#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৬)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
১৬. (Edited)
অতীত:
“What a coincidence!”
কৌশিকের চোঁখে মুখে একরাশ বিস্ময় দেখে কাশফি থতমত খেয়ে গেলো। স্বভাবত চতুর কৌশিক বেশ পটু অভিনয়ের মাধ্যমে সকলের সামনে আশ্চর্য্য হয়ে থাকলেও কাশফির দৃষ্টিতে এসব সাজানো গোছানো একটা নাটক হয়েই ঠেকলো। ফাহিম কুশল বিনিময় করে নেয়। কৌশিক মির্জা আতিকুর রহমানকে সালাম দিলেন বিনিময়ে আতিকুর রহমান সৌজন্যমূলক হেসে সালামের জবাব দেয় কেবল, তিনি কৌশিক মির্জার ব্যাপারে অবগত ছিলেন তবে দিগন্তর উপর অগাধ বিশ্বাস ছিল বলেই এই পর্যন্ত এগিয়েছেন।
কৌশিকের পুরু গলার হাস্কি কন্ঠে পাথর হয়ে থাকা কাশফির হঠাৎ টনক নড়ে উঠলো, ইতিমধ্যে ঘাম ছুটে গিয়েছে তার। কৌশিকের এতসবকিছু করার কারণ কি হতে পারে? শুধুই কি কাশফির জীবনে দখলদারী করা? তবে আবার প্রশ্ন জাগে মনে, কৌশিক মির্জার বিত্তশালী জগতে কাশফি অতি নগণ্য একজন। অন্য কোন মতলব সে খুঁজেই পাচ্ছে না, কোন রকমেই কাশফির হিসাব মিললো না। অগত্য ভোঁতা মুখে দৃষ্টি নত করে কেবল তাদের কথা শুনতে লাগলো।
কথাবার্তা বেশ খানিকক্ষণ চললো। কথার ধাঁচ দেখে কাশফি তাদের উভয়পক্ষের সম্মতি আঁচ করে নিলো। নিজের প্রতি ক্ষোভ জমেছে এখন চাইলেও বাবার সিদ্ধান্তে সে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। হঠাৎ তার ভাবনা চিন্তা ভেদ করে কৌশিকের রাখা একটা প্রস্তাব কানে এলো,
“শুনেছি আর্ট গ্যালারি দুটো প্রায় সাত আট বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে?”
আতিকুর রহমান মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়েন,
“জ্বি, আমি একা মানুষ দায়িত্বটা নিতে পারিনি। পরিকল্পনা আছে মেয়ের জিনিস গুছিয়ে বুঝিয়ে দিলে মেয়েই বুঝে নেবে।”
“রহমান সাহেব, আমি আর্টিস্টিক জিনিস ভীষন পছন্দ করি তাই ভাবছি গ্যালারি দুটোয় আমি ইনভেস্ট করব।”
কাশফি আঁতকে উঠে, তড়িঘড়ি করে না করার পূর্বেই দিগন্ত সায় দেয়। সময় নিয়ে গম্ভির কন্ঠে বলল,
“আমিও ভাবছিলাম, ঈশিতা পুনরায় গ্যালারি খোলার ব্যাপারে মত দিলেই আমরা ইনভেস্ট করব।”
তাদের কথা শোনা মাত্রই এতক্ষন হাঁসফাঁস করতে থাকা কাশফির ভয় জেঁকে ধরলো। সে কৌশিক কে পরখ করলো কিছুক্ষণ, বিতৃষ্ণা ছেঁয়ে গেলো তার কায়ায়।
সে এত নিখুঁত অভিনয় জানে! তার বাবার সামনে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেনো সে কাশফির অস্তিত্বের ব্যাপারে অজ্ঞাত, কাশফি নামের কাউকেই চিনে না এমন।
অতিষ্ঠ কাশফি কথাবার্তার ফাঁকে সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে তার বাবাকে আলাদা করে ডেকে নেয়।
“ক্যান আই হ্যাভ আ মোমেন্ট প্লিজ?”
প্রথমে সরু চোঁখে তাকালেও পরে তার বাবা ক্লায়েন্ট আর এজেন্টদের ছোট্ট করে ‘এক্সকিউজ মী’ বলে কাশফির সঙ্গে কিছুটা দুরে এসে পড়ে।
“বাবা এস্টেটের চুক্তিটা আমি তাদের সাথে করতে চাই না।”
“এটা কেমন কথা?”
