#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
[২য় পরিচ্ছেদ]
৩০.
স্টেশনে জনমানবের আনা-গোণা কম। ছুটির দিনেও মানুষদের আনা-গোণা কম হতে পারে জানা ছিলো না। বাদাম বিক্রেতা আগের মতোই একই জায়গায় বসে মানুষের সমাগম দেখছে। এসেছে আধঘন্টা হলো। তেমন বাদাম বিক্রি হয়নি। স্টেশনের আশেপাশের দোকানগুলো ধীরে সুস্থে খোলা হচ্ছে। দোকানিদের মধ্যে ‘তাড়া’ দেখা গেলো না। ছুটির দিনে বুঝি তাদের কোনো তাড়া নেই? অথচ সবসময় দেখে এসেছি ছুটির দিনেই মানুষদের আনাগোণা বেশি থাকে। দোকানি, বাদাম বিক্রেতাদের তাড়াও থাকে তখন সবচেয়ে বেশি। তাহলে আজ কেন চোখের দেখায় এতটা ব্যতিক্রম? পরমুহূর্তেই নওরির মাথায় এলো, আজ তো শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, চাকরিজীবিদের নয়। নিজের চিন্তাতে নিজেই হতভম্ব হলো নওরি। পরমুহূর্তে আড়ালে তপ্তশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো।
নওরি যেই বেঞ্চিতে বসে আছে তাঁর ঠিক পিছেই বইয়ের দোকান। দোকান খুলেছে সাড়ে আটটা নাগাদ। এখন ঘড়ির কাঁটা ন’টায় ছুঁয়েছে। লোডশেডিং হয়েছে। গরমের উত্তাপে দোকানী ভদ্রলোক হাত পাখার মাধ্যমে বাতাস করতে করতে নওরিকে দেখছে। অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে নওরিকে।ক্রেতা খুব একটা নেই। সকাল বেলা খুব একটা বেচা-কেনা হয় না।
ন’টা বেজে পনেরো। নওরিকে একই ভাবে বসে থাকতে দেখলো ভদ্রলোক। নাহ, এখনো কোনোরকম নড়চড় নেই নওরির। ভদ্রলোক এবার গলা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। গলা পরিষ্কার করে উঁচু গলায় নওরির উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
-“মা। সেই কখন থেকে দেখছি তুমি এখানে বসে আছো। ট্রেন কয়টায়? কোন এক্সপ্রেসে যাইবা?”
নওরি কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসলো। উত্তর কী দিবে, জানা নেই তাঁর। নওরি লোকটির দিকে ফিরে বসলো। সংশয় নিয়ে আওড়ায়,
–“আমার নিজস্ব কোনো গন্তব্য নেই চাচা। তাই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি, কোথায় যাবো? কোথায় ঠাই হবে আমার?”
ভদ্রলোক বেশ অবাক হলো। নির্নিমেষ চেয়ে রয় নওরির কোলে অবস্থানরত ব্যাগের দিকে। ব্যাগের মধ্যে এক বিড়ালের অবস্থান। সুঁচ নজরে চেয়ে আছে ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক গলা ভিঁজিয়ে বলে,
–“কী বলো মা? তোমার সাথে কেউ নাই? ঠিকানা ছাড়া এখানে বইসে আছো ক্যানো?”
নওরির পক্ষ থেকে কোনোরূপ উত্তর আসলো না। মৃদু কাঁপছে তাঁর অধর জোড়া। অবশেষে উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো নওরি। ভদ্রলোক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ তখনই ক্রেতা আসে৷ এবং ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে পরে ক্রেতার আপ্যায়নে। নওরি আবার ট্রেনমুখী হয়ে বসলো। বারংবার বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। নওরি সন্তপর্ণে নিজেকে সামলে নিলো৷ ব্যাগে হাত বুলিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,
–“ফ্রিশা! খিদে পেয়েছে তোর?”
—————-
নওরি এক ফাঁকে গিয়ে নতুন একটা সিম কিনে নিলো। পুরানো সিমের দিকে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পপরমুহূর্তেই চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড়িয়ে বললো,
–“স্যরি মাহি আপু।”
পরক্ষণে সিম দুই ভাগ করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো নওরি। নতুন সিম ফোনে সেট করতে করতে একই স্থানে চলে এলো সে। ফোন অন করে ব্যাগে পুরে ফেললো। আশেপাশে শূণ্য নজর দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। নওরি এখনো বুঝতে পারছে না সে কই যাবে? নিজেকে এ!তিমের ন্যায় লাগছে। কে বলবে নওরির বাবা থেকেও নেই! পরিবার, এক ছেলে থেকে বারবার পালাতে হচ্ছে তাকে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই প্রিতম ইরা’দদের বাসায় পৌঁছে গেছে?
