অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৯) #লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী ১৯. (Edited)

0
118

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (১৯)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

১৯. (Edited)
অতীত:

(কল্পনা/ অতীত)

“জুন ভাইয়া!“
এক হাতে পুতুল জড়িয়ে ধরে সারা ঘর পায়চারি করছে ছোট পাঁচ বছরের মেয়েটা। নরম পায়ের প্রতি পদে ঝুন ঝুন নূপুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে দোল খাচ্ছে কানে। কিছুক্ষণ পর পর নাকে বিধছে আতর আর ধূপের ঘ্রাণ। পূর্ব বিচলিত মেয়েটা সেই নিয়ে ভাবান্তর ঘটালো না। আপাতত তার এখন জুন ভাইয়ার সাথেই গুরুত্বপূর্ন কথা আছে। গুটি গুটি পায়ে অন্ধকারে রুম খুঁজে নেয়। প্রতি দিনের মতো কর্নারের রুমটায় তার নানা ভাইয়ের গুনগুন শব্দে জিকির আর হাতে তাসবির শব্দ সে শুনতে পেলো না। বহিরাগত হয়ে সাই সাই করে আসা ঠান্ডা বাতাস পরিভ্রমণ করছে রুম জুড়ে।
জুন ভাইয়া বুঝি আজ নানার সাথে নামাজ শেষে মুনাজাত টুকুও করলো না? মেয়েটার একটু রাগ হলো। জুন ভাইয়া তো বললো সে প্রতিনিয়ত তার গর্দভের জন্য নামাজ শেষে মুনাজাত ধরে। তাহলে আজ?
মুখ ফুলিয়ে ছোট মেয়েটা খোলা জানালার কাছে এসে দাড়ালো, তবে নানা ভাইয়ের রুমের জানালা কিছুটা উচুঁ হওয়ায় জানালার বাইরের দৃশ্য দেখতে পেলো না।

তাই জুতো জোড়া খুলে কোন রকম হাত পা আকড়ে খাটের উপরে উঠে সে, উঠেই চলে যায় জানালার সামনে। তার নানা প্রায়শই বিরশ মুখে বাইরে তাকিয়ে তার নানুর কবর দেখতেন। তবে ছোট মেয়েটা আজ ব্যতিক্রম কিছু দেখলো। তার নানুর কবরের পাশের জায়গাটা আর খালি নেই, পাশাপাশি খুড়া হয়েছে আরেকটি কবর। আধারে চারজন আবছা অবয়বকে দাঁড়িয়ে কবর খুঁড়তে দেখে মেয়েটা ভয় পেয়ে দূরে ছিটকে যায়।
তার নানা উদাস মনে বহুবার বলেছেন, তার নানীর পাশের কবরটাই তার শেষ ঠিকানা। তবে কি?…
মেয়েটা এসব কিছু ভাবতে চায় না, দৌড়ে বের হয়ে খুঁজতে লাগলো তার মা কে।
মায়ের রুমে সজোরে ধা ক্কা দিয়ে দরজা খুলেই যেনো বে কু ব বনে গেলো। এটা তো আরেকটা বাড়ি,
ঠিক বাড়ি নয়, এটা তার বাসা!

সে স্তম্ভিত পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো তার বাসার মেইন ফটক। চকচকে ফ্লোরে তার প্রতিবিম্ব দেখে আরো ঘাবড়ে যায়। তার গায়ে ফ্রকের পরিবর্তে সেলোয়ার কামিজ, কাঁধের একপাশে ওড়না মাটি ছুঁই ছুঁই হয়ে ঝুলছে। নিজের অবয়বে নাবালিকার পরিবর্তে একজন পরিপূর্ণ নারী দেখে খানিকটা থমকে গেলো।

হয়ত স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে?