“বাবা প্লিজ।”
কাশফির খামখেয়ালী কথাবার্তায় আতিকুর রহমান চরম বিরক্ত, তিনি কড়া গলায় জানিয়ে দেয়,
“না, তোমাকে আমি এডাল্টের মতো একটা সিদ্ধান্ত নিতে বলেছি আর তুমি কিনা বাচ্চামো করছো। তোমার থেকে এসব কিছু আশা করি না আমি।”
“বাবা আমার সমস্যা কৌশিক মির্জা নিয়ে।”
“কেনো?”
“এসবের সে ফায়দা লুটবে, সে মানুষটাই এমন।”
“সেটা আমি সুনিশ্চিত করব। তাছাড়া তোমাকে আমি অনেক বার বলেছি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে। আপাতত এখন সিদ্ধান্ত ফিরানোর কোন পথ নেই।”
বাকিটুকু বোঝাপড়া চলল অনেকক্ষন, দম খিচে বসে থাকা কাশফির আর কোন কথায় খেয়াল রইল না। কৌশিক নামক আঁতঙ্কে জর্জরিত তার কিশোরী মন বার বার কৌশিকের জন্য বিষিয়ে উঠছে।
একটা মানুষকে ঠিক কত রকমে ঘৃ’ণা করা যায়?
অগণিত।
আলোচনার ইতি ঘটতেই সে গটগট পায়ে বেরিয়ে পড়ল যেনো সে শেষ হওয়ার প্রহর গুনছিল এতক্ষন। কৌশিকের সাথে এক রুমে থেকেই তার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম সেক্ষেত্রে মানুষটাকে সহ্য করা বিলাসিতা কেবল।
একজন ক্লায়েন্টের কল আসায় ফাহিম কথা বলতে কিছুটা দুরে এসেছিল, যতক্ষণে ফিরে এসেছে তার পূর্বেই দেখলো কাশফি উধাও। সে আসার পাঁচ মিনিট আগেই কাশফি আর তার বাবা রওনা হয়েছিলেন। ফোন হাতে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে সে পাশ ফিরে। চোখ জোড়া ফোনের স্ক্রিনে রেখে তার গাড়ির দিকে এগোতে পা বাড়ায় তৎক্ষণাৎ ভূতের ন্যায় একজোড়া চকচকে জুতো পায়ে দাঁড়ানো একজন তার পথ রুখে দাড়ায়। মুখ দিয়ে বিরক্ত সূচক শব্দ বের করে মাথা উপরে তুলতেই তার মুখ হা হয়ে গেলো। পরক্ষণে নিজেকে সামলে একটা হাঁসি দিয়ে বলল,
“কোনো কাজ ছিল স্যার?”
“তোমার নাম।”
“ফাহিম।”
“এক্সপেরিয়েন্স?”
“চার বছরের স্যার।”
“এই শহরে নতুন?”
“জ্বি স্যার চার মাস আগেই ট্রান্সফার হয়েছে।”
কৌশিক মির্জা মুখে গম্ভিরতা বজায় রেখে নিশ্বাসের শব্দের ন্যায় ‘হুম’ শব্দ করল। অতঃপর তার শক্ত পেশল হাত ফাহিমের কাঁধে রেখে বলল,
“তোমার ভুলের মাসুল ঠিক কয় জনকে গুনতে হবে?”
ফাহিম ভরকে গেলো, কাঁধে রাখা কৌশিকের হাতটা মুহূর্তেই যেনো ভারী হয়ে গেলো। সে নিজেকে গুছিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল— “জ্বি?”
“ফ্যামিলি তে কয়জন আছে?”
“স্যার যদি অজান্তে কোন ভূল হয়ে থাকে তবে ক্ষমা করবেন কিন্তু আমার দোষটা?…”
“আমার ট্যারিটোরি(Territory) কোনটা জানো?”
“কি বলছেন স্যার এটা না জানার কি আছে?”
