অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৬) #লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী ৬. (Edited)

0
140

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৬)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

৬. (Edited)

নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র হলো “Every action (force) in nature there is an equal and opposite reaction.”

যার বাংলা ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’
প্রকৃতিতে এমন ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে যা এই সূত্রের সাথে মিলে যায়। কারণ পূর্বে মানুষ যা করে আসে পরবর্তীতে তা ভোগ করে। চারজন মানুষ— চারুলতা, আতিকুর রহমান, আবরার কবীর আর অপরাজিতা কবীর এই বাস্তবতার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
চারুলতাকে ক্ষমা করেই তিনি নিজের জীবনের বিনাশ ডেকে এনেছিলেন। আজও চোখ জোড়া বন্ধ করলে তিনি তার সেই অবুঝ ছোট মেয়েটার আর্তনাদ, পো’ড়া চামড়া, অজস্র ক্ষতের চিহ্ন, র’ক্তে’র শু’ক’নো দা’গ দেখতে পান। সেইদিন হাসপাতালের বেডে নিথর দেহখানা ব্যাথিত আর অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করেছিল,
“মা কেন আমাদের একসাথে বাঁচতে দিলো না, বাবা?”

বাবা হিসেবে তিনি আজও চরম ব্যার্থ। মেয়েটাকে ভরা মজলিসে বিয়ে করে নিলো অথচ কেউ প্রতিবাদ করলো না। তার ছোট ছেলেকেও তার সামনেই উঠিয়ে নিয়ে গেলো তবে তিনি নাকি টের পেলেন না। সব কিছু যেন তার ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। ঠিক করে দাঁড়াতেও পারছেন না। আজ শরীরের ভার দশ গুন বেড়ে গিয়েছে। লজ্জায় তিনি নিচে নামতে দ্বিধাবোধ করছেন।তাই তো খানিক আগে গাড়ির শব্দ পেয়ে জানলার ধার ঘেঁষেছিলেন। একটা বার তার মেয়েকে দেখার উদ্দেশ্যে চাতক পাখির ন্যায় অপলক চেয়েছিলেন।
হাটি হাটি পা পা করে হাঁটা শিখানো মেয়েরা কেন স্বামীর আমানত হয়? কেন বাবারা নিজের মেয়েকে সারা জীবন আগলে রাখতে পারে না? আতিকুর রহমানের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। খুব করে ইচ্ছে হলো দৌড়ে নীচে নেমে মেয়েকে জড়িয়ে ধরার; তবে কৌশিক মির্জাকে দেখার সাথে সাথেই সেই ইচ্ছে দমিয়ে নিলেন। আর দেরী না করে নিজের কক্ষে যেতে নিয়েও উল্টো দিকের একটা কক্ষে প্রবেশ করলেন।

***

কাশফি গোসল করে তার বিয়ের শাড়ি পাল্টে নিয়ে একটা মেরুন শাড়িতে নিজেকে জড়িয়েছে। সারাদিন কান্নাকাটির পর মুখ ফুলে আছে। নিজেকে ভালো দেখানোর জন্য কোন সাজ সজ্জাও করল না। বিছানার মাঝ বরাবর হাত পা উড়ন্ত কাঠবিড়ালির ন্যায় মেলে ধরে ঘুমাচ্ছে কায়েস। কিছুক্ষণ আগে কাশফি কায়েসের গায়ে যে কাঁথা মুড়িয়েছিল সেটার অবস্থান এখন পায়ের নিচে। কাশফি চলে গেলে এই ছেলের কি হবে? ভাবতেই কাশফির বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

মেহমান বলতে বাসায় কেউ নেই। গুটি কয়েকজন আত্মীয় স্বজন বিয়ের ভেনিউ থেকেই বিদায় নিয়েছেন।
প্রথমে সে বাবার সাথে দেখা করতে উপরের দিকে উঠে। আতিকুর রহমানকে রূমে না পেয়ে কিছু একটা ভেবে আবার নিজের কক্ষে এসে পরে। সন্তানের বি’ধ্ব’স্থ রূপ কোনো বাবা মার সহ্য করার মতো না, আর কাশফিতো ভরা মজলিসে নিজের আত্মা বিকিয়ে দিয়েছে শয়তানের কাছে। যে পথে সে হাঁটছে সেখানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

