#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৩০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
ইনান দ্রুত ছিল। তার অবচেতন মন তাকে বিপদের সংকেত দিলো ঠিক, তবে দেরি হয়ে গেল। ইনান মুখটা উঠিয়ে নিতেই পলকের ঠোঁট ইনানের ঠোঁটের নিচে অর্থাৎ চিবুকে লাগে। অধরের নিচে। মিনি সেকেন্ড দেরি হলে অধরেই লেগে যেত।
ইনান তড়াক করে সরে পড়ে পলকের উপর থেকে। পলক ধীর পায়ে উঠতে নেয়। সে জানে সে ভুল করেছে, কিন্তু অনুতপ্ত নয় সে। তার মন কু গাইছিল, মনে হয়েছিল যেই আশা ছিল ইনানকে পাওয়ার সেই আশাটা কোনোভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, ইনানকে পাওয়া হবে না, কোনোদিন না… সেই ভয় থেকেই পলক খুব বড় দুঃসাহস করে ফেলেছে।
ইনানের রাগ তড়তড়িয়ে বেড়ে গেল। যাকে সে ভরসার স্থল ভেবেছিল এখন সে-ই তার দিকে কামনার্ত চোখে তাকাচ্ছে। পলকের থেকে সে এটা ইহজন্মেও আশা করেনি। স্তম্ভিত নয়নে পলকের দিকে চেয়েছিল সে, বুকে মণখানেকের মতো পাথরের চাপ। কাকে ভরসা করবে? যাকে ভরসা করতে চায় সে-ই তার কোনো কোনো ক্ষতি করতে চায়। কান্নায় এবং শোকে কণ্ঠরোধ হয়ে আসে ইনানের। পলককে কথা শোনানোর জন্য মুখ খুলতে গিয়ে অনুভব করে গলা ভারী, ব্যথা করছে অতিরিক্ত কান্নার ফলে। তবে তার রেগে উঠা মন ঠিকই পলককে তিরস্কার করল,
”আমাকে তাহলে শুধু শুধু বাঁচিয়েছিলেন কেন? শিকারের মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে এনেছেন নিজে গলাধঃকরণের জন্য? আপনি এতটা নীচ! শরৎ আর আপনার মধ্যে পার্থক্যটা বাকি থাকলো কোথায়?”
ইনান মুখে বলতে না পারলেও তার হাত নিশপিশ করে উঠল। ডান হাত উঠালো পলককে চড় দেয়ার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে ইনানের পাশ কেটে গেল ঠাণ্ডা বাতাস। চোখের পলকের চেয়েও দ্রুত ছিল সেই বাতাস। ইনান পলক ফেলতেই পলককে দেখতে পেল না। দেখল বিশালদেহী কারো পিঠ পলককে আড়াল করে রেখেছে। আরেকবার চোখের ফেলতেই মুষ্টাঘাতের আওয়াজ আসলো।
ইনান হতভম্ব চোখে চাঁদের আলোয় দেখল জেহফিলকে! ইনানের চোখ কপালে উঠে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তে জেহফিলকে দেখে। জেহফিল পলককে মাটিতে ফেলে তার উপর উঠে পলকের মুখে একের পর এক ঘুষি মেরেই চলেছে। ইনানের হতচকিত ভাব কেটে গেল দাঁত ভাঙার আওয়াজে। শরীর কেঁপে উঠল তার অজানা আশঙ্কায়….
