এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫০.
চতুর্থ তলায় উপস্থিত আতঙ্কবাদীদের অস্ত্র শক্তি ধূলিসাৎ করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ের আওতায় পরিচালিত সৈন্যদল। অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরীর মুখে তখন জয়ের হাসি। দূর্জয়ের পানে তাকিয়ে তিনি বলেন,
“ সফল হয় নি মেজর। আমরা হতে দেই নি। “
দূর্জয় মলিন স্বরে বলে,
“ আলহামদুলিল্লাহ। “
সিভিলিয়ানদের নিচে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন লেফটেন্যান্ট তখন চতুর্থ তলায় এসে উপস্থিত হয়। তাদের দেখে দূর্জয় জানতে চায়,
“ সবাইকে সেফলি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে? “
সাদাত স্পষ্ট গলায় বলে,
“ ইয়েস স্যার। “
দূর্জয় এবার শোভনের পানে তাকিয়ে বলে,
“ পুলিশ ফোর্স বাহিরে অপেক্ষারত আছে অফিসার। আমাদের উপরে যেতে হবে। ইউ শুড গো ব্যাক টু ইউর ফ্যামিলি নাও। “
শোভন মৃদু হাসে। হেসে মাথা নেড়ে দূর্জয়ের দিকে হাত বাড়ায়। নিজের বুকের অস্থিরতা চেপে দূর্জয়ও হাত বাড়ায়। হাতে হাত মিলিয়ে প্রস্থানের পূর্বে অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরী বলে,
“ মেজর, বিদায় মুহুর্তে আপনি যেনো কি বলেন সবসময়? “
দূর্জয় মৃদু ভ্রু কুচকে রয়। তার মস্তিষ্ক মনে করতে পারছে না। কি বলে সে? শোভন কিছুটা মনে করার চেষ্টা করে প্রফুল্ল গলায় বলে উঠে,
“ ওহ ইয়েস! মে আওয়ার কান্ট্রি লিভ লং। “
দূর্জয় ম্লান হেসে নিজেও বলে,
“ মে আওয়ার কান্ট্রি লিভ লং। “
অফিসার প্রস্থান করতেই দূর্জয় দুইজন সৈন্যকে বলে নিহত দুই আতঙ্কবাদীর কাছে থাকতে। আর বাকিদের নিজের সঙ্গে আসার জন্য ইশারা দেয়।
বুট শু পরিহিত শক্ত পায়ের দাপুটে আওয়াজে চলন্ত এস্কেলেটরটা মৃদু কেপে উঠে। দূর্জয়রা যখন ষষ্ঠ তলায় পৌঁছায় ঠিক সেই মুহুর্তে আচমকা অষ্টম তলা হতে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। বিকট সেই শব্দ। সকলে এক মুহূর্তের জন্য থামে। হতবিহ্বল হয়ে একে অপরের মুখ পানে চায়। অত:পর একপ্রকার দৌড়ে দ্রুত অষ্টম তলায় পৌঁছায়।
অষ্টম তলার যে পাশটায় বিস্ফোরণ ঘটেছে সেদিকে সৈন্যদের হৈ চৈ। বিস্ফোরণের ফলে সম্পূর্ণ একটা স্টোরের অনেকাংশ ধ্বসে পড়েছে। ধোঁয়ার ফলে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবুও সৈন্যরা নিজেদের দুই সাথীকে খুঁজে ফিরতে ব্যস্ত।
দূর্জয়রা অষ্টম তলায় এসে উক্ত পরিস্থিতি দেখে স্তব্ধ বনে যায়। রাফি জানতে চায়,
“ কি হয়েছে? “
সাইফ এলোমেলো গলায় বলে,
“ প্রত্যয় আর লেফটেন্যান্ট হারুন আতঙ্কবাদীর সাথে ছিলো। বিস্ফোরণ হয়েছে। “
দূর্জয় এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। মুখে রুমাল বেঁধে দ্রুত এগিয়ে যায় ধোঁয়ার ভেতরে। তার দেখাদেখি বাকিরাও একই কাজ করে। কেউ রুমাল বেঁধে, কেউবা নাক মুখ খোলা রেখেই। ধোঁয়ার তীব্রতা কিছুটা কমে আসতেই ফারদিন ধ্বংস স্তুপের মধ্যে একটা দেহ দেখতে পায়। সে চিৎকার করে উঠে। সকলে এগিয়ে আসে। রক্তাক্ত সেই দেহ। জীবিত নাকি মৃত বুঝার সাধ্যি নেই। জুনায়েদ এগিয়ে গিয়ে দেহটাকে জাপটে ধরে। চেঁচিয়ে ডাকে,