কাশফি আলমারি খুলে নিজের ল্যাপটপ অন করে আবার পুষ্পকুঞ্জ একাডেমীর ওয়েব পেইজে ঢুকতে চেষ্টা করলে দেখে, “404” আর পেইজ নট ফাউন্ড বার্তা আসছে। বিরক্ত হয়ে নিজের মেইল চেক করতে গেলে তার থ্যারাপিস্টের একটা মেইল চোঁখে পড়ে। তার ডায়েটের কিছু পরিবর্তন করেছেন আর সে ভালো আছে কিনা জানতে চেয়েছেন কিন্তু কাশফি ঠিকই বুঝলো থেরাপির ব্যাপারে তিনি এখনো উদাসীন। কাশফির বাবার একজন ভালো বন্ধু ডক্টর ইয়াহিয়া খান আর কাশফি ইয়াহিয়া খানের বেশ পুরনো পেশেন্ট। বলা যায় আনুমানিক নয় বছর পুরোনো।
কাশফি ছটফট কিবোর্ড চেপে ইয়াহিয়া খানের নিকট একটা মেইল লিখতে লাগলো,

From: ishitaimroz*@gmail.com
To: yahiyakhan*@gmail.com

ডক্টর ইয়াহিয়া খান,
আপনার ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ী আমি নিজের উপর কোন রকম চাপ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছি। আশানুরূপ আমার মেন্টাল হেলথ বেশ ভালোই চলছে। তাই আমি আমার নেক্সট সেশনেই হিপনোথ্যারাপির (hypnotherapy) প্রসেস শুরু করতে চাই। এই মাসে আপনার স্ক্যাজওলে(schedule) আমাকে রাখতে ভুলবেন না। আমি শীঘ্রই ফিক্সড ডেট আর টাইম মেইল করে পাঠাবো।

Warm Regards,
Ishita Imroz

কাশফি সেন্ট করার আগে মনে পরে যায় মধ্যবয়স্ক ডক্টর ইয়াহিয়া খানের কিছু কথা। তিনি কাশফিকে যথেষ্ট স্নেহ করেন তাই কাশফিকে অনেক সুন্দর করে বুঝিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন —
“যা তোমার মস্তিষ্ক নিজে থেকে ভুলিয়ে দিয়েছে তা জোর পূর্বক মনে করার চেষ্টা মঙ্গল কিছু বয়ে আনবে না। ভেবে দেখো কাশফি, হয়তো সৃষ্টিকর্তা তোমাকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ বেঁচে থাকতে চেয়েও পারেনা, তাই তোমার উচিত জীবনের ভালো জিনিস আঁকড়ে বাঁচতে শিখা আর আমিও তোমার সাথেই আছি।”

আগের কথা ভাবতেই কাশফির চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে। তার বাবা তখনো তাকে নিয়ে পাগল প্রায়। কারণ রাতের উদ্ভট রকমের দুঃস্বপ্ন তার সম্পূর্ন ঘুম কেড়ে নিয়ে মানসিক রোগীর ন্যায় করে তুলেছিল। এখন সেই সব রকমের স্বপ্ন সে আর দেখে না দেখতে চায় না কিন্তু অতীত তার পিছু ছাড়ছেনা তাই জানা খুবই প্রয়োজন, খুব।

কাশফি কি কোন ভুল করছে? নিজের প্রান হরণকারীও মৃত্যুর আগ মুহূর্তে চায় যন্ত্রনা থেকে বাঁচতে। কিন্তু সময় বড্ড সীমিত, নিজে যা করেছে তার থেকে ফিরে আসা কঠিন।
মৃত্যু আসলেই কি সোজা জিনিস? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। কারো জন্য বয়ে আনে সুখ কারো জন্য অনুশোচনা।