কাশফি হেঁটে হেঁটে তাদের বসার রুমটায় পৌঁছেই পিলে চমকে উঠলো। সোফায় তার বাবা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। এক ছুটে বাবার হাত ধরে পালস চেক করে নেয়, বেশ দুর্বল রেট। মনে মনে ভয় আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।

“বাবা, তুমি চোঁখ খোলো প্লিজ!”
কাঁদো কাঁদো স্বরের কথাটা কিছুটা বোধহয় আতিকুর রহমানের বোধগম্য হলো, তবে চোঁখ খুলার প্রচেষ্টায় তিনি ব্যাহত হলেন। কাশফি কোন রকম বাবার পকেট থেকে ফোন হাতড়ে বের করে এনে ডায়াল প্যাডে ৯৯৯ চাপতেই কল রিং হওয়ার আগেই কেটে গেলো।

লক্ষ্য করতেই দেখতে পেলো নেটওয়ার্ক নেই। কাশফির ইচ্ছে করলো ভাগ্য কে গালমন্দ করতে।

“বাবা, আমার গায়ে ভর করে হাঁটতে পারবে তো?”

আতিকুর রহমান নিশ্চুপ। হতাশ হয়ে কাসফি বাবার হাত কাঁধে তোলার জন্য টানার পূর্বেই উপর থেকে ঠকঠক করে জুতোর শব্দ শুনতে পেলো। তৎক্ষণাৎ তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে তার পিছনেই কেউ দাঁড়িয়ে তাকে বাজপাখির মতো পরখ করতে ব্যাস্ত।
কাশফি সন্তপর্নে ওড়নার নিচে হাত ফেলে টি-টেবিল থেকে আলগোছে ফ্রুট কাটারটা হাতে গুঁজে নেয়। এবার মেরুদন্ড সোজা করে সাহস জুটিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। তবে ভুলে যাওয়া সেই চির পরিচিত Predator কে দেখা মাত্রই অপ্রস্তুত কাশফির নিশ্বাস আটকে আসে।

এলোমেলো ঘাড় ছুঁইছুঁই চুল, কয়লা রঙের জিন্স আর অফ হোয়াইট শার্ট পরনে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা, টাই লুজ হয়ে গলায় ঝুলছে বলা যায়। গম্ভীর মুখে মুখে কঠোরতা আর চোখে রাগের দীপ্তিমান অগ্নিশিখা নিয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে, দৃষ্টি যেনো এক কাশফিতেই বদ্ধ।

“দেখলেন কাশফি, আপনাকে আমি ভুলতে দিইনি।”

সেই পুরানো কর্কশ— হাস্কি, ডমিনেন্ট, পুরুষালি গম্ভীর গলা শুনে তার গায়ে যেনো প্রচণ্ড তেজে ইলেকট্রিক শক অনুভব করলো।
কাশফি সোফা ধরে নিজেকে ধাতস্থ করলো। একবার তার বাবা আরেকবার কৌশিক মির্জাকে দেখে নিলো। গলায় কথার দলা পাকিয়েছে কিন্তু ভয়ে তার শব্দ আর বেরুলো না।

“Did you miss me?”

“আমার বাবাকে…?”
বাকিটুকু কথা কাশফির গলায় আটকে রইলো। কৌশিকের মুখে তৎক্ষণাৎ সিগনেচার বাঁকা হাঁসির আবির্ভাব ঘটলো।

“তোমার বাবা বোধহয় তোমার মাকে মিস করছিলেন।”

কাশফি নির্বাক!
সে তর্কে জড়াতে চায় না, পশুকে মনুষ্যত্ব শেখানো আদো কি সম্ভব! পরাজিত হয়ে তাই গলা নিচু করে বিনয়ের স্বরে বললো —
“বাবার চিকিৎসার প্রয়োজন, প্লিজ।”

কৌশিক তার ক্যালকুলেটেড স্টেপ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কিছুটা ব্যাঙ্গতক সুরে আফসোস করে,
“Little too late!”