“ মেডিক্যাল হেল্প প্লিজ! “
দূর্জয় ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে দেহটা দেখে। লেফটেন্যান্ট হারুনের দেহ। গুরুতর অবস্থা উনার। তার কাছেই রয়েছে নিথর আতঙ্কবাদীর দেহ। বিস্ফোরণের সময় সে আতঙ্কবাদীর নিকটে ছিলো বলেই হয়তো ক্ষয়ক্ষতির ভারটা বেশি সইতে হয়েছে।
সবাই যখন লেফটেন্যান্ট হারুনকে স্ট্রেচারে তুলতে ব্যস্ত সেই মুহুর্তে সাইফ অস্থির হয়ে চারিদিকে প্রত্যয়কে খুঁজতে থাকে। আউটলেটের দ্বার প্রান্তে তখনও সাদা কালো ধোঁয়ার মেলা। সেই ধোঁয়ার মধ্যে থেকেই কারো চাপা আর্তনাদ ভেসে আসে। সাইফ চকিতে সেই পানে তাকায়। এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সেদিকে এগিয়ে যায়।
একটা বিশাল সাইনবোর্ডের নিচে চাপা পড়ে আছে অর্ধেক দেহ। ডান পা টা বেকায়দায় আটকে আছে। চোখ মুখ কুচকে ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করছে প্রত্যয়। দৃশ্যটুকু স্পষ্ট হতেই সাইফ চেঁচিয়ে উঠে। কাছে গিয়ে একা হাতে সেই সাইনবোর্ড টেনে তোলার চেষ্টা করে। ধাতব সাইনবোর্ডটা আকারে বেশ বড় এবং ওজনে অত্যাধিক ভারী হওয়ায় সাইফ প্রথম চেষ্টায় তা তুলতে পারে না। দ্বিতীয় দফায় চেষ্টা করতে নিবে সেই মুহুর্তে দেখে চারিদিক থেকে আরো পাঁচ জোড়া হাত এগিয়ে এসেছে সাহায্যর জন্য। সাইফ চোখ তুলে পাঁচ জোড়া হাতের মালিকের পানে তাকায়। দূর্জয়, সাদাত, রাফি, জুনায়েদ ও ফারদিনকে দেখে ভরসা খুঁজে পায়।
‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ উক্তিটাকে সত্য প্রমাণ করে ছয়জন মিলে সাইনবোর্ডটা তুলে দূরে ছুড়ে ফেলে। প্রত্যয়ের কাছে এগিয়ে যায়। সাইফ প্রত্যয়ের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয়। কপালের একপাশ ফেটে রক্ত ঝরছে। শরীরটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে। চেতনা তখন আধো আধো আছে। সাদাত ডাকে,
“ প্রত্যয়! শুনতে পাচ্ছিস ভাই? “
প্রত্যয় অস্ফুটে বলে,
“ আমার পা। “
রাফি চিন্তিত স্বরে শুধায়,
“ পা ব্যথা করছে? “
“ অনুভব করতে পারছি না কিছু। “
সবাই ভীতিকর দৃষ্টি মেলে একে অপরের দিকে তাকায়। ততক্ষণে আরেকটা স্ট্রেচার এসে হাজির। দূর্জয় শীতল গলায় বলে,
“ ভারী সাইনবোর্ড পায়ের উপর ছিলো, তাই হয়তো নাম্ব ফিল করছে। হসপিটাল নিয়ে যেতে দাও। কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ। “
__________
ঘড়ির কাটা অলস ভঙ্গিতে চলছে। লিভিং রুমে একত্রিত হয়ে বসে আছে গোটা পরিবার। দৃষ্টি তাদের টেলিভিশনের পানে স্থির। নিজের রুমের দরজার সামনে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রমণী দূর হতে দেখছে সেই দৃশ্য। সামনে যাওয়ার সাহস করছে না ভুলেও। গেলেই মা আর ভাবী সবার আগে তার পিঠে তবলা বাজাবে। দুমাদুম কিল ঘুষিও পড়তে পারে!
