#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৩৬ পর্ব
নিশালের এবারের ছুটিটা অনেক দিনের। নওশাদ এরকম ভাবে ছেলেকে আগে কখনো পায়নি। তাই ছেলের সঙ্গে বেশি বেশি সময় সে কাটাতে চাইছে। একটা ব্যাপার সে খেয়াল করেছে কোন জানি এবার নিশাল বীথির খুব একটা কাছে যাচ্ছে না ! অন্য সব বার ছুটিতে এসে নিশাল বীথির সঙ্গে থাকতে পছন্দ করতো। শপিং ঘুরাঘুরি বাহিরে খেতে যাওয়া সব বীথির সঙ্গে করতো । এখন সে বীথির সঙ্গে কোন প্ল্যান করছে না ।
নওশাদ ওদের নিয়ে আমেরিকা যাবে সেজন্য অফিসে অনেক সময় দিতে হচ্ছে কাজ গুছিয়ে রাখতে হচ্ছে। ফ্যাক্টরি , অফিস এসব করে আজ কয়েকদিন খুব ব্যস্ত সে। হেরা আর নিশালের সঙ্গে কথাই হচ্ছে না ভালো করে। বিশেষ করে হেরার সঙ্গে। ও সকালে ক্লাসে চলে যায় নওশাদ বের হওয়ার আগেই । ব্রেকফাস্টের সময় নিশালের সঙ্গে তবুও কথা হয় কিন্তু হেরার সঙ্গে রাতে ফিরেও কথা বলতে পারছে না । অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে বাসায় ফিরতে ফিরতে তার । এত ক্লান্ত থাকে ডিনার করে রুমে ঢুকেই বিছানায় পড়েই ঘুম। কালকে হেরা একটু বিরক্ত হচ্ছিল বোঝা গেছে । বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন ওর চোখ ঘুমে ভারী হয়ে যাচ্ছে হেরা বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি তো দেখি বালিশ ঘুম মানুষ হয়ে গেছেন !
সেটা কেমন জিনিস হেরা ?
যে মানুষ বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে যায় তাদের বলে ।
সুখী মানুষের লক্ষণ এটা বুঝলে হেরা ! তোমার তো খুশি হওয়ার কথা তোমার স্বামী একজন সুখী মানুষ।
হেরা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, খুশি হতে পারছি না কারন আপনার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে না কয়দিন খেয়াল আছে !
সরি আমি খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি ! তোমাদের নিয়ে ঘুরতে যাব আমার কাজ তো ফেলে রাখা যাবে না ।
ঠিক তখনই নিশাল মামনি বলে ডাকতেই হেরা ওকে সরিয়ে দিয়ে চলে যেতে নিলো । নওশাদ যদিও দুষ্টুমি করে ওকে জাপটে ধরে রেখেছিল এক রকম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল হেরা।
এলিনরা দুই বোন আর নিশাল, হেরা দারুন হৈচৈ করে বেড়াচ্ছে। গল্প, আড্ডায় বাসা খুব জমজমাট। শপিং, ঘুরাঘুরি বাসায় ছুটাছুটি করছে । হেরাকে সেরকম কিছুর জন্যই নিশাল ডেকে নিয়ে গেছে। হেরা ফিরে আসার আগেই নওশাদ গভীর ঘুমে অচেতন। রাতে কখন এসেছে হেরা সে টেরও পায়নি। মাঝরাতে একবার টের পেয়েছে হেরা যখন ওকে জড়িয়ে ধরেছে ঘুমের ঘোরে।
নওশাদের ভালো লাগছে খুব চারজনের দৌড় ঝাঁপ দেখে । এই যেমন এই মুহূর্তে চারজন সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখতে গেছে। তারপর শপিং করে ফিরবে । হেরা ফোন দিয়েছিল রাতে ওরা বাহিরে ডিনার করবে সে ওদের সঙ্গে জয়েন করতে পারবে কিনা জানতে। একটা দাওয়াত আছে সে জন্য নওশাদ যেতে পারবে না । এখন ওরা চারজনই ডিনার করবে বাহিরে। এত হৈচৈ আর আনন্দের ভিতরে আছে বলেই হয়তো নিশাল বীথির কাছে যাচ্ছে না । বীথি রাগে ফুঁসছে হয়তো। নওশাদ মনে মনে হাসলো।
