এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৪৩.

0
179

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৩.

বিষন্ন কোনো এক রজনীতে সোনালী আভা ছড়ানো চাঁদের পানে তাকিয়ে আছে একজোড়া সমুদ্র নীল চোখ। নির্লিপ্ত সেই দৃষ্টি কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে না। কেবল নির্নিমেষ দেখতে থাকে সেই চাঁদের মলিনতা। আজকাল ভাঙা জানালার পাশে বসে রাত কাটিয়ে দেওয়াটা জারিয়াহর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সারা রাত পেরিয়ে যায় তবে দু চোখের পাতায় ঘুমের হদিস মিলে না। মনে হয় একবার চোখ বুজলে পরের দিন সূর্যোদয় দেখাটা যদি আর নসিব না হয়?

ফিনফিনে বাতাস গায়ে এসে ধাক্কা খেতেই শরীরের সব গুলো পশম ঠান্ডায় কাটা দিয়ে উঠে। জারিয়াহ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার ধার থেকে উঠে যায়। অত:পর একটা জলপাই রঙা জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে ফের জানালার ধারে এসে বসে। দুই হাত জানালার রেলিঙে রেখে তার উপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে আবারও আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। জ্যাকেটের উষ্ণতা গায়ে ছড়িয়ে পড়তেই জারিয়াহর নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে এবার বিষণ্ণতা ফুটে উঠে।

পৃথিবীর সবথেকে নিষ্ঠুর এক সত্য হলো মানুষের হারিয়ে যাওয়া। সুন্দর এই পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখতে যেমন প্রতিদিন নতুন প্রাণের আগমন ঘটছে, তেমনই বহু প্রাণের ইতি ঘটছে কোনো এক নির্দিষ্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু যা হারায় না তা হলো কোনো এক ব্যক্তিকে ঘিরে কিছু স্মৃতি। সময় মতো সেই স্মৃতি ঠিকই মনে করিয়ে দেয় নির্দিষ্ট এক ব্যক্তির কথা।

__________

রাত আটটা কি নয়টা বাজে কেবল! নভেম্বর মাস। শীতের আমেজ প্রকৃতিকে মুড়িয়ে রেখেছে। এই শীত শীত আবহাওয়ার মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি বেশ অনাকাঙ্ক্ষিতই বটে। যেনো তেনো বৃষ্টি নয়। রাস্তায় হাঁটু জল তুলে দেওয়ার মতো দীর্ঘ সময়ের লাগাতার বৃষ্টি। পথঘাট প্রায় ফাঁকাই বলতে গেলে। মাঝে কেবল এক দুটো গাড়ি সজোরে ছুটে যেতে দেখা যাচ্ছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে অপ্রত্যাশিত ভাবে পথিমধ্যে কালো জিপ গাড়িটার টায়ার পাঙচার হয়ে গেলো।

দূর্জয় বিরক্ত হয় মারাত্মক। টায়ারটা তার গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে পাঙচার হলে কি খুব বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো? বিরক্তি নিয়েই কাউকে ফোন করতে নেয় দূর্জয়। সেই মুহুর্তে ঠিক তার পাশে এসে উল্টো পথগামী এক সাদা গাড়ি থামে। গাড়ির পিছনের সিটের একপাশের জানালা নামিয়ে এক রমণী মুখ বের করে গলা উঁচিয়ে ডাকে,

“ ভাইয়া? দূর্জয় ভাইয়া! “

পরিচিত ডাকটা কানে এসে পৌঁছাতেই দূর্জয় পাশ ফিরে তাকায়। অত:পর গাড়ির কাঁচের জানালাটা নামিয়ে বলে,

“ এই বৃষ্টির মধ্যে বাহিরে কি করছো নিশা? “

“ আমি তো বাণী আপুর বাসায় যাচ্ছিলাম। তুমি এদিকে কি করছো? “

“ মেসে ফিরছিলাম। গাড়ির টায়ার সম্ভবত পাঙচার হয়ে গিয়েছে। “

নিশা আশেপাশে তাকিয়ে বলে,

“ এখন তো কোনো রিকশা বা উবার পাবে না তুমি। “

“ সমস্যা নেই। আমি কাউকে কল করছি গাড়ি নিয়ে আসতে। তুমি সাবধানে যাও। “

নিশা বৃষ্টির বেগ দেখে বলে,

“ গাড়ি নিয়ে আসতে সময় লাগবে ভাইয়া। তুমি বরং গাড়ি লক করে আমার সাথে চলো। গাড়ি আসার আগ পর্যন্ত না-হয় বাণী আপুর বাসায় ওয়েট করবে। “