ফোনটা চিৎকার করে বেজে উঠতেই জাঈদ এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ফোনটা রিসিভ করে। সবাই উদগ্রীব হয়ে জাঈদের পানে তাকিয়ে থাকে। জাঈদ ফোন রেখে মুখটা থমথমে করে রয়। চারু চিন্তিত স্বরে জানতে চায়,
“ কি বলেছে আংকেল? প্রত্যয়ের কোনো খবর পাওয়া গিয়েছে? “
“ বিস্ফোরণ হয়েছে। ইঞ্জুরড। হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। “
মেয়ের জন্য পছন্দ করা সুপাত্রের ব্যাপারে এমন একটা করুণ খবর জানতে পেরে আলাউদ্দিন সাহেব আহত হয়। বন্ধুর প্রতিও সহমর্মিতা অনুভব করেন। বন্ধু নিজের মনের কথা প্রায়ই আলাউদ্দিনের সাথে আলাপ করেন। এক পুত্রশোকই এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে তিনি লোকটা। এই পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পড়েছে?
আলাউদ্দিন সাহেব স্থির থাকতে পারেন না। উদ্বেগ মিশ্রিত স্বরে বলে,
“ আমি ঢাকা যাবো জাঈদ। এয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করো। নেক্সট ফ্লাইটেই যেতে চাচ্ছি। “
জাঈদ অমত জানায় না। আগামীকাল তার খুব গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস মিটিংটা না থাকলে সে-ও এই মুহুর্তে আব্বুর সাথে যেতো। আলাউদ্দিন সাহেব রেডি হওয়ার জন্য রুমের ভেতর যেতে নিবে ঠিক সেই মুহুর্তে বাড়ির ছোট মেয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হয়। অদ্ভুৎ অধিকারবোধ মিশিয়ে বলে,
“ আমিও আব্বুর সাথে যাবো। আমার জন্যও একটা টিকিট বুক করো ভাইয়া। “
আলাউদ্দিন সাহেব মেয়ের দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। পুত্রবধূর কাছে মেয়ের অসামাজিকতা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীনতা সম্পর্কে জেনেছেন তিনি। আর জানার পর থেকেই তিনি মেয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট। তবুও তিনি কথা না বাড়িয়ে বলেন,
“ জাঈদ, তোমার বোনের জন্যও টিকিটের ব্যবস্থা করো। “
__________
চারপাশে মৃদু ফিনাইলের গন্ধ। এয়ারকন্ডিশনের আওতাভুক্ত স্থানে থেকেও তিরতির করে ঘামছে সাইফ। অস্থির পায়ে ইমারজেন্সি এরিয়ার বাহিরে পায়চারি করছে। শুধু সে একা নয়। আরো চার জন সৈন্যও একই অস্থিরতার ভেতর সময় পাড় করছে। করিডর হয়ে হেঁটে যাওয়া প্রতিটা মানুষই ঘুরে ঘুরে বারবার তাদের দেখছে। আচমকা ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই সাইফ পকেট থেকে ফোনটা বের করে। স্ক্রিনে নামটা দেখতেই দ্রুত সবার অগোচরে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে। কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই আতঙ্কিত রমণী শুধায়,
“ ঠিক আছেন আপনি? “
সাইফ চোখ তুলে একবার চারিপাশে তাকায়। চারিপাশে কেমন দুঃখ দুঃখ ভাব মিশে আছে। হসপিটাল প্রাঙ্গণ বলে হয়তো! সাইফ ধীমি স্বরে বলে,
“ ঠিক আছি। “
“ আব্বুর সাথে কথা হয়েছে মাত্র। আলহামদুলিল্লাহ সিভিলিয়ানরা ঠিক আছে। চিন্তা করবেন না প্রত্যয় ভাইয়াও ঠিক হয়ে যাবে। “
