তবু_সুর_ফিরে_আসে ৩৫ পর্ব

0
159

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

৩৫ পর্ব

ন‌ওশাদ পার্টি ছেড়ে উপরে উঠে এলো । সব গেস্ট এখনো আনন্দ করছে । নিশাল গিটার বাজালো কিছুক্ষণ। গল্প গুজব চলছে এখনো। ন‌ওশাদ আসার সময় হেরার কাছে গিয়ে শুধু বলল, আমি রুমে যাচ্ছি । টায়ার্ড লাগছে।
জ্বি ।
হেরার গান শুনে সে ছয় বছর পিছনে এক রাতে ফিরে গেল। তার খুব মনে আছে গীতি সেদিন তার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিল উত্তরায়। ন‌ওশাদ গাজীপুর থেকে আসার পথে গীতিকে সঙ্গে নিয়ে এলো উত্তরা থেকে। গীতির সেই বন্ধুর বাসায় উঠবে না উঠবে না করেও অনুরোধ টা ফেলতে পারেনি, ন‌ওশাদ‌ কে কফি খাওয়ার জন্য বাসায় যেতেই হলো। সেখানে গীতির আরো দুই বান্ধবী ছিল তারাই কথা বলছিল স্বামীদের ব্যস্ততা আর তাদের প্রতি উদাসীনতা এসব নিয়ে । সংসারের কোন খবর রাখে না কেউ।
ন‌ওশাদ তোমরা পুরুষ মানুষ এমন কেন বলো তো ? রুমা নামের গীতির এক বন্ধু বলল।
আমি কি বলব এটা তো তোমার বন্ধু গীতি উত্তর দিবে আমি উদাসীন নাকি মনোযোগী ?
তুমি পুরুষ দের ব্যাপার টা বলো ওরা এমন কেন ?
আমি কোন পক্ষ নিব না রুমা এই মুহূর্তে আমি এখানে একা, পুরুষ মানুষের পক্ষে কথা বলে ধোলাই খাওয়ার ইচ্ছা নেই। তারচেয়ে মেয়েদের অভিযোগ মাথা পেতে নিলেই মঙ্গল , ন‌ওশাদ হাসতে হাসতে বলল।
তুমি সাধে কি লাইফে এত তাড়াতাড়ি এত সফল বুদ্ধি মাথায় শুধু গিজগিজ করে তাই না ?
বুঝতে হবে রুমা ।
রুমার বাসা থেকে ফিরে আসার সময় ন‌ওশাদ ড্রাইভ করছে গীতি পাশে বসে ছিল। ন‌ওশাদ‌ মজা করে বলল, কি কি অভিযোগ আলোচনা করলে আমার নামে বন্ধুদের সঙ্গে তুমি ?
তোমার কি মনে হয় আমি তোমার নামে কি কি অভিযোগ করি ন‌ওশাদ ?
একবারেই যে কোন অভিযোগ নেই, সেটা হতেই পারে না।
সেটা ভাবাও তো ভুল ।
সেটাই গীতি ডার্লিং জানতে চাইছি কি কি অভিযোগ তোমার ?
সাধারণ অভিযোগ তুমি সব আমার উপর ছেড়ে খুব নিশ্চিন্তে অফিস, বিজনেস করে পার করে দিচ্ছ জীবন, সংসারে তোমার টাকা দেয়া ছাড়াও কিছু দ্বায়িত্ব পালন করা উচিত এটাই আমার তোমার ব্যপারে একমাত্র অভিযোগ ন‌ওশাদ।
শুধু এই টুকুই গীতি ! ঠিক আছে যাও আজ থেকে তোমার সঙ্গে সংসারের সব ব্যাপারে নাক গলাবো কথা দিলাম !