প্রিতমের আগমণ বার্তা রাফিয়া-ই নওরিকে দিয়েছে। রাফিয়া না বললে হয়তো আবারও কোনো ন!রকে ঠেলে দেয়া হতো তাকে। ঠেলে নয় অবশ্য, আরেকজন জোর – জবরদস্তি করতো। নওরির সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করা হতো না কখনো। রাফিয়ার বলা কথাগুলো এখনো নওরির কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
–“তুই যেখানেই থাক না কেন নওরি, তুই দ্রুত পালিয়ে যা। প্রিতম তোর ঠিকানা জেনে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই আমায় ফোন দিয়ে বলেছে এবার তোকে পেলে ঘন্টাখানেকের মাঝে বিয়ে করে আমার সামনে হাজির হবে। এই ভুল করিস না নওরি। আমি ভুল পথে পা দিয়েছি বলে তোকে পা দিতে দিবো না। পালা আমার বোন। ওরা কখনো তোর ভালো চায়নি।”
পুণরায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো নওরি। রাফিয়ার কথাগুলো বড্ড অদ্ভুত লেগেছিলো নওরির। রাফিয়া কী নওরির ভালোর জন্যে বললো নাকি প্রিতমের থেকে নওরিকে দূরে সরে যেতে বললো। এখনো কী রাফিয়ার হৃদয়ে, মস্তিষ্কে প্রিতমের বাস? এমনও হতে পারে প্রিতমকে শিক্ষা দেওয়ার ফন্দি এঁটেছে রাফিয়া? অথবা প্রিতম তাঁর সাথে যা করেছে তাঁর প্রতি!শো!ধ নিচ্ছে?
–“উপন্যাস পড়ো মা?”
নওরি হঠাৎ চমকে তাকালো পেছনে। ভদ্রলোক তাঁর দিকে উচ্ছ্বসিত নজরে চেয়ে আছে। চোখে-মুখে আলাদা চাকচিক্য। কই, কিছুক্ষণ পূর্বেও তো ছিলো না। তাহলে প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যে কী? নওরি একপলক ঘর্মাক্ত ভদ্রলোকের দিকে চাইলো৷ নওরি হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“কখনো পড়ার সুযোগ হয়নি!”
–“বলো কী? কখনো পড়ো নাই?”
নওরি নেতিবাচক মাথা নাড়ায়। এবার ভদ্রলোক তাঁর দৃষ্টিজোড়া আরও চকচক করে বললো,
–“তাহলে একটা কিনে ফেলো! আমি তোমাকে একদম ভালোটা দিবো৷ একদম চিন্তা নিও না!”
নওরি এবার জড়োসড়ো হয়ে গেলো। একটু আগেই তো সিম কিনলো সে। হাতে যা আছে তা দিয়ে তাঁর থাকার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তার উপর ট্রেনের টিকিটেরও তো একটা ব্যাপার আছে। যদিও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সিদ্ধান্ত না নিলে-ই বা কী? সারাদিন তো আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে না। একটা না একটা পথ তাঁর ঠিকই হয়ে যাবে। নওরি আমতা আমতা করে নিচু স্বরে বললো,
–“বই কেনার মতো টাকা আমার কাছে নেই চাচা!”
ভদ্রলোকের মুখমন্ডলে বিদ্যমান হাসি এবং উচ্ছ্বাস নিমিষেই যেন কোথায় হারিয়ে গেলো। মায়াভরা নজরে নওরির দিকে তাকিয়ে বলে,
–“ওহ। সমস্যা নাই!”
নওরি আবার ভদ্রলোকের দোকানের দিকে ঘুরে বসলো। ভদ্রলোকের সর্বপ্রথম নজর ফ্রিশার দিকে গেলো। ফ্রিশার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিলো ভদ্রলোক।
–“তুমার বিড়ালডা মেলা সুন্দর!”
নওরি আলতো হাসলো। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,
–“মা জানো, বাংলা ভাষা ছাড়া কিছু বুঝি না। পড়ালেখাও খুব একটা করি নাই। কিন্তু উপন্যাস, কবিতা পড়ার প্রতি আলাদা সখ ছিলো। পড়তাম, ধার নিতাম। কিন্তু খুব একটা পারতাম না পড়তে। গরিব মানুষ, গরিব মানুষগো উপন্যাস বিষয়ডা একদম বিলাসিতা। তাও সখ আমার কমতো না। পরে ঠিক করলাম বইয়ের দোকান দিমু। এইযে এখন দ্যাখো, আমি জ্ঞানের রাজ্যের মাঝে বসে আছি!”
বলেই ভদ্রলোক খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। নওরি অবাক নয়নে ভদ্রলোকের হাসি দেখলো। মনে হচ্ছে ভদ্রলোক নয় বরং নওরির বাবা হাসছে। কারো মাঝে বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে নওরির চোখ জোড়ায় অশ্রুকণা ভীড় জমালো। নওরি এও বুঝলো লোকটি ভালো-ই পড়েছে। এজন্যই তো আধো শুদ্ধ এবং আধো আঞ্চলিক মিলিয়ে ফেলছে। একেক জনের ভাব প্রকাশ করার অভ্যাস একেক রকম। নানান মানুষের সাথে মিশলে বোঝা যায় বাংলার মতো রূপ। কতো স্নিগ্ধতা।
–“তুমি সত্যি কোনোদিন পড়ো নাই?”
–“না চাচা!”
ভদ্রলোক হঠাৎ ভাবনায় পরে গেলো। কী ভেবে বইয়ের সম্ভারে কিছু খুঁজতে শুরু করলো। কিন্তু স্বল্প আলোয় সে সেভাবে খুঁজে পাচ্ছে না। বিদ্যুৎ এখনো দেখা দেয়নি। নওরি নিরবে শুধু ভদ্রলোকটির কান্ড লক্ষ্য করলো। হঠাৎ একটি বই বের করে ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। হাত বাড়িয়ে বইটি নওরির দিকে দিয়ে ভূবন ভুলানো হাসি দিয়ে বলে,
–“এটা নাও মা! তোমারে দিলাম।”
নওরি বিস্মিত হলো। নির্বাক চাহনিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“কিন্তু চাচা, আমি কীভাবে…”
–“পড়ো, টাকা-পয়সা দেয়া লাগবো না। তুমি কখনো উপন্যাস পড়ো নাই। তাই তোমারে পড়তে দিলে আমার লোকসান না, বরং লাভ হবে। এ ভেবে শান্তি পাবো, কখনো উপন্যাস না পড়া মা’কে আমার উছিলায় পড়সে। রাইখা দাও তোমার কাছে। ভালো লাগলে অন্যসময় কিছু বই কিনা নিয়া যাইও। আমি অপেক্ষা করুম তোমার আসার।”
নওরি এক ধ্যানে চেয়ে রইলো ভদ্রলোকের দিকে। এত ভালো মানুষ বুঝি এ দুনিয়ায় আছে? এত বড়ো মানুষ অথচ ভেতরের হৃদয়টা এতটা স্বচ্ছ? নওরি আবেগ প্রকাশ করতে পারলো না। সন্তপর্ণে হাত বাড়িয়ে বইটি নিয়ে নেয়। মাস্কের আড়ালে অধরে হাসি ফুটিয়ে বলে,
–“বেঁচে থাকলে আসবো চাচা, আপনার কাছ থেকে অনেক বইও কিনে নিবো।”
———-
নওরি বইটা উল্টে, পাল্টে সামনে তাকাতেই চমকে গেলো। ভয়ে, আত!ঙ্কে নওরি ঘামতে শুরু করলো। ওইতো প্রিতম এবং তাঁর মা মিলে এদিক সেদিক কিছু খুঁজছে। এর মানে কী নওরিকে খুঁজতে এসেছে ওরা? নওরির ভয়ে নেতিয়ে পরার উপক্রম। আশেপাশে নজর বুলালো। দ্রুত সময় ব্যয় না করে বই ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত ভঙ্গিতে আড়ালে চলে গেলো। প্রিতম ফোনে একটি ছবি দেখাচ্ছে বেশ কয়েকজনকে। নওরির গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। এভাবে কেন খুঁজছে প্রিতম তাকে? কী চায়? বিয়ে করাটাই কী তাঁর মূল উদ্দেশ্য?
নওরি দেয়ালের পেছন থেকে মাথাটা বের করে উঁকি দিয়ে ওদের কার্যক্রম দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ পেছন থেকে কনুইয়ে হেঁচকা টান লাগলো। নওরি ফিরে কিছু বুঝবার পূর্বেই তাঁর বাম গালে টনটনে ব্যথার উৎপাত অনুভব করলো। নওরি চোখ-মুখ খিঁচে কুঁকড়ে উঠলো। নিজের অজান্তেই বাম গালে হাত চলে গেলো। গরম ধোঁয়া যেন বের হচ্ছে গাল দিয়ে। এত যন্ত্রণা লাগছে কেন?
®লাবিবা ওয়াহিদ
————————-
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
বিঃদ্রঃ অবশেষে ফিরে এলাম। তবে পুরোপুরি না। এই পর্বটি এক সপ্তাহ লাগিয়ে লিখেছি। বেশ অনেকদিন পর লেখার কারণে লেখা কিছুটা খাপছাড়া হয়েছে। তাই আশা করছি আমার পাঠকমহল বুঝে নিবেন। পরীক্ষার ফাঁকে অবসর সময় পাওয়া যায়। তাই ওই টুকটাক লেখা হতো। কিন্তু আপনাদের আহাজারি দেখতেও ভালো লাগছিলো না, তাই দিয়ে দিলাম। আশা রাখছি রেসপন্স করবেন। পরবর্তী পর্ব বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবারে পাবেন ইন-শা-আল্লাহ্। সকলে মন্তব্য করবেন কিন্তু? নয়তো আমার ছোট্ট হৃদয় ভেঙে যাবে।