কাশফি প্রতিবাদ করে কিছু বলার পূর্বেই দেখতে পেলো কৌশিক হল’স্টার হতে রি’ভ’লভা’র টেনে বের করে তার ভ্রুদ্বয়ের মাঝ বরাবর তাক করে ধরলো। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটলো যে কাশফির ঠিক হজম হলো না। একবার রিভলভার আরেকবার কৌশিকের চোঁখে চোঁখ রেখে পরখ করলো।

মৃত্যুর ভয় কার নেই? নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে সে লুকিয়ে রাখা ছু রি টা নিক্ষে প করতে নিলেই কৌশিক তার একহাত ধরে ফেলে, অন্য হাত দিয়ে কৌশিকের মুখে নখের আঁচড় দিয়ে বাঁচতে চাইলে কৌশিক দুহাত তার মুঠোয় শক্তভাবে পুরে নেয়। কিছু বোঝার আগেই কাশফিকে কাচের গোল টেবিলে ছু ড়ে ফে লা হয়, পরক্ষণে শক্ত পুরুষালি হাতের দম’রু’দ্ধকর মু’ষ্ঠি তার গলা চে পে ধরে। এবার সে জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে ভয়ে চোঁখ মুখ শুকিয়ে যাওয়া কাশফির চোঁখে চোখ রেখে রিভলভার কপালে ঠেকিয়ে ধরলো,

“হ্যাপি ফ্যামিলি রিইউনিয়ন, সুইটহার্ট!“

(কল্পনার সমাপ্তি)

দুঃস্বপ্নের পরিশেষে রাতের বিদঘুটে অন্ধকারে একপ্রকার দম বন্ধ হয়ে কাশফির ঘুম ভেঙে যায়। মুখখানা ঘেমে নেয়ে একাকার। কৌশিক মির্জা নামক মানুষটা কেবলই তার দুঃস্বপ্ন এই বুঝ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলে আকস্মিক তার হাতে টান পড়লো। প্রথমে ভয় পেলেও পরে হাতড়ে হাতড়ে বুঝতে পারলো যে, তার হাত দুটো হার্ড বোর্ডের সাথে দড়ি দিয়ে বাধা। মুহূর্তেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেলো!

তার রুমের দরজা জানালা সব বন্ধ, তাহলে কেউ কি করে ভিতরে এলো?

কম্পিত হাতে কাশফি গিঁট খুলতে নেয়, খোলা মাত্রই ভয়ার্ত কাশফি শুন্য মাথায় দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকেই তার পায়জামা আর নিজেকে চেক করে নিলো। সব ঠিক ঠাক জানা সত্ত্বেও অজানা ভয় হানা দিতে থাকলো তার মাঝে। তবে কি…?

চোঁখ বুঝে সে মনে ঢের সাহস জুটিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রুমের বাতি জ্বালিয়ে দিলো, তবে আরেক দফায় আশ্চর্য হলো। তার খাটের নিচে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে একটা নুপূর। এই নুপূর তো কাল সে তার দরজার সামনে পড়ে থাকতে দেখেছিল। তবে ধারণা করেছে এটা জোভান নামের উদ্ভট লোকটার দেওয়া।
খাটের দিকে পরখ করতেই তার ভয় এবার জেঁকে বসলো। নিশ্বাসের উঠানামা অগ্রাহ্য করে সে বড়বড় চোঁখে খাটের হার্ডবোর্ডে লাগানো স্টিকি নোটের হ্যান্ড রাইটিং পড়ে নেওয়া মাত্রই নোট খানা টেনে ছিঁড়ে দূরে ছুড়ে ফেলে।

বরংবার মাথায় শুধু একটা নাম ঘুরপাক খাচ্ছে আর নোটের শব্দগুচ্ছ—
“আমাকে রাগানো ভুল সিদ্ধান্ত বোকা মেয়ে। আমানত খিয়ানত করার শাস্তি কি জানো?”