বাণীর বাসায় যাওয়ার কথা শুনেই দূর্জয় বলে উঠে,

“ শুধু শুধু এতো ঝামেলার দরকার নেই পাকনি। তুমি যাও। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি। “

নিশা এবার মুখ ভার করে বলে,

“ আমি বিকেলে আপুকে কল করেছিলাম। বহ্নির নাকি খুব জ্বর এসেছে। আব্বুরও রাতে বাসায় ফিরতে দেরি হবে। তাই ভাবলাম বাসায় একা বসে না থেকে বহ্নিকে দেখে আসি। তুমিও চলো না। বাচ্চাটা তোমাকে দেখে খুশি হবে অনেক। “

দূর্জয় মিনিট খানেক নীরব রয়। অত:পর কিছু একটা ভেবে গাড়ির চাবি আর ফোন নিজের পকেটে ভরে নেমে আসে। নিশার পাশে উঠে বসতেই নিশা মুখে জয়ের হাসি ফুটিয়ে সামনে বসে থাকা ড্রাইভারকে বলে,

“ চলুন। “

__________

তিন তলার এ থ্রি ইউনিটের দরজায় পরপর দু’বার কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে আছে দূর্জয়। টানা দুই ঘন্টা ধরে চলমান এই বৃষ্টিতে বিদ্যুৎও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। চারিদিকটা কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে তলিয়ে আছে।

মিনিট একের মধ্যেই ভেতর থেকে দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যায়। দরজার ধারে মোম দানি হাতে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের থ্রি পিস পরিহিতা নারী। মোমের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠে সেই নারীর মলিন মুখশ্রী। চোখের কার্নিশে জল জমে আছে মৃদু।

মোমবাতির স্বল্প আলোতে সেই মুখখানি দেখে দূর্জয় থমকায়। পরপর প্রশ্ন করে,

“ সব ঠিক আছে? “

বাণী মুখ ফুটে বলতে পারে না কিচ্ছু ঠিক নেই। সে নীরব রয়। এরই মাঝে একটা কাপড়ের ব্যাগ ও ফোন হাতে তিন তলায় এসে পৌঁছায় নিশা। বাণীকে দেখেই দ্রুত জুতো খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলে,

“ আপু। জ্বর কমেছে বহ্নির? “

প্রশ্নটুকু করে নিশা আর অপেক্ষা করে না। নিজেই হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ভেতরের রুমে চলে যায়। দূর্জয় বাণীর মুখপানে তাকিয়ে ধীরে সুস্থে ভিতরে প্রবেশ করে। নিচু স্বরে বলে,

“ আমার গাড়ির টায়ার পাঙচার হয়ে গিয়েছিলো। পথিমধ্যে নিশার সাথে দেখা হয়। ও বললো বহ্নির জ্বর। তাই দেখতে এলাম। “

বাণী মাথা নত করে দরজা আটকে দিয়ে বলতে নেয়,

“ তুমি… “

বাকি কথাটুকু সম্পন্ন করতে পারে না বাণী। তার আগেই ভেতরের রুম থেকে নিশা চেঁচিয়ে উঠে,

“ আপু! “

চেঁচানো শুনে বাণী দ্রুত পায়ে ভিতরের রুমের দিকে যেতে নিলেই দূর্জয় শান্ত স্বরে শুধায়,

“ ক্যান আই কাম? “

বাণী এক পলকের জন্য ফিরে তাকায়। মাথা সামান্য নেড়ে সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে যায়। দু’জন একসঙ্গে রুমে প্রবেশ করতেই দেখে নিশা বহ্নির পাশে বসে কপাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। জ্বরে কাবু বাচ্চাটা বিছানার সঙ্গে মিশে আছে যেনো। দুই চোখ উত্তাপে খুলতে পারছে না। কেমন করে কাতড়াচ্ছে! নিশা বাণীকে দেখতেই বলে,