ইনান জেহফিলের কাছে এগিয়ে গেল তাকে থামাতে। পলক পুলিশ মানুষ, তাকে দুয়েকবার মা’রলে ঠিকাছে, কিন্তু যদি ও’কে মে’রে ফেলে তাহলে কেস খাবে জেহফিল। জেহফিল যেভাবে আঘাত করছে তাতে মনে হচ্ছে দুই মিনিটের মাথায় পলক পটল তুলবে।
জেহফিলকে থামাতে পারল না ইনান। জেহফিলের চোখমুখ ভয়ঙ্কর ক্রোধান্বিত, ঘাড়ের রগ ফুলে উঠেছে, অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় লাগছে তাকে। তার চোখের ভাষা ইনান বুঝতে না পারলেও তার মন বলছে মৃ’ত্যু খেলা করছে জেহফিলের চোখে। এলোমেলো চুলে জেহফিলকে আরো ভয়ানক লাগছে। সাইকোর মতো। যেমনটা সে মুভিতে সিরিয়াল কি’লারদের দেখেছে।
পলকের মুখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে নিজেকে রক্ষার সুযোগ পেল না। তার আগেই অতর্কিত হামলার শিকার হতে হয় তাকে। কয়েক ঘা পরে পলক চোখে তারা দেখতে পায় যেন। চোখ বুজে আসে তার।
ইনান জেহফিলের হাত ধরে থামানোর চেষ্টা করল। জেহফিল এমনভাবে ইনানের দিকে চাইল যে ইনান ছিটকে দূরে সরে গেল। জেহফিল চোখ দিয়েই যেন ইনানকে ভস্ম করে দিবে।
জেহফিলের হাত ভরে গেছে পলকের মুখের র’ক্ত দিয়ে। আরো দুটো ঘুষি মেরে পলকের থেকে উঠে ইনানের দিকে এগিয়ে যায়। ইনান বারংবার ঢোক গিলছে। চাঁদের আলোয় সাদা শার্ট পরুয়া, উস্কখুস্ক চুল, ধূসর চোখে অদমনিত ক্রোধ ও রক্তে রঞ্জিত জেহফিলকে হিংস্র দানবের ন্যায় লাগছিল। ইনান পিছু হটল, পড়ে থাকা লতার সাথে পা বেঁধে মাটিতে পড়ে গেল। জেহফিল ঘাড় কাত করে ইনানের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল। ইনানের পিঠ গাছে ঠেকে যায়। জেহফিল ইনানের দিকে এক পলক তাকিয়ে আচমকা তার চুল চেপে টেনে উঠায়। মুখের সামনে নিয়ে আসে।
ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে ইনান। জেহফিলের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই জেহফিল আরো শক্ত করে ধরল। ইনান জেহফিলের হাত হালকাভাবে ধরল যাতে জেহফিল মনে না করে যে সে ছাড়ানোর জন্য হাত ধরেছে। জেহফিল তার রক্ত লাগা হাতে ইনানের ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায়, গাল চেপে ধরে রূঢ়ভাবে। ইনান চেষ্টা করছে চেহারা স্বাভাবিক রাখার, কিন্তু ব্যথা সইতে না পেরে তার চোখমুখ কুঁচকে গেল।
জেহফিল গম্ভীর গলায় শুধু ডাকল, ‘বাটারফ্লাই!’
তারপর ইনানকে আচম্বিতে কাঁধে তুলে নেয়। ইনান জেহফিলকে বাঁধা দিলো না। সে জানে জেহফিল তাকে ছাড়বে না।
জেহফিল ইনানকে কাঁধে তুলে পলকের চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিতে থাকে। জঙ্গলে পড়ে থাকা ভাঙা ডাল, লতাপাতায় অচেতন পলকের শার্ট ছিঁড়ে যায়, শরীর কেটে যায়।
বাসায় আসার পর পলককে গোডাউনে ফেলে ইনানকে নিয়ে যায় বাথরুমে। ঝর্ণার নিচে ইনানকে রেখে লুফায় সাবান নিয়ে ইনানের ঠোঁটে ঘষতে লাগে। সাবানের তেঁতো স্বাদ ইনানের মুখের ভেতর চলে যায়। ইনান যতবার কিছু বলার জন্য মুখ খুলে ততবার জেহফিল লুফা দিয়ে জোরে রগড়াতে থাকে ইনানের ঠোঁটে। কিছু বলার সুযোগ পায় না ইনান। শুধু চেয়ে থাকে জেহফিল হিম শীতল চোখে।