সেই রাত বোধহয় দুইজন মানুষ নির্ঘুম কাটিয়েছেন, একজন ভোরের আলোর অধীর অপেক্ষারত Predator অন্যজন তার Prey।

***

আতিকুর রহমান ব্যাস্ত মানুষ তবে ইদানিং তিনি মহা ঝামেলায় আছেন। এই যে একটা দামড়া ছেলে প্রতিদিন তার বাড়ির আশেপাশে ঘুর ঘুর করে, তাকে আসতে যেতে সালাম দেয়, প্রতিদিন তাকে চা খেতে বা নাস্তা করতে ডাকে। এমন আরেকটা আজব কান্ড আজ বাধিয়েছে ছেলেটা।

এসব নিয়ে ইদানিং তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে টুকটাক কানাঘুষা শুনেছেন, তাই ভেবেছেন একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন তার মেয়েকে, যে ছেলেটা কি কোন সমস্যা করছে কিনা? তবে আসলে ছেলেটা তো কোন সমস্যাই করছেনা।

আজ আতিকুর রহমান বিরক্ত হয়েছেন বটে। তিনি সোজা মুখে বলেছেন মেয়ে বিয়ে দিবেন না। তবুও এই ছেলের থামার জো নেই। তাছাড়া ছেলেটার পরিবারই তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তিনদিন আগে ছেলেটার বাবা তার স্কুল পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন, এরপর ইনিয়ে বিনিয়ে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা তুলেছেন। তখন মেয়ে বিয়ে দিবেন না বলার পরও আজ তাদের জন্য কেটে কুটে পাঁচ কেজি দীঘির মাছ পাঠিয়েছে।

আতিকুর রহমান ভেবে পাচ্ছেন না যে তিনি শুকরিয়া জানাবেন না লজ্জা পেয়ে চুপ থাকবেন। তার মেয়েটা খুব একটা কথা বলে না। এসব দেখেও বিশেষ হেলদোল নেই তার মাঝে, তাই তার ভয়ের কোন কারণ ছিল না। অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন এখন এসব নিয়ে কথাই বলবেন না, আরো কয়েক দিন গেলে না হয় দেখা যাবে।

টুকটাক কাজ শেষে তিনি হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে ভাবলেন, সাড়ে আটটা বেজে চলছে অথচ কাশফি এখনো উঠলো না? ভাবলেন রাত জেগে পড়াশোনা করেছে হয়ত, তাই আর জাগ্রত করার জন্য উপরে গেলেন না।

***

কাশফি হন্তদন্ত হয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ে। স্যারের লেকচার গুলো নোটে না তুললে, পরে সে পরীক্ষার আগে হায় হুতাশ করেও মিলাতে পারবেনা। এদিকে ভয়ে আর রাগে রাতের ঘুম না হওয়ায় চোঁখে নিচে কালি জমে গেছে। যা একটু ঘুম হয়েছে সকাল সাতটার পরে।

ধুপধাপ নেমে কলেজে গেইটে প্রবেশ করার পূর্বেই রিক্সা ওয়ালা গলা উঁচিয়ে ডাকলেন —
“কি গো আফা ভাড়া দিবেন না?”

কাশফির মাথায় চট করে ঢুকলো যে, সে ভাড়া পরিশোধ না করেই প্রস্থান করছিল। ইতস্তত হয়ে ব্যাগ ঘটাতে ঘাটতে ঘটে আরেক বিপত্তি। তার ম্যানি ব্যাগটা তাড়াহুড়োয় বাসায় রেখে এসেছে হয়ত।
লজ্জায় নাস্তানাবুদ হয়ে রিক্সা ওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলে —
“চাচা একটু অপেক্ষা করেন আমি ভাড়া শোধ করে দিবো।”

রিক্সা ওয়ালা চাচা বিরক্ত হয়ে চোঁখ কুচকে ফেসফেসে গলায় বলে—
“আগে কইতেন ট্যাহা নাই, বহাইয়া রাইখ্যা আমার লস কেন করবার?”

