রোদরঞ্জন #পর্ব_১৮ #আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

0
424

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১৮
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

আজকে ক্লাসে প্রথম দিন ইনানের।‌ ইনান এতই এক্সাইটেড যে আজকে ইম্পর্টেন্ট ক্লাস থাকা সত্ত্বেও ভার্সিটি যায়নি। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে হালকা সাজিয়ে নিলো সে। অফ শোল্ডার ফ্লোরাল টপ আর স্কিনি ডেনিম প্যান্ট পরেছে সে। চুল আঁচড়ে পিঠে ছেড়ে দিলো, মোবাইল পকেটে পুরে রুম থেকে বেরিয়ে দেখল জেহফিল হাতে ঘড়ি ঠিক করে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

‘চলুন, লেটস গোওও।’ ইনান প্রায় লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।

জেহফিল ইনানকে দেখে‌ এক মুহুর্ত থমকায়। স্থির হয়ে ইনানকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে। শীতল গলায় বলে,

‘কী পরেছ এসব?’

ইনান নিজের দিকে তাকায়, নিজের ড্রেসিংএ কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে না পেয়ে বলল,

‘দেখেন না জামা পরেছি?’

জেহফিল ইনানের কাছে এসে ইনানের কাঁধ থেকে নেমে যাওয়া জামার হাতা টেনে উপরে গলায় উঠিয়ে দেয়। যার ফলে টপ উপরে উঠে পেট দৃশ্যমান হয়।

‘কী করছেন আপনি আবার?’ বিরক্ত গলায় শুধায় ইনান।

‘কী জামা পরেছো এটা? গলায় উঠালে পেট দেখা যাচ্ছে কেন?’

চোখ উল্টায় ইনান, ‘কারণ এটা গলায় উঠানোর জামা না। অফ শোল্ডার এটা।’

‘চেঞ্জ করে আসো।’ জেহফিলের থেকে আদেশ আসে।

‘কীহ!’ ইনান চোখ গোল গোল করে তাকায়, ‘আপনি জানেন কত সময় ওয়েস্ট করেছি এই জামা চুজ করতে?’

‘আই ডোন্ট কেয়ার। এক্ষুনি জামা চেঞ্জ করে ফুল স্লিভের জামা পরে আসবে। গলা যাতে না দেখা যায়‌।’ জেহফিল শক্ত গলায় বলল।

ইনান মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। গত দেড় ঘন্টা লাগিয়ে জামা প্যান্ট চুজ করে মেকাপ করেছে সে, আর জেহফিল কিনা…

‘যাচ্ছো না কেন?’ কিছুটা ধমকের সুরে বলল জেহফিল।

‘কী সমস্যা পরলে? রাস্তায় হাজারো মেয়ে পরে আমি পরলে কী প্রবলেম?’

‘এগুলো কেন, এর চেয়েও ছোটো ছোটো জামা তুমি পরতে পারো, তবে তা ঘরে, একমাত্র আমার সামনে। বাহিরে এগুলো পরে বের হওয়ার পারমিশন নেই তোমার।’

জেহফিলের কন্ঠে হুমকির আভাস পেল ইনান। গোমড়ামুখে রুমে যেতে নিলে জেহফিল আবার ডাক দেয়। ইনান পেছন ফিরে খেঁকিয়ে উঠে,

‘আবার কী?’

জেহফিল এগিয়ে আসে। ইনানের গাল একহাতে হঠাৎ চেপে ধরে। ব্যথা না পাওয়ার মতো করেই ধরে, তবে জেহফিলের কাষ্ঠ আঙুল ইনানের গালে বসতেই সে ব্যথাতুর আওয়াজ করে। জেহফিল ইনানের গালে চিমটি কাটে জোরে,

‘ঝাড়ি মেরে কথা বলবে না আমার সাথে।’

ইনান অসহায় চোখে তাকায়, ‘কী হয়েছে আপনার বলুন তো? মেজাজ এত তুঙ্গে কেন?’

জেহফিল ইনানের গাল ছেড়ে দেয়, তার কঠিন মুখ নরম হয়, ইনানের চিমটি কাটা গালে হাত বুলিয়ে আদর করে বলে,

‘তুমি এসব খোলামেলা ড্রেস পরলে মাথা ঠিক রাখতে পারি না, রাস্তাঘাটে কেউ তোমাকে এসব পোশাকে দেখলে আমার কতটা খারাপ লাগবে বুঝতে পারছো?’

ইনানের কিছু বলার থাকল না আর। হতাশ হয়ে বলল, ‘আচ্ছা যাচ্ছি।’

‘আর প্যান্টও চেঞ্জ করে আসবে।’

‘আবার প্যান্ট কী দোষ করেছে উফ!’

‘এত টাইট কেন প্যান্ট? সব বুঝা যাচ্ছে।’

বাধ্য হয়ে ইনানকে তার পছন্দের জামা কাপড় খুলে জেহফিলের পছন্দ করা ফুল নেক আর ফুল হাতার শার্ট আর ওয়াইড লেগ জিন্স পরল। আয়নায় নিজেকে দেখে ইনানের মাথা ঘুরে গেল। কেমন আন্টি আন্টি দেখাচ্ছে তাকে। জেহফিলকে কিছু বলবে তার আগেই জেহফিল এত ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকাল যে ইনান ভয়ে কিছু উচ্চারণ করতে পারল না।

গাড়িতে ইনান মুখ ভার করে বসে রইল। একটা কথাও বলল না জেহফিলের সাথে। জেহফিল যত কথাই বলে হু হা করে উত্তর দিয়ে দেয়। তার চোখের দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না পর্যন্ত।

জেহফিল চোয়াল শক্ত রেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে। ইনানের অবহেলা তার সহ্য হয় না একদম। কিন্তু ইনানের উপর রাগ ঝাড়তেও পারবে না যদি জেহফিলের অগ্নিমূর্তি দেখে ইনান ভয় পায়!

মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়ল সে। গলার স্বর যতটা নরম করা যায় ততটা করে বলল,

‘একটু এদিকে আসো তো সোনা।’

ইনান গাড়ি থেকে বের হতে নিচ্ছিল যেহেতু একাডেমিতে এসে গেছে। জেহফিলের কথা শুনে ইনান চেঁচিয়ে উঠতে নিতেই তখনকার হুমকির কথা মনে পড়ে। তাই নরমাল সুরে বলল,

‘কেন?’

‘আসোই না আগে।’

ইনান এগিয়ে গেল জেহফিলের নিকট।

‘এবার চশমাটা খোলো।’

‘কেন?’

“আগে খোলো।’

ইনান জেহফিলের চিকন ফ্রেমের চশমা খুলতে না খুলতেই জেহফিল ইনানের ঠোঁটে আচানক চুমু দিয়ে বসল। ইনান চকিতে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে জেহফিল না ছেড়ে ইনানের হাত ধরে আরো কাছে নিয়ে আসে সুবিধার জন্য‌। ছাড়ল অনেকক্ষণ পর। ইনান হাঁপাচ্ছে। তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে জেহফিল মৃদু স্বরে বলল,

‘চশমা খুললে চুমু খেতে সুবিধা হয়।’

এই বলে ইনানের নাকের ডগায় চুমু বসিয়ে দিলো আরেকটা। ইনানের একটু আগের রাগ বিলীন হয়ে লজ্জা ঘিরে ধরে, আরক্ত হয় গাল।

‘ছাড়ুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ লাজুক হেসে বলল ইনান।

‘আগে বলো আমার উপর রেগে আছো?’

ইনান দুপাশে মাথা নাড়াতে গিয়েও নাড়ায় না, উপর নিচ নাড়িয়ে হুম বলল।

‘তাহলে তো রাগ না ভাঙা অবধি আরো চুমু খেতে হয়।’ আবেশিত গলায় বলে জেহফিল ইনানের ঠোঁটের কাছে যায়। ইনান তাড়াতাড়ি মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘আমি রেগে নেই একদম, এবার ছাড়ুন।’

‘সত্যি রেগে নেই?’ ইনানের রাঙা গালের দিকে চেয়ে বলল জেহফিল।

‘না।’

‘তাহলে চুমু দিয়ে বুঝাও যে তুমি রেগে নেই।’

ইনান জেহফিলের বুকে ধাক্কা মেরে বলল,

‘সব দিক দিয়েই তো দেখি নিজের সুবিধা। অসভ্য লোক।’

এই বলে ইনান গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল জেহফিল ধরার আগেই।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে জেহফিল চোখের ইশারায় বলল,

‘বাসায় চলো, চুমুর শোধ সুদে আসলে তুলব।’

চোখ পাকায় ইনান। লোকটার লজ্জা শরম কিচ্ছু নেই।

.

ইনান তার ক্লাসে ঢুকে অবাক হয় অনেক। সে ভেবেছিল তার ক্লাসমেটরা হয়তো তার সমান অথবা কয়েক বছরের বড় ছোট। কিন্তু এখানে তো দেখি বিভিন্ন বয়সের মানুষ। প্রায় আন্টি আঙ্কেল বলা যাবে এই টাইপের মানুষ সব। ইনানের বয়সী কেউই নেই। ক্লাসের মধ্যে যাকে কমবয়সী লেগেছে সেই লোকটার বয়স কমপক্ষে আটাশ ঊনত্রিশ হবে। তারমানে এই ক্লাসে ইনানই সবার ছোটো। অস্বস্তি লাগলো প্রথমে।

রুমটা বিশাল। তবে কাজ শেখার লোক মাত্র বিশ-পচিঁশ জন। প্রায় অনেকগুলো মাঝারি সাইজের টেবিল সবার সামনে, আর সবগুলো টেবিলে একজনের জন্য বরাদ্দ। তাদের সামনে কাজ করার সরঞ্জাম। ইনান গিয়ে বসল একদম শেষ বেঞ্চে, জানালার পাশে। সাধারণত স্কুল কলেজে যেমন হাউকাউ থাকে এখানে তার ছিটেফোঁটাও নেই। যেমন শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে একাডেমি স্থাপিত, তেমনি শান্ত সব ভবন। গাছের ছায়ায় ঢেকে গাছে বাহিরের মাঠ।

ইনানের ক্লাসে দুইজন মেন্টর। একজন মহিলা, আর একজন পুরুষ। মহিলা যিনি তাকে ঠিক মহিলা বলা যায় না, তিনি আটাশ ঊনত্রিশ বছরের মেয়ে, আর একজন পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ।

ইনানের পাশের সারিতে আটাশ বছরের ছেলেটা। ইনান তাকে বলল,

‘আপনি কি নতুন?’

ছেলেটা মাথা নাড়ায়, ‘এটা আমার তৃতীয় ক্লাস।’

‘আচ্ছা।’

ইনান ক্লাস মনোযোগ দিয়েই করল‌। মেয়ে মেন্টর যখন ইনানের কাছে এসে ইনানকে দেখিয়ে দিচ্ছিল তখন ইনানের ওনাকে দেখে মনে হলো পরিচিত কেউ। তারপর মাথায় আসলো ইনি টয়ার বড় বোন তোয়া‌। টয়ার মোবাইলে ছবি দেখেছিল। এইজন্যই তো চেনা চেনা লাগছিল। তবে তোয়ার সাথে পরিচয় হওয়া গেল না ইনানের। তোয়া প্রচণ্ড ব্যস্ত, একজনকে রেখে আরেকজনের কাছে যাওয়া আসাতে ইনানও সুযোগ পেল না নিজেকে টয়ার বান্ধবী হিসেবে পরিচয় দেয়ার। তবে মনে প্রশান্তি খেলে গেল পরিচিত কেউ একজন তার ক্লাস নেয় বলে।

ইনান তখন পটারি হুইলে মাটি ঘুরানো শিখছিল আর তোয়া ইনানের পেছনে দাঁড়িয়ে ইনানের হাত ধরে ধরে মাটি বসানো শিখাচ্ছিল, সেই সময় ক্লাসে প্রবেশ করল জেহফিল। জেহফিলের দৈবাৎ আগমনে ক্লাসের প্রত্যেকের চোখ তার উপর গিয়ে পড়ে। ইনান আর তোয়াও জেহফিলের দিকে চায়। জেহফিল অশান্ত নজর শান্ত শেষ বেঞ্চে বসা ইনানকে দেখে, তবে অতর্কিতে চোখমুখ শক্ত হয়ে যায় ইনানের হাতের উপর আরো দুটো হাত, আর ইনানের শরীরের সাথে লেগে থাকা আরো একটি শরীর দেখে। তার চোখে ভর করে ক্রোধ, কপালের রগ ফুলে উঠে সহসা। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এগিয়ে যায় শেষ মাথায়। ইনানের হাতের উপর থেকে তোয়ার হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য জেহফিলের হাত বাড়ানোর আগেই তোয়া হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। জেহফিলের ক্রোধ কিছুটা কমলেও বুকে আগুনের স্ফুলিঙ্গের গর্জন একই মাত্রায়।

‘আরে স্যার আপনি? কোনো প্রয়োজন?’ তোয়া কণ্ঠ যথাসম্ভব সফ্ট করল।

ইনান বিস্মিত হলো অনেক। এতক্ষণ তোয়া ভ্রু কুঁচকে কড়া মেজাজে সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল আর এখন জেহফিলকে দেখে কী নরম মাখনের মতো গলে গলে কথা বলছে! সুন্দর ছেলে দেখলেই মিষ্টি কণ্ঠ চলে আসে?

জেহফিল তোয়ার কথায় পাত্তা দিলো না। ইনানের দিকে তাকিয়ে এনেয়েত তথা পুরুষ টিচারের উদ্দেশ্যে বলল,

‘আজকের বেসিক ক্লাসের দায়িত্ব আমার।’

তা শুনে যারপরনাই অবাক হলো তোয়া এবং এনায়েত। জেহফিল একজন হাই লেভেলের টিচার হয়ে প্রাইমারি লেভেলের ক্লাস নেবে – এটা আসলেই অবিশ্বাস্যকর কথা।

‘স্যার আপনার পারমিশন আছে?’ অবাক সুরে বলে তোয়া।

‘পারমিশন কি আপনি দিবেন এখন?’ জেহফিলের গম্ভীর গলা।

জেহফিলের জবাবে বিব্রত হয় তোয়া। ক্লাসের সবাইই ম্যাচিওর, এমনকি বয়সে বড় বড় অনেকেই আছে। তাদের সামনে জেহফিলের এমনভাবে কথা বলাটা ইনানের খারাপই লাগল। মানুষের সাথে এভাবে কথা বলে?

তবে তোয়া বিব্রত হলেও খুশিও হলো, সে এনায়েতকে বলল,

‘স্যার আপনি গিয়ে রেস্ট নিন। আমি আর জেহফিল স্যার সামলে নিবো।’

এনায়েত চলে গেলেন। জেহফিল ইনানের পাশে বসে ইনানকে হাতে কলমে ধরিয়ে শেখাতে লাগল, ইনান ফিসফিস করে বলল,

‘আপনার তো বেসিক ক্লাস নেয়ার প্রশ্নই আসে না। কী ব্যাপার বলুন তো?’ ইনান চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায়।

জেহফিল ইনানের কাঁধ জড়িয়ে ধরতে চায়, ইনান কনুই দিয়ে সরিয়ে দেয়, চোখে বলে পাবলিকে এসব জড়াজড়ি না করতে। জেহফিল মাটিতে শেইপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইনানের হাতের উপর হাত রাখে। জেহফিলের মুখশ্রী কেমন কঠিন।

‘মুখ অমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছেন কেন?’

‘তুমি কেন এত গাধী বলো তো?’ জেহফিল হঠাৎ বলে উঠল, তার চোখ কেমন রাগ রাগ।

ইনান বোকা বোকা চোখে চেয়ে বলে, ‘কী করলাম আমি আবার?’

‘আমি তোমাকে শিখাইনি কীভাবে মাটি বসাতে হয়? তাও কেন ঐ মেয়েটার তোমাকে শিখিয়ে দেয়া লাগল?’

‘উনি টিচার উনি শিখাবেন না? এখানে ভর্তি হয়েছিই তো শিখার জন্য, আজিব লোক!’

জেহফিল বিরক্ত হয়ে ইনানের হাত চেপে ধরল। এতে শেইপ দেওয়া কাঁচা মাটির পট ভেঙে যায়,

‘আরে কী করলেন এটা? ধূর, এত কষ্টে বানিয়েছি।’ ইনান মুখ দিয়ে বিরক্তিকর আওয়াজ বের করে।

জেহফিল ইনানের পেছনে এসে ইনানের দুইহাত ধরে আবার মাটির শেইপ দিতে থাকে।

‘বলেন না কেন এখানে কেন এসেছেন? ঐ সুন্দরী ম্যাডামের জন্য নাকি?’

ইনানের ইঙ্গিত চট করে বুঝে যায় জেহফিল। ইনানাকে চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘বাজে কথা বলে মেজাজ আরো খারাপ করাবে না।’

‘আপনার মেজাজ আগে থেকেই খারাপ নাকি?’

জেহফিল ইনানের দিকে আরো ঘেঁষে আসে, যার কারনে জেহফিলের বুক ইনানের পিঠে লেগে যায়‌। ইনান তাড়াতাড়ি আশেপাশে তাকিয়ে জেহফিলকে জোর করে সরালো,

‘কিচ্ছু বলব না আর, সরি।’

জেহফিল ইনানের পাশ থেকে এক পাও নড়ল না। অন্যান্যরা কে কী বানালো সেটা দেখার সময় নেই জেহফিলের, সে ইনানের পাশেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে লক্ষ্য করল তোয়া আসছে, আর আসার পথেই ইনানের পায়ের দিকে একবার তাকিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই চোখ পড়েছে, এর বেশি কিছু না। কিন্তু তোয়ার গুণে গুণে পাঁচ সেকেন্ডের জন্য তাকিয়ে থাকাটা জেহফিলের গায়ে লাগল। সে ইনানের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল ইনানের পায়ের জুতার ডিজাইনের ফাঁক গলে ইনানের ফর্সা পা, পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে। জেহফিল ভেবে নিল ইনানকে এখন থেকে শ্যু পরা ছাড়া বের হতে দিবে না।

তোয়া ইনানের সারিতে এসে জেহফিলকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে,

‘স্যার আপনার প্রজেক্টের কী খবর? রাশিয়ার প্রজেক্টটা কমপ্লিট? কবে যাচ্ছেন ব্লা ব্লা..’

জেহফিল কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠল। সে নিজের রাগ লুকালো না, চেহারাতেই প্রকাশ পেল। তোয়া তা লক্ষ্য করে স্তিমিত গলায় বলল,

‘সরি স্যার, বেশিই প্রশ্ন করে ফেলেছি।’

তারপর সে ইনানের আরেক পাশে দাঁড়াল। ইনানের কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘বাহ খুব সুন্দর হচ্ছে তো তোমার কাজ। জেহফিল স্যারের আন্ডারে থাকলে একদিনেই অনেক এগিয়ে যাবে যে কেউ। তুমি ভাগ্যবতী।’

শেষ কথাটা সে ফিসফিস করে বললেও ইনানের কানে গিয়েছে কথাটা। জেহফিলের ঘাড় কাত করে ইনানের কাঁধে রাখা হাতের দিকে চেয়েছিল। তার হাত নিশপিশ করছে। সামনের একজন লোক ডেকে উঠল তাদেরকে। জেহফিল সাড়া দিল না। অগত্যা তোয়াকেই যেতে হলো লোকটির কাছে।

ইনান বিড়বিড় করে বলল,

‘আসছে আমার জামাইরে লাইন মারতে, শয়তান, বুঝি না মনে হয় তার কথাবার্তা।’

‘জেলাস নাকি?’ জেহফিল ঝুঁকে আসল।

ইনান ভেংচি কেটে বলল, ‘জেলাস না হওয়ার কী আছে? আমার স্বামীর উপর কেউ নজর দিবে সেটা আমার সহ্য হবে?’

‘ক্ষমতা থাকলে কী করতে?’

ইনান মজা করে বলল, ‘মে’রে ফেলতাম মেবি?’

‘হুম!’ জেহফিল কিছু একটা ভাবতে লাগল।

.
ইনানের ক্লাস শেষ। জেহফিলের আরেকটা ক্লাস বাকি। ইনানকে আবারও কড়া করে বারণ করেছে এদিক সেদিক কোথাও না যেতে। জেহফিলের বেশিক্ষণ লাগবে না। ইনান ভদ্র মেয়ের মতো জেহফিলের কথা মানল। মানার কারণ হচ্ছে জেহফিল এক টেবিল খাবার ইনানের সামনে দিয়ে গেছে। ইনানের ক্ষিদেও পেয়েছিল প্রচুর, তাই চুপচাপ বসে খেতে থাকল।‌

একটু পর সন্ধ্যা নেমে যাবে। ইনান থাই গ্লাসের বাইরে নজর দিয়ে খাচ্ছিল, তখন চোখে পড়ল একটা মাটির বড় পদ্মফুল। যেটা এখন মাত্র বানানো হয়েছে, আর পদ্মফুলের পাতার স্মুদনেসের কাজ করছে একটা ছেলে। তার মুখের এক পাশ দেখা যাচ্ছে। এটাতো কালকের সেই ছেলেটা। ইনান চট করেই চিনে ফেলল ছেলেটার এক গালে গভীর করে টোল পড়া দেখে। এই টোল এত সহজে ভুলেনি সে। ইনান কখনোই টোল পড়া কোনো সুদর্শন এখনো পর্যন্ত দেখেনি টিভি ছাড়া‌। তাই ঐ ছেলেটার টোল সহজেই ভুলার না। আর একটা জিনিস ভুলবে না সেটা হচ্ছে ছেলেটার হাসি। এতটা প্রাণবন্ত…

বাহির থেকে হট্টগোলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ইনান ধ্যান ফিরিয়ে বাহিরে বের হলো। দেখল সব ভবনের মানুষের সব তলা থেকে নিচে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে নিচে তাকাতেই দেখল তোয়াকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার অবস্থা প্রায় মরণাপন্ন। কপাল রক্তে রঞ্জিত। পরনের জামাটাও রক্তাক্ত।

ইনান মুখে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। তোয়ার রক্তাক্ত অবস্থা সে দেখতে পারছে না। তোয়াকে ভয়ানক রকমের বীভৎস দেখাচ্ছি, মুখ হা করে হাঁপরের মতো নিঃশ্বাস নিচ্ছে, রক্তাক্ত হাত পা কাঁপছে। যেন হরর মুভি থেকে বেরিয়ে আসা ভূত।

ইনান পাশে থাকা অন্যান্য মানুষকে বলল কী হয়েছে। তারা বলল যে তোয়া ক্লাস করে আসছিল, যেইখান থেকে আসছিল ওখানের সিঁড়িটা সবার শেষ মাথায়, তাই মানুষও কম আর অন্ধকার। ভাগ্যক্রমে একজন স্টুডেন্ট ঐখান দিয়ে যেতে নিচ্ছিল আর দেখে তোয়া সিঁড়িতে রক্ত মাখা অবস্থায় পড়ে আছে। ধারণা করা হয় অন্ধকারে সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে গিয়েছেন।

ইনান রুমে চলে আসে ভার হৃদয়ে। এসব দৃশ্য সে সহ্য করতে পারে না। জেহফিলের অফিসে আসলে সে আওয়াজ পায় বাথরুমের ট্যাপে পানি পড়ার। জেহফিল এসেছে তার মানে। ইনান দেখল বাথরুমের দরজাটা খোলা আর জেহফিল বেসিনের সামনে। তোয়ার কথাটা বলার জন্য ইনান জেহফিলের কাছে যায়, তবে তার বলা মাঝ পথেই থেমে যায় যখন দেখল জেহফিল একাধারে হাত ধুচ্ছেই ধুচ্ছে। হ্যান্ডওয়াশ শেষ করে ফেলবে যেন হাত ধুতে ধুতে। জেহফিলের চোখমুখ ক্রোধান্বিত।

‘হাতে কী হয়েছে? এতবার ধোয়া লাগে?’

ইনানের উপস্থিতি পেয়ে জেহফিল ঝট করে তাকায়। জেহফিলের চোখ অসম্ভব রকমের লাল দেখে ইনান ভয় পেয়ে গেল হঠাৎ, জানে না কেন, তবে কেমন ভয়ঙ্কর লাগল ইনানের। তার পিঠ বেয়ে কেমন ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল আচমকা।

জেহফিল অদ্ভুত গলায় বলল, ‘নোংরা জিনিস ছুঁয়েছি তো, তাই হাত ভালোভাবে ধুতে হচ্ছে। তোমাকে তো আর নোংরা হাতে স্পর্শ করতে পারি না আমি বাটারফ্লাই।’ ‌

বলেই হাসল জেহফিল, যেই হাসি তার চোখ ছুঁতে পারেনি..

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here