#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৯ ( বর্ধিত অংশ )
রুদ্রর ভয়ে আস্ত একটা রাত নিদ্রাহীন কাটাল হৈমী। অথচ সকাল সকাল রোশান এসে খবর দিল রুদ্রকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না৷ হৈমীকে এ খবর রোশানের মাধ্যমে রুদ্রই পাঠাল। সে সত্যি সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে৷ কারণ এক রাতের ব্যবধানে গালে ক্ষতের চিহ্ন দেখলে সকলের কাছে নানারকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে৷ যার উত্তর তার কাছে আপাতত নেই। দিনের শেষে যখন বাড়ি ফিরবে তখন অবশ্য এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে ফাঁকি দেয়া যাবে। ব্যান্ডেজের উপরে ক্ষতের পরিমাণটা নিশ্চয়ই কেউ আন্দাজ করতে পারবে না৷ রুদ্র বাড়িতে নেই এ সংবাদ শুনে হৈমী জ্বলে ওঠল৷ ফুঁস করে তার সমস্ত চিন্তা, ভয় দূর হয়ে গেলেও মুহুর্তে আবার রেগেমেগে আপনমনেই বলল,
-” আরে ব্যাটা আগে বলবি তো তুই সকাল সকাল গায়ে হাওয়া লাগাতে বেরিয়ে যাবি। শুধু শুধু সারারাত না ঘুমিয়ে, পানি খেয়ে পেট ফুলিয়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসের দফারফা করে ফেললাম। ধ্যাৎ! ”
নিয়ম অনুযায়ী বিকেলবেলা শশুরবাড়ি ফিরে গেল সূচনা৷ রুদ্রর জন্য সন্ধ্যা ছ’টা অবধি অপেক্ষা করার পর রুদ্র না ফিরতেই চলে যেতে বাধ্য হলো৷ শাশুড়ির কড়া আদেশ নতুন বউ রাত করে ফেরা যাবে না৷ রুদ্রও ফোন করে তাকে চলে যেতে বলেছে এবং আশ্বাস দিয়েছে সে তার শশুর বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসবে৷ এ কথা শুনে সূচনা খুশি হলেও হৈমীর মাথায় টোপ করে চিন্তা ঢুকে পড়ল৷ বুকের ভিতর শুরু হলো দুরুদুরু। সারাপথ বার বার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল সে। এই বুঝি রুদ্র একটা থ্রেট মার্কা ম্যাসেজ করবে। এই বুঝি ভিডিয়ো পাঠিয়ে শাসাবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সে-সবের কিছুই করল না রুদ্র।
বিয়ের কয়েক দিন পেরিয়ে গেল। ছুটি শেষ মাহেরের। রোজ সকাল ন’টার সময় রেডি হয়ে বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে ভার্সিটিতে চলে যায় সে৷ তৃতীয় বর্ষে ছাত্রী সূচনা। সপ্তাহে দুদিন ক্লাস থাকে তার৷ যে দু’দিন তার ক্লাস থাকে সে দু’দিন মাহের বাইক করে তাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যায়। অনেক সময় ছুটির পর সকল ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে নয় কি.মি অতিক্রম করে নিতেও যায়। সে যতই বলুক একা আসতে পারবে, একা যেতে পারবে মাহের কানে তুলে না৷ বিয়ের আগে নিজেদের পার্সোনাল গাড়ি করেই চলাফেরা করতো সে। মাহেরের পার্সোনাল চার চাকার গাড়ি নেই। এতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। কারণ তার স্বামীর যে পার্সোনাল মনটা রয়েছে তার অঢেল যত্ন সে পাচ্ছে। জীবনে টাকা, পয়সা, গাড়ি, বাড়ির চেয়েও পাশে একজন মানুষ থাকা কতটা জরুরি বাইশটা বছর তা সে খুব গভীর ভাবেই উপলব্ধি করেছে। বন্ধুত্বের বন্ধনে তাদের জীবনের গতিবিধি স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে…
