাহলে ?
সোহাম ভাইয়া সেদিন ঐ ভাবে না বুঝালে আমি কষ্ট মনে নিয়ে বসে থাকতাম পাপা ! আমি তো দেখেছি মাম্মা কে ছাড়া তুমি কতটা একা ! আর দেখো দাদা ভাই দাদু কে ছাড়া কেমন হয়ে গেছে। আমি চাইনা তুমি দাদা ভাইয়ের মত একা থাকো ! তুমি চিন্তা করো না আমি সত্যিই হ্যাপি তুমি বিয়ে করাতে !
নিশাল উঠে এসে পাপার ঘাড়ে হাত রাখলো ! তুমি বিশ্বাস করবে না আজ সকালে বাসায় এসে কেন যেন মনে হলো বাসার খালি খালি একটা ভাব ছিল এত দিন, সেটা আর নেই !
আমার আন্টিকে পছন্দ হয়েছে ! উনি যত্ন নিয়ে আমার জন্য রান্না করেছেন আমার খুব ভালো লেগেছে !
উনার বয়স তো অনেক কম ভালোই হয়েছে তোমার যত্ন অনেক দিন করতে পারবে । মাম্মার মত হঠাৎ ছেড়ে চলে যাবে না ! এই বাসার জন্য একজন মানুষ দরকার বাসাটা আগের মত করতে তাই না পাপা ?
ন‌ওশাদের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে । সে চোখের পানি ছেলেকে দেখাতে চায় না! কিছু কিছু জিনিস খুব যত্ন নিয়ে লুকিয়ে রাখতে হয় সেটা হলো পুরুষ মানুষের চোখের পানি !
নিশাল আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাচ্চা !
জানি পাপা !
আমি তোমার মাম্মা কেও অনেক ভালোবাসি !
সেটাও আমি জানি পাপা !
নিশাল টের পাচ্ছে পাপার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তাই সে আর সামনে গেল না ! পিছনে ই দাঁড়িয়ে র‌ইলো ! পাপা আমি রুমে যাচ্ছি থাকো তুমি !
হুম!
নিশাল চায় পাপা এখন কিছুক্ষণ একা থাকুক ! ও জানে পাপা এখন মাম্মার ছবি দেখে কাঁদবে ! মাম্মা চলে যাওয়ার পর সে দেখেছে প্রতিটা রাতে পাপা মাম্মার ছবি নিয়ে কাদতো !
আজকেও কাঁদবে সে জানে !
তার খুব ইচ্ছে করছে পাপার কাছে থাকতে কিন্তু তাহলে সেও কেঁদে ফেলবে এটা ভালো হবে না !
এক কাজ করলে কেমন হয় হেরা আন্টিকে পাপার কাছে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয় ! উনার সামনে নিশ্চয়ই পাপা কাঁদবে না !
কিন্তু উনার সঙ্গে কথা বলতে তার খুব লজ্জা লাগছে কেন জানি !
নিশাল গেস্ট রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তার খুব লজ্জা লাগছে তবুও সে দাঁড়িয়ে আছে !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here