“ পুড়ে যাচ্ছে একদম। ভয়াবহ অবস্থা। “

দূর্জয় এগিয়ে যায়। নিশা বিছানা ছেড়ে নেমে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। দূর্জয় বহ্নির মাথার কাছে বসে কপাল ছুঁয়ে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে সে আঁতকে বলে উঠে,

“ মারাত্মক জ্বর এসেছে। “

বাণী মাথা নত করে বলে,

“ দুপুরে জোর করে কিছুটা খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলাম। বমি করে সব উগড়ে দিয়েছে। এরপর থেকে আর কিছু খাওয়াতে পারি নি। জলপট্টিও দিতে দিচ্ছে না। “

নিশা সামান্য রাগ দেখিয়ে বলে,

“ এরকম একটা অবস্থা আর তুমি কলে বলছিলে যে সিরিয়াস কিছু না। আমি নিজে না আসলে তো এই অবস্থার কথা জানতামও না। “

দূর্জয় সিরিয়াস গলায় বলে উঠে,

“ হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে। “

বাণী সঙ্গে সঙ্গে বাধা দেয়,

“ না। প্রয়োজন নেই। কিছু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেই জ্বর কমে যাবে। “

নিশা বলে উঠে,

“ আমি আরো বৃষ্টি দেখে ভুনা খিচুড়ি আর বেগুন ভেজে নিয়ে এসেছিলাম। বেড়ে নিয়ে আসছি। জোর করে হলেও একটু খাইয়ে দাও। “

বাণী মানা করতে চাইলো। কিন্তু নিশা অপেক্ষা করলো না। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ধরে চলে গেলো খাবার টেবিলের কাছে।

বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দূর্জয়ের দিকে তাকায়। বলে,

“ এরকম একটা সময় এসেছো। একদিকে বহ্নির এই অবস্থা অপরদিকে কারেন্ট নেই। পানি দেবো তোমাকে? “

দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক বাণীকে দেখে থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ প্লিজ বাণী। ফরমালিটির প্রয়োজন নেই। “

দূর্জয়ের একহাত বহ্নির গালে ছিলো। জ্বরের ঘোরে বহ্নি সেই হাত জড়িয়ে ধরে পাশ ফিরে অস্ফুটে বলে,

“ পাপা। “

বাণী এবং দূর্জয় দু’জনেই চমকে তাকায় বহ্নির পানে। বাণীর চোখ মুহুর্তেই টলমল করে উঠে। গত চার মাসে তার মেয়ে এক মুহুর্তের জন্য ওই লোকটার নাম মুখে নেয় নি। কিন্তু আজ! সন্ধ্যা থেকেই জ্বরের ঘোরে বারবার পাপাকে খুঁজছে। বাণী গত দুই ঘন্টা ধরে অসহায়ের ন্যায় মেয়ের পাশে বসে ছিলো। একটা পর্যায়ে যখন পরিস্থিতি অসহনীয় ঠেকে তখন বসে নীরবে ডুকরে কেঁদেছে।

দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে আবার বাণীর পানে তাকায়। বাণী সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে নিজের মুখ লুকিয়ে ফেলে। দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বহ্নির মাথার কাছে সামান্য ঝুকে কোমল স্বরে শুধায়,

“ পাপা নই। ইট’স মি কিডডো। মেজর। “

বহ্নি কি তা শুনতে পেলো কিনা জানা নেই। কেবল আরেকটু দূর্জয়ের হাত জড়িয়ে মিশে গেলো। কারো অযাচিত স্পর্শে বিরক্ত অনুভব করা দূর্জয় হয়তো জীবনে প্রথমবার কারো স্পর্শে বিরক্তবোধ করলো না। বহ্নির এই জ্বরের ঘোরের আহ্লাদকে প্রশ্রয় দিলো।

__________

একটা কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে দুজন যুবক ও যুবতী। যুবতী নিজেদের ডান পাশের টেবিলে বসা আরো পাঁচ যুবককে দেখেই মুখ কালো করে বলে উঠে,

“ একা আসবে ভেবেছিলাম। “

প্রত্যয় ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের বাম পাশের টেবিলে বসা এক রমণীকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ তুমিও তো একা আসো নি। “