ও আমার খুব জানা আছে তুমি কতটুকু কি করতে পারবে , গীতি গাল ফুলিয়ে বলল ।
তুমিই তো সব সামলে আমার অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছো গীতি।
এটা ঠিক বলেছো তোমাকে খারাপ টা আমিই করেছি সব মুখের সামনে রেডি করে দিয়ে দিয়ে।
ন‌ওশাদ হাসতে হাসতে বলল সে জন্যই তোমার আঁচলের তলায় থাকতে ভালো লাগে ।আর এভাবেই এই আঁচলের তলায় হেসে খেলে বাকি জীবন কাটিয়ে দিব গীতি। ন‌ওশাদ গীতির হাত ধরে গান গেয়ে উঠেছিল সেদিন , এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়, স্বপ্ন মধুর মোহে ….
আজ এত বছর পর গানটা শুনে সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল। এর ঠিক সাত আট দিন পরেই গীতি চলে যায় । সেই মায়ার আঁচল চলে যায় চিরতরে। যে সংসার একা ও সামলাতো , আত্মীয় স্বজন, সামাজিকতা । সব ন‌ওশাদের হাতে ছেড়ে ছুড়ে চলে গেল। অভিযোগ করার , অভিমান করার কেউ নেই তারপর থেকে।
ন‌ওশাদ বারান্দায় অন্ধকারে বসে আছে। নিচ থেকে হাসাহাসি , বাচ্চাদের হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। ন‌ওশাদ গীতির কথা ভাবছে গীতির পড়িয়ে দেয়া আঙুলের আংটি টার দিকে তাকিয়ে আছে।

বীথি নিশালের কাছে গিয়ে বসলো । নিশু পরীক্ষার সময় একটা ফোন দাও নি কেন ?
পরীক্ষা শুরুর আগের দিন দিলাম না ফোন তোমাকে !
আমি বলছি এর পর একটা কল‌ও দাওনি, আমি জানার জন্য অস্থির হয়ে ছিলাম কেমন হচ্ছে আমার নিশু বেবির পরীক্ষা গুলো?
পরীক্ষার মাঝখানে ফোন দেয়ার মত এত সময় কোথায় খালামনি ।
পাঁচ মিনিট কথা বলার সময় হয়নি তোমার ! পাপাকে ফোন দাওনি বলছো নিশু ?
পাপার সঙ্গে তো কথা বলতেই হতো তাই না !
আমি তো খবর পেয়েছি তুমি প্রতিটা পরীক্ষার পর, পাপা শুধু না হেরার সঙ্গেও অনেকক্ষণ করে কথা বলেছো নিশু !
পাপা আর মামনি অপেক্ষা করে থাকতো তাই ডিনারের আগে আগে চার পাঁচ মিনিট কথা হতো এই যা ।
তোমার পাপা আর দুই দিনের মামনির অপেক্ষা তোমার কাছে অনেক বড় কিছু আমার ফিলিংসের কোন দাম নেই ?
ওফফ খালামনি এত কিছু পরীক্ষার সময় ভাবার মানসিক অবস্থায় ছিলাম না। পরীক্ষার সময় জ্বর হলো সেটাই পাপা মামনি কাউকে বলি নাই টেনশন করবে দেখে ।
তোমার জ্ব‌র ছিল আর তুমি কাউকে বলোনি ! তুমি অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছো নিশু ! তুমি অসুস্থ থাকলে আমার সঙ্গে কথা না বললে তোমার অনেক খারাপ লাগতো সব সময় এটাই বলতে, আর আজ তুমি গোপন তো করেছোই এবং ভালোও ছিলে তাই না ? আমার এই পাওনা ছিল বাচ্চা !
প্লিজ খালামনি আমি অতশত ভাবি নাই পরীক্ষার সময় পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম।
পারুল এসে নিশালের কাছে দাঁড়ালো ।
কিছু বলবে তুমি পারুল বুয়া , নিশাল বলল?
আম্মা আপনার জন্য কেক দিয়ে পাঠালো ।
না এখন খাব না মামনিকে গিয়ে বলো মামনি তো ডিনার করেনি আমি মামনির সঙ্গে পরে কেক খাব !
পারুল বীথির দিকে তাকিয়ে আছে , আপনে খাবেন খালাম্মা ?