“তাহলে অবশ্যই এটাও জানার কথা যে তুমি যার দিকে দৃষ্টি ফেলেছো সে আমি ব্যতীত সকল পুরুষের জন্য নি’ষিদ্ধ।”
***
লুজ টাই আর সুট খুলে কৌশিক মির্জা পায়ের উপর পা তুলে বসেছে, তার সামনে তিরিক্ষ মেজাজে বসে আছে রায়হান তালুকদার। Las Vegas এর বহুল আলোচিত কুখ্যাত ড্রাগ লর্ড রোয়ান লুকাসের একজন রেগুলার ক্লায়েন্ট সে। আর রোয়ান লুকাস?
সে ভেগাসের একজন ক্লাব ওনার, আর ডিলার। এশিয়ায় ড্রা’গ সাপ্লাই সহ নির্দিষ্ট ক্লায়েন্টের ডিমান্ড অনুযায়ী মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে প্রো স্টি টিউ ট পেশায় থাকা নারীদের ভিআইপি ক্লায়েন্টদের সপে দেয়। ক্ষমতাবান কিছু মানুষের হাত ধরে এই দেশেও তার একটা জেন্টলম্যান ক্লাব খুলেছে। অদ্ভুত হলেও ইংরেজি নামে “জেন্টলম্যান ক্লাব” বলা হয় তবে কোন ভদ্র, শালীন আর মার্জিত ঘরের ছেলে মেয়েদের সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
কৌশিক হাত বাড়াতেই লেভিন একটা ফোন কৌশিকের হাতে ধরিয়ে দেয়, কৌশিক ফোনের ডিসপ্লে রায়হানের দিকে ফিরিয়ে ভিডিও অন করতেই দেখতে পায় তার আর সুমনার অ’ন্ত’রঙ্গ মুহূর্ত। সুমনা রেলমন্ত্রীর স্ত্রী, রেলমন্ত্রীই মুলত সুপারিশ করে তাকে এই পর্যন্ত এনেছেন।
এসব দেখা মাত্রই তার চোখ মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে যায়, ভয়ের চোটে তার সাংঘা তি ক কাঁপুনি উঠে গেলো। সে এবার ভাব ছাড়িয়ে কৌশিকের চরণতলে এসে তার পা জোড়া আঁকড়ে ধরে। মধ্যবয়স্ক রায়হান চোখে পানি নিয়ে আকুতির স্বরে বলল,
“আমি তোমাকে ক্ষমতায় বসাবো। কত টাকা লাগবে তুমি আমায় বলো?”
এসব ভন্ডামীর ধার ঘেষলো না কৌশিক মির্জা। সে কিছুটা ভাবুক হওয়ার অভিনয় করলো, এই অভিনয় সকলকে কনভিন্স করতে পারলেও একরেখা মেয়েটা বিশ্বাস করতেই চায় না।
ঘাড় এপাশ ওপাশ করে ফ্লেক্স করে নিলো সে। বেশ আয়েশি ভঙ্গিতেই বসা অবস্থায় বলল,
“আমার এসব কিছুই চাইনা।”
“তাহলে কি চাই?”
কৌশিকের শান্ত রূপ ভ য়ংক র, সে নিজেকে কাম আর কালেক্টেড রেখেই সময় নিয়ে বলে,
“রোয়ানের জেন্টেলম্যান ক্লাবের দুটো ভিআইপি মেম্বারশিপ।”
রায়াহান কপাল কুঁচকে ফেলে, ভি আই পি মেম্বারশিপ এমনি এমনি বিষয় না। সে মনে করল পুরুষ মানুষ, কৌশিক মির্জা না রী দে হে সু খ খোঁজার লক্ষ্যেই হয়ত ভি আই পি মেম্বারশিপ চাইছে। তবে কে জানে এটা রোয়ান লুকাসের সাথে যুক্ত দেশের ক্ষমতাশীল লোকদের জন্য ঠাণ্ডা মাথায় তৈরি করা একটা ফাঁদ।
“কিন্তু এটা তো লম্বা সময় নিবে আর রোয়ান সন্দেহ করবে।”
“তুমি আমার ডিমান্ড জানতে চেয়েছে, আমি বলেছি। তুমি অবশ্যই চাইবে না যে সে তোমার এসব কুকীর্তি জানুক।”
“দুই দুটো— সে যদি কিছু আঁচ করে ফেলে ?”
