রোদরঞ্জন #পর্ব_২১ #আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

0
408

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২১
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

ভার্সিটির ক্লাস শেষে ইনান আর তার এক ক্লাসমেট পাশের ক্যাফেতে গিয়েছিল‌ ঠান্ডা কিছু কেনার জন্য। আকাশে মেঘ ধরলেও আবহাওয়া গরম। তার উপর ইনান জেহফিলের জোরাজুরিতে ফুল স্লিভ আর ফুল নেকের জামা পরেছে, পায়ে শু, গরমের থেকে বাঁচতে ঠান্ডা কিছু কেনার আশায় ক্যাফেতে গিয়েছে। গল্প করতে করতে বের হতেই ইনানের সামনে জেহফিল আচম্বিতে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ সামনে আসায় ইনান ভয় পেয়ে যায়।

‘ভুতের মতো এভাবে সামনে আসেন কেন?’ ইনান বুকে হাত দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল।

‘কাজ শেষ?’ জেহফিলের গম্ভীর গলা।

‘হুম।’

ইনানের ক্লাসমেটের হাত ইনানের এক হাতের মধ্যে ছিল। তার দুজনই হাত জড়াজড়ি করে ধরে ঘনিষ্ঠভাবে হাঁটছিল। মেয়েরা একসাথে হাঁটলে যা হয় আরকি! ইনান আর তার ফ্রেন্ড সামনে আর পেছনে জেহফিল।

আচানক পেছনের থেকে জোর ধাক্কায় ইনানের হাতের মধ্যে থাকা তার ফ্রেন্ডের হাত ছিটকে যায় আর সে পড়ে যায় রাস্তায়। ঘটনার আকস্মিকতায় ইনান প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠে, কেননা এখনি রাস্তার কাছ ঘেঁষে গাড়ি গিয়েছে। ভাগ্য ভালো গাড়িটা হঠাৎ মোড় নিয়েছে নয়তো ইনানের ফ্রেন্ডের দেহ থাকত এই পাশে আর কাটা মাথা থাকত রাস্তার অপরপাশে।

ইনান তড়িৎ গতিতে তার ফ্রেন্ডকে তুলে উঠায়, মেয়েটার ডান হাত রাস্তার সাথে ঘেঁষে ছিঁলে গেছে, কপালে চোট পেয়েছে। জেহফিল তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

‘সরি, পেছন থেকে মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে ব্যালেন্স‌ হারিয়ে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি।‌ ঠিক আছেন আপনি?’

ইনান জেহফিলকে বড়সড় ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল। দেখছে মেয়েটা আহত আর সে কিনা বলে- ঠিক আছেন আপনি? ইনান বোতল বের করে তার ফ্রেন্ডের ক্ষতস্থানে পানি ঢালতে লাগল। আর জেহফিলকে ইশারা করল গাড়ি নিয়ে আসতে। ইনানের মেজাজ চটে গেল জেহফিলের কোনো নড়চড় না দেখে। কেমন নিষ্পাপ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন আজই পৃথিবীতে এসেছে, কিচ্ছু জানে না।

‘জেহফিল!! গাড়ি নিয়ে আসুন। হারি আপ।’

এবার যেন ইনানের কথায় জেহফিলের টনক নড়ল। গাড়ি আনার বদলে গাড়ি থেকে এইড বক্স নিয়ে আসল। ইনান যেন পাগল হয়ে গেল রাগে। কিন্তু এখন প্রথম কাজ হলো মেয়েটাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া। তাই জেহফিলের হাত থেকে ছোঁ মেরে বক্স নিয়ে দোকানের বেঞ্চিতে বসিয়ে মেয়েটার হাত ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগল‌। যদিও দুর্ঘটনাটা গুরুতর না, তাও ইনানের বারবার মনে হতে লাগল ও’কে হসপিটালে নিয়ে যেতে।