কাশফি অপরাধীর ন্যায় নিচে তাকিয়ে তার ফোন বের করে ঈশান কে কল করে,

“কিরে তুই এই টাইমে কেনো কল করলি? জানিস না আমি ক্লাসে?”

“ভালো করে জানি তুই ক্লাস না করে কোনো দোকানে আড্ডা দিচ্ছিস। কথা না বাড়িয়ে কলেজের সামনে আয় আমি টাকা আনতে ভুলে গিয়েছি।”

“পাঁচ মিনিটে আসছি।”

কল শেষ হতে না হতেই নিজের পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে, বিরক্ত হয়ে সরে দাঁড়াতে বলার পূর্বে চিরচেনা ক্লোনের মাস্কি ঘ্রাণ সুরসুর করে নাকে এসে বিধলো। ইন্দ্রীয়ে অনুভব হওয়ার ক্ষনক্রমেই ঝড়ের বেগে শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল শিহরণ নেমে গেলো।

ঠিক যেনো কোনো দুঃ’স্বপ্নের মতো!
কাশফি ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে কাঁধে থাকা ব্যাগের স্ট্র্যাপটা শক্ত করে ধরে। নিজেকে ধাতস্থ করে, পিছনে ফিরে দেখার কৌতূহল গিলে নেয়। তৎক্ষণাৎ তার বাহুতে শক্ত পেশল বাহুর ছোঁয়া লাগা মাত্র আড় চোখে পরনের অফ হোয়াইট শার্টটা দেখে সে যেনো থমকে গেলো।

হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ এমনিই চেয়ে রইল, তার মানে কি সে কাল রাত মানুষটা কে দেখেছিল কিন্তু রেসপন্স করেনি?
দপ করে তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। ঘৃণায় গা রি রি করছে তবুও সে কোন বাক্য ছুড়লো না। এখানে আপাদত কোনো সিন ক্রিয়েট করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তাই নিজের রাগ আর ঘৃণা দমিয়ে রাখলো। মুখ সম্মুখে ফিরিয়ে এমনভাবে অবস্থান করলো যেনো সে কৌশিক মির্জা কে চোখেই দেখে নি।

কাশফির পাশে কৌশিক মির্জাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মধ্যবয়স্ক রিক্সা চালক রিক্সা থেকে নেমে দাড়িয়ে পড়েন। সে খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে সুন্দর করে সালাম দিলো। কৌশিকের নির্জীব আঁখি কালো চশমায় ঢাকা। বেশ শান্তভাব মূর্তি বজায় রেখে পকেট থেকে পাঁচ হাজারের নোট এগিয়ে দিয়ে রাশভারী কন্ঠে বললো—
“ম্যাডাম কে প্রতিদিন কলেজে আনা নেওয়ার দায়িত্ব আপনার। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা করে পাবেন। আর যেনো রাস্তাঘাটে এভাবে কাউকে অপদস্থ করতে না দেখি, আপনার হক তাই সুন্দর করে চাইবেন।”

“জে আইচ্ছা।”

কাশফি হতচকিত হয়ে তাকিয়ে ছিল এতক্ষন, ধ্যান ভাঙলে কৌশিকের দিকে রাগে গজগজ করে শক্ত কন্ঠে বলে—
“আপনার দয়ার প্রয়োজন ছিল না, আমি ভাড়া শোধ করতে পারব!”

কৌশিক তার কথা কানে না তুললে সে রিক্সা চালকের দিকে তাঁকিয়ে শক্ত পুরুষালি কণ্ঠে বলে —
“চাঁচা উনার টাকা উনাকে ফিরিয়ে দিন আমি আপনাকে ভাড়া পরিশোধ করব বলেছি তো।”

পরপর শোনালো কৌশিকের হাস্কি কণ্ঠের কাঠ কাঠ জবাব —
“আমার কথার অবাধ্য হওয়া আমি পছন্দ করি না বুঝলেন তো?”

রিক্সা ওয়ালা চাচা মাথা নেড়ে কাশফির দিকে তাঁকিয়ে বলে — “ম্যাডাম, আমি অফেক্ষা করুম।”

চাঁচা টাকা পেয়ে খুশি হয়ে আর কিছুই বললেন না। এদিকে কাশফি দাঁতে দাঁত চেপে আশেপাশে পরখ করে নেয়। ঠিকই অনেক জন তাদের বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেছে। কাশফি জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো। গলার আওয়াজ খানিকটা নিচে নামিয়ে তবে তেজী স্বরে বলল—
“মির্জা সাহেব, আপনার সমস্যাটা কি?”

কাশফির মির্জা সাহেব ডাকটা কৌশিকের ঠাট্টা সমতুল্য মনে হলো। সে তো কাছের মানুষ, এসব বললে কি মানায়?
সে চোখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে অগ্নিশর্মা হয়ে থাকা কাশফিকে দেখে। এলোমেলো চুল কোনরকম প্যাঁচিয়ে ক্লিপ লাগিয়ে রেখেছে, ছোট ছোট চুল কপালে পড়ে আছে। ঘুমুঘুমু চেহারার ফুলো ফুলো চোঁখে যেন আরো স্নিগ্ধ লাগছে। হয়ত তার কারণে ঘুম হয়নি আর যা ঘুমিয়েছে পরে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছে ম্যাডাম। কাশফির উচ্চতা কৌশিকের বুক পর্যন্ত। তাই সে তার প্রশস্থ দেহ কিছুটা ঝুঁকে কন্ঠ নামিয়ে শাসনোর সুরে বলে —

“নেক্সট টাইম কলেজে এভাবে যাতে না আসতে দেখি।”

“কী?”

“আপনার এমন স্নিগ্ধ মোহিনীরূপ অন্যকেউ দেখবে সেটা আমি চাইনা।”
কাশফি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। আর নিজেকে দমিয়ে না রাখতে পেরে চোখে মুখে একরাশ ঘৃণা নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,

“আপনি ফিরে এলেন কেনো আবার? আমাকে কি দু দণ্ড শান্তি দেওয়া যায় না?”

“নিজের পাওনা আদায় করে নিতে এসেছি কাশফি। বলেছিলাম, ভুলতে দেবো না আপনাকে।”

“হেঁয়ালি করেছেন?”

“না তবে যাওয়ার আগে ওয়ার্ন করেছিলাম।”

“আমি আপনাকে ভয় পাইনা!”

কৌশিক তার সুঠাম দেহ দৃঢ় করে কাশফির সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। তৎক্ষণাৎ কাশফির শ্বাস আটকে আসার জোগাড় যেনো। ততক্ষণে কৌশিক আঙ্গুলের আলতো স্পর্শে কাশফির গালে পরে থাকা চোখের পাঁপড়িটা তুলে নেয়,

“Convince yourself that you are not afraid of me, Kashfi. Yet, I keep stealing your sleep, don’t I?”
(অর্থ: “নিজেকে বোঝাও যে তুমি আমাকে ভয় পাও না, কাশফি। তবুও আমি ঠিকই তোমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছি, তাই না?”)

কৌশিক আর দাড়িয়ে না থেকে রাস্তার অপর পাশে পার্ক করা, মেটালিক সিলভার বিএমডাব্লিউর ড্রাইভিং সিটে থাকা লেভিনের চোখে চোখ রাখতেই বিএমডাব্লিউটা তার সামনে এসে থামে। সে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠার পূর্বে তার সিগনেচার স্মার্ক মুখে এনে থমকে দাড়ায়। পরক্ষণে ঘাড় ঘুরিয়ে বিব্রত হয়ে থাকা কাশফির দিকে ফিরে তাকায়। অতঃপর তড়িৎ বেগে মুখ কাশফির কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,

“কাল আমারও ঘুম হয়নি কাশফি। চলুন বিয়ে করেই নাহয় দুজন এক বিছানায় শান্তির ঘুম দিবো।”

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here