***

কাশফি নিঃশব্দে, গুটি গুটি পা ফেলে সে তার বাবা আতিকুর রহমানের ছোট লাইব্রেরী রুমে প্রবেশ করে। রুমের দুই দেওয়ালে সেলফ, এক দেওয়ালের অনেকটুকু জুড়ে জানালা। উপরের দিকের বেশ পুরাতন কিছু কিছু বইয়ে ধুলোর মোটা আস্তর জমে আছে। দেওয়ালের রঙ প্রায় ঊঠে গিয়েছে। রূমের কর্নারে একটা পুরনো টেবিল চেয়ার পাতা আছে সেখানে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছেন আতিকুর রহমান। রুমের জানালাটা খোলা থাকায় বাতাসে টেবিলে রাখা বইটার পাতা বার বার উল্টে যাচ্ছে। অযত্নে পরে থাকা বইটা হয়ত তিনি নিয়েছিলেন নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য, কিন্তু পড়ার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র নেই।

কাশফি তার বাবার পায়ে হাত রেখে নিকটেই হাঁটু ভাঁজ করে বসে পরে। আতিকুর রহমান অনড়, মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন না এই ভেবে যে তিনি নিজেকে আটকাতে পারবেন না তাই। কাশফি বাবার কোলে মাথা রেখে ছোট করে বলে,
“আমি ব্যর্থ বাবা।”
বলেই সে নিরবে অশ্রু ফেলে। আতিকুর রহমানের চোঁখ উপচে পরে পানি গড়িয়ে পরলো। তিনি কাশফির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন—
“তুমি হেরে যাওনি, বাবা হেরেছি। কিন্তু তাই বলে আমি মনক্ষুন্ন হইনি কারণ আমার কাশফিকে আমি একবার না পেরে চুপ হয়ে বসে থাকা শিখাই নি। তাই না বাবা?”
আতিকুর রহমানের কথায় কাশফি উপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে সে বুঝেছে।
বাবা মেয়ে কিছুক্ষণ এইভাবে বসেছিল। তাদের মাঝে না হওয়া অনেক কথাই যেন এই নিরবতা বলে দিয়েছে। কাশফির বাবার কোলে প্রশান্তি পেয়ে চোখ বুঁজে নেয়। বাস্তবতায় ফিরে যাওয়ার আগে এই সুখটুকু নিতে চায়।

***

কৌশিক ফ্রেশ হয়ে রুমে এসেই সর্বপ্রথম চেরি ব্লসমের একটা খুবই সুন্দর ঘ্রাণ তার নাকে লাগে। ছোট টেবিলটায় চায়ের কাপ রাখা। কাপ থেকে গরম ধোয়া উড়ছে, দেখে বোঝাই যাচ্ছে কেউ এইমাত্র রেখে গিয়েছে। এই ঘ্রাণ বেশ পরিচিত, তার ম্যাডামের খুবই পছন্দের লোশন। তার আসলেই একটা চায়ের খুবই প্রয়োজন ছিল।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে কাব্যের সাথে কথা বলে কাল ফেরার ব্যবস্থা করে নিয়েছে।এরপর চা টুকু শেষ করে কিছু মেইল চেক করে তার এসিস্ট্যান্টকে তার স্কেজুওল(schedule) মেইল করতে বলেছে। রাজধানীতে মির্জাদের পুরোনো অনেক বড় হোটেল চেইনের বিজনেস। তাছাড়া তাদের আর্কিটেক্ট সেক্টরে তাদের কিছু শাখা আছে। একটা সিগা’রে’ট ধরিয়ে কিছু ফোন কল শেষে অফিসিয়াল কাজ শেষ করতে না করতেই তার ম্যাডাম একটা ট্রে তে রাতের খাবার নিয়ে হাজির হয়।

ভোঁতা মুখে কাশফি হাতে আনা পানির বোতল নাইট স্ট্যান্ডে রেখে খুবই সতর্কভাবে খাবারে ট্রে টা কৌশিকের পাশে রেখে দেয়।
কৌশিক খুবই সূক্ষ ভাবে পরখ করে। সদ্য গোসল করে আসায় যেন তাকে আরো স্নিগ্ধ লাগছে।

