ভাড়াটিয়া -৭
শাহিন সাহেবের মনখারাপ! মানুষের মনখারাপ হতে কারণ লাগে না! কারণ ছাড়াই এ একটা মাত্র রোগ মানুষের দেখা যায়। শাহিন সাহেবের মনখারাপের অবশ্য একটা কারণ আছে। তিনি খুব আশা করেছিলেন এত বছর পরে রুবিনা কে দেখবেন। কিন্তু ওনার আশা পূরন হয়নি!
আবার আশাভঙ্গের কথা উনি কাউকে বলতেও পারছেন না! আনোয়ারা কে তো আর বলা যাবে না। সুইটি নামের মেয়েটির মতো সুন্দরী আমার একজন প্রেমিকা ছিলো। আমার বাবার হলের ব্যবসা থাকার কারণে আমাদের বিয়ে হয়নি! এতবছর পরে রুবিনার কথা খুব মনে পড়ছে।
ফাতেমা চা নিয়ে শাহিন সাহেবের রুমে আসল। ওকে দেখে শাহিন সাহেব বললেন, “কী রে মা চা নিয়ে এসেছিস?”
“হ্যাঁ, তোমার কী মাথা ব্যথা করছে?”
“একটু একটু করছে! তোর ব্যস্ত হতে হবে না।”
ফাতেমা চায়ের কাপটা শাহিন সাহেবের সামনের টি-টেবিলে রাখল। শাহিন সাহেবের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।মাথায় আলত করে হাত দিয়ে বলল,” মাথা বানিয়ে দিই বাবা?”
শাহিন সাহেবের মাথা ব্যথা নেই। মেয়েটা এমন করে বলল, মনে হলো মাথা ব্যথা নেই এটা বললে ওর খারাপ লাগবে! মাঝেমধ্যেই ফাতেমা শাহিন সাহেবের মাথা বানিয়ে দেয়। ওনার খুব ভালো লাগে! সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে মাথা বানানোর সময় ফাতেমা গুটর গুটর করে গল্প করে। মেয়েটার গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে!
শাহিন সাহেব খেয়াল করেছেন একই কাজ ফাতেমা আনোয়ারার সাথেও করে। এবং আনোয়ারাও মেয়েটা কে খুব পছন্দ করে।
মেয়েটা ওনার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ে। বাবা মা দুইজনেই মারা গেছে! প্রথম যখন ফাতেমা কে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। শাহিন সাহেবের মনে হয়েছিল আনোয়ারা মেয়েটা কে সহজভাবে নিবে না। কাজের মেয়ের মতো ব্যবহার করবে।
উনি চাননি ফাতেমা কাজের মেয়ের মতো থাকুক। ওনাকে অবাক করে দিয়ে আনোয়ারা মেয়েটা কে এত আপন করে নিলো। যা উনি কল্পনাও করেননি!
“তোর রেজাল্ট কবে দিবে রে মা?”
“সামনের সপ্তাহে দেয়ার কথা।”
ফাতেমা আলত করে চুল টেনে দিচ্ছে। শাহিন সাহেব চোখ বন্ধ করে আছেন।
“কোচিং-এ যাচ্ছিস ঠিক মতো?”
“হ্যাঁ।”
“বুঝলি মা। জীবনের এ সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একবার ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারলে আর চিন্তা নাই!”
“চিন্তা নাই কে বলল বাবা! ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেই হবে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে না? তারপর পাশ করলেও তো হবে না! ভালো চাকরি পেতে হবে। চিন্তা ছাড়া জীবন নাই বাবা!”
“তা ঠিক বলেছিস রে মা। একবার চিন্তা শুরু হলে আর শেষ হয় না! একটা শেষ হলে আরেকটা শুরু হয়! এমন করে চলতেই থাকে! সব কাজের চিন্তা শেষ হলে শুরু হয় মরন চিন্তা!”
“তোমার মাথা ব্যথা এখনো আছে?”
“না রে মা। এখন মাথাটা খুব হালকা লাগছে। তোর মা কই?”
“মা গেছে তিনতলার বাড়াটিয়ার বাসায়।”
“তুই কি জানিস তোর মা চায়। সুইটি মেয়েটার সাথে রায়হানের বিয়ে দিতে।”
“হ্যাঁ।”
“মেয়েটা কে তোর কেমন মনে হয়?”
মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দর। ফাতেমার কেন জানি মনে হয় মেয়েটা ভালো না। সে অবশ্য ভালো না লাগার কারণটা জানে না। তাই কিছু বলল না।
“ভালোই তো।”
“তোর কি মনে হয় রায়হান মেয়েটাকে পছন্দ করবে?”
“ভাইয়া মেয়েটা কে পছন্দ করে বাবা।”
শাহিন সাহেব অবাক হওয়া কন্ঠে বললেন, “তা-ই নাকি! তোর সাথে আলাপ হয়েছে বুঝি?”
“না, ভাইয়া কারো সাথে আলাপ করে না।”
আদুরে কন্ঠে বললেন, ” তুই কেমন করে বুঝলি?”
“মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে বাবা।”
“তাহলে তো ভালোই হলো। মেয়েটা কে আমার ভালোই লাগে! মেয়েটার মধ্যে কেমন একটা মায়া আছে।”
ফাতেমা কিছু বলল না। অবশ্য ওর বলার মতো কিছু নাই। ও দেখেছে রায়হান ভাই মেয়েটার কে নিয়ে প্রায়ই ঘুরতে যায়। ওর ধারনা দুইজনের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে গেছে। মেয়েটা দেখতে খারাপ না। বাবার কথা ঠিক চেহেরায় কেমন একটা মায়া আছে। কেন জানি তার মন বলছে মায়াটা আসল না!
——
পাঁচটা বাজেই তো আশার কথা বলেছিল সুইটি। এখন বাজে পাঁচটা চল্লিশ! পাক্কা পাঁচ পঞ্চাশ মিনিট ধরে বসে আছে রায়হান। এত সময় ধরে অপেক্ষা করতে কার ভালো লাগে? তবে রায়হানের কেন জানি খুব একটা খারাপ লাগছে না! ওর কেন জানি মনে হচ্ছে আজ সুইটি আসবেই না।
রমনায় বসে না থেকে পাবলিক লাইব্রেরির দিকে গেলে ভালো হতো। সুইটি না আসলেও সমস্যা হতো না। লাইব্রেরিতে বসে বসে বই পড়া যেত। অবশ্য অপেক্ষার সময় বই পড়া যায় না! মনের মধ্যে কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করে!
রায়হান সিদ্ধান্ত নিলো। আর বিশ মিনিট বসে থাকবে। ছয়টা বাজলে বাসায় চলে যাবে।
সুইটি মেয়েটা কেমন জানি! হুট করে বলল,” আপনার সাথে জরুরি কথা আছে। পাঁচটার সময় রমনায় থাকবেন।”
আসবে না ভেবেও না এসে পারল না রায়হান। কেন জানি মেয়েটা কে ওর খুব ভালো লাগে! হ্যাঁ, মেয়েটা একটু গা ঘেঁষা।
সুইটি কি প্রেমের কথাটথা বলবে না-কি কে জানে? এ মেয়ের বিশ্বাস নেই! প্রথম দিন আচানক রিকশায় উঠে বসল! এরপরেও বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে ক্যাম্পাসে। বাসায় তো প্রায়ই সময় চলে আসে।
সারাজীবন প্রেম না করে রায়হানের সুইটির কথা ভাবতে ভালো লাগে! সুইটির সাথে একটা সম্পর্ক হলে খারাপ হয় না।
ছয়টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে সুইটি উপস্থিত হলো। আজ একটা সাদা শাড়ি পরেছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে একটা সাদা পরী নেমে এসেছে! যে কোনো সময় শাড়ির মধ্যে থেকে দুইটা ডানা বের করে উড়াল দিবে!
সুইটি কাছে এসে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “কখন এসেছেন? ”
“পাঁচটার সময়।”
“স্যরি! আপনাকে লম্বা সময় অপেক্ষা করালাম। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আসবেনই না।”
রায়হান কিছু বলল না। সুইটির দিকে তাকিয়ে রইল।
“এখানেই বসি কেমন?”
রায়হান হালকা হেসে মাথা নাড়াল। সুইটি রায়হানের পাশেই বসল। কিছু সময় নীরব কাটল। কেউ কিছু বলল না।
“আপনা কে যে কথাটা বলার জন্য আসতে বলেছি।”
রায়হান সুইটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। রায়হান খুব খুশি!
“দেখুন, আমরা আপনাদের বাড়িতে এসেছি মাসখানেক হয়েছে। আমার সম্পর্কে আপনার তেমন কিছু জানেন না। কিন্তু আপনি কি জানেন? আপনার মা আমাদের নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখছেন! ”
“খুব বেশি কিছু জানার দরকার?”
“অবশ্যই দরকার। না জেনে একটা সম্পর্ক হয়?”
“অনেক জানার পরও তো কত সম্পর্ক টিকে না তা-ই না?”
সুইটি অবাক দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল,” তারমানে আন্টির কর্মকান্ড আপনি সব জানেন! ”
“তা ঠিক না। আমি কিছুই জানতাম না। পরে শুনেছি।”
“আন্টিকে নিষেধ করেননি কেন?”
রায়হান কোনো জবাব দিলো না। আবার আলগা হাসি দিলো। রায়হান মায়ের এ সব ব্যাপার জানত না। কিন্তু জানার পরও খারাপ লাগেনি। সুইটি মেয়েটাকে ওর ভালোই লাগছে। তাই মা কে সাপোর্ট দিয়েছে বলা যায়।
“আপনার পছন্দের কেউ আছে?”
একটু হেসে বলল, “না তা নেই। তবুও এমন হুট করে হয় বলেন!”
“কেন হয় না? পৃথিবীর অনেক কিছুই হঠাৎ হয়ে যায়। অবশ্য আপনার আপত্তি থাকলে বলুন।”
সুইটি কিছু বলল না। লাজুক হাসি দিলো। রায়হান যা বুঝার বুঝে গেল। “তাহলে তো মা কে বলতে হয় সব কিছু দ্রুত করতে।”
“আপনিও তো দেখি আন্টির চেয়ে কম না!” একটু লজ্জিত হলো সুইটি।
চলবে–