প্রায় আধঘন্টা পর ইনান নিস্তার পায় জেহফিল থেকে। ইনানকে টেনে রুমে নিয়ে আসে। ভেজা অবস্থায়ই ইনানকে খাটে ফেলে একহাতে ইনানের দুহাত মাথার উপর, আরেক হাতে তার কোমর চেপে ধরে ঠোঁট দখলে নিয়ে নেয় জেহফিল। যেন কতদিনের অভুক্ত সে, এমনভাবে ইনানের উপর আক্রমণ চালায়। যখন ইনানের দম বন্ধ হয়ে চোখ বড় হয়ে যায় তখন জেহফিল তাকে ছাড়ে, তবে তা এক সেকেন্ডের জন্য। ইনান শ্বাস নিতে না নিতেই জেহফিল আবার ইনানের ওষ্ঠাধর আয়ত্ব করে নেয়। এভাবে বারবার ইনানের দম ফুরিয়ে আসলে জেহফিল এক মুহুর্ত সময় দিয়ে আবার নিজের কাজ চালাতে থাকে। চলতে থাকে ততক্ষণ যতক্ষণ না ইনান দুর্বল হয়ে যায়।
ইনান ক্লান্ত হলে জেহফিল ঠোঁট ছাড়ে। ইনানের ঠোঁট ফুলে লাল হয়ে গেছে। জেহফিল সেদিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
‘ইউ হ্যাভ টু মিনিটস।’
এই বলে উঠে চলে যায় সে। ইনান আয়নায় গিয়ে দেখে তার ঠোঁট আর ঠোঁট নেই, যেন সে র’ক্ত মেখেছে। জেহফিল তাকে ওয়ার্ন করে গেছে, তাই ইনান সময় নষ্ট করল না। আগে গিয়ে জামা চেঞ্জ করল। চুল মোছার জন্য তোয়ালে হাতে নিতেই জেহফিল ঠাস করে দরজা খুলে ইনানের হাত ধরে নিয়ে যায়। ইনান চুল মোছার সময়ও পায় না।
জেহফিল ইনানকে নিয়ে গোডাউনে গেল। একটা হলুদ টিমটিমে বাল্ব ঝুলে আছে সিলিয়ে। তার নিচে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে আছে পলক, ইনানকে একটা চেয়ারে বসাল। পলকের পাশে একটা বড় ব্যাগ পড়ে আছে। জেহফিল সাথে করে আনা বোতলটার সবটুকু পানি পলকের মুখে ছুঁড়ে মারল।
কেশে উঠল পলক। তার প্রতিটা কাশের সাথে রক্ত বেরোচ্ছে। চোখ মেলতে পারল না। অস্ফুটে কিছু বলল বিড়বিড় করে।
জেহফিল ব্যাগ থেকে বড় একটা হকিস্টিক বের করল।
ইনানের বুঝতে বাকি রইল না জেহফিল কী করবে। পলকের উপর তার রাগ হলেও সে চায় না তার জন্য কারো জীবন যাক। সে পলককে চড় দিতে পারেনি, তবে জেহফিল যা করেছে তাতে তার শাস্তি হয়ে গেছে। ইনান চায় না পলককে নিয়ে আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে। সে চায় পলক তাদের জীবন থেকে চলে যাক, তবে জীবন্ত অবস্থায়। ইনান দৌঁড়ে যায় জেহফিলের কাছে।
মিনতি করে বলে, ‘জেহফিল, উনি ওনার শাস্তি পেয়ে গেছে জেহফিল, আর কিছু করিয়েন না প্লিজ।’
জেহফিল অনুভূতিহীন চোখে চায় ইনানের দিকে। ইনানকে আবারও চেয়ারে বসিয়ে থ্রেট দিলো,
‘চেয়ার থেকে উঠলে ঐ বাস্টার্ডের শাস্তি আরো দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। তোমার একটা ভুল পদক্ষেপ মানে ঐ জানোয়ারের মৃ’ত্যুর দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। অ্যাম আই আন্ডারস্টুড?’
ইনান ভয়ে ভয়ে মাথা উপর নিচ করল।
জেহফিল মাথা হেলিয়ে দুদিকে ঘাড়ের হাড় ফুটিয়ে বলল,
‘সে ইট।’
‘ব..বুঝেছি।’
‘অ্যান্ড ইয়েস, আরেকটাবার তুমি রিকুয়েস্ট করবে আমাকে থামার জন্য, তাহলে…’ জেহফিল রুঢ় চোখে তাকায় ইনানের দিকে, ‘ইউ নো দ্যাট রাইট?’