কাশফি দেখতে বাকি আট দশটা মেয়ের মতোই। তার গায়ের রং না ধবধবে সাদা না শ্যামলা।‌ তবে কৌশিকের নয়নে তার টানা টানা চোখ আর ঘন বাঁকানো অক্ষিপক্ষ্ম খুব মোহনীয় আর অতি রাগে লাল হয়ে যাওয়া ঠোঁট জোড়া সম্মোহনী। গায়ে জড়ানো মেরুন রঙের শাড়িটা যেন মিসেস মির্জার জন্যই বানানো হয়েছে। কৌশিকের ধ্যান নেই যে হাতের সিগারেটটা ছোট হয়ে এসেছে। কাশফি কৌশিকের আঙ্গুলের ফাঁক থেকে সিগারেটটা নিয়ে অ্যাসট্রে রেখে দেয়। কাশফির এই ছোট কাজটা কৌশিকের জন্য যেনো অনেক বড় কিছু। তার মনে হলো সে এখন তার বউকে দেখতে পাচ্ছে — শুধু কাশফি নয় মিসেস কৌশিক মির্জা।
কাশফি সিগারেটের ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য বারান্দার দরজা খুলে পিছনে ফিরতেই দেখে কৌশিকের মুখে খুবই সূক্ষ্ম হাঁসির ভাঁজ। এই হাসিতে কোন খাদ মিশানো নেই যেন। কাশফি হকচকিয়ে যায়। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, মুহূর্তের মধ্যেই যেন কৌশিকের সরল হাসিটা মিলিয়ে যায়। তবে এই হাঁসির জায়গায় এখন একটা ধূর্ত হাসি তার মূখে। কৌশিক মির্জা টাইপ হাসি।

“তোমাকে আমার বউ বউ লাগছে মিসেস মির্জা। আমার কাছে এসে বসো আদর করে দিই। স্বামীর ছোঁয়া না পেলে পরিপুর্ণ বউ হওয়া যায় না।”
কৌশিকের আউলা ঝাউলা যুক্তিতে কাশফি বিরক্ত হয়ে চোখ উল্টিয়ে গাল বাঁকায়। এতে কৌশিকের মুখে হাসির রেখা যেন আরো কিছুটা প্রসারিত হয়। কাশফি কৌশিকের মতি গতি বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বলে,

“খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

“খাইয়ে দাও”

কাশফি এক ভ্রু উচুঁ করে রেগে বলে,
“আল্লাহ আপনাকে এই দুই হাত উল্টা পাল্টা কাজ করার জন্য দেয়নি।”
তৎক্ষণাৎ কৌশিক চোঁখে মুখে দুষ্টু হাসি দেখা দেয়।
“উল্টা পাল্টা কাজ?”

কাশফি যেন বেকুব বনে গেল যেনো, পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেল সে। কি বুঝিয়েছে আর কি বুঝেছে সে! সে চোখ শক্ত করে বন্ধ করে আমতা আমতা করে বলল,
“সব মিলিয়ে আমি বোঝাতে চেয়েছি আপনি না খেলে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।”

কৌশিক মুখ দিয়ে বিরক্তির শব্দ বের করে বলে,
“বাসরের মুড নষ্ট করো না জান।”

কাশফির মনে হচ্ছে লজ্জায় তার গাল জ্বলছে। সে বিরক্ত প্রকাশ করে ধমকের সুরে বলে — “কৌশিক!”

