অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৫) #লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

0
54

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৫)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

“Are you having second thoughts.”
ইয়ারিংয়ের লুপ কানে লাগতে গিয়ে তার হাত থেমে যায়, আয়নার মধ্যে দৃষ্টি রেখেই উৎসুক হয়ে থাকা তরীর দিকে চাইলো। আসলেই তো তার এই বিয়ে নিয়ে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। ইচ্ছে করছে ছুটে অন্যত্র পালিয়ে যেতে কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। অন্তত সে তার বাবাকে মাথা হেট করে অপরাধীর ন্যায় শাস্তি দিতে চায় না।
হালকা কাজের ফিকে গোলাপি রঙের একটা ড্রেসের সাথে কানের দুল আর জুতো মিলিয়ে সে শেষবার নিজেকে আয়নায় দেখে নেয়। আজ তার এনগেজমেন্ট পার্টি, সুমন শিকদারের বড় পরিবার আর বেশ রমরমা ব্যাবসা। তাছাড়া জোভান বেশ নামকরা পার্সোনালিটি হওয়ায় আয়োজন ছোট করে করতে চাইলেও ফ্যামিলি ছাড়াও কিছুসংখ্যক লোকজনের ভিড় জমেছে বেশ। এটা নিয়েও তার মাঝে নার্ভাসনেস কাজ করছে প্রচুর।

“একটু বাইরে যাবি? আমার না একটু একা থাকা প্রয়োজন।”
কাশফির শুকনো কণ্ঠে তরী আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। কেবল মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। কাশফি হেরফের না করে পার্স থেকে ফোন বের করে থ্যারাপিস্টের কাছে কল লাগলো। ডক্টর খান তখন বাসায় ফিরছেন মাত্র, কাশফির কল দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে গেলেন।

“কোনো সমস্যা ঈশিতা?”

কাশফি চোঁখ বন্ধ করে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নেয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সে আজ জেনেই ছাড়বে তাই গড়গড় করে সব বলে দিলো,
“সে সফট বয়, আমাকে প্রচুর ভালোবসে কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসতে পারছি না। তার সাথে নিজের চলা ফেরা বড্ড বেমানান মনে হয়।”

ডক্টর খান বোধহয় চমকালেন, তিনি কিছুক্ষণ কোনো শব্দও করলেন না। কাশফির মনে হলো ডক্টর খান তার কথায় বিরক্ত হয়ে কেটে দিয়েছেন কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে ডক্টর খানের বিস্ফোরিত কণ্ঠ কানে এলো কিছুক্ষনেই,
“তুমি এসব তোমার এনগেজমেন্টের আগে বলছো?”

ডক্টর খান থেমে গিয়ে নিজেকে শান্ত করে আবার বললেন,
“তুমি যদি প্রেসারাইজড ফিল করো তবে লেট মি হেল্প ইউ বাই টকিং উইথ ইউর ফাদার।”

কাশফি অতি দ্রুত না জানিয়ে দিলো,
“না না প্লিজ এমন করবেন না, আমি চাই আমার ফিয়ন্সের সাথে মানিয়ে চলতে, প্লিজ আমাকে হেল্প করুন!”

“ওকে”
তিনি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
“তার প্রতি তোমার অনুভূতি কেমন?”

“তাকে নিরাশ করতে চাই না আমি তাছাড়া আর কিছুই ফিল হয় না।”

“সে তোমার প্রতি কেমন?”

“আমাকে জানতে ভীষণ আগ্রহী, ক্যারিং আর অনেক বছর আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করেন।”

ডক্টর খান গম্ভীর হয়ে রইলেন,
“দেখো ঈশিতা সাইকোলজির ভাষায় বলা যায় তোমার ইনার চাইল্ডটা ভালবাসা না পেতে পেতে অভ্যস্ত তাই সে এতখানি ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারছে না। তার প্রতি তোমার দয়া হয় কারণ সে তোমাকে ভালোবেসেছে।”

“এসব ঠিক হওয়ার কি কোনো সুযোগ নেই?!”