ছেলেটার আনন্দ দেখে নওশাদের খুব ভালো লাগছে। দুই বোন ও নিশালের বন্ধুর মত হয়ে গেছে। এদের জন্য আর হেরার জন্য ছেলে নিজের বন্ধুদের সঙ্গেও যাচ্ছে না খুব একটা। ভালোই হয়েছে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরছে শুনলে ওর বুকে অজানা আশংকা ভর করে। ইয়াবা, নারী ঘটিত কুকর্মে এই বয়সী ছেলেরা যেভাবে ইনভল্বব হচ্ছে তারচেয়ে ঘরের মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটাই ভালো। হেরা নিশালের দ্বায়িত্বশীল মায়েরও ভূমিকা পালন করছে দেখলো সেদিন।
নিশালের একটা বাজে অভ্যাস আছে পানি কম খায় এবং রাতে প্রায় সময়ই না খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। হেরা কোন এক সময় আনারের মায়ের কাছ থেকে পানি কম খাওয়ার ব্যাপার টা শুনেছে এখন দেখা যাচ্ছে একটু পর পর ছেলের সামনে পানির গ্লাস ধরছে । না খেতে চাইলে জোর করছে। সেদিন রাতে খাবে না ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশালকে ঝাড়িও দিলো । আবার কড়া গলায় বলল, নিশাল না খেলে সে নিজেও ডিনার করবে না। অগত্যা অনিচ্ছা স্বত্বেও নিশাল বাধ্য ছেলের মত ওদের পাশে বসে ডিনার করলো। নিশাল মাছ খায় না সেদিন হেরা ইলিশ মাছের কাটা বেছে প্লেটে তুলে দিলো নিশাল সেটা খেলো । হেরা বলল, ইলিশ মাছ না খাওয়া মানে বাঙালি হয়ে মাছ টাকে অপমান করা তাই এই মাছ তোমাকে খেতেই হবে, নিশাল আমি কাটা ফেলে দিচ্ছি তুমি খাও। দৃশ্যটা দেখে নওশাদের চোখে পানি চলে এলো। গীতি এরকম করতো নিশালের সঙ্গে ওর সঙ্গে।
নওশাদ তো এরকম একটা সংসারই চেয়েছিল। তার সংসার টা আবার আগের মত হচ্ছে এটাই তাকে বেশি আনন্দ দিচ্ছে।
সেদিন জুম্মার গোরস্থানে গিয়েছিল নিশালকে নিয়ে সাধারণত গীতির কাছে গেলে সেদিন সারাক্ষণ নিশাল খুব চুপচাপ থাকে। কিন্তু নওশাদ এবার খেয়াল করলো নিশাল স্বাভাবিক আছে । বাসায় সবার সঙ্গে গল্প, হাসাহাসি করছে।
হঠাৎ মোবাইলে রিং এর শব্দে নওশাদ তাকিয়ে দেখে নিশালের ফোন।
হ্যালো পাপা।
বলো বাবা।
পাপা মামনি যদি ইউএসএ গিয়ে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে তুমি কি রাগ করবে ?
ছেলের প্রশ্ন শুনে নওশাদের ভিমড়ি খাওয়ার মত অবস্থা ! বুঝলাম না বাবা কি বলতে চাইছো ? কোন টাইপের ওয়েস্টার্ন ড্রেস ?
এই যেমন ধরো জিন্স , টপস এসব !
তোমার মামনি কি পড়তে চাইছে ?
না ও পড়তে চাইছে না আমরা ওকে জোর করছি । মামনি বলছে তুমি রাগ করবে আর ওকে ভালোও নাকি লাগবে না। এখন তুমি আগে বলো তুমি রাগ করবে কিনা ? মামনি কে অনেক কিউট লাগবে তুমি দেখো পাপা।
যে পড়বে তার ইচ্ছা আমি রাগ করব কেন ? তোমার মামনি কি চায় সেটা খেয়াল করো ।
ঠিক আছে আমি ওকে বলছি তোমার কোন সমস্যা নেই।
নওশাদ মনে মনে হাসছে । নিশাল তোমরা কোথায় ?