“তুমি আমার নাম ধরে ডাকলে কেমন অস্থির অস্থির মনে হয় কাশফি। আজ যতবার ডেকেছো ততবার তোমাকে জাপটে তোমার গলায় নাক ডুবাতে চেয়েছিলাম…”
কাশফি আরেকদফায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তার ঠোঁট জোড়া আপনা আপনি ফাঁক হয়ে যায়। কৌশিক কি তাকে কথার জালে ফাঁসিয়ে বিরক্ত করছে? ভাবুক হয়ে সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরতেই কৌশিকের বৃদ্ধাঙ্গুল কাশফির ঠোঁট ছুঁয়ে দাঁতের মাঝখান থেকে বের করে আনে। কাশফির শরীর থেকে আগত ফুলের সুবাস আর তার শরীরের ঘ্রাণ কৌশিককের মাতাল হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। কৌশিক নিজেকে চেপে মোটা স্বরে অতি গম্ভির ও কর্কশ কন্ঠে বলল,

“এটা আমার কাজ তোমার না।”
ঠোঁটে কৌশিকের ছোঁয়া পেয়ে কাশফির সর্বাঙ্গ আচানক গরম হয়ে এলো যেন, হৃদপিণ্ডের উত্তাল গতি যেন তার কানে বাজছে। কৌশিক আর তার মাঝের দুরত্বটা দূরত্ব বলার অযোগ্য। কৌশিকের বাক্য বুঝে আসতেই কাশফির ভিতরটা ছট্ফট্ করতে শুরু করল। বার বার কানে বাজতে থাকলো কৌশিকের কথাটা। কোন রকম সে ফিসফিস শব্দে বলে উঠলো,

“আপনার খাবার!”
কথাটা কাশফির নিশ্বাসের শব্দের মতো শোনালো যেন। পরপর সে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে কিছুটা সরে বসে। কৌশিক একটা বড় শ্বাস ফেলে উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল।

সে সিঙ্ক থেকে হাত ধোয়ার সময় ভাবতে থাকে, সে তো কাশফি কে বিরক্ত করতে চেয়েছিল ঠিক কিন্তু তাদের মধ্যকার আকর্ষণটা অস্বীকার করার মতো না।

কাশফি মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে, কি করতে এসে কি হয়ে গেল। অস্বস্থিতে পা জোড়া কাঁপছে তার। তৎক্ষণাৎ কৌশিক হাত ধুয়ে বের হয়ে কাশফির দিকে একবার চেয়ে বসে ট্রে থেকে প্লেট তুলে খাবার নেয়। কাশফি একবার কৌশিক আরেকবার খাবারের দিকে তাকিয়ে চায়। কৌশিক শার্টের হাতা গুটিয়ে খাবার খেতে যাবে তার আগে কাশফি বলে উঠে,

“পাশের বাড়ির আঙ্কেলটা আমেরিকায় থাকে, তার বাড়ীর উঠানে ধুতরা ফুলের গাছ অনেক আগে দেখেছিলাম। শুনেছি ঔষুধি গাছ নাকি? তবে ধুতরা ফুলের বিষ প্রা’ণ’না’শ করার জন্য যথেষ্ঠ।”
কৌশিকের হাত ততক্ষণে মুখ পর্যন্ত এসে থেমে গিয়েছে। সে ভ্রূ কুঁচকে কাশফির দিকে তাকায়, নিমিষেই তার কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়ে যায়। একবার খাবারের দিকে আবার কাশফির দিকে তাকিয়ে নিচু তবে গম্ভির স্বরে আওড়ালো — “তুমি সেই ফুল খাবারে মিশিয়েছ?”

কাশফি দাঁত কেলিয়ে হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝায়। এরপর এক হাতের পাঁচ আঙুল বের করে ঘুরিয়ে আবার বন্ধ করে বলে,
“আমি রিস্ক নিতে চাইনি তাই পাঁচটা ফুল দিয়েছি।”

কৌশিক একটা হিউমরলেস হাসি হেসে জগের পানি গ্লাসে ঢেলে হাত ধুতে গেলে কাশফি চুক চুক শব্দ করে বলে,
“আপনার গ্লাসের পানিতে উচ্চ মাত্রায় ক্লোরিন আছে, হাতে ঢাললে ফুসকুড়ি দেখা দিবে।”
কৌশিক স্বশব্দে জগ ট্রেতে রেখে এবার অবাক চোঁখে শুধূ চেয়ে আছে। তার নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। কি সুন্দর সাবলীল ভাবে বলে গেল কাশফি।
দুর্দান্ত!