ডান পাশের টেবিলে বসা পাঁচ যুবকের মধ্যে সবথেকে চঞ্চল স্বভাবের যুবকটা বলে উঠে,

“ ঝগড়াঝাটি ভাবী। আমরা কিছু দেখছি না। ইউ গাইস ক্যারি অন। “

জেসি চোখ মুখ কুচকে ফেলে। প্রত্যয় নামক এই কুত্তার সাঙ্গ পাঙ্গ গুলোর মধ্যে এই সাইফ নামক লোকটাকেই সবথেকে বিরক্তিকর লাগে তার। কোনো ম্যানারস নেই। জেসি বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ ম্যানারলেস কোথাকার। “

জেসির বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটা প্রত্যয়ের কানে পৌঁছায়। সে চোখ গরম করে বলে,

“ তোমার ফ্রেন্ড তো খুব ম্যানারসের দোকান, তাই না? পাশের বাড়ির আন্টির মতো আমাদের টেবিলে আড়ি পেতে রেখেছে। “

“ অন্তত তোমাকে ঝগড়াঝাটি দুলাভাই তো ডাকছে না। “

প্রত্যয় বলে,

“ না ডাকাই ভালো। কারণ তোমার হাজবেন্ড কিংবা তোমার ফ্রেন্ডের দুলাভাই হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। “

জেসি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আওয়ার ফিলিং ইজ মিচুয়্যাল। “

“ আর মাত্র চার মাস সহ্য করে নিতে হবে। ফ্যামিলি থেকে বেধে দেওয়া ছয় মাস পাড় হলেই আমরা ক্লিয়ারলি জানিয়ে দিবো যে উই ট্রাইড টু নো ইচ আদার। কিন্তু আমাদের মেন্টালিটি ম্যাচ করে না। সো কোনো এনগেজমেন্ট হবে না। “

জেসি বিদ্রুপ করে বলে,

“ এক্স্যাক্টলি। তোমার মতো কাউকে বিয়ে করার আগে আমি দরকারে হারপিক খেয়ে মরে যাবো। তবুও তোমাকে বিয়ে করে নিজের প্রেস্টিজ নষ্ট করবো না। “

পাশের টেবিল হতে খাবার খেতে ব্যস্ত সাইফ কারেকশন করে দিয়ে বলে,

“ হারপিক খেয়ে সুইসাইডের ট্রাই করলে এভাবেও আপনার প্রেস্টিজ বলতে আর কিছু থাকবে না ভাবী। আর তাছাড়া হারপিক খেয়ে কেউ মরে না, বড়জোর পেটে গন্ডগোল দেখা দিবে। আপনি বরং ফিনাইল খেয়ে দেখতে পারেন। “

সাইফের কথার পিঠে সেই টেবিলে বসা বাকি চারজন সরবে হেসে উঠে। জেসি চোখ গরম করে সামনে তাকাতে দেখে প্রত্যয়ও অন্যদিকে ফিরে মুখ টিপে হাসছে। এবার সে নিজের বাম পাশে তাকাতে দেখে তার সো কল্ড বেস্ট ফ্রেন্ডও সাইফের কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মুহুর্তেই জেসির শরীরে যেনো আগুন ধরে যায়। সে শব্দ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ এ বাঞ্চ অফ ইডিয়টস। “

বলেই সে গটগট পায়ে হেঁটে সেখান থেকে প্রস্থান করে। সাইফ অবাক সুরে বলে,

“ ঝগড়াঝাটি ভাবী চেতে গেলো কেনো? আমি তো ভালো সলিউশন দিলাম। মানুষ আজকাল উপকারের দাম দেয় না। “

__________

একটা পেস্ট্রি শপে দাঁড়িয়ে অর্ডার হাতে পাওয়ার অপেক্ষা করছে বাণী। পেস্ট্রি শপটা এই এলাকায় নতুন। কিছুদিন আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে বহ্নিকে এখান থেকে ডোনাটস কিনে দিয়েছিলো বাণী। বাচ্চাটা মিষ্টি খাবার খুব একটা পছন্দ করে না কখনো। কিন্তু আজ মুখে অরুচি নিয়েও নিজ থেকে এই শপের ডোনাটস খেতে চেয়েছে। তাই বাণী আর অপেক্ষা না করে দ্রুত পার্স হাতে বেরিয়ে এসেছে।