সকলের জীবন স্বাভাবিক নিয়মে চললেও হৈমীর জীবন বড্ড অস্বাভাবিক চলছে। কারণ তার জীবনে সুনামি বয়ে আনা মানুষটি হুট করেই যেন থেমে গেছে। যে থেমে যাওয়াটাই মাত্রাতিরিক্ত শঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঠিকঠাক খেতে পারছে না, ঘুমাতে পারছে না, কলেজ অবধি নিশ্চিন্তে যেতে পারছে না। খেতে বসলে মনে হচ্ছে এই বুঝি বাসায় এসে তার সামনে বসে কয়েকটা হুমকি-ধামকি দেবে। ঘুমালে মনে হচ্ছে এই বুঝি এসে কামড় দেয়ার অপরাধে ঘুমন্ত অসহায়িনী তার ছোট্ট দেহখানি তুলে আছাড় মারবে। মোবাইলে যে কোনো ম্যাসেজ বা কল এলেই চমকে ওঠছে, হাত পায়ে কাঁপন ধরছে, গলা শুকিয়ে বেহাল দশা। দিনকে দিন জীবনটা যেন দুর্বিষহ হয়ে ওঠল তার। ঠিকঠাক না ঘুমানোর ফলে চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠল। আম্মু, ভাই, ভাবি এসবের কারণ জানতে চাইলে সে কোনো উত্তর দিতে পারল না৷ ফার্স্ট ইয়ারে অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা এরই মধ্যে হয়ে গেল। না পড়াশোনায় ঠিকঠাক মন বসল আর না পরীক্ষায়। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে রুদ্রের কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গকে কলেজের সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল সে। তাদের সামনে দিয়েই অটো করে বাসায় ফিরেছে কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারেনি। অবশ্য চেনার কথাও নয়৷ কারণ সেদিনের পর থেকে রুদ্রকে নিয়ে মনের ভিতর ভয়টা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠেছিল যে কলেজ আসার সাহসটুকুও পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত মা ভাইয়ের কঠিন বকা খেয়ে বোরখা, হিজাব পড়ে কলেজ এসেছে। এরপর থেকেই বোরখা পড়ে পড়েই কলেজ আসা তার৷ খুব কাছের এবং পরিচিত জন ছাড়া বোরখা পরিহিত এই বাচ্চা মেয়েটিকে কেউই চিনতে পারে না৷
সূচনার বিয়ের একত্রিশ দিনের মাথায় তার বাবা রিদওয়ান শেখ পুনরায় আমেরিকায় চলে গেলেন। বাসায় বসে শেখ বাড়ির খবরাখবর টুকটাক কানে এসেছে হৈমীর। এরপর ঠিক পনেরো দিন পেরোতেই শুনতে পেলো শেখ বাড়ি থেকে সূচনার দাদিন, রুদ্র এবং তার ছোটো চাচা আসছে তাদের বাসায়। এ কথা জানার পরই আত্মা হাতের মুঠো করে নিয়ে টিশাকে ফোন দিল সে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্ল্যান করে হামিদা বেগমকে জানালো টিশা ভীষণ অসুস্থ। সাড়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা টিশা৷ আজকাল সত্যি সত্যি শরীর খুব একটা ভালো যায় না তার। বাবা, মা, শশুর, শাশুড়ি কেউ বেঁচে নেই। খালামুনি হিসেবে তার প্রতি কোনো দায়িত্বই পালন করতে পারেননি হামিদা। কিন্তু বুকের ভিতর মেয়েটার জন্য খুব পুড়ে। তাই তো ছোটো বোনের মেয়েটার অসুস্থতার কথা শুনে নিজের মেয়েকে পাঠিয়ে দিল তার দেখাশোনা করার জন্য। শেখ বাড়ি থেকে লোকজন আসার পূর্বেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে হৈমী চলে গেল টিশার বাসায়।
দুপুর তিনটার দিকে রুদ্র, দাদিন, এবং ছোটো চাচা রিজওয়ান শেখ এলেন। বিয়ের পর এ প্রথম বাপের বাড়ির লোক এভাবে আসাতে সূচনা ভীষণ খুশি হলো। আদর, আপ্যায়নে কোনো প্রকার ত্রুটি রাখল না। কিন্তু দাদিনের মুখ ভার হলো হৈমী বাসায় নেই এ কথা শুনে। রুদ্রর মেজাজও কম বিগড়ে গেল না! সে কেবল দাদিনের চোখের ইশারায় দমে রইলমাত্র। খাওয়াদাওয়ার পর্ব সেড়ে কথায় কথায় দাদিন মাহেরের মা হামিদাকে জানালেন, তাদের মনের কথা। বললেন,
-” আত্মীয়ে আত্নীয়ে এবার পরম আত্মীয় হতে চাই মা৷ তুমি যেমন তোমার সংসারে আমাদের ঘরের মেয়ে নিয়ে এসেছো, আমরাও তেমন আমাদের সংসারেও তোমার মেয়েকে নিতে চাই৷ ”
মুরুব্বির মুখে এমন একটি বাক্য শুনতেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল মাহের৷ তার এই দাঁড়ানো দেখে সূচনা থতমত খেয়ে গেল। প্রথমে দাদিনের কথায় বিস্ময় এবং স্বামীর আকস্মাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ায় থতমত খেল। চাপা স্বরে বলল,
-” দাদিন কী বলছো এসব তুমি? ”