“নেই বলবো না এটা অনেক লম্বা প্রসেস। যদি তুমি চাও তার সাথে থাকতে তাহলে ইউ হ্যাভ টু ফিগার আউট ফার্স্ট অ্যান্ড দেন টেইক থিংস স্লোলি (you have to figure out first and then take things slowly)।”

কাশফি কেবল শুনে গেলো, আর কিছুই বললো না। এদিকে ডক্টর খান তাকে চুপ থাকতে দেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করার জন্য ছেড়ে দিলেন। কাশফি তার মেয়ের মতই কেবল তার পেশেন্ট বলা যায় না। কল কেটে সে থ মেরে বসে রইলো, তার ভিতর নিরব ঝড় বয়ে চলছে।
ভাবতে ভাবতে সময় গড়িয়েছে অনেকটুকু ততক্ষণে দরজায় করাঘাত পড়লো।

“ঈশিতা, তুমি কি রেডি?”
কাশফি দরজার দিকে মাথা তুলে চেয়ে নিশ্চুপ রইলো কেবল। তার বাগদত্তা তাকে নরম স্বরে ডাকছে তবে তার তো বেরুতেই ইচ্ছে করছে না কিন্তু এখন তো আর সিদ্ধান্ত বদলানোর সময় না। কেনো এমন হতে হলো? কেনো সবকিছু তার গলায় আটকে যাওয়ার মতো মনে হচ্ছে। নিজের মনের অবস্থা উপেক্ষা করে সে বর্তমান পরিস্হিতির উপর নজর দিলো। ফুল লেন্থ মিররের সামনে দাড়িয়ে নিজেকে খুঁটে খুঁটে দেখে নিলো কয়েকবার, তারপর দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দরজা খুলে দাড়ালো।

কাশফিকে দেখা মাত্রই জোভানের মুখে অন্যরকম ঝলক, উপচে পড়া খুশি যাকে বলে। তৎক্ষণাৎ কাশফির ভিতরে খারাপ লাগা কাজ করলো। সে কি আসলে জোভানের মতো নরম মানুষটাকে ঠকাচ্ছে? এসব কি সিম্প্যাথি ছাড়া আর কিছুই না।
নিজেকে নিজের চোখে নিচু রকমের মনে হলো তার।

এদিকে জোভান কাশফির হাতে হাত রেখে নরম ভঙ্গিমায় ধরলো তার হাত, সে কাশফিকে সাথে নিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এলো যেখানে মানুষজন কেবল তাদের অপেক্ষায়। কাশফির জন্য এতো গুলো চোঁখ এড়ানো সম্ভব হলো না, তার হাত পা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে তার পদক্ষেপ ও কেমন নড়বড়ে হয়ে এলো। তবুও নিজেকে কাম আর কালেক্টেড দেখিয়ে সে ড্রেস হালকা উচু করে ধরলো তারপর একটা একটা সিঁড়ি পেরিয়ে এলো। তার প্রতি পদে জোভানের সতর্ক দৃষ্টি আটকে ছিলো। এদিকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে না আসতেই করতালিতে মুখরিত হলো ভবন।
কিন্তু ততক্ষণে হতবাক বনে মূর্তির মতো খাড়া হয়ে এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকা কাশফির কানে তখন কোনো শব্দ এলো না, তার মস্তিষ্ক আগত বার্তাও সে অগ্রাহ্য করলো। টেম্পারেচার নাতিশীতোষ্ণ হওয়ার সত্বেও তার কপাল বেয়ে ঘামের ফোটা টুপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। চোখে মুখে তার স্পষ্টত আতঙ্ক, সারা শরীর কাঁপছে। যা দেখে জোবান কিছুটা ঘাবড়ে যায়।

“ঈশিতা তুমি কি ঠিক আছো?”
কাশফি জোভানের দিকে চাইলো না কেবল আগের দৃষ্টিতে চেয়ে মাথা নেড়ে উত্তর দিলো। কৌতুহলী জোভান সেদিকে লক্ষ্য করে দেখলো কাশফির বাবা দাড়িয়ে আছে তাই সে আর কিছুই বললো না।
কিন্তু জোভান আতিকুর রহমানের পিছনে যে মেয়রের সাথে কৌশিক মির্জা দাড়ানো সেটাই দেখলো না।

অতঃপর জোভান হাঁটু গেটে বসে হাসি মুখে তাকে রিং পরিয়ে দিলো, এরপর উঠে দাড়িয়ে কাশফির হাতের অনামিকায় চুমু খেয়ে সেই হাত নিজের দুই হাতের মাঝে নিলো।
“ঈশিতা, তুমি কি আমার অনামিকা হবে?”