তার কিছুক্ষণ বাদে জেহফিলের আরেক অমানবিক রূপের সাথে পরিচিত হলো ইনান। জেহফিল তাকে তাড়া দিচ্ছে গাড়িতে উঠতে, ইনান ভেবেছিল হসপিটালে নিয়ে যাবে, তাই ফ্রেন্ডকে নিয়ে দ্রুত উঠে পড়ে। জেহফিল সেই মুহুর্তে কিছু না বললেও বড় রাস্তায় উঠে ইনানের ফ্রেন্ডকে নেমে যেতে বলে, কারণ সে হসপিটালে না, একাডেমিতে যাবে। জেহফিলের এমন নির্দয় কাণ্ডে ইনানের লজ্জায় মাথা কাটা গেল। জেহফিলকে ইশারা ইঙ্গিতে বললো হসপিটালে নয়তো তার ফ্রেন্ডের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু জেহফিল যেন ইনানের ইশারা বুঝেইনি এমন ভাবে গাড়ি থামিয়ে মেয়েটার নামার অপেক্ষা করছে। মেয়েটার বিব্রতবোধ বুঝতে পেরে ইনান শেষমেশ না পেরে বলেই ফেলল,

‘সাত নং রোডে চলুন, ওর বাসা ওখানেই।’

ইনানকে আবার লজ্জার আর অস্বস্তির সাগরে ডুবিয়ে জেহফিল সরাসরি বলল,

‘দেরি হয়ে যাবে ওখানে গেলে। তোমার ফ্রেন্ডকে বলো এখান থেকে গাড়ি নিয়ে যেতে।’

ইনান অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে রইল। অসহায় চোখে মেয়েটার দিকে তাকাল। বান্ধবীর চোখে অপ্রত্যাশিত অপমানে ছোট হয়ে যাওয়ার ভার সইতে পারছে না ইনান। তার ফ্রেন্ডের চোখের তারায় অপমানের ছায়া ইনানের নজর এড়ালো না, হয়তো এই ধরনের নিষ্ঠুর আচরণের মুখোমুখি এই প্রথম। মেয়েটি‌ দ্রুত ইনানের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে সে শুধু দেখতে পেল ইনানের ফ্যাকাশে মুখের আওয়াজ ছাড়া সরি বলা।

মেয়েটি অন্য গাড়িতে করে চলে যাওয়ার পর ইনান চড়াও হলো জেহফিলের উপর।

‘এইসব কী ধরনের আচরণ জেহফিল?? একটা মেয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে তাও আবার আপনার জন্য, সেখানে দয়া দেখানো দূরের কথা, আপনি কিনা মাঝ রাস্তায় মেয়েটাকে বের করে দিলেন? এতটা অমানবিক আচরণ কেন আপনার? মন বলতে কি কিছু নেই?’

জেহফিল নিশ্চুপ। সে গাড়ি থেকে নেমে পিছনের সিটের দরজা খুলে দিলো। পানির বোতল নিয়ে মেয়েটা যেই সিটে বসে ছিল সেখানে ঢেলে দিলো। ইনান হতবাক হয়ে জেহফিলের কাণ্ডকারখানা দেখছে। জেহফিল টিস্যু নিয়ে ভালোভাবে সিট মুছল, যেন সিটে এক বস্তা কাঁদামাটি ছড়ানো ছিল। ইনান ভাবতে লাগল জেহফিলের ওসিডি আছে কিনা।

কাজ শেষে জেহফিল ইনানের পাশের দরজা খুলল। ইনানের মুখের কাছে মুখ এনে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকল। ইনান বুঝল না জেহফিলের এমন করার কারণ। ইনানকে অবাকের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছে দিয়ে জেহফিল বোতলের শেষ পানিটুকু সজোরে ইনানের মুখে ছুঁড়ে মারল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল ইনান‌। তার মুখ হা হয়ে আছে বিস্ময়ে।

‘জেহফিল!’