শান্ত রইলেন হামিদা। ছেলেকেও ইশারায় শান্ত হতে বললেন। মায়ের আদেশে মাহের শান্ত হয়ে বসল। অত্যন্ত মার্জিত শব্দে বলল,
-” এসব কী বলছেন দাদিন? বোন আমার অনেক ছোটো তাছাড়া আমি এসব ভাবতে পারি না।”
দাদিন করুণ চোখে সূচনার দিকে তাকাল। সে তো কম বোঝানোর চেষ্টা করেনি নাতিকে। সূচনার সংসারে অশান্তি হবার ভয়ে এতদিন চুপই ছিল। কিন্তু রিদওয়ান শেখ চলে যাবার আগে মাকে অনুরোধ করে গেছেন। যেন যে করেই হোক রুদ্রর এই চাওয়াটা পূর্ণ করা হয়৷ এক বছরের মাথায় দেশে এসে যেন ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দিতে পারে৷ জীবনে প্রথমবার রুদ্র তার বাবার কাছে একটি জিনিস চেয়েছে। যে সে জিনিস নয় আস্ত একটা মানুষকে চেয়েছে। বাবা তাকে আশ্বাস দিয়েছেন। কাজের প্রয়োজনে দ্রুত ফিরে যেতে হচ্ছে কিন্তু সে আবার আসবে। ভাই, মা দিয়ে কাজ না হলে নিজে সশরীরে মেয়ে জামাই, বেয়ানের কাছে হাত পাতবে। ছেলের করা প্রথম আবদার বলে কথা! বাবা হিসেবে ছেলেমেয়ে দুটোকে জীবনে কিছুই দিতে পারেনি। দূর দেশে থেকে খবরাখবর নেয়া, অঢেল অর্থ ছাড়া কিছুই করতে পারেনি ওদের জন্য৷ মেয়েটা তো জীবনে কিছুই চাইল না, ছেলেটা মুখ ফুটে চেয়েছে এই তো ভাগ্য। যদিও সে জানে রুদ্রর মতো ছেলে চেয়ে নেবার অপেক্ষা রাখে না৷ শুধুমাত্র বোনের সংসারের প্রতি খেয়াল রেখেই এইটুকুন সভ্যতা দেখিয়েছে।
পরিস্থিতি ভীষণ এলোমেলো হয়ে গেল। কারো মুখ বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ়, কারো চোখে অসহায়তা, বা কারো তীব্র ক্রোধ মিলেমিশে খান মঞ্জিল অর্থাৎ মাহেরের একতলা বাড়ির পুরো পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠল৷ হামিদা পাংশু মুখে ছেলের পানে তাকিয়ে রইলেন। মাহের রিজওয়ান শেখকে হাতজোড় করে বললেন,
-” বেয়াদবি মাফ করবেন, এই প্রস্তাবে আমি সম্মতি দিতে পারছি না৷ ”
অবিশ্বাস্য চোখে সূচনা রুদ্রর রাশভারী মুখটায় তাকিয়ে কেঁদে ফেলল। মুখ লুকিয়ে চলে গেল বেডরুমে। এক পর্যায়ে থমথমে মুখে বিদায় নিলেন শেখ বাড়ির প্রতিটি সদস্য। যাওয়ার আগে দাদিন হামিদাকে বলে গেলেন,
-” সূচনা এসবের কিছুই জানতো না। রুদ্র আপনার মেয়েকে ভীষণ পছন্দ করেছে বলেই বাধ্য হয়ে এসেছিলাম। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই আল্লাহর ইশারায় হয়। এখানে আমার আপনার হাত নেই৷ আসি। ”
থেকে যাওয়ার জন্য তেমন জোর করতে পারলেন না হামিদা। শরীর, মস্তিষ্ক কেমন যেন অবশ হয়ে এলো তার। এরপর থেকে মাহের, সূচনার মধ্যেকার স্বাভাবিক সম্পর্কটা কেমন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠল৷ এই অস্বাভাবিকতা আনলো সূচনা নিজেই। কেন জানি মাহেরের সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত লাগতে শুরু হলো। প্রয়োজন ছাড়া একটি শব্দও সে উচ্চারণ করে না৷ শাশুড়ির সঙ্গেও মেলামেশা কমিয়ে দিল। চারপাশের সবকিছুই কেমন অসহ্য লাগতে শুরু হলো।
হাজার হোক রুদ্র সূচনার ভাই। তার ভাই সবার চোখে যেমনই হোক তার চোখে সেরা। কারণ যে বসয়ে একটা ছেলের বাবা, মাকে খুব প্রয়োজন পড়ে সে বয়সটায় সে বোনের দায়িত্ব নিয়ে একা একা বেড়ে ওঠেছে। সূচনা মেয়ে বলে হয়তো তার জীবনটা সঠিক পথে এগিয়েছে। ছেলে হওয়ার দরুণ বাইরে চলাফেরা করে সঙ্গ দোষে রুদ্র আজ গুন্ডা, মস্তান হয়ে ওঠেছে৷ তার এই গুন্ডা ভাইটা, নারী বিদ্বেষী ভাইটা যে হৈমীর মতো ছটফটে বাচাল মেয়েটাকে পছন্দ করতে পারে ভাবতেই পারেনি। কষ্টটা এখানেই বেশি লাগছে তার। মাহেরের প্রতি উচিৎ নয় এমন একটি অভিমান বুকে চেপে রয়েছে। স্বার্থপরতা হয়ে যাচ্ছে তবুও অভিমানটুকু সরাতে পারছে না। তার ভাইটা কি খুব খারাপ? তার কি অধিকার নেই পছন্দের মানুষটাকে পাওয়ার?