ইনান কম্পিত গলায় বলল, ‘হুম।’
‘দ্যাটস সো সুইট অফ ইউ।’ জেহফিল হাসল, কাষ্ঠ হাসি।
জেহফিল পলকের কাছে এসে হকিস্টিক নিয়ে পলকের পেটে জোরে বারি দিলো। পলক পেট চেপে উল্টে গেল প্রায়। ইনান চিৎকার করে উঠে। কিছু বলার সাহস পায় না সে। জেহফিল আরো কয়েকবার পলকের মুখে আর পেটে আঘাত করতে লাগল। রক্তে পলকের চেহারা চেনা যাচ্ছে না, চুল গুলোও র’ক্তে রঞ্জিত। র’ক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে পলকের চুল, মুখ থেকে। র’ক্ত দেখে ইনানের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
জেহফিল নির্দয়ের মতো মা’রতেই লাগল পলককে, ইনান না পেরে জেহফিলের কাছে উঠে আসলো। জেহফিল তা দেখে হিংস্র চোখে তাকায়,
‘আই ওয়ার্নড ইউ!’
‘আমার কথাটা শুনুন, প্লিজ।’ ইনান জেহফিলের গাল ধরার চেষ্টা করল, জেহফিল ইনানের হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে সেই হাত ইনানের পিঠের কাছে নিয়ে চেপে ধরে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? দরদ উথলে উঠছে এই জানো’য়ারের জন্য?’
এই বলে পলকের মুখ পিষে ধরে পা দিয়ে।
‘উনি পুলিশ। যদি ওনার কিছু হয় তাহলে আপনি বিপদে পড়বেন জেহফিল।’
জেহফিলের চোখ নরম হয়, ‘তার মানে তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করছিলে?’
ইনান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। জেহফিল স্মিত হেসে বলে,
‘তুমি আমাকে কেয়ার করো জেনে ভালো লাগলো। বাট আই প্রমিস, আমি এ’কে মা’রব না। শুধু একটু শাস্তি দিবো। প্লিজ সোনা, ট্রাস্ট মি, জাস্ট একটু।’
ইনান কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। জেহফিল নরম সুরে কথা বললেও ইনানের মনে হচ্ছে জেহফিল ভান ধরছে। জেহফিল ইনানকে গোডাউনের বাইরে নিয়ে এসে ইনানকে বাইরে দাঁড় করিয়ে হুট করে দরজা আটকে দেয়।
ইনান বারবার দরজায় কড়াঘাত করলেও জেহফিল খুলল না। সে এসে একটা জানালা খুলে দিলো শুধু। ইনানকে বলল জানালায় দাঁড়াতে।
তারপর মিষ্টি হেসে বলল, ‘সরি সোনা তোমাকে ঢুকতে দিচ্ছি না বলে। তুমি কাছ থেকে দেখলে ভয় পাবে, তাই দূর থেকেই দেখো।’
‘জেহফিল, প্লিজ, ওনাকে ছেড়ে দিন, উনাকে আর শাস্তি দিয়েন না।’
জেহফিলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বাটারফ্লাইয়ের চোখে অন্যের জন্য করুণা দেখতে পারবে না সে, তাও আবার একটা ছেলের জন্য যে তার বাটারফ্লাইকে ছুঁয়েছে।
জেহফিল পলকের পাশে বসল। ব্যাগ থেকে ধারালো ছু’রি বের করল সে। এটা তার স্কাল্পচারের, তার খুব প্রিয় একটা ছু’রি। ইনান এদিকে একাধারে চিৎকার করেই যাচ্ছে। জেহফিল তা কানে নিলো না। পলকের হাতের ছু’রি গেঁথে প্যাটার্ন আঁকতে লাগল। পলক গলা কাটা মুরগীর ন্যায় ছটফট করছে, অসহ্য যন্ত্রণায় তার মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে।
এই হাতে পলক তার বাটারফ্লাইকে ছুঁয়েছে। পলকের হাত ইনানের কোমর চেপে ধরেছিল। যেটায় একমাত্র জেহফিলের অধিকার সেই জিনিসে হাত দিয়েছে পলক। পলকের দুই হাতে খুব সুন্দর ফুল আঁকলো জেহফিল, পানি নিয়ে জায়গাটা মুছে দিতেই পলকের ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করল। জেহফিল ধ্যানের সহিত দেখল, রক্তগুলো বের হয়ে ফুলটাকে কী সুন্দর কালার করছে, তারপর ধীরে হাত বেয়ে ফুলের চারিদিক লাল রঙা হয়ে উঠছে, অ্যাস্থেটিক একটা দৃশ্য। জেহফিল পানি দিয়ে আবার হাতটা পরিষ্কার করল, আবারও একই প্যাটার্নে রক্ত বের হয়ে ফুলটাকে রঙিন করছে।
এবার সে পলকের শার্ট ছিঁড়ে পলকের বুকে ছু’রি দিয়ে লিখল, ‘BAS’TARD’। এই বুকে তার বাটারফ্লাইয়ের হাত লেগেছে, বাটারফ্লাই এখানে মাথা রেখেছে। জেহফিলের বুকে সূচালো তীরের মতো বিঁধল যখন সে দেখেছিল ইনানকে পলকের বুকে হাত রাখতে। তার মাথায় র’ক্ত চড়ে গেল। ছু’রিটা আরো গভীর করে গাঁথল সে। পলক জ্ঞান হারালো নিমিষেই।
ইনানের কান্নারত মুখের দিকে চাইল সে,
‘তুমি কাঁদছ কেন বাটারফ্লাই? এ’কে শাস্তি দিয়েছি বলে?’
