রোদরঞ্জন #পর্ব_২০ #আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

0
408

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

বর্ষার শেষ সময় এখন। অথচ বাইরের আকাশ দেখলে মনে হয় বর্ষাকাল শুরু মাত্র। হাত বাড়িয়ে কয়েকটা কদম ফুল ছিঁড়ে নিলো ইনান। আর কয়দিন পর আর দেখা যাবে না এই ফুল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অন্যান্য দিন হলে ইনান রুমে গিয়ে ঘুম দিতো কিংবা বই নিয়ে বসে পড়তো। কিন্তু আজ ভাল্লাগছে না। সে অন্য চিন্তায় মশগুল। বিমর্ষ হয়ে ইনান বারান্দায় সারি বেঁধে রাখা ফুলগাছের পাশে বসল। তার মন বিক্ষিপ্ত, বিষণ্ন। কারণটা জেহফিল। দুইদিন আগেও যেই জেহফিলকে তার মনে হয়েছিল মন ভালো করার ঔষধ, আজ সেই জেহফিলই তার মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জেহফিল বদলে গেছে। অনেকটাই বদলে গেছে। জেহফিলের এই পরিবর্তিত রূপের সাথে ইনান পরিচিত না। প্রথম প্রথম ঠিক থাকলেও আজকাল জেহফিল কেমন ডমিনেটিং হয়ে যাচ্ছে। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এখানে যাওয়া যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না, গেলেও হাজারো কৈফিয়ত দেয়া লাগে। আমাকে ছাড়া কেন গিয়েছ, কোথায় গিয়েছ, কার সাথে গিয়েছ, এই জামা পড়া বাদ দাও, এই জুতা এখন থেকে পড়বে না, ঐ ছেলের দিকে কেন তাকিয়েছ, এটা খাওয়া যাবে না, আনহেলদি, এর সাথে কথা বলবে না…আরো কতো কী… ইনান প্রথমে এগুলোকে কেয়ার হিসেবে নিতো। তারও ভালো লাগতো জেহফিলের এই কেয়ার করা। কিন্তু এসব যত্ন অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে গেলে গলায় ফাঁসের মতো বিঁধে। অতিরিক্ত চিনিতে যেমন ডায়বেটিস হয় তেমন অতিরিক্ত ভালোবাসা ভালো না থাকার কারণ হয়, অন্তত ইনানের কাছে তেমনটাই লেগেছে। ইনানের মনে হয় এই বুঝি জেহফিল হঠাৎ করে এসে ইনানের গলা চেপে ধরে বলবে, “আমাকে না বলে শ্বাস কেন নিয়েছো?”

জেহফিল আর আগের মতো দুষ্টুমি করে না, আগের হাসিখুশি জেহফিল নেই। এখনকার জেহফিল হাসলেও ইনানের কাছে ভাণ মনে হয়। যেই হাসিতে চোখ হাসে না সেটা অবশ্যই মিথ্যে হাসি! জেহফিলের চোখের ভাষা ইনান বুঝে না, কখনোই বুঝতে পারেনি.. চেষ্টা করেছে অনেক, কিন্তু জেহফিল যেন কোনো খোলস দ্বারা নিজেকে ঢেকে রেখেছে।

কয়েকদিন আগে জেহফিলকে ইনান বলেছিল এই বাড়িটা বিক্রি করে শহরে বাড়ি নিতে। বলার কারণ হচ্ছে এই জায়গাটা পরিত্যক্ত এবং নির্জন। আশেপাশে সিঙ্গেল দোকানও নেই। ইনান এমন পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত না। তাই সে চেয়েছিল শহরে যেতে, ঐখান থেকে ভার্সিটি একাডেমি দুইটাই কাছে হবে। আশা যাওয়ারও সুবিধা আছে। কিন্তু জেহফিল ডিরেক্ট না করেছে‌। তার ব্যস্ত নগরীতে থাকতে ভালো লাগে না, কোলাহল, চেঁচামেচি, বিশেষ করে মানুষ – সে এড়িয়ে চলে এসব। ইনানের এক মুহুর্তের জন্য জেহফিলকে অসামাজিক মনে হয়েছিল, পরে ভেবেছে, জেহফিল তো ছোটো থেকেই একা, বাবা মা ছাড়া বড় হয়েছে, তাই একা থাকাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু একটা মানুষ কতক্ষন পারে এভাবে একাকীত্ব সহ্য করতে? জেহফিলকে বললেই বলে, আমি থাকতে তুমি একা কিসের? ইনান বুঝাতে পারে না জেহফিলকে নাকি জেহফিল নিজেই বুঝতে চায় না, তা ভেবে পায় না‌ সে।