পাপা আমরা বসুন্ধরা সিটিতে মুভি দেখলাম এখন মামনির জন্য শপিং করব । ও বেঁকে বসে আছে জিন্স কিনবে না তুমি রাগ করবে । আমি বারবার বলছি, পাপা ঐ টাইপের মানুষ না মাম্মাও তো দেশের বাহিরে গেলে পড়তো, না মামনি শুনছে না ।
ঠিক আছে মামনিকে বাঁকা থেকে সোজা করার দ্বায়িত্ব তোমার । মামনির জন্য জিন্স, টপস বাসায় চলে আসবে সমস্যা নেই আর তুমি যদি চাও নিজেরাই ঘুরে কিনবে তাহলে ওখানে আমাদের আউটলেটে নিয়ে যাও আমি ইনচার্জ কে বলে দিচ্ছি সে তোমাদের এটেন্ড করবে । আর একটা কথা মামনির ছবি পাঠাবে আমাকে দেখি ঘটনা কি দাঁড়ায়।
ঠিক আছে পাপা।
ফোন রেখে নওশাদ একা একাই হাসলো কিছুক্ষণ । তারপর শোয়েব কে ফোন দিয়ে বলল, বসুন্ধরা সিটিতে ওদের আউটলেট ইনচার্জ যেন নিশালদের এটেন্ড করে ।
হেরা কোন ভাবেই নিশাল আর এলিন, নাহিনদের বোঝাতে পারছে না যে সে কোন জিন্স পড়বে না। ওরা এক রকম জোর করেই ওকে নওশাদের কম্পানির ফ্যাশন আউটলেট ‘ হেরা’ তে নিয়ে এলো। বিশাল এক আউটলেট এখানে ছেলে, মেয়ে , বাচ্চাদের ফর্মাল, ক্যাজুয়াল , সব ধরনের তৈরি পোশাক পাওয়া যায় মেয়েদের শাড়ি ছাড়া। এই প্রথম হেরা র কোন আউটলেটে নিশাল আর হেরা এসেছে। আউটলেট ইনচার্জ ওদের এটেন্ড করার জন্য কর্মচারীদের নিয়ে দৌড় ঝাঁপ শুরু করে দিল।
তিনি খুব নার্ভাস হয়ে গেছেন দেখে নিশাল বলল, ভাইয়া প্লীজ আপনি অস্থির হবেন না আমরা অন্যান্য কাস্টমারদের মত দেখব যা পছন্দ হবে বলব, আপনি এরকম করলে সবার সামনে লজ্জায় পরে যাচ্ছি আমরা।
কি বলেন স্যার , আপনারা আর অন্য কাস্টমার কি এক !
ঠিক আছে ভাইয়া আপনি যেকোন একজনকে দিন তাহলেই হবে।
নিশালের অনুরোধের পরেও ইনচার্জ সহ পাঁচ জন হেরা, এলিন, নাহিনদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল।
সেলসগার্ল গুলো যখন হেরাকে নিয়ে ব্যস্ত হঠাৎ হেরার সেই বান্ধবী রিমার সঙ্গে দেখা ওর।
হেরা তুমি এখানে !
কেমন আছো রিমা ?
ভালো।
হেরা এলিন নাহিনদের পরিচয় করিয়ে দিল ওর বান্ধবীর সঙ্গে ।
তোমাকে যেখানেই দেখি অবাক হয়ে যাই সেদিন সিলেটে আজ এখানে ?
অবাক হচ্ছেন কেন , নাহিন প্রশ্ন করলো ?
আসলে ওর সঙ্গে আমার যখন পরিচয় হয় সেই হেরা আর এখন চোখের সামনে যে হেরা দুটোকে ভিন্ন মানুষ লাগে । বারবার চমকে যাচ্ছি! আপনারা কি তখনের হেরাকে দেখেছেন ,দেখলে আপনারাও অবাক হতেন!
হেরা রিমার হাত ধরে বলল, রিমা আকাশের সূর্য টা প্রতি সেকেন্ডে তার রং, তেজ, আলো, বদলায় মানুষ তারচেয়েও বেশি দ্রুত বদলায় । ধরে নাও আমিও তাই ।
তাই বলে এত বদল হেরা ! তুমি খুব সাধারণ একটা মেয়ে ছিলে, বোরকা, নেকাবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চুপচাপ একটা মেয়ে ! হ্যাঁ নেকাবটা খুললে তুমি সবার চেয়ে আলাদা ছিলে কারণ আমাদের ক্লাসে তোমার মত সুন্দরী আর কেউ ছিল না। তুমি ভালো স্টুডেন্ট ছিলে । সৌন্দর্য আর পড়াশোনা করা ছাড়া তোমার কোন বিশেষত্ব ছিল না। না মানে তুমি অন্য মেয়েদের মত ছিলে না !
আচ্ছা আপু বৌমনি কেমন ছিল গো, এলিন বলল? ওরা ঘুরে ঘুরে ড্রেস দেখছে আর কথা বলছে।
হেরা বুঝতে পারছে এলিন রিমাকে আজকে সাইজ দিবে ! রিমা বাঁকা কথা শুরু করেছে ও জানে না এলিন আর নাহিন হেরার মত না খোঁচা দিয়ে কথা বলা মানবে না।
আপনার বৌমনি কে অনালাইসিস করার মত সময়ই ছিল না আমাদের গ্রুপের । আমরা খুব মাস্তি করতাম । হৈচৈ করতাম।
আপনারা কি করতেন জানতে চাইনি তো । ও কি করতো সেটা বলেন ?
ও খুব চুপচাপ একটা কোনায় বসে থাকতো। খুব মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করতো । স্যাররা প্রশ্ন করলে উত্তর দিতো । কখনো ক্লাসের বাহিরে ওকে দেখা যেতো না কোথাও।
ও আচ্ছা এসব কিছুই অস্বাভাবিকতা বলছেন , নাহিন বলল।
আসলে আমরা খুব মজা করতাম ও এসব করতো না ।
হয়তো বৌমনি অন্য কিছুতে মজা খুজে পেতো ।সব মানুষের মজা পাওয়ার জায়গা কি এক ?
সবচেয়ে অবাক লাগছে ওকে এখনের হেরা হিসেবে দেখে । তুমি তিন মাসের মত ক্লাস করে ডুব দিলে তারপর অনেক দিন পর অন্যরকম ভাবে পেলাম তোমাকে ।
এটা ঠিক বলেছো রিমা ! মানুষের জীবনে বিয়ে অনেক বড় একটা পরিবর্তন আমিও যা বদলেছি সে জন্যই বদলেছি।
কি কেনাকাটা করলে হেরা ?
দেখছি কি কেনা যায় !
ফিসফিস করে রিমা বলল, এখানে সব কিছু মারাত্মক দাম !
আমারও তাই মনে হচ্ছে রিমা ! তুমি কি কিনতে এলে ?
আমার সামনে ম্যারেজ ডে ওর জন্য গিফট কিনতে এসেছি। এখানে জিনিস সুন্দর কিন্তু দাম বেশি ।
আচ্ছা হেরা একটা ব্যাপার সত্যি করে বলো তো , সেদিন সিলেটে তুমি বললে না তোমার হাজব্যান্ড এর রিসোর্ট এ আছো তুমি, এটা কি চাপাবাজি ছিল তাই না ? আমি তখনই বুঝতে পেরেছি ! একটা রিসোর্টের মালিক মানে কি বুঝো তুমি হেরা ?
রিমা সত্যি বলেছো আমি ওসব কিছুই বুঝি না !
নাহিন, এলিন খুব মজা পাচ্ছে মেয়েটার কথায়।
আমার বর কে বললাম ও বলল , হয়তো হাজব্যান্ড বোকা সোকা বউ পেয়েছে তাই চাপাবাজি করেছে তোমার বান্ধবীর সঙ্গে । হাসতে হাসতে রিমা গড়িয়ে পড়ছে। স্বামীরা কখনো কখনো বউদের ইমপ্রেস করতে কত কি বলে !
হেরা ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছে।
নাহিন হেরার কানে কানে বলল , শুনিয়ে দেই কয়টা কথা বৌমনি।
বাদ দাও।
ওদের কথার মাঝখানে সেলস গার্ল রা অনেক গুলো কুর্তি আর জিন্স নিয়ে এলো । হেরাকে আর নাহিন, এলিনদের দেখাচ্ছে খুব মনোযোগ দিয়ে। অন্য কাস্টমারদের থেকে ওদের প্রতি এত মনোযোগ দেখে রিমাও দাঁড়িয়ে দেখছে ব্যাপার টা।
একটুপর হেরা ট্রায়াল রুম থেকে বের হতেই নিশাল দৌড়ে এলো ওদের কাছে ছবি তুলল হেরার।
হেরা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।
খুব স্মার্ট লাগছে তোমাকে বৌমনি।
নিশাল তুমি কোথায় ছিলে ?