কৌশিক শ্রাগ করে সোফায় মাথা এলিয়ে দেয়, মুখে নির্বিকার ভাবে জানালো,
“ইটস আপ টু ইউ। ছয় মাসের মধ্যে আমি অন্তত একটা ভিআইপি মেম্বারশিপ চাই, মনে থাকে যেন?”
কৌশিক তার কথা বলে শেষ হওয়া মাত্র আর অপেক্ষা করল না। যেতে যেতে ছোট্ট একটা মেসেজে তাদের ইনফরমার কার্ডানকে জানিয়ে দেয়।
রায়হান তালুকদার হয়ত ন রা ধ ম, কি ট সমতুল্য। তবে কে বলেছে পুরুষ মানুষ অপেক্ষা করতে জানে না?
সবাই তো আর অধম হয়না।
কেউ কেউ দৃষ্টান্ত প্রমাণ ফেলে যায়। তারাই তো ভলোবাসাকে টিকিয়ে রাখতে লড়াই করে, করছে।
***
কৌশিকের কালো মার্সিডিজ থামে একটা কবরস্থানের সামনে। চারিপাশ শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ, আসেপাশে সুন্দর করে ফুলগাছ লাগানো। কৌশিক বুঝে পায়না তার বাবা , তোফায়েল মির্জা মানুষটা এতো জ’ঘ’ণ্য কেন? ক্ষমতার জন্য কিসের এত মায়া? তিনি কিনান মির্জাকে প্রশয় দিয়েছেন বলেই কৌশিকের সম্পূর্ন জীবন উল্টে পাল্টে গিয়েছে, প্রতিনিয়ত তাকে লড়তে হচ্ছে।
চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো সিমেন্টের তৈরি সমাধিতে খোদাই করে বড়বড় অক্ষরে লেখা নাম —
‘মুশফিকুর রহমান কিনান মির্জা’
কিনানের কবরে প্রাপ্য শাস্তি দেখার তার ভীষন ইচ্ছা। বড় ভাই মানে জান প্রাণ তবে তার বড় ভাই তার জান নিয়ে খেলা করবে জানলে সে এই বি’শ্বা’স ঘা’ত’ক কে জ্যান্ত রাখতো না।
“একই ঔরসের ভাই তুই আমার। অথচ বেঁচে থাকতে আমার সুখ কে ড়ে নিয়ে ছিলি আর ম রা র পরও তোর করা পাপের বোঝা আমাকেই টানতে হচ্ছে।”
কৌশিক শক্ত তবে ধরা গলায় তী’ব্র’বা’ন ছুড়ে। চোখ বন্ধ করে সে নিশ্বাস নেয়। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে তার বাবার বোকামির উপর।
“জানিস তোর বাবা তোফায়েল মির্জা তোর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে তোকে নারী ধা’ন্ধা’য় জড়িয়েছিল। আর তুই ভাবতিস তুই তার অতি প্রিয় পুত্র। বেশ হাস্যকর ব্যাপার!”
রাগ আর বিতৃষ্ণা নিয়ে কবরস্থান ছেড়ে চলে আসার আগে সে একবার কবরস্থানের মাটির দিকে তাকায়,
“ম রে গিয়ে তুই আমার থেকে বেঁচে গিয়েছিস, না হয় তোকে আমি নিজ হাতেই মে রে ফেলতাম।”
***
গভীর রাত, বেশ জোরে সোরে মেসেজের টুং টং শব্দ হলো। বিরক্তিতে নাক কুঁচকে ফেললো কাশফি, এই সময় তাকে মেসেজ কে দিলো? হাতিয়ে নাইট স্ট্যান্ডে রাখা ফোনটা খুঁজে নিয়ে কাশফি ফোনের স্ক্রিন অন করে নিভু নিভু চোখে দেখতেই আলোর কারণে কুঁচকে চোখ বন্ধ করে নেয়।
কোন রকম চোখ বড়বড় করে তাকাতেই সে চোঁখ ডলে নেয়। চোখ পিট পিট করে আবার চাইতেই তার ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেলো। কাঁচা ঘুম ভেঙেছে তাই চক্ষু লালাভ দেখাচ্ছে, বেশ কিছুক্ষণ অপলক মেসেজটার দিকে চেয়ে রইল, চোখজোড়া লাল হয়ে আছে তার।
“আপনাকে দুরে থাকার সুযোগ দিয়েছিলাম কাশফি, আপনি আমার কথা হেলাফেলা করলেন, ভেরি ব্যাড সানশাইন। বলুন তো কি শাস্তি দিই আপনাকে?”