গত রাতে জেহফিলের সম্পর্কে ইনানের ধারণা বদলে গেছে একটা ঘটনার মাধ্যমে। তারপর থেকেই ইনান উদ্বিগ্ন হয়ে আছে জেহফিলের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে, ভাবতে বসেছে জেহফিল আসলেই তার জন্য সঠিক ছিল কিনা…

ইনান গত রাতে রুমে বসে জেহফিলের চেঞ্জ হওয়া নিয়ে ভাবছিল। তখন হঠাৎ মনে পড়ল বাবাকে আজ সারাদিনে কল দেয়া হয়নি। ডায়ালে গিয়ে বাবাকে কল দিবে এমন সময়ে জেহফিল কোত্থেকে এসে ইনানের হাত চেপে ধরে, মোবাইল নিয়ে যায় ঝট করে, সন্দেহী চোখে বলল,

‘কাকে কল দিতে নিচ্ছিলে?’

ইনানের মুখ চুপসে যায়, আবার জেহফিলের কোন নাটক দেখবে!!

‘বাবাকে।’

‘কেন?’

ইনান অবাক হয়ে বলে, ‘কেন কী আবার? কথা বলব।‌’

‘কথা বলা লাগবে না, কী বলবে আর? কেমন আছো, কী করছো এসব ছাড়া!’

‘তো আমি আমার বাবার খোঁজ নেব না?’ বিস্মিত গলা ইনানের।

‘না।’

জেহফিলের জবাবে ইনান হতভম্ব। সে ফোন নিয়ে নিতে চাইল। তার আগেই বিরাট শব্দ হলো। হাত দিয়ে কান চেপে ধরল ইনান। চোখ খুলে দেখল ফ্লোরে তার ফোনের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। ইনানের চোখ চলে গেল অন্ধকারে থাকা জেহফিলের দিকে। চোখ যেতেই আঁতকে উঠল ইনান। জেহফিল ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অপ্রকৃতিস্থের মতন লাগছে দেখতে। চোখ দুটো রক্তিম। জেহফিল ইনানের কাছে এগিয়ে ইনানের দুই বাহু আঁকড়ে ধরল। ইনানের মনে হলো তার বাহুতে কেউ দুটো পাথর চাপা দিয়েছে এত ব্যথা! কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘জেহফিল!’

জেহফিল উন্মাদের মতো রাগে কাঁপছে। তার শরীরের কাঁপুনি ইনানকে ভয়ে কাঁপাচ্ছে।

‘তোমার বাবা ম’রে গেছে?’ জেহফিল গম্ভীর গলায় বলে।

ইনানের ভয় উবে গেল, তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘কীহ!’

জেহফিল কানে হাত দেয়, ‘চেঁচাবে না সোনা। আমার এসব ভালো লাগে না।’

ইনান জেহফিলের কথায় তোয়াক্কা করল না, ‘আপনি কী বলেছেন একটু আগে? এসবের মানে কী?’

জেহফিল স্থির চোখে তাকায়, ‘তোমার বাবা ম’রলে তোমার ফুফি নিশ্চয়ই ফোন দিয়ে খবর জানাত। যেহেতু তোমার বাবা ম’রেনি তার মানে ভালোই আছে। তাই এসব আদিখ্যেতার কোনো দরকার নেই..’

সাথে সাথে জেহফিলের গালে সপাটে চড় দিলো ইনান। এই জেহফিলকে সে চেনে না। জেহফিলের এই রূপের সাথে সে পরিচিত না।

‘আপনার মানসিকতা এতটা বাজে! ছিঃ জেহফিল! নিজের বাবা- মা থাকলে ঠিকই মর্ম বুঝতেন।’

জেহফিল ঘাড় কাত করে ইনানের দিকে রুদ্র মূর্তি ধারণ করে তাকাল। তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ইনানের তেজস্বী রূপ ফুস হয়ে গেল। ভীত সন্ত্রস্ত হলো সে।