___
বাড়িতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই জানানো হয়নি হৈমীকে। বোনের বাসায় সে বিন্দাস দিন কাটাচ্ছে। এরই মধ্যে একদিন নয়নের কল পেয়ে ঘুরতে বের হয় হৈমী। তাড়াহুড়ায় বোরখা পরতে মনে ছিল না। যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই ফুচকা খেতে বেরিয়ে পড়ে সে। দুই বান্ধবী ফুচকা খেয়ে শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এমন সময় রুদ্রর গাড়ি এসে থামল তাদের পাশে। চমকে ওঠে দুকদম সরে গেল হৈমী, নয়ন৷ গাড়ির ডোর খুলে রুদ্র বেরিয়ে এলো। চোখে অদ্ভুত নেশা, ঠোঁটে বাঁকা হাসি। দুই বান্ধবী ঠোঁটজোড়া ফাঁক করে অপলক তাকিয়ে রইল। যেন কোনো সিনেমার ভিলেন এসে দারুণ এটিটিউড নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালো। হৈমীর অন্তরআত্মা কেঁপে ওঠল যখন সেদিন রাতের ঘটনা টুশ করে মনে পড়ল! জোর পূর্বক মুখে হাসি টেনে নয়নের হাত চেপে ধরল সে৷ ফিসফিস করে বলল,
-” দোস্ত বিপদে পড়লে কোন দোয়া পড়তে হয় জানি? আমার সব গুলিয়ে গেছে মনে করাই দে। ”
-” আরে বান্ধবী আমিও ভুলে গেছি কী জানি! ”
-” শা’লি, হা”রামি যাহ। ”
-” হৈমী গাড়িতে ওঠে বসো। ”
সাদা রঙের প্রাইভেট কারের পেছনের ডোর খুলে আড়চোখে তাকিয়ে কথাটা বলল রুদ্র। বলিষ্ঠ দেহের পেশিবহুল হাতটি তার দিকে ইশারা করা। ঘাড় ভর্তি চুলগুলোর জন্য মুখ পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। তবে কন্ঠস্বর শুনে যতটুকু বোঝা গেল দ্যা গ্রেট গুন্ডাসাহেব খুব একটা রেগে নেই। তাহলে কি সেই রাতের কামড়ের কথা ভুলে গেছে? গাছের সাথে মাথায় ঠুশ করে আঘাত পেয়ে স্মৃতি ভ্রষ্ট হয়েছে? ভাবতে ভাবতেই খুশিতে গদগদ হয়ে হৈমী বলল,
-” ভাগ্যিস সব ভুলে গেছেন। একটা কামড়ের ঝাঁজ এত বেশি আগে জানতাম না। আমার কতগুলো দিন হারাম হয়েছে এটার জন্য জানেন? তা বেয়াইমশায় আমাদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবেন নাকি? শুনুন আমি এখন আমাদের বাড়িতে থাকি না। আপনি আমাদের বাড়ি যাবেন শুনেই আমি পালিয়েছি বুঝেছেন। ”
হৈমীর কথা শুনপ নয়ন তার পেটে গুঁতো দিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” কী বলছিস এসব? গাড়ির নিচে পড়ে ভর্তা হবার শখ হইছে তোর? পেটের ভিতর একটা কথাও চেপে রাখতে পারিস না। এই কথার জন্য কী বিপদে পড়বি আইডিয়া আছে তোর শালা পাগলা জানি কোথাকার! ”
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হাতের চার আঙুলে ঠোঁট চেপে ধরল হৈমী৷ কাঁদো কাঁদো মুখে নয়নের দিকে তাকাল। রুদ্র খুব বেশি অপেক্ষা করতে নারাজ তাই ধমক দিল,