বীথি যা ভাগ বলে ধমক দিয়ে উঠলো পারুল কে।
পারুল দৌড়ে চলে গেল।
খালামনি তুমি বসো আমি ওদিকে যাচ্ছি ।
না আমার কথা শেষ হয়নি নিশাল । তুমি আমার সঙ্গে চলো আমার বাসায় । পরীক্ষার পর আমার বাসায় থাকার কথা ছিল তোমার । আর বাবা মনে আছে আমরা প্ল্যান করেছিলাম তুমি আমি তোমার পরীক্ষা শেষ হলে নেপাল ঘুরতে যাব !
খালামনি পাপা আমাকে জীবনেও নেপাল যেতে দিবে না । মনে নেই নেপালে প্লেন ক্রাশ করলো !
প্লেন ক্রাশ করলো বলে ওখানে কি মানুষ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে ফালতু কথা !
তুমি জোর করলে তোমার পাপা রাজি না হয়ে যাবে কোথায় ?
খালামনি আমি এখন আর পাপার মনের বিরুদ্ধে পাপাকে কোন কাজে বাধ্য করতে চাই না । ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার ইচ্ছে নেই আর অনেক হয়েছে । তুমি বসো আমি ঐদিকে যাচ্ছি বলে উঠে গেল নিশাল ।
বীথি তাকিয়ে আছে নিশালের দিকে !

হেরা বেড রুমে ঢুকে দেখে ন‌ওশাদ রুমে নেই ! প্রথমে ভাবলো ওয়াসরুমে । তারপর গিয়ে দেখে বারান্দায় বসে আছে । হেরা ঘাড়ে হাত রাখলো, কি ব্যাপার শরীর খারাপ ?
ন‌ওশাদ একটু চমকে গেল হঠাৎ হেরা ধরাতে !
না শরীর ঠিক আছে।
তাহলে মন খারাপ ?
ভীড়ের মধ্যে থাকতে ভালো লাগছিল না ! সবাই চলে গেছে ?
যুথী আপা বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেছে বাকিরা আছে ! ভাইয়ারা আব্বার রুমে গল্প করছে । আর বাকিরা সব নিচে । আপনি একা বসে আছেন আমি ভাবলাম মন খারাপ ।
সেরকম কিছু না হেরা । নিশাল কোথায় ?
নিচে ।
ও খুব আনন্দ পেয়েছে ।
হুম।
গীতি যাওয়ার পর এভাবে এই বাসায় কোন উৎসব হয়নি । থ্যাংকস তুমি অনেক দিন পর বাসায় একটা আনন্দ করার উপলক্ষ তৈরি করলে । ন‌ওশাদ হেরার হাত ধরলো।
থ্যাংকস এর কি হলো, নিশালের ভালো লাগাছে এটাই বড় পাওয়া।
আপনি তো চলে এলেন ছেলে কত সুন্দর গিটার বাজিয়ে শোনালো আমাদের।
তোমার গানটা চমৎকার হয়েছে।
আরে ধুর সবার রিকুয়েস্ট রক্ষা করতে গাইলাম । আমি কখনো মানুষের সামনে গান গেয়েছি নাকি আগে ।

বীথি ন‌ওশাদের ঘরের দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকলো নক না করেই । বারান্দা থেকে কথা শোনা যাচ্ছে ,বারান্দার কাছে আসতেই দেখে ন‌ওশাদ চেয়ারে বসা ওর কোলে হেরা পা দুলিয়ে বসে আছে । হেরা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে । দু’জনে কেউই ওকে দেখতে পায়নি। হয়তো ভাবতেই পারেনি এই মুহূর্তে এখানে কেউ আসবে।
ওভাবে দুজনকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বীথির পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাওয়ার মত অবস্থা! সে নিজেকে সামলে নিলো । আদিখ্যেতা। মনে মনে বলল, কিভাবে পারে মানুষ ঘর ভর্তি লোকজন এর ভিতরে রুমের মধ্যে ব‌উ কে কোলে নিয়ে বসে থাকতে !