ইনানের কান্না থামছে না। পলক তার প্রাপ্য শাস্তি জঙ্গলেই পেয়ে গেছে। জেহফিল এখন যা করছে তা পলকের প্রাপ্য নয়। এটা নৃশংসতা। ইনান ভাঙা জানালাটা জোরে জোরে ধাক্কাতে থাকে। কোনোমতে একটা কাঠ ভাঙতে পারলেই হলো।
জেহফিল ছু’রিটা ফেলে দেয়। এবার ব্যাগ থেকে বের করে বড় একটা সুই আর সুতা। ইনান তা দেখে আঁতকে উঠে। বুক ধুকপুক করে উঠে। আরো জোরে ভাঙা জানালা ধাক্কাতে থাকে।
জেহফিল সুইয়ে সুতা ঢুকিয়ে ইনানের দিকে চায়। হিসহিসিয়ে বলল,
‘এবার তোমার ঠোঁট স্পর্শ করার শাস্তিটাই খালি বাকি।’
ইনান দ্রুত বলে উঠল, ‘উনি আমার ঠোঁটে স্পর্শ করেনি জেহফিল, বিশ্বাস করুন..’
জেহফিলের চোখমুখ অন্যরকম হয়ে গেল, ‘তুমি ওর জন্য কেন এত উতলা হচ্ছো বাটারফ্লাই? তার মানে কি তুমি ও’কে বাঁচানোর জন্য আমার কেয়ার করার অভিনয় করেছো? তুমি আসলে আমার জন্য চিন্তা করোনি? অভিনয় করেছ যাতে আমি ও’কে শাস্তি না দেই?’
ইনান জোরে জোরে মাথা নাড়ায়। জেহফিল বলল,
‘তাহলে কেন ও’কে শাস্তি দিলে তোমার কষ্ট হয়? আমার কষ্টটা তোমার চোখে পড়েনি যখন দেখেছি তোমাকে এই অসভ্যটা কিস করেছিল?’
‘উনি আমাকে কিস করেনি, জেহফিল।’ ইনান কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
‘ইউ আর লায়িং।’ জেহফিল এই বলে পলকের ঠোঁট দুটো একত্রে চেপে ধরে। এই জঘন্য ঠোঁট আজকে সে সেলাই করবে। কাপড় বুননের মতো করে।
পলকের ঠোঁটে সুই ঢুকানো মাত্রই ইনান জানালা ভেঙে চলে এসে জেহফিলের হাত থেকে সুই সুতা টেনে দূরে ফেলে দিলো। জেহফিলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে,
‘আমি মিথ্যে বলছি না জেহফিল, যখন ওনার ইনটেনশন বুঝেছি তখনই আমি নিজেকে সরাতে চেয়েছি, যার কারণে উনি আমাকে কিস করতে পারেনি।’
ইনান জেহফিলের মুখ হাতের আঁজলায় নিলো, কোমল গলায় বলল, ‘জেহফিল, আপনি আপনার বাটারফ্লাইকে বিশ্বাস করুন। আমার জীবনের একমাত্র পুরুষ আপনি, আপনাকে ছাড়া কখনো কাউকেই আমি এলাউ করিনি। উনি যখন ঐ কাজটা করতে নিয়েছিল তখন আমার নিজেরই খুব রাগ উঠেছিল। আমার স্বামী ছাড়া আমাকে কেউ স্পর্শ করবে এটা ভাবতেই আমার গা ঘিনঘিন করছিল, তাই ওনাকে সেই সুযোগ দেইনি আমি।’
জেহফিল তার গালে থাকা ইনানের হাত ধরে, ‘তুমি সত্যিই বলছো তো বাটারফ্লাই?’