কাশফি সামনে তাঁকিয়ে তর্জনী সোজা করে নাইট স্ট্যান্ডে থাকা পানির বোতলের দিকে ইঙ্গিত করে বলে,
“এই পানির ক্ষেত্রেও আমি রিস্ক নিতে চাইনি তাই গ্লাভস পরে পাশের আর্সেনিক চিহ্নিত কল থেকে বোতলে করে পানি এনেছি। নিজের টা পাগলেও বুঝে তাহলে প্যাথেটিক কাশফি কেন নয়?”

কাশফি কথার ফাঁকে সূক্ষ খোঁচাটা যে কৌশিককে দিয়েছে তা কৌশিকের ধরতে সময় লাগেনি। সে কিছুক্ষণ অনুভূতিহীন আর অনড় রইল। কাশফির চোখে উত্তেজনা, এসব তার বউয়ের তার প্রতি বিদ্রোহ দেখানোর এক একটা নিখুঁত পন্থা। কাশফির অবাধ্যতায় তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। কিন্তু রাগকে দমিয়ে সে নিজের আওয়াজ শান্তু রেখে বলে,

“তুমি অনেক জিনিয়াস মিসেস মির্জা। বাসরে স্বামীর মৃত্যু পরিকল্পনা করার জন্য কলিজার প্রয়োজন, and they say romance is dead”

কাশফি একটা মুচকি হাঁসি দিয়ে বলে — “They don’t know about us… থ্যাংকস বাই দ্যা ওয়ে।”
কৌশিকের শক্ত হাতের রগ ফুলে আছে, রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ কৌশিক মির্জার নেহাতই কম। এত সূন্দর করে বউয়ের মতো আচরণ নিয়ে কৌশিকের মনে এত কিছু চলছিল না। কিন্তু এত সুন্দর ষ’ড়য’ন্ত্র করে রেখেছে কে জানতো? সিগারেট ফেলে দেওয়া টাও অভিনয়ের অংশ কেবল? কৌশিক কোন রকম হেরফের না করে কাঠ গলায় শুধলো —
“আমাকে মারতে এতকিছু করলে অথচ নিজের প্ল্যান নিজের হাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে?”

কাশফি তার জিভ গালের ভিতরের একপাশে এনে কিঞ্চিৎ বাকায় — ঠিক কৌশিকের মতো হাসি দিয়ে প্রতুত্তরে বলে,

“আমি কম্প্রোমাইজ করতে জানি না। তাই বলে রাখছি আপনি আমার সাথে যা করবেন তাই পাবেন। বিশ্বাসঘাতকতার পরিবর্তে বিশ্বাস ঘাতকতা, নিশ্বাসের পরিবর্তে নিশ্বাস, র’ক্তে’র পরিবর্তে র’ক্ত’ কৌশিক।”

কিছু মনে করে কাশফি এবার মুখ থেকে হাঁসি ঝেড়ে ফেলে। কৌশিককে একটা ঘোরের মধ্যে রেখে সে চোঁখের দৃষ্টি তীর্যক করে উঠে দাড়ায়,
” ঘণ্টা খানেক আগে আমার শ্বাস রোধ করেছিলেন না? কিছুক্ষণ আগে সুন্দর করে আমার বানানো যে চা টা গিলেছেন তাতে কোকোনাট মিল্ক ছিল আর নারিকেল দুধে আপনার এলার্জি আছে, রাইট? মা’রা যাবেন না নিশ্চিত তবে কিছুটা কষ্ট হবে তাই ইনহেলার এনে রাখুন।”

কাশফি ভাবমূর্তিহীন কৌশিকের দিকে হেসে এক চোখ টিপে ট্রে নিয়ে চলে যায়।

#চলবে…

আপনাদের মূল্যবান মতামত দিন আর বন্ধুমহলে আমার পেইজ বা গল্প শেয়ার করতে ভুলবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here