সাইফ এবার মাথা তুলে আকাশের পানে তাকায়। মেয়েটা হয়তো জানে না এই মিশনে একজন লেফটেন্যান্ট শহীদও হয়েছে। লেফটেন্যান্ট হারুন। অবশ্য কেউই হয়তো এখনো জানে না এই ব্যাপারে। কিছুক্ষণ পূর্বে ইমারজেন্সি ইউনিট থেকে বেরিয়ে আসা ডক্টর সাইফদের এই ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন।
ফোনের অপর পাশ হতে নিশা নিজেই আবার বলে,
“ আপনি কি ক্লান্ত? “
বিষন্নতায় মোড়ানো পরিবেশের মধ্যে এই তিন বাক্যের প্রশ্নতে সাইফ সুখ খুঁজে পায় আচমকা। সে কোমল স্বরে বলে,
“ আমি সুখী ইয়াসমিন। আপনি আজকাল সুখ হয়ে ধরা দিচ্ছেন। আমার ছন্নছাড়া জীবনের সুখ হওয়ার জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। “
__________
রাত তখন সাড়ে আটটার কাটা পেরিয়েছে কেবল। ব্যস্ত নগরীর শান্ত রাস্তার ধারে গাড়ি এসে থামে। গাড়ি হতে নেমে আসে প্রায় চার ঘন্টা নিঃশ্বাস আটকে বসে থাকা মানুষটা। মস্তিষ্কটা তার তখনও ফাঁকা। আকাশপথে ঢাকা হতে চট্টগ্রাম রওনা দেওয়ার পূর্বেই সে কাঙ্ক্ষিত খবরটুকু পেয়েছে। তবুও পুরোটা সময় হৃৎপিণ্ড একপ্রকার হাতে নিয়েই বসে ছিলো সে।
পথের ধারে পিচ ঢালা রাস্তা থেকে সামান্য উঁচু ফুটপাতে স্থবির হয়ে বসে থাকা মানবীকে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেই পানে। সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। ক্লান্ত দেহী মানবী এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসে ছিলো। সামনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই সে চোখ তুলে তাকায়। থমথমে মুখের স্থির দৃষ্টি দেখতেই ফের চোখ নামিয়ে ফেলে।
দূর্জয় একটুও শব্দ করে না। কিছু বলেও না। কেবল হাত বাড়িয়ে বাণীর ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে রাখা বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা আতংকে কেপে উঠে। আরো শক্তপোক্ত ভাবে মা’কে জড়িয়ে ধরে। বাণী শান্ত গলায় বলে,
“ এখনো ভয় থেকে বের হতে পারে নি। “
দূর্জয় দমে না। আবারও হাত বাড়িয়ে বহ্নির মাথায় হাত রাখে। কোমল স্বরে ডাকে,
“ আমি মেজর। লুক এট মি বাচ্চা। দেখুন, ভয়ের কিছু নেই। “
বহ্নি মাথা তুলে তাকায় না। মায়ের কোলেই পড়ে রয়। শেষ অপরাহ্নে দেখা দৃশ্যটা এখনো তার ছোট মস্তিষ্ক প্রসেস করতে পারে নি। হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে, ওষুধ পত্র নিয়ে যখন মাম্মার সাথে ফিরে কেবল রিকশা থেকে নামলো ঠিক সেই মুহুর্তে বিভৎসকর ঘটনাটা ঘটেছে। চোখের সামনে বহ্নি দেখলো তাদের এপার্টমেন্টটা আগুনে দাউদাউ করে উঠলো। সেই সঙ্গে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। আর তারপর… তারপর আর কিছুই বহ্নি বুঝতে পারে নি। বারবার ওই দুপুরের ঘটনাটাই তার চোখের সামনে প্লে হচ্ছে। আর সঙ্গে সঙ্গে সে ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে।
দূর্জয় এবার বাণীর উদ্দেশ্যে বলে,