ইনান মাথা উপর নিচ করে।
‘আচ্ছা, তাহলে ও’র ঠোঁট একটুখানি কা’টি, যেহেতু তোমার চিবুক ছুঁয়েছে?’ খুব নিষ্পাপ গলায় আবদার করল জেহফিল।
‘তাহলে আপনি আমার চিবুকটাও কেটে ফেলেন যেহেতু ওনার ঠোঁটের স্পর্শ লেগেছে।’
জেহফিল ইনানকে ছু’রি দিয়ে আঘাত করবে ভাবতেই জেহফিলের বুকের ভেতরটা কামড়ে ধরে। সে কখনো তার বাটারফ্লাইকে রক্তাক্ত করতে পারবে না।
ইনান জেহফিলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পলককে শাস্তি দেয়া থেকে বাঁচালো। জেহফিল পলককে বস্তায় পেঁচিয়ে মুখের দিকটা খুলে দিলো শ্বাস নেয়ার জন্য।
‘টেনশন করো না বেবি, এই বে’জন্মা আগামী ছয় মাসে নড়াচড়া তো দূর, মুখ খুলতেই পারবে না।’
ইনানের মনে হলো না ছয় মাসে পলক স্বাভাবিক হবে, যেভাবে জেহফিল পলকের গলায় মুখে আঘাত করেছে আগামী এক বছরে সে ঠিক হবে কিনা সন্দেহ। সে মনে মনে জেহফিলের নিষ্ঠুর আঘাতের কারণে পলকের কাছে সরি বলে নিলো। তাই বলে এই না যে পলককে সে ক্ষমা করেছে।
ইনান ইতিউতি করছিল আজকের মধ্যেই যাতে পলককে হসপিটালের সামনে রেখে আসে। কিন্তু জেহফিল মানবে না। তার নাকি আরো একটা কাজ বাকি।
‘কী কাজ?’
জেহফিল হঠাৎ বলে উঠল,
‘তুমি আজ অনেক বড় দুঃসাহস দেখিয়েছ। আমাকে খাটের সাথে বেঁধে আমার থেকে পালানোর দুঃসাহস। তুমি ভেবেছ এতকিছুর পরও আমি ভুলে যাবো? ঘুম থেকে উঠার পর তোমাকে না পেয়ে নিজেকে কতটা পাগল পাগল লাগছিল জানো? তুমি আমার কাছে নেই ভেবেই তো আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, কষ্টও হয়েছিল। তারপর আরো একটা সাহস দেখিয়েছ একটা ছেলের সাথে একই গাড়িতে বসার। আবারও সাহস দেখিয়েছ আমাকে তালাবদ্ধ করে ঐ ছেলেটাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার। তুমি সাহসের কতগুলো ধাপ অতিক্রম করেছ আজ একদিনে! আ’ম সারপ্রাইজড। তোমার বুকের পাটা আছে বলতে হয়। থাকার কথা অবশ্য, তুমি জেহফিল এহসানের ওয়াইফ, দুঃসাহস তো তোমার থাকাই লাগবে। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রটা ভুল ছিল।’
ইনানের মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল যে আজকের দুঃসাহসটা দেখিয়েছে সে!! জেহফিলের হিংস্র রূপ দেখে ঢোক গিলল সে, কী করে ভুলে গেছে যে জেহফিল তাকে এত সহজে ছেড়ে দিবে?
‘কী…কী করবেন আপনি?’ ইনানের কণ্ঠ কেঁপে উঠল।
ব্যাগ থেকে ডার্ক রেড শেডের একটা লম্বা ফিতা বের করল। হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে ইনানের নিকট এগিয়ে আসতে আসতে বাঁকা হেসে বলল,
‘ইওর পানিশমেন্ট ইজ গনা বি হার্ড, লিটল কিটেন!’
.
.
চলবে…
(ভাবিয়েন না যে কাহিনী আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে)