#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
কলেজ ছুটির পর ইনান তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে রেস্টুরেন্টে চলে গেল। তিনতলার সবচেয়ে বড় টেবিলটা আগেই বুক করে রাখা ছিল। কাঁচের দেয়ালের দিকটাতে ইনান বসেছিল। এইখান থেকে তাদের কলেজের ভিউটা খুব সুন্দর দেখা যায়। হাসিঠাট্টার এক পর্যায়ে ইনানের চোখ চলে যায় কলেজ গেটের কাছে। জেহফিল ছেলেটা কলেজ থেকে বের হচ্ছে। ইনান চোখ ছোট ছোট করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। জেহফিল খুব ধীরে ধীরে পা ফেলে হাঁটছে, যেন সে কদম গুণে হাঁটে। একটা হামাগুড়ি দেওয়া বাচ্চাও তাকে অতিক্রম করতে পারবে সহজে। মেইন রোডে এসে জেহফিল এক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। ইনান চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে জেহফিল কী করে সেটা দেখার জন্য। হুট করে, একদম হুট করে জেহফিল তিনতলার রেস্টুরেন্টটার কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ইনানের চোখে চোখ রাখল। এই হঠাৎ কান্ডে ভরকে গেল ইনান। জেহফিল কোনোদিকে না তাকিয়েই কীভাবে হুট করেই তার চোখে তাকাল? যেন সে জানত ইনান এইখানেই আছে!! বুক ধড়ফড় করে উঠে ইনানের। ইনানের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, যেন সে এইমাত্র চুরি করে ধরা খেয়েছে। চোখ সরিয়ে নিলো দ্রুত।
নিজেকে ধাতস্থ করে চোরা চোখে আবার তাকাল ইনান। জেহফিল তখন গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছিল। যেন এই মুহূর্তে কিছুই হয়নি! মুগ্ধ ইনানের পাশের চেয়ারে বসে ছিল। ইনানের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল জেহফিলের পানে। জেহফিল চোখের আড়াল হতেই সে ইনানকে বলল,
‘ছেলেটা ভারী অদ্ভুত!’
ইনানের ধ্যান ফিরে, ‘কিছু বলছিস?’
‘হুম, ঐ বোবা থুরি জেল না যেন কি নাম..’
‘জেহফিল?’
‘রাইট, এত বড় নাম মাথাতেই থাকে না।’
‘ওর কথা কী বলছিলি?’
‘বলছি ও অনেক অদ্ভুত।’
‘কেন মনে হলো?’ ইনানকে কিছুটা কৌতুহল দেখালো। মুগ্ধ কোকাকোলার বোতলে সিপ দেওয়া থামিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ভঙ্গিতে বলল,
‘ও না কেমন যেন জানিস! ওর পাশের বেঞ্চেই বসেছিলাম আমি, কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু ছেলে পাত্তাই দিল না! আজিব! প্রত্যেকটা ক্লাসে ও কী করেছে জানিস?’
কৌতুহলে চোখ বড় বড় হয়ে গেল ইনানের, ‘কী করেছে?’
‘যেই সাবজেক্টের ক্লাস হতো সব বইতেই খালি স্কেচ করতো। লেখাগুলার উপরেও। ও একটা বারও মাথা তুলে তাকায়নি, ইভেন প্রেজেন্টও দেয়নি। সারাক্ষণ বইয়ে স্কেচ করে গেছে নয়তো জানালা দিয়ে বাহিরে একধ্যানে তাকিয়ে ছিল। আর মুখে কী যেন বিড়বিড় করে বলত। তুই না দেখলে বুঝতেই পারতি না, ওকে কেমন যেন সাইকোপ্যাথের মতো লাগছিল ট্রাস্ট মি। তারপর শুন কী হয়েছে!’
ইনানের থেকে মুগ্ধকেই বেশি এক্সাইটেড লাগছিল। চোখ বড় করে মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ করে বলতে লাগল, ‘অ্যাকাউন্টিং ক্লাসে আমি বই আনিনি। তো ও যেহেতু পড়ায় মনোযোগ দেয়নাই তাই ভাবলাম ওর থেকেই নেই। ও তখন জানালার বাহিরে তাকিয়ে ছিল। কয়েকবার ডাকছি বাট সাড়া দেয়নাই, শেষবার পানির বোতল দিয়ে ওর হাতে একটু টাচ করছি অ্যাটেনশনের জন্য…’
মুগ্ধ ঢোক গিলল, এক ঢোকে সম্পূর্ণ কোকাকোলা সাবার করল।
‘কচুর মাথা, বল কী হয়েছে তখন?’ ইনান তাড়া দিল, তার তর সইছে না।
‘ওই জেহফিল আমার দিকে এমন ভাবে তাকাইছে মনে হয় যেন আমাকে খেয়ে ফেলবে, আর আমার বোতলটা খুব জোরে ধাক্কা মেরে হাত থেকে সরাইছে। ভাই!!! ওর চোখটা দেখলেই তুই বিশ্বাস করতি, কেমন যেন দেখাচ্ছিল, সিরিয়াসলি আই কান্ট এক্সপ্লেইন! আর কী বিড়বিড়াইতেছিলো, আই ফিল লাইক হি ওয়াজ কার্সিং মি আন্ডার হিজ ব্রেথ! আমার আত্মা যেন বাইর হইয়া যাইতেছিলো ঐ টাইমে, ওরে এতো ভয়ংকর লাগছে যে আই ওয়াজ গনা পি ইন মাই প্যান্ট!’
‘এইজন্যই তুই তখন সিট চেঞ্জ করছিলি?’
‘হুম, আমার তো মনে হইছে ওর পাশে থাকলে আমি ওখানেই মা’রা যাইতাম। হি ইজ লিটারেলি আ সাইকোপ্যাথ!’
ইনান ভাবনায় পড়ে গেল। যখন জেহফিলকে সে দেখেছিল কাছ থেকে তখন জেহফিলের শ্যামবরণ মুখের ঐ দৃষ্টি এতটাই মায়া মায়া লেগেছিল যে ইনান ভেবেছে এর থেকে নিষ্পাপ চেহারা আর কারো হয় না। সত্যিই! কী কোমল, স্নিগ্ধ ছিল ঐ চেহারাটা! একটু আগেও তো কেমন শান্ত দেখেছিল। আর এখন মুগ্ধর কথা শুনে তো সম্পূর্ণ বিপরীত মনে হচ্ছে। ইনানের তো বিশ্বাসই হতে চাইছে না যে আসলেই জেহফিলের এমন কোনো রুপ আছে!
.
.
রাতে ইনান ঘর সাজিয়ে অপেক্ষা করছিল বাবার জন্য। সবকিছুই সাজানো শেষ শুধু কেক ছাড়া। বারোটা বাজতে পঁচিশ মিনিট বাকি। এখনো তার বাবা আসেনি। ইনান ছোটোবেলার মতোই বার্বি ড্রেস পরে আছে। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার মন থেকে জন্মদিন নামক দিনটা ধীরে ধীরে মুছেই যেত। এখন আর তার ভালো লাগে না জন্মদিন পালন করতে, বার্বি গাউন পরতে…একটু একা থাকা.. অন্ধকার রুমে। যতটাদিন মা বেঁচে ছিল তত দিন পর্যন্তই জন্মদিনটাকে জীবন্ত লেগেছিল। গত তিনবছর আগেও জন্মদিনে বার্বির মতো সাজাটা উপভোগ করত..কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর কেমন পানসে লাগে সবকিছু। একমাত্র বাবার মন রক্ষার্থে ছোটবেলার মতো সাজা হয়! দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইনান। টেবিলের উপর রাখা মায়ের ছবি। অপলক চেয়ে রইল মায়ের দিকে। যদি কখনো বিশ্বসুন্দরীর খেতাব ইনানকে ঘোষণা করতে দেয়া হয়, সে নিঃসন্দেহে এই খেতাবটা তার মাকে দেবে।
কলিংবেলের শব্দ ইনানকে ভাবনা থেকে ছুটিয়ে আনে। ফোলানো পিংক গাউনটা দুই হাতে উঁচু করে ধরে দরজা খুলতে যায়। বাবার সাথে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে, ফুলের ব্যুকে হাতে নিয়ে। ইনানের জন্মদিনে এই প্রথম নতুন অতিথির আগমন ঘটল।
ইন করা সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা পুরুষালী দেহটার দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ইনান। পলক ডেইজি ফুলের ব্যুকে হাতে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল ইনানের দিকে। এই মেয়েটার এত রূপ পলককে প্রতিবার বাধ্য করে ইনানের প্রেমে হাবুডুবু খেতে।
‘হ্যাপি বার্থডে ইনান।’ নিষ্পলক চেয়ে ব্যুকেটা ইনানের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
ইনান পলকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
ইফাজ মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘হ্যাপি বার্থডে বার্বি ডল। ইউ আর লুকিং সো প্রীটি!’
ইফাজ খানের চোখ টলমল করতে লাগল। তার ইনান এখনো সেই বাচ্চাটাই আছে। দশবছরে যেরকম লাগত উনিশ বছরেও সেই একই আছে। একটুও বদলায়নি তার আম্মুটা!
‘কেক এনেছো বাবা?’
সেই ছোটোবেলার মতো। “কেক এনেছো বাবা?” যেমনটা কথা শেখার পর থেকে প্রতি জন্মদিনে বলতো!
মিক্সড ফ্লেভারের কেক ইনানের হাতে দিলেন তিনি। ইনানের চোখ চকচক করে উঠল কেক দেখে। বাবা ছাড়া তার দ্বিতীয় দুর্বলতা হলো ডেজার্ট আইটেম। দুহাতে কেক আর ফুল নিয়ে হাঁটতে গিয়েই বিপত্তি বাঁধলো। সে ভুলেই গিয়েছিল তার পরনে যে লং গাউন। হুট করেই গাউনের সাথে পা বেঁধে পড়ে যেতে নিচ্ছিল ইনান। পলক তার পাশে থাকায় শক্ত হাতে ইনানের কোমড় জড়িয়ে ধরে দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচাল। ইফাজ ছুটে আসলেন মেয়ের দিকে।
অস্থির হয়ে বললেন, ‘ব্যথা পেয়েছ আম্মু? পায়ে বেশি লেগেছে?’
ইনানকে উঠে দাঁড় করায় পলক। ‘ঠিকাছি বাবা।’
‘এগুলো আমার হাতে দাও।’
কেক আর ফুল ইফাজ খান নিয়েই এগিয়ে চলল। ইফাজ খান যেতেই পলক ইনানের কানের কাছে এগিয়ে বলল,
‘সারাদিন তো দেখি খাই খাই করো। ওজন বাড়ে না কেন? এত শুকনা থাকলে কিন্তু পরে সমস্যা হবে।’
ইনান রাগী চোখে তাকাল, ‘কী সমস্যা হবে?’
পলক ঠোঁট চেপে হাসল, ‘তোমার সমস্যা হবে না, তোমার তাইনের সমস্যা হতে পারে।’
এহেন কথায় ইনান তার হিল দিয়ে খুব জোরে চেপে ধরল পলকের পা। ব্যথায় কঁকিয়ে না উঠে পলক বরং জোর করে হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে রইল। ইনানও পাল্টা হাসি দিল। ‘কেমন লাগছে পাখির পালক?’
পলক ফিসফিস করে বলল, ‘সেটা তো বিয়ের পরই বলতে পারব।’
ইনান মুখ কঠিন করে পা উঠিয়ে আরেকবার পা দিয়ে পাড়া দিল। এবার আর ব্যথা লুকিয়ে রাখতে পারল না পলক। চোখমুখ কুঁচকে ফেলল।
.
ইনানের জন্মদিন খুব সুন্দর ভাবেই সম্পন্ন হলো। পলক চলে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পর আবার কলিংবেল বেজে উঠল। ইফাজ তার রুমেই চলে গেছেন। ইনান তখন রান্নাঘর পরিষ্কার করছিল। রাত বাজে দেড়টা। এই টাইমে কে আসবে?? ভ্রু কুঁচকে গেল ইনানের। কী হোলে উঁকি দিয়ে দেখল কেউই নেই। কিন্তু নিচে কিছু একটা বক্স টাইপ দেখা যাচ্ছে। ইনান দরজা খুলে আশেপাশে দেখল। নাহ! কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বক্সটা খুব সুন্দর ভাবে ডেকোরেট করা। উপরে একটা কার্ড লেখা ছিল, ‘হ্যাপি বার্থডে, দিস ইজ আ লিটল গিফ্ট ফর ইউ।’
আড়াইফুট সাইজের গিফ্ট কিনা ছোট্ট!! গিফ্টটা কে পাঠিয়েছে তার কোনো অস্তিত্বই দেখা গেল না। ইনান দোনোমনা করে টেনেহিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে গেল। যেই দিক না কেন! ফ্রি গিফ্ট কে না চায়?
.
জন্মদিনের হাসি আনন্দে জেহফিল নামক অধ্যায়টা ধীরে ধীরে মুছে গেল ইনানের মস্তিষ্ক হতে। কিয়ৎক্ষণের জন্য…
.
.
চলবে…
গ্রুপে জয়েন হয়ে নিন সবাই, https://m.facebook.com/groups/1031660127365464/?ref=share&mibextid=NSMWBT