“ চলো। “
বাণী ক্লান্ত স্বরে জবাব দেয়,
“ আমাকে আমার পরিস্থিতিতে ছেড়ে দাও। “
“ সরি বাট রাস্তার মাঝে ছেড়ে দিতে পারছি না। রেস্ট দরকার তোমাদের। সঙ্গে চলো। “
বাণী নড়ে না। উঠেও না। দূর্জয় বাধ্য হয়ে হাত বাড়িয়ে বহ্নিকে কোলে তুলে নেয়। বহ্নি ভয়ে গুটিয়ে যেতে নিলেই সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা বুকে চেপে ধরে বলে,
“ ইট’স ওকে, ইট’স ওকে। ভয় পাবেন না। আমি। “
বহ্নি আশ্বস্ত হলো কিনা বুঝার উপায় নেই। সে নীরব হয়ে আবার মুখ লুকায় দূর্জয়ের কাধে। বহ্নিকে কোলে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দূর্জয় অপর হাত বাড়িয়ে দেয় বাণীর দিকে। সেই বাড়ানো হাতে বিন্দুমাত্র সংকোচ কিংবা অস্বস্তি নেই। এই দুটো মানুষের চিন্তায় ঘন্টা খানেক আগেও দূর্জয়ের শ্বাস আটকে ছিলো। বিশাল একটা মিশন চলাকালীন সম্পূর্ণ সময়টায় মস্তিষ্ক জুড়ে এই দুটো মানুষের আধিপত্য ছিলো। অদ্ভুৎ সেসব অনুভূতি! অদ্ভুৎ সব হিসাব! সেসব নাহয় দূর্জয় পরে মেলাবে।
দূর্জয়ের বাড়ানো হাতের দিকে ফিরে তাকালো না বাণী। নিজের জায়গায় অনড় রইলো। দূর্জয় ডাকে,
“ চলো বাণী। “
কারো মুখে নিজের নামটুকু শুনে বাণীর চেপে রাখা দলা পাকানো অনুভূতিরা যেনো আশকারা পেলো। ঠেলেঠুলে তা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসে। বাণী দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। নিজেকে বড্ড দোষী মনে হচ্ছে। সকালে তাড়াহুড়োর করা ভুলের ফলে একটা লোকের সম্পূর্ণ প্রোপার্টিজ জ্বালিয়ে দিলো সে। কেবল বাড়িওয়ালার বাড়িটাই না, সেই সঙ্গে বাণীর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে একটু একটু করে সাজিয়ে নেওয়া সুখ গুলোও আগুনে জ্বলে ছাঁই হয়ে গিয়েছে। একটা জীবনে আর কতবার তিক্ততার স্বাদ ভোগ করতে হবে তার?
দূর্জয়ের চোখেও নেমে আসে বেদনার ছায়া। সামনে বসে থাকা এই মেয়েটার জন্য আজকাল তার মায়া হয়। হুটহাট চিন্তাও হয়। সেই চিন্তার সঙ্গে দমবন্ধকর অনুভূতিও হয়। নিঃশ্বাসও রুদ্ধ হয়। দূর্জয় থমকায়। কিন্তু সেসব কিছু দূর্জয় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকে। কিছু বলা হয় না। ঠিক যেমন এই মুহুর্তে সে বলার জন্য কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। ঠিক কোন শান্তনাটা এই মেয়েকে দেওয়া যায় তা-ও তার মাথায় আসছে না।
দূর্জয় এবার নিজের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধীরে ধীরে বাণীর মাথায় রাখে আলতো করে। এইটুকু আশ্বাস বাণীর বেদনার সামনে খুব কম তা সে ভালো করেই জানে। তবুও সে নিজের হাতটা সরায় না। যদি মেয়েটা সামান্য ভরসা খুঁজে পায়! যদি মেয়েটা বুঝতে পারে সে কারো অঘোষিত দায়িত্বের তালিকায় নিজের নামটা লিখেছে! যদি মেয়েটা উপলব্ধি করে কখনো কখনো কংক্রিটেও গাছ জন্মায়! সেই গাছে ফুটে কোনো নাম না জানা ফুল।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]