-” গাড়িতে ওঠো। ”
নয়নকে কঠিন স্বরে বলল,
-” এই মেয়ে বাসায় যাও। যাও এখান থেকে যাও। ”
ধমক খেয়ে আমতা আমতা করে ব্যস্ত পায়ে চলে হে
গেল নয়ন৷ হৈমীও তার পিছু ধরতে চাইল কিন্তু তার পূর্বেই রুদ্র তার হাত চেপে ধরল। হৈমী বলল,
-” আমি কিন্তু চিল্লাব। ”
-” চিল্লালেই সর্বসম্মুখে চুমু খাব। তারপর সেটা ভিডিয়ো করে পাবলিক গ্রুপে ছেড়ে দিব। এ শহর যেমন তোমার আমার নষ্টালজিক সিন দেখবে তেমনি ফেসবুক শহরকেও দেখাব! ”
মুখ কাচুমাচু করে গাড়ির পেছন সিটে গিয়ে বসল হৈমী৷ ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল রুদ্র। এরপর গাড়ি চলতে শুরু করল মেইন শহরের রাস্তায়। হৈমী জিজ্ঞেস করল,
-” কোথায় যাচ্ছেন আমাকে নিয়ে? ”
-” কাজি অফিসে! ”
-” কীহ! কেন কার বিয়ে? ”
-” আমাদের বিয়ে। ”
-” কী বলছেন। আমার বিয়ে? আপনার সাথে? ওহ আল্লাহ গো এ আমি কী শুনি শেষ পর্যন্ত কিনা একটা গুন্ডা, সন্ত্রাস আমার জামাই হবে। হে আল্লাহ তুমি আমারে ওঠাই নেও। ”
ঠোঁটে কুটিল হাসি ঝুলিয়ে ড্রাইভ করতে লাগল রুদ্র।
হৈমীর মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বইতে লাগল। কাঁপা গলায় বলল,
-” আপনি এমন করবেন না, প্লিজ আপনার দুটো পায়ে পড়ি। ”
রুদ্র যেন শুনেও শুনল না৷ সে তার সিদ্ধান্তে স্থির। হৈমী যখন বুঝল রুদ্র সত্যি সত্যি আজ ভয়ানক কাণ্ড ঘটাবে তখন নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারল না৷ তার উপস্থিত বুদ্ধি তাকে বাধ্য করল নিঃশব্দে গাড়ির ডোর খুলে গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। মস্তিষ্ক এবং মনের প্ররোচনায় এক গুন্ডার হাত থেকে বাঁচতে রুদ্র কল্পনাও করতে পারবেনা এমন একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল সে। গাড়ির ডোর খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তৎক্ষনাৎ। আকস্মিক হৈমীর এমন কাণ্ড দেখে ভয়ে আত্মা কেঁপে ওঠল রুদ্রর। স্টেয়ারিং থেকে আপনাআপনিই দুহাত সরে গেল তার। নিমিষেই ঘটে গেল ভয়ানক একটি এক্সিডেন্ট!
গাড়ি ঝাঁপিয়ে পড়ার পর হাত, কপাল ছিলে রক্ত বেরিয়ে ডান পা মচকে গেছে হৈমীর। সন্ধ্যার আবছা আলোতে রাস্তার আশপাশে চলাচল করা কিছু মানুষ ছুটে এসে তাকে ধরেছিল। ঠিক তার এক মিনিটের ব্যবধানে ভয়াবহ এক্সিডেন্টটি ঘটল। দূর থেকে সাদা রঙের গাড়িটার রাস্তার পাশের কড়ুই গাছের সঙ্গে সংঘর্ষ লাগা স্পষ্টচোখে অবলোকন করে নিজের দেহের ব্যথা, বেদনা ভুলে গিয়ে জ্ঞান হারালো হৈমী। জ্ঞান হারানোর পূর্বে মস্তিষ্ক জানান দিল, শেষ সব শেষ রে হৈমী !
চলবে…
(অনুমতি ছাড়া কপি নিষেধ)
রিচেক দেইনি ভুলগুলোর জন্য দুঃখীত।