মামনি আমি পাপা আর আমার জন্য কিছু নেয়া যায় কিনা দেখছিলাম।
এলিন, নাহিন ই পছন্দ করলো হেরার ড্রেস হেরার কোন আপত্তি কানে তুলল না ওরা ।
রিমা হেরার কাছে এসে বলল, তোমার সঙ্গিরা তোমাকে বিপদে ফেলছে হেরা তুমি কি ড্রেস গুলোর দাম খেয়াল করেছো । এত গুলো নিচ্ছ যে ! ছেলেটা কে হয় ?
কথাটা শুনেই নাহিন ফট করে বলে উঠলো এক্সকিউজ মী আপু একটা কথা বলি, শোরুমটার নাম টা খেয়াল করেছেন ?
হ্যাঁ এইচ ই আর এ
মানে কি দাঁড়ায় , হেরা । কার নামে এই ব্রান্ড টা জানেন ?
কার আমি কিভাবে জানব ?
কথা বলতে হলে অনেক কিছু জানতে হয় , না জেনে কথা বলে একমাত্র মুর্খরা । আপনি তো শিক্ষিত মানুষ তাহলে জানবেন না ! আপনার বান্ধবী যাকে একসময় খুব সাধারণ দেখেছেন তার নামে এই ব্রান্ড । এই সব প্রোডাক্ট তার হাজব্যান্ড এর কম্পানির । আর একটা কথা আপনার হাজব্যান্ড কে বলবেন সবাই চাপাবাজ হয় না ঠিক আছে । ঐ রিসোর্ট আপনার বন্ধুরই আই মীন তার হাজব্যান্ডের ই । আপনার যদি কোন কিছু কিনতে ইচ্ছা করে ম্যানেজার কে বলে দিচ্ছে বৌমনির অনারে ডিসকাউন্ট দিয়ে দিবে আপনাকে।
রিমা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে !
হেরা নাহিনকে হাত ধরে আটকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ও এসব রিমাকে বলেই গেল।
সরি রিমা তুমি কিছু মনে করো না । ও একটু এমনই।
এসো তো বৌমনি বলে হেরাকে টেনে কাউন্টারে নিয়ে গেল নাহিন।
বিল মিটিয়ে ওরা বের হওয়ার সময় নিশাল বারবার প্রশ্ন করছিল কি হয়েছে তোমাদের ওখানে ?
কিছু না তোমার মামনি র বন্ধু ওকে দেখে খুব অবাক হয়েছে আমরা সেটা নিয়ে গল্প করছি।
ও ।
গাড়িতে বসে নিশাল বলল,
আমি পাপাকে মামনির ছবি পাঠিয়ে দিয়েছি ।
কি ? হেরা আঁতকে উঠলো !
কেন?
পাপা বলেছিল পাঠাতে । তোমাকে দেখতে চাইছিল।
ইস উনি কি বলল? হেরা জিব কাটলো লজ্জায়।
দেখো লাইক দিয়েছে ।
নাহিন বলল, আমি তো ভেবেছিলাম ভাইয়া একটা রেড লাভ পাঠাবে । বলেই দুই বোন হেসে দিলো।
হেরা চোখ পাকাচ্ছে নিশালের সামনে কি বলছো এসব তোমরা ।
এলিন ফিসফিস করে হেরার কানের কাছে এসে বলল, বাসায় ড্রেস গুলো পড়ে দেখাবে যখন তখন ভাইয়া কিস রিয়েকশন টা লাইভ দিবে তোমাকে ।
হেরা এলিনের মুখ চেপে ধরলো । চুপ বেশি কথা বলে।
দুই বোন হাসছে হি হি করে ।
রাতে ডিনার করে ওরা বাসায় ফিরে এসে দেখে নওশাদ আসেনি তখনও ।
হেরা চেন্জ করে রুম থেকে বের হয়ে দেখে , দুই বোন লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছে।
আচ্ছা তোমরা রিমাকে এত কথা না বললেও পারতে ও কি ভাবছে কে জানে ?
তুমি চুপ করো বৌমনি , যার যা ইচ্ছা তোমাকে বলে আর তুমি বাদ দাও বাদ দাও বলো! তুমি কি বলো তো ?
আমি এমনই ঝামেলা ভালো লাগে না আমার!
সে জন্যই তো ঐ বীথি তোমাকে যখন ইচ্ছা তখন যা খুশি বলে যায় !
চুপ ! নিশাল শুনবে হেরা আশেপাশে তাকালো !