জেহফিল বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ইনানের ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা সরিয়ে দুই আঙ্গুলের মাঝে চেপে ধরল ঠোঁট। ইনান ব্যথায় শব্দ করে উঠল, তাও জেহফিল ছাড়ল না। চাপে ইনানের ঠোঁটের রক্ত সরে সাদা হয়ে গিয়েছে, দুই মিনিট পর জেহফিল ছেড়ে দেয়। ঠোঁটে রক্ত জমাট বেঁধে আগের চেয়েও টকটকে লাল হতেই জেহফিল ইনানের ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। ভালোবাসার ছোঁয়ার বদলে রাগান্বিত কামড়ে ইনানের ঠোঁটে দাগ বসে গেল। জেহফিল সরে এসে ইনানের লালচে দাগ পড়া অধরে তর্জনী দিয়ে ছুঁয়ে বলল,

‘তোমার ফ্রেন্ডের লাক আছে বলতে হয়, মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে। অ্যান্ড ইয়েস, আমার মন আছে বলেই তোমাকে ভালোবাসি বাটারফ্লাই। যদি কোনো ডাউট থাকে আমি প্রমাণ দিতে রাজি আছি।’

ঠোঁটের ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় জেহফিলের প্রথম লাইনের মিনিং বুঝতে পারল না ইনান। জেহফিল ইনানকে ছেড়ে সিটে এসে বসল।

.

আজকের ক্লাসে তোয়া এসেছে। মেয়েটা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সবাইকে কাজ শেখাচ্ছে। আজকে জেহফিল আসবে না, কারণ তার আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে এই সময়। ইনান ক্লাস শেষ হওয়ার বিশ মিনিট আগেই বেরিয়ে পড়ল। তার মন বিক্ষিপ্ত। তার ফ্রেন্ডের সাথে জেহফিলের কড়া আচরণ ভুলতে পারছে না। কলেজে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবে সে??

এদিক সেদিক হাঁটতে হাঁটতে ইনান তিন তলার লম্বা বেলকনিতে এসে পৌঁছল। কিছুক্ষণ পর পর তার বুক চিরে অজানা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকা ইনান খেয়াল করল না তার পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়ে তাকে সূক্ষ্ম চোখে পরখ করছে।

‘আবারও হারিয়ে গিয়েছেন?’

পেছনে কারো অকস্মাৎ আওয়াজে চমকে উঠে ইনান। পিছু ফিরে দেখে ঐদিনের টোলওয়ালা ছেলেটা স্নিগ্ধ হাসছে। ইনানের মন বিষণ্নতায় ডুবে থাকায় এই ছেলের স্নিগ্ধ হাসি ইনানের গভীরতা ছুঁলো না। বরং ইনান প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। তার চোখেমুখে ফুটে উঠল তা। চোখ ঘুরিয়ে ইনান রেলিংয়ে ফিরে তাকায়।

তাজবীর অফিস রুমের দিকে যাচ্ছিল কিছু কাজে। তখন তার চোখ পড়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক রূপসী কন্যার দিকে। তাজবীর নজর ফিরিয়ে হাঁটতে নিলে হঠাৎ মনে আসে মেয়েটিকে তার চেনা চেনা লাগছে। আরেক পলক তাকাতেই চিনে যায়। সেদিনের হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি। আজকেও আবার হারিয়ে গেছে কিনা জানতে তাজবীর তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। ভেবেছিল দাঁড়িয়ে থাকলে মেয়েটি তার উপস্থিতি টের পাবে। প্রায় ছয় মিনিট পরও যখন মেয়েটির হেলদোল দেখল না তাই নিজ থেকেই বলে উঠল,

‘আবারও হারিয়ে গিয়েছেন?’

মেয়েটি চমকানো দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকায়। ডাগর ডাগর চোখের ঔদাসীন্য চট করে ধরে নেয় তাজবীর। ঘন পল্লবে ঢাকা বিমর্ষ চোখজোড়া হঠাৎ করেই তাজবীরের অন্তঃকরণে ঝড় তোলে। মেয়েটার মন খারাপের কারণ জানার ঝড়। তাজবীর কিছু বলার আগেই লক্ষ্য করল মেয়েটার চোখে বিরক্তি ভাব। তাকে দেখেই কি বিরক্ত হয়েছে? তাকে দেখে মানুষ বিরক্তও হয়? বিশেষ করে মেয়ে মানুষ?? ভাবল তাজবীর।

কাশি দিয়ে আবারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। তার কাশি যে ইচ্ছে করেই দেয়া হয়েছে তা ঢের বুঝতে পারল ইনান। তাই বিরক্তির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। কপালে ভাঁজ ফেলে ‘চ’ কারান্ত বিরক্তির শব্দ তুলে ছেলেটার পানে চাইল। চোখ দুটোয় অদৃশ্য প্রশ্ন, “কী চাই?”

তাজবীর বুঝল ইনানের চোখের প্রশ্ন। তাই হালকা হেসে বলল,

‘আই থট আপনি আবার হারিয়ে গেছেন ঐদিনের মতো। নেভারমাইন্ড। আমার বোঝার ভুল।’

‘দ্যান লিভ নাউ।’ ইনান কঠোর সুরে বলল।

আবারও হাসল তাজবীর। হাসির সাথে তার ডান গালে সুন্দর গর্ত হয়ে হাসিটাকে দ্বিগুণ সুন্দর করে তুলছে।

‘নো নিড টু বি সো রুড। অপরিচিত মানুষের সাথে রুড বিহেভ করবেন না, তার মনে খারাপ ধারণা হতে পারে। বাই দ্য ওয়ে, আপনার কি কোনো কারণে মন খারাপ? এত রেগে আছেন? ঐদিন তো আপনাকে দেখে শান্তশিষ্ট ভেবেছিলাম।’

ইনানের মন খারাপের মাঝে তাজবীরের ভালো কথা গুলো আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল। ইনান বিচলিত মস্তিষ্কে আজগুবি ভাবনা টোকা দিলো। ভাবল ছেলেটা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ইনানের সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করছে, এই ভাবনা তার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিলো।

‘এই মিয়া, জ্ঞান দিতে বলছি? ভাগেন এখান থেকে, যতসব ফাতরা!’

তাজবীরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তার সামনে কেউ মন খারাপ করে থাকলে সে সবসময় তার মন ভালো করার চেষ্টা করে। হোক পরিচিত কিংবা অপরিচিত। আর এই মেয়েটা পনের বিশ মিনিটের জন্য পরিচিত তার কাছে। মেয়েটার মুখ দেখে তাজবীর আন্দাজ করে নিলো মেয়েটার ভারী মন খারাপ। সে শুধু বিনয়ী হওয়ার চেষ্টা করছিল, এ ছাড়া তো আর কিছুই না!! আজকাল দেখি মানুষের ভালোও করতে নেই।

তারা যেখানে কথা বলছিল সেটা একটা গলির মতো। সেই গলির মাথার সামনে দিয়ে কেউ একজনের দ্রুত পায়ে হাঁটার শব্দ হলো। লোকটা এক সেকেন্ডের মাথায় এই পাশ হতে ঐ পাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার দ্রুত চলার কারণে বোঝা গেল না লোকটি কে, তবে ইনানের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বলছে এক্ষুণি চলে যাওয়া লোকটা থামবে আর দুই পা পিছু হটে গলির দিকে তাকাবে। ইনানের ইন্দ্রিয়কে প্রমাণিত করে ঐ লোকটার হাঁটার আওয়াজ থেমে গেল। ইনান সতর্ক হয়ে উঠে। পিছু হাঁটার আওয়াজ শোনা যাওয়ার পূর্বেই ইনান এক ছুট লাগাল। চোখের পলকে সে সিঁড়ি মাথায় চলে গেল। ইনান দৌড়ঁ দিয়ে যখনই আড়াল হলো ঠিক তখনই, একদম ঠিক তখনই গলির মাথা থেকে জেহফিল দুই পা পিছু হটে গলিতে তাকায়। দেখতে পায় তাজবীর রেলিংয়ের পাশ ফিরে একা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার যে মনে হলো তার বাটারফ্লাইও এখানে ছিল!! সে তো ভুল হতে পারে না! বিশেষ করে বাটারফ্লাইয়ের ক্ষেত্রে! শকুনের ন্যায় তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে বেলকনিতে ভালোভাবে চোখ বুলায়, মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা তাজবীরকে ছাড়া তো আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না!

যখন কাউকেই দেখল না তখন তাজবীরকে ফেলে সে আবারও নিজের মতো সামনের দিকে পা বাড়ায়। গুণে গুণে আট পা আগানোর পর তার শার্ট চেপে ধরে পেছন থেকে কেউ একজন। ঝট করে পেছনে তাকাতেই দেখে ইনান এক হাত হাঁটুতে রেখে হাঁপাচ্ছে।

‘আপনি..আপনি কোথায় ছিলেন? সেই কতক্ষণ ধরে খুঁজছি।’ ইনান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। জেহফিল ইনানকে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলো,

‘কোথায় ছিলে তুমি?’ ভারী কণ্ঠে বলল জেহফিল।

শান্ত হয়ে আসলে ইনান জেহফিলকে নিয়ে হাঁটা শুরু করে, বলে,

‘আপনাকে খুঁজতে বেরিয়ে ছিলাম, ভবনটা পুরো গোলক ধাঁধার মতো, আমার কাছে তো সব ভবনই এক রকম লাগে। আমি সিরিয়াসলি ভেবেছি আমি হারিয়ে গেছি। থ্যাংক গড, আপনাকে পেলাম।’ ইনান ঠোঁটে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করল। সফলও হলো।

তারপর জেহফিলকে জড়িয়ে ধরল। জেহফিলকে একটু আদর আদর কথা বললে শান্ত হয়ে যাবে। জেহফিল ইনানের গাল ধরে নিজের কাছে নেয়,

‘সোনা, আর কখনও একা একা অফিস থেকে বের হবে না। তুমি জানো আমি কতটা টেনশনে থাকি তোমাকে না দেখলে? আর কক্ষণও যাবে না আমাকে না বলে, কেমন?’ জেহফিল ইনানের চুলে হাত বুলায়।

ইনান বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। সেই মুহুর্তেই তার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি খেলে গেল। জেহফিলের বাহু দুইহাতে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘দোষটা তো আপনারই।’

‘আমি কী করেছি?’

ইনান দুঃখ পাবার ভান করে বলে,

‘আজ যদি মোবাইলটা থাকত তাহলে তো আপনাকে কল করলেই পেয়ে যেতাম। আমার এত দৌঁড়াদৌঁড়ি করাও লাগতো না। যদি কোনো বিপদে পড়তাম কী হতো বলেন তো? এইখানের কোনো ছেলে যদি আমাকে অসহায় পেয়ে ক্ষতি করত?‌ মোবাইলটা থাকলে কিন্তু এসব হতো না।’

ইনান জেহফিলকে টেনশনে ফেলে আড়চোখে তার দিকে তাকায়। জেহফিল কোনোভাবে যদি তার চাল বুঝে যায় তাহলে সে শেষ!! তাই জেহফিলকে আরো টেনশনে ফেলতে ইনান মোবাইল না থাকলে আজ কি কি ক্ষতি হতে পারত সব বলতে লাগল।

‘ঠিকাছে সোনা, তোমাকে মোবাইল দিয়ে দিবো‌। তবে তোমাকেও কথা দিতে হবে তুমি আমাকে না বলে কোথাও যাবে না।’

ইনান ভেতরের উপচে পড়া খুশিকে খুব কষ্টে থামাল, বলল,

‘আচ্ছা প্রমিস।’

জেহফিলকে কোনো সন্দেহ না করতে দেখে ইনান মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এবার বাবার সাথে একটু কথা বলতে পারবে।

.

.

ভোরে কোনো কিছুর আওয়াজে ঘুম থেকে উঠে ইনান। আওয়াজটা বারান্দার দিক থেকে আসছিল। তখন আকাশ পাতাল এক করে বৃষ্টি হচ্ছিল। চারিদিক অন্ধাকারে ছেয়ে গেছে। ইনান ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় গিয়ে নিচে তাকানো মাত্রই তার ঘুম কর্পূরের মতো উড়ে গেল। নিচে ঝোপঝাড়ে ঢাকা অন্ধকার জলাশয়ের কাছে জেহফিল দাঁড়িয়ে। তার হাতে কতগুলো ফুলের গাছ। ইনান বারান্দায় তাকালো। ফুলের টব আছে কিন্তু একটাও গাছ নেই। ছয়টা টব ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে, মাটি চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে অত্যাধিক ক্রোধের সাথে গাছগুলো তুলে ফেলা হয়েছে।

জেহফিলের দুই হাতের মুঠোয় গাছগুলো প্রাণহীন অবস্থায় দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। ইনানের চোখ বড় বড় হয়ে গেল যখন দেখল জেহফিল একটা একটা করে ফুলগুলো হাতে পিষে মাটিতে ফেলছে। দৃশ্যটা দেখে ইনানের মাথায় ‘পশু’ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ মাথায় আসলো না।

ইনানের তখন চোখ গেল কয়েক টুকরো করা কদম গাছের দিকে। ফুল গাছগুলো পায়ে পিষে জেহফিল এগোলো কদম গাছের দিকে। জেহফিল একটা একটা করে কদম ফুল জুতোর তলায় গর্জন করে হিংস্রভাবে পিষে দিচ্ছে। যেন বহুদিনের ক্ষোভ মেটাচ্ছে। বৃষ্টিতে তার ঘাড় অবধি চুলগুলো কপালে, ঘাড়ে লেপ্টে আছে, শরীর চুপচুপে ভেজা। তার চৌকশ ধারালো মুখশ্রী অপ্রকৃতিস্থের মতো লাগছে। জেহফিলের কাজে আপনাআপনি ইনানের মুখ থেকে জোরে আওয়াজ বেরিয়ে আসল।

ইনানের আওয়াজ বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ থেকে জোরে ছিল কিনা ইনান জানে না, তবে ইনানের আওয়াজ শোনা মাত্র কদম ফুলের উপর থাকা জেহফিলের শক্ত ভারী পা থেমে যায়। ধীরে ধীরে ঘাড় কাত করে ইনানের দিকে চায়। জেহফিলের চেহারার দিকে তাকানো মাত্রই ভয়ের শীতল স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। ঠিক এই চাহনি.. ঠিক এই চাহনিতেই প্রথম দিন রাস্তা থেকে রেস্টুরেন্টে ইনানের দিকে তাকিয়ে ছিল জেহফিল‌। জেহফিল বাঁকা হাসে আর কী যেন বিড়বিড় করতে থাকে। ইনান কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে জেহফিলের হাসি দেখে। সে ভেবে পায় না এই মুহুর্তে জেহফিলকে কী বলবে, সুন্দর নাকি ভয়ঙ্কর!!‌

ইনানের দিকে তাকিয়ে থেকেই জেহফিল একের পর এক কদম ফুলে পা মাড়াতে থাকে। যেন ইনানকে দেখিয়ে দেখিয়ে ইনানের পছন্দের জিনিস নষ্ট করছে।‌ ইনানের মাথা ঘুরে উঠল। বৃষ্টিতে সেও ভিজে গেছে। ইনান জানে না, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা নাকি জেহফিলের নির্মম রূপ দেখার পর ইনানের মাথার ভেতরটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। আবছা হয়ে আসে চারিদিক। বৃষ্টিতে চোখ খুলে রাখাও দায় হয়ে পড়েছে। শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফ্লোরের সাথে ইনানের মাথায় আঘাত লাগবে এই সময়ে শক্ত এক হাত এসে ইনানের মাথা ধরে ফেলে। ইনানের ছোট্ট শরীরটাকে তার দানবের মতো বুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ইনান শুধু অস্পষ্ট কণ্ঠ শুনতে পায় সেই মানুষ রূপী দানবটার গর্জন,

‘আমার বাটারফ্লাই.. তুমি শুধু আমার..শুধু.. শুধুই আমার। তোমার প্রায়োরিটির লিস্টে টপে থাকা ব্যক্তি বা বস্তুটি শুধুই আমি, আমি এবং আমি। যদি কেউ এই আমাকে ক্রস করতে চায় তাহলে তার অবস্থাও হবে তোমার প্রিয় ফুলগুলোর মতো…মৃ’ত…’

.
.
চলবে..

[নাইস, নেক্সট বাদে দুই লাইনের মন্তব্য করলে কী হয়?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here