বীথি জানে না ন‌ওশাদ কতটা আদরে, আহ্লাদে, ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে হেরাকে। যদি জানতো তাহলে ওর বুকে যে হিংসার আগুন সেটা দিয়ে হেরাকে জ্বালিয়েই দিতো।
বীথি পিছনে চলে গেল আবার রুমের দরজার কাছে গিয়ে দরজায় নক করতে শুরু করলো।
হেরা , হেরা ।
হেরা বীথির গলার আওয়াজ শুনে রুমের ভেতর এসে দাঁড়ালো ।
আসেন আপু ভেতরে আসেন ।
দুলাভাই কোথায় ?
উনি বারান্দায় বসে আছে ডাকছি আপনি বসুন না ।
ন‌ওশাদ বারান্দা থেকেই বীথির কথা শুনতে পাচ্ছে । উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনটা এত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে কথা বলতে ভালো লাগছে না‌ বীথির সঙ্গে তো আরও না।
বীথি বারান্দায় এসে হাজির হলো ।
দুলাভাই আপনার সঙ্গে কথা ছিল ।
বলো ।
আপু বসেন চেয়ারে ।
বীথি ন‌ওশাদের সামনে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলো । আপনারা কথা বলেন আমি নিচে যাই ।
থাকতে পারো হেরা এমন কোন কথা নেই যা তোমার সামনে বলা যাবে না।
হেরা ন‌ওশাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ।‌
বারান্দার আলো নিভানো আবছা আলোয় ন‌ওশাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। ন‌ওশাদ বীথির দিকে তাকিয়ে বলল, বলো কি বলবে ?
দুলাভাই অনেক দিন থেকেই আমি আর নিশাল প্ল্যান করেছিলাম ওর পরীক্ষা শেষ হলে ওকে নিয়ে নেপাল ঘুরতে যাব । আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিতে এসেছি।
ন‌ওশাদ কিছুক্ষণ চুপ করে র‌ইলো।
নেপাল ।
হ্যাঁ ও তো কখনো নেপাল যায়নি তাই ওকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম।
নিশাল কি পাহাড় পছন্দ করে নাকি ? আমি তো জানি ওর কিছুটা এক্রোফোবিয়া আছে ।
মানে ?
ওর উচ্চতা ভীতি আছে । তারচেয়েও বড় কথা ত্রিভুবন এয়ার পোর্ট টা খুব রিস্কি । যে কয়বার গিয়েছি টেক‌অফ আর ল্যান্ডিংয়ের সময় আমার ই ভয় লাগে। মনে এই বুঝি প্লেন টা ধাক্কা খেলো পাহাড়ের সঙ্গে।
দুলাভাই পাইলট জানে কিভাবে কি করতে হয় এখন যেতে দিবেন কি দিবেন না সেটা বলেন।
নেপাল বাদ দাও মালদ্বীপ থেকে ঘুরে আসো তোমরা, আমি স্পন্সর করব ট্রীপ ।
ওদের কথার মাঝখানে দরজায় ফারহান এসে দাঁড়ালো । বড় ভাবি ?
হেরা রুমে গিয়ে ঢুকলো ।
জ্বি ভাইয়া !
আমরা যাচ্ছি অনেক রাত হয়ে গেছে ভাইয়া কোথায় ?