শোন বৌমনি আমরা যা বলি শুনে দেখো একবার, দুই দিনের মধ্যে বীথিকে জন্মের সাইজ দিয়ে দিতে পারবে , এলিন বলল !
আমাকে তো ভূতে পেয়েছে তোমাদের দুই বোনের কথা শুনি ! হেরা উঠে শ্বশুরের রুমে ঢুকে গেল ।
নাহিন ওরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না বুঝলি , কিছু মানুষ দুনিয়াতে আসেই অন্য মানুষের কথা শোনার জন্য বৌমনি হলো এমনই মানুষ।
ঠিক কথা বলেছো !
হঠাৎ সিঁড়ি দিয়ে নওশাদকে আসতে দেখে এলিনের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল !
সে নওশাদ কে শুনিয়ে শুনিয়ে নাহিনকে বলা শুরু করলো,
বৌমনি বলেই এত কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করছে আমি হলে খেয়েই ফেলতাম ঐ বীথি আপা কে বুঝলি নাহিন !
ঠিক বলেছিস এত কষ্ট কিভাবে দিতে পারে বৌমনিকে নরম, অসহায় পেয়েছে তাই দিচ্ছে।
নওশাদ ওদের কথা গুলো সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে শুনলো। তারপর ওদের সামনে এসে দাড়ালো !
এলিন !
জ্বি ভাইয়া ।
কি হয়েছে ?
কোথায় ?
বীথি হেরার সঙ্গে কি করেছে ? নওশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
এলিন দুই সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, বৌমনি কে নিশালের বার্থডে পার্টিতে অনেক কথা শুনিয়েছে । বৌমনি খুব কেঁদেছে কিন্তু আপনাকে বলতে নিষেধ করেছে প্লিজ আমি টের পাইনি আপনি শুনছেন । সরি আপনাদের ফ্যামিলির ব্যাপারে কথা বলে ফেললাম কিছু মনে করবেন না ভাইয়া । বৌমনি অনেক নরম স্বভাবের তাই ওকে উনি কথা শোনায় সুযোগ পেলেই।
থ্যাংকস এলিন । তোমার বৌমনি কোথায় ?
নিশালের দাদার রুমে !
হুঁ । নওশাদ নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
এলিন আর নাহিন খুব এক্সাইটেড এবার বীথি রানী মজা টের পাবে বুঝলি নাহিন।
হি হি ।
চল রুমে বৌমনি আসার আগে এখান থেকে কেটে পড়ি , নাহিন বলল।
চল।
হেরা কিছুক্ষণ পর নিজের রুমে ঢুকে দেখে নওশাদ চলে এসেছে !
আপনি কখন এসেছেন ?
এই তো দশ মিনিট হবে । নওশাদ সোফায় বসে টিভির চ্যানেল চেন্জ করছে। হেরা এসে ওর পাশে বসলো ।
খুব টায়ার্ড আপনি , মাথায় হাত বুলিয়ে দেই ?
লাগবে না আই এম ফাইন !
আমরা আজ অনেক মজা করেছি । খুব টায়ার্ড লাগছে এখন। নিশাল তো এসেই ঘুমিয়ে গেছে ।
নওশাদ চুপ করে আছে ।
হেরা উঠে গিয়ে রুমের আলো গুলো কমিয়ে দিলো ।
হেরা !
জ্বি ।
এদিকে এসো । আমার সামনে দাড়াও ।
হেরা নওশাদের সামনে এসে দাড়ালো ।
তোমার আমাকে কেমন মানুষ মনে হয় ?
কি হয়েছে ? হেরা চিন্তিত মুখে তাকালো ।
উত্তর দাও।
আমি আগেই বলেছি আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ আপনি, হেরা খুব সুন্দর করে হাসলো নওশাদের দিকে তাকিয়ে।
সেদিন বললে আমি তোমার সবচেয়ে কমফোর্ট জোন তোমার বন্ধু তাই না ?
হুম। আপনি রাগ করেছেন ওসব জিন্স কেনাতে আমি জানতাম আগেই বারবার বলেছি ওদের এখন হলো তো !
নওশাদ ঝট করে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দিল হেরাকে তাকাও আমার দিকে !
হেরা বিস্ময় এবং ভয়ে নওশাদের দিকে তাকালো ! সে গত ছয় মাসে এমন শক্ত চোখ মুখ করে থাকতে দেখেনি নওশাদ কে ! ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না !