বাসা থেকে অবশ্য বেশি একটা দূরে না এই শপটা। আর তাছাড়াও বাসায় বহ্নি একা নেই। সঙ্গে নিশাও আছে। তাই মোটামুটি নিশ্চিন্তেই আছে বাণী। গতকাল রাতে যে এসেছিলো মেয়েটা তারপর আর ফিরে নি। ফোন করে জুলফিকার মুজতবার থেকে অনুমতি নিয়েই বহ্নির কাছে রয়ে গিয়েছে। বহ্নির জ্বরের কথা শুনে আজ বিকেলে জুলফিকারও একবার এসে বাচ্চাটাকে দেখে গিয়েছে।

অর্ডার প্যাক করে দিতেই বাণী পেমেন্ট করে হাতের ফোনে সময়টা দেখে নেয়। রাত ৯ টা বেজে ২৭ মিনিট। বাণী দ্রুত শপ থেকে বের হয়। বাসায় ফিরে বহ্নিকে খাইয়ে ওষুধও খাওয়াতে হবে।

ফুটপাথ ধরে বাড়ির পথে হাঁটছিলো বাণী। আচমকা পাশের এক গলি থেকে একজোড়া হাত তার মুখ চেপে ধরে টেনে অন্ধকারে নিয়ে যায়। আকস্মিক ঘটনায় বাণী হতভম্ব হয়। হাত থেকে পার্স এবং পার্সেলের ব্যাগটা পড়ে যায়। হাত পা ছোড়াছুড়ি শুরু করে। কিন্তু সেই সুবলিষ্ঠ হাতের শক্তির সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে পেরে উঠে না সে।

এই গলিটা নির্জন। কোনো মানুষ নেই। কেবল সারি সারি করে কিছু গাড়ি পার্ক করে রাখা। সম্ভবত পার্কিং এরিয়া কোনো। গলির শেষ মাথায় যেতেই সেই বলিষ্ঠ হাতের বাধন আলগা হয়। বাণী তৎক্ষণাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে তাকায়।

গলির এক কোণে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বাণী দেখতে পায় একটা পুরুষালী অবয়বকে। সাধারণ দশটা পুরুষের মতোই শার্ট এবং প্যান্ট পরিহিত। তবে সেই পরিধেয় পোশকের অবস্থায় কোনো যত্নের ভাজ নেই। শুভ্র রঙা মুখের অর্ধেকটা কালো মাস্কের আড়ালে ঢাকা। তবে উন্মুক্ত চোখ জোড়া দেখে বাণী জমে যায়। ভয়ে দু’পা পিছিয়ে যায়। রক্ত হিম করা সেই দৃষ্টি দেখে চিৎকার করার কথা ভুলে বসে।

উক্ত পুরুষ বাণীর হাবভাব দেখে নীরবে নিজের মুখের মাস্কটা খুলে। এক কদম এগিয়ে যায় বাণীর দিকে। বাণী সঙ্গে সঙ্গে আরো দু কদম পিছিয়ে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে গলির মাথায় তাকায়। পথ খোলা নেই। গলির মাথায় একই বেশ ভূষায় দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন যুবক। যেনো পাহারা দিচ্ছে। বাণী পালানোর চেষ্টা করলেই খপ করে তাকে ধরে ফেলবে।

বাণী ভীত চোখ জোড়া মেলে আবার সামনে তাকায়। ঘামছে সে। এই শীতল আবহাওয়ার মধ্যেও সে তিরতির করে ঘামছে। ঘামে ভেজা চুল গুলো গাল ও ঘাড়ে লেপ্টে আছে। অজ্ঞাত পুরুষ নীরবে এগিয়ে আসে। একহাতে বাণীর গালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরাতে সরাতে অতি শান্ত গলায় বলে,

“ খুনি তো আমি ছিলাম বাণী। তুমি কেনো তোমার হাত নোংরা করলে? “

বাণী ভয়ে কাপছে। অতি শান্ত গলায় বলা কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে আরো ভীত হয়ে পড়ে সে। সেই পুরুষ এবার গাল থেকে হাত নামিয়ে বাণীর গলা চেপে ধরে। চোখে চোখ রেখে বলে,

“ আমার বাচ্চাকে কেনো মারলে? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here