করতালি শব্দে বোধহয় কাশফি শুনলো না, নয়ত সে খেয়ালই রাখেনি। সে একরাশ ভয় নিয়ে, বাকশুণ্য হয়ে জোভানের পিছনে দাড়ানো কৌশিক মির্জার দিকেই চেয়ে রইলো। ফরমাল গেটআপে আর শক্ত মুখে বাঁকা হাসি রেখে কৌশিক মির্জা তার হাতের গ্লাস কিছুটা উপরে তুলে কংগ্রেটস জানানোর ভঙ্গিমা করলো।
তৎক্ষণাৎ কাশফি আরো ঘাবড়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে জোভানের দিকে তাকালো, তার এই মুহূর্তে হাত মুখ ধোয়ার প্রয়োজন। সব কেমন কাটার মতো লাগছে তার কাছে।

“আমার প্রচুর নার্ভাস লাগছে আমি কি উপরে চলে যেতে পারি?”
কাশফি দ্বিতীয়বারের মতো জোভানের প্রশ্ন এড়িয়ে চলায় জোভানের মনক্ষুন্ন হলো কিছুটা তবুও সে কাশফির কাঁপতে থাকা ঘর্মাক্ত হাত দেখেই তাকে উপরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

***

ভারী গয়না, লাল শাড়িতে সাজিয়ে বিয়ের আগ মুহূর্তেও নিজেকে সে এমন প্রশ্ন করতে বাধ্য, কেনো তার এত ভয় করছে কেনো?! যেখানে ছয়দিন আগেও লোকটা তাকে অবাক করে দিয়ে তার এনগেজমেন্টে এসেছিলো সেটা তাকে কাঁপিয়ে তুলেছে তবে কি ভালোয় ভালোয় সব হয়ে যাবে? হয়ত হ্যাঁ হয়ত না।
ফোনে শব্দ করে নোটিফিকেশন আসা মাত্রই ডিসপ্লেতে জোভানের ম্যাসেজটা জ্বলজ্বল করতে থাকলো,

“তোমাকে দেখার অপেক্ষায় রইলাম।”
কাশফির কোনো অনুভূতি কাজ করলো না। সে একদৃষ্টিতে বড় জানালার বাইরে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিজেকে আশ্বস্থ করে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেললো। মিনিট খানেক বাদেই তাকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার বান্ধবীরা আর কিছু দূর সম্পর্কের আত্মীয় এলো, সেও অনুভূতি শুন্য পা বাড়ালো।
মনে মনে বারবার আওড়ালো জোভানের নাম, নিজেকে কঠোর ভাবে মনে করিয়ে দিলো আজ থেকে তার নাম জুড়ে যাবে জোভান শিকদারের সাথে।

বিয়ের আসরে মানুষ ভর্তি, চারপাশে হইহুল্লোড়, গান বাজনা। সবাই নতুন বউকে দেখতে ব্যাস্ত। এদিকে কাশফিকে স্টেজে বসানো মাত্রই কয়েক দফা গুলিগোলার শব্দে চারপাশ শান্ত হয়ে পিনপতন নীরবতা কাজ করলো, বেশ রমরমা পরিবেশ এখন নিস্তব্ধ।
স্নিগ্ধ হওয়ার মতি গতি উল্টে গেছে, বিপরীতে একপ্রকার শিরশির করে দেহ খান কাপিয়ে বইছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস উত্তরে প্রবহমান, ছিল হট্টগোল চারপাশ। কিছুক্ষণ আগেও বেজে চলেছিল সানাই, গান, বাজনা। জনমানবশুন্য শিকদার বাড়ির বিবাহ আয়োজনে রাস্তা ঘাট বেশ রমরমা, উত্তপ্ত পরিবেশ চারপাশ কিন্তু একজন মানুষের আগমনে যেন সব নেতিয়ে পড়েছে। সে কি..