তোমাকে বীথি কি কি কথা শুনিয়েছে সব কথা একটা একটা করে আমাকে বলো এবং এই মুহূর্তে ।
হেরা চোখ নামিয়ে ফেলল।
বলো হেরা ! আমি মনে হয় তোমাকে বলেছিলাম তোমাকে কেউ কিছু বললে আমাকে বলতে ।
থাক না এসব কথা , হেরা বিড়বিড় করে বলল।
আমি শুনতে চাইছি হেরা ?
হেরা চুপ করে আছে।
বলো ।
হেরা বীথির বলা সব গুলো কথা বলল । ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে কথা গুলো বলার সময় । নওশাদ রাগে কাঁপছে ! হেরা এমন নওশাদকে আগে কখনো দেখেনি। ওর খুব ভয় লাগছে ।
নওশাদ হেরার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর আচমকাই হেরাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো । সরি হেরা সেদিন রাতে অনেক কষ্ট পেয়ে আমাকে তুমি আঁকড়ে ধরেছিলে হয়তো, আমি বুঝতে পারিনি । আমার মাঝেই মগ্ন হয়ে ছিলাম। সরি ।
হেরা কাঁদতে কাঁদতে বলল , আমার মনে হচ্ছিল আপনি আমাকে একটু আদর করে দিলেই আমি সব কষ্ট ভুলে যাব।
তাহলে আমাকে সব বললে না কেন ? নওশাদ হেরার কপালে চুমু খেলো।
আপনি কষ্ট পাবেন তাই বলিনি আর আপনাদের মাঝে ঝামেলা হোক আমি চাই না।
আমি বীথিকে কালকেই ডেকে আনছি এত বড় বড় কথা তোমাকে শোনানোর অধিকার ওকে কে দিয়েছে আমি জানতে চাইব ?
আপনার কাছে আমার অনুরোধ আপনি উনাকে কিছুই বলবেন না ।
আশ্চর্য হেরা তুমি বলছো এই কথা !
হুঁ নিশালের কথাটা চিন্তা করেন ও ওর খালাকে খুব ভালোবাসে !
তাই বলে বীথি তোমার সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করবে আর বলবে ?
উনি বললেই হলো নাকি, আমাকে যখন বলেছে কথা গুলো তখন কষ্ট পেয়েছি এখন আমার মাঝে কোন কষ্ট নেই । বিশ্বাস করুন।
তাই বলে ও তোমাকে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারে না হেরা।
আমার নানাভাই একটা কথা বলতো , কখনো কখনো আঘাত না করেও অনেক কঠিন জবাব দেয়া যায়।
আমি তোমার নানার মত সাম্যবাদী মানুষ না হেরা !
হেরা নওশাদকে বিছানায় বসালো দুই হাত দিয়ে নওশাদের মুখটা তুলে ধরে বলল, আমি দুই দিন উনার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছি তারপর নানা ভাইয়ের কথাটা মনে হলো তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি নিশালকে এতটা আদর আর ভালবাসা দিব যেন সত্যি সত্যি নিশাল আমাকে তার মায়ের জায়গাটা দিয়ে দেয় । এটাই হবে বীথি আপুর কথার জবাব।
কিন্তু আমার খুব কষ্ট লাগছে হেরা আমাদের যে বাচ্চা জন্মই নেয়নি তাকে কেউ এত টা বাজে গালি দিলো ! এই দুঃখ কোথায় রাখব তুমি বলো ?
হেরা নওশাদের চোখে চোখ রেখে বলল, সেরকম কেউ তো আসবে না আমাদের লাইফে , এত কষ্ট পাওয়ার কি আছে আমাদের !
মানে , বুঝলাম না ?
নিশাল ছাড়া আমাদের তো আর কোন সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই তাই না ? তাই খালি খালি মনে মধ্যে অশান্তি বোধ করে লাভ কি ?
আমাদের আর কোন সন্তান হবে না তোমাকে এই কথা কে বলল ? নওশাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হেরার দিকে !
হেরা চোখ নামিয়ে ফেলল , আপনিই না বললেন কিছুদিন আগে ।
কি বলেছি বাচ্চা লাগবে না আমার ?
বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকতে হবে না আমাকে পড়াশোনা করতে হবে মনোযোগ দিয়ে ।
সেটাতো পড়াশোনা করা পর্যন্ত তাই বলে তোমার আমার কোন প্ল্যান থাকবে না সেটাতো বলিনি হেরা ! তুমি ভাবলে কিভাবে আমি তোমাকে এত বড় অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখব ! নওশাদ ধাক্কা দিয়ে হেরাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো তারপর হেরার দিকে ঝুঁকে বলল, আমার তো ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে তোমাকে বুঝিয়ে দিতে আমি আসলে কি চাই !
কি চান আপনি ?
সময় হোক জানবে, নওশাদ হেরার ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেলো।
নওশাদ হেরাকে নিজের বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো , হেরা আমার সত্যি সত্যি খুব শখ ছিল আমার তিন চারটা বাচ্চা থাকবে । গীতির নিশাল হওয়ার আগেই কমপ্লিকেসি ধরা পড়লো নিশালই ওর আমার অনেক দোয়ার ফসল । নিশালের পর অনেক ঝামেলা বাড়লো ওর শরীরে আমিই ওকে বলতাম আর বাচ্চাকাচ্চা লাগবে না আমার। ও যেন মনে কষ্ট নিয়ে না থাকে তাই ।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে, আমার খুব ভালো লাগে বাচ্চাকাচ্চায় ভরা একটা বাড়ি। আমরা চার ভাই বোন ছিলাম, কাজিনরাও থাকতো খুব হৈচৈ করে জীবন পার হয়েছে । আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাকে অনেক সম্পদ দিয়েছে আমি চাই আমার সন্তানরা এসব কিছু খুব আনন্দ নিয়ে ভোগ করবে আমি দেখব।
নওশাদ হেরার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আমি যদি তোমার কাছে অন্তত দুইটা বেবি আশাকরি তুমি কি না করবে ?
হেরা মাথা নেড়ে না করলো লজ্জায় ওর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। না করবো কেন?
তুমি মনে কষ্ট নিয়ে বসে থেকো না শুধু পড়াশোনা টা শেষ করো আগে তারপর যা হওয়ার হবে ইনশাআল্লাহ। একটা মেয়ে পরিপূর্ণ নারী হয় তখনই ,যখন সে নিজের গর্ভ থেকে একটা সন্তানের জন্ম দেয়। আমি তোমাকে সেই পরিপূর্ণতা থেকে বঞ্চিত করে রাখার কেউ না । মেয়েদের সৃষ্টি কর্তা প্রচন্ড ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন তারা এই মানবসভ্যতা কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুরুষের ভূমিকা সেখানে সামান্য ।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
তুমি এত কষ্ট বুকে পুষে বসে ছিলে আমাকে বললে কি হতো ?
এখন আমার মনে কোন কষ্ট নেই , এই যে আপনি বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন । হেরা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো নওশাদকে।
হেরা আমি বীথির সঙ্গে এবার বোঝাপড়া টা করতে চাই তুমি বাঁধা দিও না।
প্লিজ আমার কথাটা শুনেন, যত কিছুই বলেন উনি নিশালের আপনজন আপনি বা আমি উনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে নিশাল কষ্ট পাবে। আর এটা তো সত্যি নিশালের মায়ের অনুপস্থিতিতে উনি নিশালকে মায়ের স্নেহ দিয়েছেন। অন্তত সেই জন্য উনাকে আমরা কিছু না বলি।
ঠিক আছে আমি কিছু বললাম না , কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও নেক্সট টাইম ও একটা কথা বললে তুমি ওকে দশটা জবাব দিয়ে দিবে।
ঠিক আছে দশটা না একটা কথার অন্তত একটা জবাবই দিয়ে দিব।
গুড। তুমি এত সহজ কেন হেরা ?
কারণ আপনি অনেক ভালো তাই ! হেরা নওশাদের বুকে নাক ঘষতে ঘষতে বলল।
তাই ?
হুম।
এখন সত্যি করে বলুন তো আপনি এই কথা গুলো কোথা থেকে শুনলেন?
সব জানতে হয় না !
হয় । ঐ দুই বোন বলেছে ?
কে আমি কারো নাম ম্যানশন করি নাই !
প্লিজ বলুন না।
উহু বলব না।
প্লিজ।
চুপ এক দম চুপ। এখন কোন কথা হবে না হেরা।
শুনি না।
তোমার মুখ কিভাবে বন্ধ করতে হয় দেখাচ্ছি দাড়াও।
প্লিজ প্লিজ প্লিজ হেরা দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে আছে।
( চলবে)