হঠাৎ করে বেশ জোরে ফোন বেজে উঠলো। তৎক্ষণাৎ কাশফি ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে পড়লো। বুকে জামার অংশ খাঁমচে ধরে নাম্বারের দিকে দ্বিধান্বিত চোখে তাঁকিয়ে রইল। লাস্ট রিং বাজছে ঠিক সেই মুহূর্তেই কাশফি ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো,
“তিনটা নাম্বার ব্লক করেছেন আপনি আমার, হিসাব রেখেছেন ম্যাডাম।”
“আপনি আমার পিছু ছেড়ে দিলেই পারেন।”
“এত্ত সহজ?”
“চাইলে সব সহজ, প্লিজ আপনি আপনার পথে চলুন আর হুটহাট সামনে এসে আমাকে বিচলিত করবেন না, ইটস আ হাম্ভল রিকুয়েস্ট(It’s a humble request)!”
“কেন? আমাকে কি দেখে অস্থির অস্থির মনে হয়?”
“You speak highly of yourself, যা মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তির কর।”
অপর লাইনে কোন জবাব এলো না তাই কাশফি সুযোগ পেয়ে আবার শায়েস্তা করার ভঙ্গিমায় বলল,
“একটা ফ্রী এডভাইস দিলাম, আপনার এই দাম্ভিকতা চিরস্থায়ী হবে না।”
“আর আপনাকে আমি একটা অর্ডার দিলাম, আপনি এক্ষুনি আপনার ফোন নিয়ে নিচে নামবেন।”
কাশফি ভরকে গিয়ে দুরুদুরু বুকে ছুট লাগলো জানলার কাছে, তাদের বাড়ীর আঙিনায় কৌশিকের কুচকুচে কালো গাড়ি পার্ক করা, আর গাড়ীর হুডের উপর বসে আছে কৌশিকের পুরুষালী অবয়ব। কৌশিক তার থেকে ছয় সাত বছরের বড় হয়ত কিন্তু তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। একজন সুঠামদেহী পাকাপোক্ত পুরুষ, যে এখন সরাসরি কাশফির দিকে চেয়ে আছে।
ভ’য়ংক’র সেই চাহনী, কাশফি পুরোপুরি থমকে যায়, তাকে এভাবে দেখে অপ্রস্তুত এবং বিব্রত হয়ে পরে। সে অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল—
“আপনি এখানে কেন?”
“আপনাকে দেখার ভীষন ইচ্ছে জাগছিল।”
“আর আপনার মনে হয় আমি নিচে নেমে আপনার সাথে দেখা করাটা এক কথায় মান্য করব?”
“Of course.”
“বাধ্য নই।”
“আপনি কি আমার অবাধ্য হচ্ছেন তবে?”
“যা ইচ্ছে মনে করুন, আই ডোন্ট গিভ আ ড্যাম।”
কাশফি নিজেকে শক্ত আর নির্ভীক প্রমাণ করতে কথাটা বলেছে কিন্তু কৌশিকের পরবর্তী বাক্য শোনা মাত্রই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো,
“আপনি এক্ষুণি নিচে নামবেন নাহয় আমি উপরে উঠে আপনার রুমের আসছি।”
“দরজা ভিতর থেকে আটকানো।”
“তাহলে চাইছেন আমি চিৎকার করে আপনাকে ডেকে পুরো এলাকা সজাগ করে দিই।”
“আপনি এমন কিছুই করবেন না।”
“Try me.”
“আপনি…”
কাশফির দুর্বল কন্ঠের বাক্য পূর্ন হওয়ার আগে কৌশিক কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে,
“আপনি নিচে নামবেন রাইট ফা’কিং নাও কাশফি।”
“কিভাবে কি? আপনি পাগল হলেন নাকি?”
“আমি কাউন্ট ডাউন করছি, থ্রী, টু…”
কৌশিকের ভরসা নেই তাই কাশফি তড়িঘড়ি করে বলে,
“আমি আসছি, আমি আসছি, সময় দিন।”
“জাস্ট টু মিনিটস।”
আদেশের সুরে বিড়বিড় করে বলে লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিলো।
কাশফি ফোন হাতে কোন রকম ওড়নাটা গলার দুই পাশে ঝুলিয়ে রূম থেকে বের হয়। বের হতে হতে নিজের কপাল চাপড়ালো সে।
কত বড় গণ্ডমূর্খ সে! বিড়াল হয়ে বাঘের সাথে পাল্লা দিতে গিয়েছিল।
নিঃশব্দে পা টিপে টিপে মেইন দরজা খুলে বের হয়ে এসে দেখে কৌশিক এখনো নির্বিঘ্নে গাড়ির হুডের উপর বসে আছে। তার টাইটা লুস হয়ে গলায় ঝুলছে, ওয়েস্ট কোট আর সুট গায়েব। শার্টের হাতা ফোল্ডেড, গুটিয়ে উপরে তোলা। ইন করা শার্টের নিচের দিকের ভাঁজ কিছুটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। হাতের দামী ঘড়ি এখনো আগের অবস্থানেই আছে।
কৌশিক ছো মেরে কাশফির হাত থেকে ফোন নিয়ে তার নাম্বার গুলো ব্লকলিস্ট থেকে বের করে নিলো। তার চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি। কাজ শেষে কাশফির দিকে ফোন বাড়িয়ে দিলো।
দুই হাত দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকা কাশফি কৌশিকের পানে অসহায় চোঁখে চায়। এরপর হতাশামিশ্রীত কন্ঠে বলল,
“আপনি এমন কেন করেছেন?”
কৌশিক গম্ভির স্বরে বলল,
“আপনি বুঝতে পারছেন না? নাকি বুঝতে চাইছেন না?”
“আপনাকে বোঝার সাধ্য আমার নেই কৌশিক।”
“আমি আপনার আশায় থাকা চাতক পুরুষ আর আপনি আমার একান্ত নারী।”
“অসম্ভব! আপনি এত মেয়ে থাকতে আমার কাছে আসবেন এমন আজাইরা কথা বিশ্বাস, আমি ঈশিতা কখনো করব না। মতলব ছাড়া আগানোর মানুষ আপনি না!”
“তিন চামচ বেশি বুঝেন, আমি তো অন্য কাউকে নয় আমার জ্বলন্ত শিখা কাশফি কে চেয়েছি।”
“আমি আপনাকে চাই না।”
কাশফির সোজা সাপটা জবাবে কৌশিক কিঞ্চিৎ হাসে তবে এই হাসি ক্ষণিকের মধ্যে উধাও হয়ে গেলো। সে কাশফিকে নরম স্বরে বলল,
“তাহলে আপনি আমাকে কি ভাবেন সেটাই বলুন।”
“আপাদত মনে হচ্ছে আপনি নতুন শিকার পেয়েছেন, একটা খেলা খেলবেন। আমাকে প্রেমের বেড়াজালে ফাঁসিয়ে শরীর উ প ভো গ করার খেলা।”
বেফাঁস কথা বলা মাত্রাই কাশফি ভয়ে জমে গেলো যেন। কৌশিকের নির্জীব তবে তির্যক চাহনি উপেক্ষা করতে পারলো না। কৌশিক তার চোয়াল শক্ত করে নেয়, হাতের মুষ্ঠি একবার খুলে বন্ধ করে নিলো অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে নেয়। মিনিট খানেক পর সে গুরুগম্ভীর হয়ে রুক্ষ কন্ঠে বলে,
“আজ দ্বিতীয়বারের মতো যা করলাম না, তারই অপবাদ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন আপনি। অন্যকেউ হলে এতক্ষণে এক চ ড়ে হসপিটাল এডমিট হয়ে যেতো কিন্তু আপনার উপর রাগ উঠলেও হাত উঠতে বুক কাঁপে। তাও আপনি বুঝছেন না?”
কাশফির পিলে চমকে উঠলো, চোঁখ জোড়া ছোট ছোট করে বলল,
“দ্বিতীয়বার? আশ্চর্য, আমি পার্সোনালি আপনাকে কবে থেকে চিনি? আর এসব বুঝাবুঝির দরকার আমার নেই।”
“আলবাত আছে, আমায় পার্সোনালি চিনতে ইচ্ছুক?”
“মোটেই না। আপনার ফালতু সব কথাবার্তা অনেক সহ্য করেছি, সুতরাং যেই পথ দিয়ে এসেছেন সেই পথেই ফিরে যান আমাকেও যেতে দিন।”
“যাবোই তো এত তাড়া কিসের? আগে একটা বিষয় ক্লিয়ার করে নিই।”
কাশফি ভ্রূ কুঁচকে ফেলে, কৌশিক এসব কিছুর পরোয়া না করে তাদের দূরত্ব ঘুচিয়ে নেয়। তারা ঠিক ততখানি দুরত্বে অবস্থান করছে যতখানি অবস্থানে থাকলে একে অপরের নিশ্বাসের মিলিয়ে পড়া শব্দ শুনতে পায়। কৌশিকের গরম নিশ্বাস কাশফিকে ছেয়ে গেলো।
“আপনি সর্বদা আমার নিকট পবিত্র কাশফি। কথা দিলাম আমি, কৌশিক মির্জা, কোন অধিকার বোধ ছাড়া আপনাকে ছুঁয়ে দেখবো না। আর আপনি কৌশিক মির্জার এই পবিত্র আমানত খিয়ানত করতে দিবেন না।”
কাশফি হতবিহ্বল তাকে আবার কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে বলে ঊঠে,
“মনে থাকবে তো?”
কাশফি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো কেবল। কথাগুলো বোধহয় মাথার উপর দিয়ে গেলো। প্রত্যুত্তরে কৌশিক মির্জা একটা আময়িক হাসি হাসে। এই হাসি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম হাসি মনে হলো তার। পুরুষের হাসি এত মন্ত্রমুগ্ধ হতে নেই। গোটা নিষ্ঠুর, নির্মম একজন মানুষ অথচ এই হাসিটা এতটা স্নিগ্ধ এত বিশুদ্ধ, আদো কি সম্ভব?
কৌশিক সোজা হয়ে দাড়িয়ে যায়, কাশফির আরো কাছে দাড়িয়ে ঠিক তার চোখে চোখ রাখে, যেনো সে কতশত আলাপ বসিয়েছে সেথায়। তবে মুখে কেবল মিনমিনে স্বরে আওড়ালো —
“নিজের খেয়াল রাখবেন, সানশাইন।”
কাশফি কিছু একটা বলতে নিলেও আর বলা হয় না, তার গলা ধরে আসলো যেনো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো কৌশিক মির্জা কাশফির জীবনে শৈত্য প্রবাহ হয়ে এসেছিল যা বসন্তের আগমনে হারিয়ে যাবে। ততক্ষণে কৌশিকের ব্ল্যাক মার্সিডিজ গাড়ি চলতে শুরু করেছে, যেতে যেতে এক সময় দৃষ্টির অগোচরে হয়ে যায়। আমানত? সে কারো আমানত নয়? মেয়েরা স্বামীর আমানত শুনেছে সে কিন্তু…
আকাশ কুসুম ভাবনার অন্তরে তার নাকে সুরসুর করে পুরুষালী কোলনের ঘ্রাণ এলো, এবার নিজের দিকে খেয়াল দিতেই দেখলো কৌশিক তার হাতের কোট খানা বেখেয়ালি কাশফির দুই কাঁধে জড়িয়ে আছে। কবে পরিয়েছে? কখন?
দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ফজরের আযানের ধ্বনি, নতুন ভোরের ডাক। তবে এটাই কি বিদায়? অবসান ঘটবে তার দুশ্চিন্তার?
কক্ষনো না! বোকামির চরম পর্যায়ের চিন্তাভাবনা রাখা কাশফি হয়ত বুঝলোই না যে আলো ছাড়া আধার অস্তিত্বহীন।
#চলবে…
বেশ বড় করে দিয়েছি, মন্তব্য করতে ভুলবেন না আর যারা মন্তব্য করেছেন তাদের ধন্যবাদ। গল্প ভালো লাগলে আমার ছোট পেইজটা শেয়ার করে দিবেন।