কাশফি আতকে উঠে, তার বুকের ভিতর মুচড়ে উঠলো, যে জিনিসের ভয় ছিলো তাই কি হতে চলছে?
চোখের পলকেই পরিপাটি বেশভূষায় একদল সুঠামদেহী দল হাতে রিভলভার, পিস্তল আর শটগান নিয়ে ভিতরে ঢুকে কাশফির সামনে এসে দাড়ালো, কাশফির একজন চাচা চেচিয়ে কিছু বলতে যাবে তৎক্ষণাৎ তার দিকে বন্দুক তাক করা হয়, ভদ্রলোক সাহস হারিয়ে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে যান।

বরযাত্রী চলে এসেছে তবে বর এখনও পৌঁছায় নি, এই মুহূর্তে সব অন্ধকার দেখা কাশফির একমাত্র ভরসা জায়গা বাবা মনে হলো। এপাশ ওপাশ তাকিয়েও তার বাবাকে সে দেখতে পেলো না। বিদ্যুতের বেগে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে কৌশিক কাশফির সামনে এসে একটা হাসি দিল। তার শক্ত পেশল হাত দিয়ে আলতো করে কাশফির চোয়াল ধরে গম্ভীর সরে বললো,
“আমার আর তোমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আতিকুর রহমান আর জোভান শিকদার ফিরছে না ডার্লিং।”

কাশফি চোঁখ বড় বড় করে মানুষটাকে চাইলো, আশ্চর্য্য হয়ে হিতাহিত জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে বোধহয়। তবুও নিজেকে অটুট রেখে দাঁতে দাঁত চেপে ঝাঁঝালো শব্দ প্রয়োগ করলো,
“ঠিক কেমন ধরনের অমানুষ আপনি?!”

কৌশিকের কোনো জবাব এলো না সে একজন গার্ড কে ইশারা করা মাত্রই সে মাথা নেড়ে ঘুমন্ত কায়েসকে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। হতবম্ব কাশফি এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো, তার চেঁচামেচি করে আহাজারি করাও কাজে আসলো না বরং কৌশিক মির্জা শক্ত মুখে কাজীকে বললো কাজ শুরু করে দিতে।
মাথা নেড়ে কাজী সাহেব ভয়ে ভয়ে পাঠ করতে শুরু করলেন, কাশফির আহাজারীতেও থামলেন না এদিকে কাশফির চাচা চাচী তাকে বোঝানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন কিন্তু সে থামলো না। কাজী যখন কাশফির পুরো নাম উচ্চারণ করবেন তখন কৌশিক শুধুই ‘কাশফি’ বলে সম্পন্ন করতে বলল। কাশফি চোঁখে অশ্রু নিয়ে কৌশিক কে অভিশাপ ছুড়লো, পাঁচ বছর আগে খুন করতে দেখতে পাওয়া নিকৃষ্ট মানুষ নাকি তার স্বামী।

“যদি ঘৃণা থেকেও বেশি কিছু প্রকাশ করার জন্য কোনো জঘন্য শব্দ থাকতো তবে তা আমি আপনার জন্যই আমার অনুভূতি প্রকাশ করতাম।”

কৌশিক কিছুই বললো না, সে তার মুখ কাশফির থেকে হালকা দুরত্বে রেখে তার ঠোঁটের দিকে চেয়ে হাস্কি কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
“আমি পৃথিবীর একজন সবচেয়ে জঘন্য পুরুষ,
কৌশিক মির্জা আমার একান্ত নিরুপমা, কাশফিতে মত্ত।”

বন্দুক হাতে গম্ভীর মুখে থাকা কৌশিক থেমে গিয়ে চট করে কাশফির অনামিকা হতে জোভানের দেওয়া আংটি খুলে ফেলে আরেকটা হীরের আংটি পরিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বললো অবশেষে,
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

***

— তাদের অতীতের কাহিনী এখানে সমাপ্ত —

#চলবে…

বিশেষ নোট: যারা তাদের বিয়ে, রোম্যান্স আর রহস্য জানতে ইচ্ছুক তারা একটু সময় দিন শীগ্রই নতুন পর্ব নিয়ে আসবো। বিয়ের পরের পর্ব লিখতে হলে আমাকে গল্পটার প্রথম দিকের জিনিস গুলো পড়ে তারপর সেইসময়ের তাল ধরে লিখতে হবে। তাহলে আপনারা বরং কৌশিক মির্জার বাসরের অপেক্ষায় থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here