জেহফিল এক পা করে এগোচ্ছে ইনানের নিকট। তারপর তার শক্ত হাত ইনানের নিকট আসতেই চোখ বন্ধ করে নিলো ইনান, জেহফিলের শক্ত হাতের চড় খাওয়ার জন্য নিজের নরম গাল রেডি রাখল। কয়েক পল পেরোনোর পর জেহফিলের হাতের ছোঁয়া ইনানের গালে নয় বরং ইনানের হাত ধরল আলতো ভাবে। চোখ খুলে ইনান দেখল জেহফিল ইনানের ডান হাতে আঙুল দিয়ে চাপছে। ইনান বুঝল না জেহফিলের কারবার। সে তো ভেবেছিল তার চড়ের বদলে জেহফিলও একটা দিয়ে দিবে। কিন্তু জেহফিল ইনানের হাত ধরে ক্লেশ নিয়ে বলল,

‘তোমার হাতটা এত তুলতুলে, আমার তো মনে হলো তুমি আমাকে থাপ্পর না, আদর করে দিয়েছো।’

এই বলে ইনানের হাতে চুমু দেয়া শুরু করল। ইনান হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। জেহফিলকে সে বুঝতে পারে না। কী করে না করে ইনানের কল্পনাতীত।

.

.

‘বাটারফ্লাই! সোনা, তুমি কোথায়?’

জেহফিলের আদুরে গলায় ইনানের হুশ ফিরে। গতকালের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে কখন জল গড়িয়ে পড়ছিল খেয়াল করেনি সে। ইনানের মোবাইল জেহফিলের জিম্মায়। বাবার খোঁজটাও নিতে না পেরে সারারাত ছটফটানিতে কেটেছে।

ইনান দেখল জেহফিল বারান্দায় এসেছে। তার পরনে অ্যাপ্রোন, হাতে খুন্তি। ইনান ঢোক গিলে, ইনান কোনো অসঙ্গত কথা বললে জেহফিল যদি খুন্তি দিয়ে মারে? জেহফিল দেখার আগেই দ্রুত চোখ মুছে নেয় সে।

জেহফিল ইনানকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে দ্রুত এসে কোলে তুলে নেয়।

‘বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আনার ইচ্ছে আছে নাকি?’

ইনান জবাব দিলো না। জেহফিল ইনানের হাত কদমগুচ্ছ দেখে ইনানের গালে হাত দিয়ে বলল,

‘তোমার কদমফুল খুব পছন্দের তাই না সোনা?’

ইনান এবারও নিশ্চুপ। জেহফিলের হাসি হাসি মুখ কঠিন হয়ে গেল,

‘একবার বলেছি না প্রশ্ন করলে সাথে সাথে উত্তর দিবে।’

জেহফিলের শক্ত কণ্ঠে ইনান নড়েচড়ে উঠে। তাই জেহফিল আবারও হেসে বলল,

‘এবার বলো আর কী কী ফুল পছন্দ তোমার?’

‘সব ফুলই পছন্দ।’ ধীরে ধীরে বলল ইনান।

‘যদি তোমার কাছে দুইটা অপশন থাকে, একটাতে আমি আরেকটাতে সব ফুল তাহলে তুমি কোনটা বেছে নেবে?’

জেহফিলের অযৌক্তিক এবং বাচ্চামি কথায় ইনান বিরক্তির শ্বাস ফেলে।

‘এটা কোনো প্রশ্ন হলো?’

‘আমি না ফুল?’

‘জেহফিল, কীসব বাচ্চামো..’

‘আমি. না. ফুল?’ থেমে থেমে বলল জেহফিল। তার ধূসর চোখদুটো কঠোর।

‘আপনি।’

সাথে সাথেই স্মিত হাসল জেহফিল। জেহফিলের এই মুখের এক্সপ্রেশন চোখের পলকের মতো বদলাতে দেখে ইনান হতবাক হয়, জেহফিলের কোনো মুভিতে কাস্ট করা উচিৎ, এত দ্রুত তো চোখের পলকও পড়ে না..

.

.

‘স্ট্যাচুর উইংস গুলো ঠিকঠাক লাগানো হয়নি। দেখেছিস?’

‘হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি, আর পাখার স্ট্রাকচার স্মুথ হয়নি।’

‘পাখার দায়িত্বে কে ছিল?’

‘তাজবীর।’

তাদের কথোপকথনের মাঝে ভারী পুরুষালী কণ্ঠ শোনা‌ গেল,

‘আমাকে নিয়ে কী কথা হচ্ছে?’

সবাই পেছনে ঘুরল। চাবি আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে লম্বা এক সুপুরুষ সটান হেঁটে তাদের সামনে আসলো, এক হাতে চশমা খুলে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘এখন চুপ কেন? দলবল নিয়ে কী বলা হচ্ছে আমার নামে?’

দলের একমাত্র মেয়েটি টিয়া বলল, ‘তুই না উইংসের দায়িত্বে ছিলি?’

‘কঠিন কাজের দায়িত্বে এই তাজবীর ছাড়া আর কে থাকবে?’ তাজবীর গর্বের হাসি হাসল।

‘এইজন্যই তো বাঁশটাও খাব আমরা।’ দলের আরেকটা ছেলে বলল।

আঙুলে চাবি ঘুরানো বন্ধ করে দিল তাজবীর। ছেলেটার সামনে এসে তার কলারে হাত দিয়ে ময়লা মোছার মতো করে হাত বুলাল।

‘নাম কী?’

‘আকাশ।’

‘আমাদের দলে নতুন নাকি?’

ছেলেটি উপর নিচ মাথা নাড়াল। তাজবীর পাশে থাকা টিয়াকে ইশারায় বলল,

‘এই মাল আমাদের গ্রুপে জয়েন করল কবে?’

‘আজ।’

তাজবীর ছেলেটির কলার ঠিক করে দিলো, ছেলেটির দিকে চেয়ে টিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ছোটভাইকে ম্যানারস শিখিয়ে দিস, বিশেষ করে তাজবীরের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তার উপর স্পেশাল ক্লাস নিবি। বোঝা গেল?’

টিয়া ঢোক গিলে ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলল। ছেলেটি তাজবীরের কথার পিঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরেকজন ছেলে আকাশকে টেনে কাঁধে দিয়ে বলল,

‘টেনশন নট বিগ ব্রো। নতুন তো, শিখে যাবে।’

এই বলে ছেলেটাকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলল।

তাজবীর চুল ব্যাকব্রাশ করে বলল,

‘এবার বল কী‌ নিয়ে এত আলাপ?’

মাহিন বলল,

‘পাখাগুলো ঠিকমতো বসেনি মনে হয়, বাঁকা হয়ে গেছে শুকানোর..’

তাজবীর হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিলো, অভিজ্ঞ চোখে মূর্তিটাকে পরখ করতে লাগল। সেই সময়েই আকাশ ছেলেটা বলে উঠল,

‘এটার সমাধান জেহফিল স্যার ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না মনে হ…আহ!’

ছেলেটি কপাল চেপে ধরল। টিয়া আকাশকে থামানোর পূর্বেই তাজবীর তার দিকে চাবির রিংটা ছুঁড়ে মেরেছে। মাহিন ফিসফিস করে বলল,

‘তুমি এত কথা বলতে গেলে কেন? বলেছি না চুপ থাকতে?’

আকাশ দ্বিধাগ্রস্ত চোখে চায়, সে বুঝলো না তার ভুল কোথায়। টিয়াও ফিসফিস করে বলল,

‘তাজবীরের সামনে জেহফিল স্যারের নাম কখনো বলবে না, জেহফিল স্যার তাজবীরের দুচোখের বিষ।’

আকাশ ঘটনার কিছুই বুঝল না। তাই অগত্যা চুপ করে রইল। কিন্তু তাজবীর চুপ রইল না। আকাশের কাছে এসে আকাশের কপালে প্রতিটা শব্দের শেষে আঙুল দিয়ে ঠোকা দিতে দিতে বলল,

‘আমার কোনো কাজ ঠিক বা বেঠিক হলে আমি দেখব, অন্য কাউকে ডেকে এনে আমার কাজের বিচার করার মতো চিন্তা আর কখনো তোর এই ছোট্ট মাথায় যাতে না আসে। গট ইট?’

মাহিন আকাশকে চিমটি কাটে হ্যাঁ বলার জন্য। তাই বাধ্য হয়ে তাজবীরের অগ্নিমূর্তির সামনে নত হতে হলো তাকে, বাধ্য বাচ্চার মতো হ্যাঁ বলল।

‘কী হচ্ছে এখানে?’

জেহফিলের ডাকে তাজবীর ছাড়া সবাই তটস্থ হয়ে গেল। তাজবীর পেছনে ফিরে দেখারও প্রয়োজনবোধ করল না। মাহিন পরিস্থিতি সামলাতে হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘কিছু না স্যার, আমরা স্কাল্পচার নিয়ে গবেষণা করছিলাম জাস্ট।’

‘গবেষণা করতে এত চিৎকার চেঁচামেচি করা লাগে?’ ধমকের সুরে বলল জেহফিল।

‘সরি স্যার।’

এর মধ্যে আকাশ যেন সুযোগ পেল, ফট করে বলে দিলো,

‘স্যার, উইংসে সমস্যা আছে, আপনি নিজ চোখে দেখেন, স্মুথনেসে প্রবলেম আর ঠিক মতো বসানো নেই।’

তাজবীর হুমকির চোখে তাকাল। বাকি সবাইও বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইল আকাশের দিকে।

জেহফিল স্কাল্পচারের দিকে এক পলক তাকায়, তারপর মাহিনের দিকে চেয়ে বলে,

‘আজ আমার সময় নেই বলে তোমাদের কাজ দেখতে পারলাম না, তাই বলে ছাড় দিচ্ছি না। কালকে এসে যাতে সব ঠিকঠাক দেখি।’

কারো বুঝতে বাকি রইল না জেহফিল কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। সবাই নিরবে মাথা নাড়ায়।

‘ওকে স্যার।’

জেহফিল চলে যাওয়ার সময় থেমে ঘাড় পেছনে ফিরিয়ে বলল,

‘পেস্ট ঠিক মতো মেশালে স্মুথনেস পাওয়া যাবে আর ভেতরের পাইপ আরো বাঁকা করতে হবে।’

এই বলে সে চলে গেল। তাজবীর সাথে সাথেই গর্জে এসে আকাশের মুখে ঘুষি মারে। আকাশের উপরে সবার রাগ উঠলেও এই মুহুর্তে কেউ ঝামেলা চাইছে না। মাহিন আকাশকে ধরে তাজবীরের দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে গেল। টিয়া সহ বাকিরা তাজবীরকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

মাহিন এসে বলল,

‘তাজবীর, তোর উচিত তাড়াতাড়ি উইংসগুলো ঠিক করা। কাজে লেগে পড়, নাহলে আবার জেহফিল স্যার…’

‘স্টপ ইওর ড্যাম মাউথ।’ তাজবীর দাঁত কটমট করে বলে, ‘আমার সামনে ঐ লোকটার নাম নিতে বারণ করেছি না?’

টিয়া এবার অধৈর্য হয়ে বলে, ‘প্রবলেমটা কী তাজবীর? জেহফিল স্যার তোর কী এমন ক্ষতি করেছে যে তুই ওনাকে দেখতে পারিস না? একদিন না হয় তোকে অপমান করেছিল, তবে অপমানেরও কারণটাও যাথযথ ছিল, তুই কাজ না পারলে স্যার নিশ্চয়ই তোকে মাথায় তুলে তুলে কাজ শেখাবে না? টিচাররা স্টুডেন্টদের বকে বকেই পড়া শেখায়।’

‘মাথার টিচার। অন্যান্য স্যারেরা তো ঠিকই ধরে ধরে কাজ শেখায়, যেখানে এই লোক ধমক ছাড়া কথা বলে না।’

‘জেহফিল স্যার এমনিতেও একটু গম্ভীর দেখিস না? উনি ধমকালেও ওনার কাজ অন্যান্য টিচারদের থেকে বেস্ট। আর ঐ লোক কী হ্যাঁ? স্যার হয় আমাদের।’

‘নিজের সমবয়সীকে স্যার কেন ডাকতে হবে?’

টিয়া চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল, ‘বাই এনি চান্স, তুই কি জেহফিল স্যারকে হিংসা করিস?’

তাজবীর ক্ষুব্ধ চোখে তাকায়, ‘আমি কেন জেলাস হবো?’

‘না মানে, তোর সমবয়সী স্যার, ওনার এই বয়সেই এত অ্যাচিভমেন্ট, যেখানে তুই মাত্র স্টুডেন্ট আর অর্জনের খাতাও শূন্য..’

‘টিয়া, নিজের ভাগ্যের উপর সন্তুষ্ট হ যে তুই মেয়ে, নাহলে আমার হাতের মার একটাও মাটিতে পড়তো না।’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল তাজবীর।

টিয়া চুপ করে গেল। তাজবীর মাটির বস্তা পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে উঠে চলে গেল।

‘তুই ওরে আবার রাগাতে গেলি ক্যান?’ মাহিন বলল।

টিয়া সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘এই ছেলেটা আসলে যে কী! ভালোর সময় এতো ভালো যেন মাদার তেরেসার মেল ভার্সন, আর খারাপের সময় এত খারাপ যেন ইবলিশ মানুষ রূপে এসেছে…’

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here