বারান্দায় বীথি আপুর সঙ্গে কথা বলে ।
ফারহান বারান্দায় এসে দাঁড়ালো । ভাইয়া আমরা যাচ্ছি ।
ঠিক আছে আমি আর নামলাম না।
তোমার আসতে হবে না তুমি কথা বলো।
আমি সবাইকে বিদায় দিয়ে আসি বলে হেরাও ফারহানের সঙ্গে বের হয়ে গেল।
ন‌ওশাদের একা বীথির সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে।
দুলাভাই আমিও উঠব সমস্যা টা কি নেপাল নাকি আমার সঙ্গে যাওয়া সেটা বলেন ? না আপনি হয়তো ভাবছেন আমার সঙ্গে গিয়ে আপনার ব‌উ হারিয়ে গেছে এখন ছেলে কে নিয়ে ইনসিকিউর ফীল করছেন হয়তো।
এত প্যাচাও কেন বীথি তুমি সমস্যা হতে যাবে কেন ? তুমি নিশালকে কতটা ভালোবাসো আমি জানি।
আমার সমস্যা নেপাল যাওয়া টা। আমার একটা মাত্র সন্তান । তোমার বোনের আমানত ও । আমার জানটা ওর মধ্যে, ওকে নিয়ে সব সময় আমার ভেতরে আতঙ্ক কাজ করে ।
নেপাল কি মানুষ যাচ্ছে না দুলাভাই ?
যাচ্ছে কিন্তু ওরা আমার কেউ না, তোমার আপাও কিন্তু নেপাল পছন্দ করতো না । একবার নিয়ে গেছি পোখরা যাওয়ার পথেই কান্নাকাটি অবস্থা তার । পাহাড়ী রাস্তা খুব ভয় পেতো। নিশাল ও ভয় পায় । প্লেনে বসলে কখনো উইন্ডো সীট নেয় না ।
মালদ্বীপ হলে তখন বলবেন সাগরে গিয়ে প্ল্যান ঝাঁপ দিয়ে পড়বে ?
আপনি কি সব কাজ আপার পছন্দ অনুযায়ী করেন ,এই যে আপার সাজানো ঘরে আরেক জনকে কোলে বসিয়ে ….বীথি চুপ করে গেল ।
ন‌ওশাদের এত মেজাজ খারাপ হলো কথাটা শুনে । তারপরও সে ঠান্ডা গলায় বলল, কমপ্লিট করো কথাটা বীথি ?
শোনো আরো অনেক কিছুই হয় এই ঘরে এখন। কথা সেটা না , কথা হলো হেরার জায়গায় বীথি হলেই কি সব শুদ্ধ হয়ে যেতো তখন ? ন‌ওশাদ রাগে দুঃখে তাকিয়ে আছে বীথির দিকে । গীতি যাওয়ার পর সে নিজের সঙ্গে প্রমিজ করেছিল গীতির পরিবারের মানুষদের আমৃত্যু নিজের আপনজন ভাববে। কিন্তু বীথি ওর ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়ার জন্য বসে থাকে ।
শোন নিশাল যদি যেতে চায় ওকে বলো আমার সঙ্গে কথা বলতে ।
ঠিক আছে। বীথি উঠে গেল।
আর দরজা খোলা থাকলেও কারো বেডরুমে ঢোকার সময় দয়াকরে একটু নক করবে, তা না হলে এমন কিছুর মুখোমুখি হয়তো হয়ে গেলে কষ্ট, রাগ সব অনেক বেশিই বেড়ে যেতে পারে বীথি।
মানে ? বীথি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
মানে বেডরুম আমার বিয়ে করা ব‌উ আমার বাকিটুকু আশাকরি তুমি বুঝতে পারছো।
বীথি উঠে চলে গেল ।
ন‌ওশাদের মন খারাপ ছিল বীথির সঙ্গে কথা বলে মন, মেজাজ সব‌ই এখন খারাপ হয়ে গেছে।

মামনি তুমি কিন্তু খুব ভালো গান গেয়েছো আজকে।
চুপ এটাকে গান গাওয়া বলে নাকি !
সত্যি বলছি।
হেরা খাচ্ছে ওর পাশে নিশাল বসে আছে।
পাপা কোথায় মামনি ? কখন থেকে দেখছি না ।
রুমে বীথি আপুর সঙ্গে কথা বলে ।
খালামনির সঙ্গে কি কথা ? নিশাল বিরক্ত নিয়ে তাকালো।
তুমি আর বীথি আপু ঘুরতে নাকি নেপাল যাবে সেটা নিয়ে কথা বলছে ।
নিশাল আরো বিরক্ত হলো এটা শুনে। ঘাড় ফিরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই দেখে বীথি আসছে।
নিশালের কাছে এসে দাঁড়ালো বীথি । নিশু বেবী পাপা ডাকে উপরে যাও । আর প্লিজ পাপাকে গিয়ে বলো তুমি নেপাল যাবে, প্লিজ আমার জন্য। আমি বাসায় যাচ্ছি তুমি যাও পাপার কাছে।
নিশাল বীথির দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না , পাপার রুমের দিকে রওনা হলো।
হেরা খাচ্ছে বীথির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার।
বীথি হেরার দিকে তাকিয়ে বলল , গেলাম হেরা তোমার এরেন্জমেন্ট ভালো ছিল আজকে। থ্যাংকস আমার নিশালের জন্য তুমি এতটা চিন্তা করেছো।
আপু নিশালের জন্য‌ই সব কিছু আমাদের ।
তোমার চেষ্টার কোন কমতি নেই বুঝতে পারছি।‌ কয়দিনেই দুলাভাইকে নিশালকে একেবারে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলে ! এই বিদ্যা কি ছোটবেলা থেকেই জানতে নাকি এই বাসায় এসে ন‌ওশাদ আজমীর ব‌উ হয়ে শিখে নিয়েছো ? তোমাদের মতো কিছু মেয়ে আছে যাদের দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারে না কিন্তু এরা নিজেরাই আসলে গভীর পানির মাছ । তুমি একটা কথা মনে রেখো, যত খুশি ন‌ওশাদ আজমীর কোলে বসে দোল খাও আমার নিশালের মাথা খাওয়ার চেষ্টা করবে না ছয় টা বছর ওকে আমি লালন পালন করেছি । এত সহজে আমার ছেলেকে তোমার ছেলে হয়ে যেতে দিব না ! মামনি ডাকে বলেই ওর মা ভাবা শুরু করে দিয়েছো তুমি নিজেকে ! ভুলেও নিশালের মা ভেবো না নিজেকে বলে দিলাম।
হেরা খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে বীথির দিকে । বীথি হেরার অসহায় দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়িয়ে গেল ।
হেরার বুকের ভিতরে এত যন্ত্রণা হচ্ছে । কষ্টে চোখে পানি চলে এলো। সে উত্তর দিতে পারতো কিন্তু আসলেই কি উনাকে উত্তর দেয়ার অধিকার তার আছে আদো, সে এটাই ভাবছে।

নিশাল পাপার রুমে ঢুকে দেখে পাপা বিছানায় শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছো পাপা?
না বাবা শুয়ে আছি।
তোমার কি মন খারাপ ?
আমাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে বুঝি ?
হ্যাঁ ! তুমি মাম্মার কথা ভাবছো ।
কিভাবে বুঝলে ? ন‌ওশাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।
মাম্মাকে যখন তুমি মিস করো তুমি চুপচাপ হয়ে যাও। আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝে যাই পাপা।
ন‌ওশাদ ছেলের মাথায় হাত রাখলো ।
আমাকে তুমি ডেকেছো ?
তুমি কি নেপাল যেতে চাও বীথির সঙ্গে ?
তুমি বললে যাব !
আমি বলি কি নিশাল তুমি আর বীথি অস্ট্রেলিয়া থেকে ঘুরে আসো। নানুকেও দেখে আসলে ,নানু অসুস্থ । তোমার মাম্মা যাওয়ার পর তো তোমার যাওয়া হয়নি অস্ট্রেলিয়া কিছুদিন মামা আর নানুর সঙ্গে থেকে এলে। ওদের‌ও ভালো লাগবে তোমার ও ভালো লাগবে।
আইডিয়া খারাপ না পাপা। কিন্তু শোয়েব ভাইয়া তো বলল, আমি তুমি মামনি ইউএসএ তে ফুপির বাসায় যাচ্ছি ?
হ্যাঁ তুমি অস্ট্রেলিয়া থেকে ঘুরে আসো তারপর গেলাম কিংবা আমরা ঘুরে আসার পর তুমি গেলে অস্ট্রেলিয়া যেটা তোমার ইচ্ছে।
তাহলে আগে ফুপির ওখানে যাব তারপর নানুকে দেখতে যাব ।
বীথিকে জানিয়ে দাও তোমরা অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছো।
তুমি কি নেপালের কথা শুনে রাগ করেছো পাপা ?
রাগ করিনি , ভয় পাই ।
বাবা আমার তোমাকে দূরে যেকোন জায়গায় পাঠাতে ভয় করে । কলেজে নিরাপত্তার ভিতরে থাকো তাই চিন্তা কম হয় তখন কিন্তু অন্য যেখানেই আমার চোখের আড়ালে যাও আমার টেনশন হয়। তুমি ব্যথা পেলে, কষ্ট পেলে মনে হয় তোমার মাম্মা কষ্ট পাচ্ছে। আমি তোমাকে আর তোমার মাম্মা কে কষ্টে আছো দেখতে পারি না।
তুমি টেনশন করো না আমি কোন রিস্ক নেই না পাপা।
ঠিক আছে।
ঘুমাও তুমি আমি গেলাম।গুড নাইট।
গুড নাইট বাচ্চা।

হেরা বীথির কথা গুলো শুনে আর কিছু খেতে পারেনি। ওর এত কান্না পাচ্ছে সে খাবার প্লেট সরিয়ে রেখে দিলো। হাত ধুয়ে উঠে এলো ।
সিঁড়ির কাছে এলিনের পাশ দিয়ে আসার সময় ও হাত ধরে আটকালো ।
কি হয়েছে তোমার ?
কোথায় কিছু হয়নি তো?
বৌমনি এই কয় মাসে তোমাকে অনেকটা চিনে গেছি এটা বিশ্বাস করবে তো ।
হেরা মাটির দিকে তাকিয়ে আছে !
বলবে না আমাকে ?
এলিন বীথি আপুর আমাকে নিয়ে এত সমস্যা কিসের বলো তো ? উনি সহ্য ই করতে পারেন না আমাকে কেন জানি ! হেরা কেঁদে ফেলল।
কি হয়েছে বৌমনি !
হেরা কাঁদতে কাঁদতে বীথির কথা গুলো বলে ফেলল এলিনকে ।
তুমি এগুলো অবশ্যই ভাইয়াকে গিয়ে বলবে এখন !
না কোন দিনও না !
কেন ! উনার জানা উচিত ঐ মহিলা জেনে বুঝে তোমার সঙ্গে কতটা নির্দয় আচরণ করছে । তোমাকে ইচ্ছে করে বিপদে ফেলে চলে এলো শপিং মলে কত বড় দূর্ঘটনা হতে পারতো সেদিন , আজ কত খারাপ খারাপ কথা বলল কিসের জন্য এমন করছে সেটা জানা দরকার সবার ।
না এলিন যত কিছুই বলো উনি নিশালের আপনজন । নিশাল উনাকে খুব ভালোবাসে । অনেক দিন পর নিশাল আর ওর পাপা কাছাকাছি এসেছে আমার জন্য আবার দূরে সরে যাক এটা আমি চাই না।
তাই বলে তোমার বাচ্চাকে কালসাপ বলতে তো উনি পারেন না !
আমার তো বাচ্চাই নেই, আর হবে সে সম্ভাবনাও নেই তাই কেউ কিছু বললেই বা কি আসে যায় বলো। হেরা কথাটা বলেই চোখ মুছে ফেলল।
বাচ্চা হবে না কেন বৌমনি ?
হবে না নিশাল আছে তো আর কারো দরকার নেই আমাদের ।
তুমি কাউকে বলো না এসব কথা নিশাল শুনলে কষ্ট পাবে বীথি আপু যা বলেছে ।
ঠিক আছে যাও , কেঁদো না ফালতু মানুষ দের কথায় কষ্ট পেয়ো না । ভাইয়া তো তোমাকে অনেক ভালোবাসে সেটাই বড় কথা ।
একটা কথা বলব বৌমনি , বাচ্চার ব্যাপার টা কি ভাইয়া বলেছে নাকি তুমিই চাওনা তোমাদের কোন সন্তান হোক?
হেরা মুখে কিছু বলল না শুধু কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে র‌ইলো এলিনের চোখের দিকে।
হেরা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে রুমে ঢুকলো।
নিজের রুমে ঢুকে সে অবাক ! ঘর অন্ধকার ন‌ওশাদ ঘুমিয়ে গেছে! এমন কখনো হয়নি ওকে রেখে একা একাই ঘুমিয়ে গেছেন উনি। শরীর খারাপ করেছে ?
হেরা খুব সাবধানে এসে ন‌ওশাদের পাশে দাঁড়ালো।
ঘুমাচ্ছে দেখে আর কোন শব্দ করলো না।

নিজের শাড়ি পাল্টে ন‌ওশাদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
ভেবেছিল অন্যান্য রাতের মত ন‌ওশাদ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই , আজ বীথির দেয়া কষ্ট গুলো ভুলে যেতে পারবে সে‌। কিন্তু ন‌ওশাদ পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে।
সিলেট থেকে আসার পর ন‌ওশাদ ওকে বুকের সঙ্গে আটকে রাখে প্রতি টা রাতে। রাতে হেরার পানির তৃষ্ণা পেলে ন‌ওশাদের হাতের বাঁধন খুলে বের হতে হয় তাকে। প্রথম প্রথম হেরার একটু অস্বস্তি হতো সারারাত ন‌ওশাদের শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঘুমাতে। কিন্তু এখন এটা অভ্যাস হয়ে গেছে । ঘুমন্ত ন‌ওশাদের ভারী নিঃশ্বাস টা ওর ঘাড়ের ওপর যখন পরে ওর সমস্ত শরীরে আনন্দ খেলে যায়। ন‌ওশাদের বুকের পাঁজর উঠা নামা করে সে তার পুরো শরীরের ভেতর তা অনুভব করে। সারা রাতে কতবার যে সে শিহরিত হয় ন‌ওশাদের ছোঁয়ায়।
হেরা হাত বাড়িয়ে ন‌ওশাদকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। হেরা জানে এই মানুষটার সামান্য একটু স্পর্শ তাকে সব কষ্ট থেকে মুক্তি দিবে। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে ন‌ওশাদকে আপনি প্লিজ আমাকে একবার একটু জড়িয়ে নিন আজ আমার ভেতরে অনেক কষ্ট !এই কষ্ট গুলো নিয়ে আমি ঘুমাতে পারছি না।
ন‌ওশাদ জেগেই আছে আজ গীতির কথা এত বেশি মনে পড়ছে, এর মাঝে বীথির উল্টোপাল্টা কথা সব মিলিয়ে ন‌ওশাদের ভেতরে সেই পুরোনো হাহাকার। হেরা তাকে জড়িয়ে আছে প্রচন্ড আবেগ নিয়ে সে বুঝতে পারছে।
মনে মনে ন‌ওশাদ বলল, হেরা আমাকে সামান্য একটু সময় দাও আমি এই হাহাকার থেকে বের হ‌ই ।
মাথার কাছের জানালার পর্দা টা একটু ফাঁক হয়ে যাওয়ায় কাচের ভেতর দিয়ে চাঁদের আলোটা ওদের গায়ে এসে পড়ছে। হেরা তাকিয়ে দেখছে তার মনের মতোই বিষন্ন একটা জোছনা তাদের দুজনের গায়ে মেখে আছে। কোন কোন রাতের জোছনা বুকের ভেতরের হাহাকার কে আরো বেশি বাড়িয়ে দেয়। যেমনটা আজ ন‌ওশাদের ভেতরে।
দুজন মানুষ আজ দুইরকম কষ্ট বুকে নিয়ে জেগে আছে ।

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here