প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১০।

0
173

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১০।

রাতের রান্না আর তনুকাকে করতে হয়নি। সবটা বাড়ির ভৃত্যরাই সেরেছে। শ্বশুরমশাইকে দেখে এসে আর রুম থেকে বের হয়নি সে। মাঝখানে মেহতাব মায়ের রুমে একবার গিয়েছিল। কথাও বলেছে বেশ কিছুক্ষণ।

এখন ঘড়িতে নয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। তনুকা চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে আছে। মাথা ধরেছে খুব। হয়তো এর পেছনের কারণ ঘাটলে “দুশ্চিন্তাটাই” বেরিয়ে আসবে। মাথার উপর এক হাত তার। মেহতাব বাইরে থেকে নিজের রুমে ফিরে আসে। তনুকাকে দেখে চোখে মুখে তার চিন্তার ছাপ পড়ে। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, তনু? শরীর খারাপ লাগছে?’

তনুকা চাইল। তারপর উঠে বসল আস্তে করে। মৃদু সুরে বলল,

‘না, একটু মাথা ধরেছে শুধু।’

‘ওমা, আগে বলোনি কেন?’

এই বলে মেহতাব ড্রেসিং টেবিল এর উপর থেকে একটা তেলের বোতল নিয়ে এসে বিছানায় উঠে বসল; ঠিক তনুকার পেছনে। তনুকার চুল থেকে খোঁপা খুলতেই সে জিজ্ঞেস করে,

‘এই, কী করছেন?’

‘চুলে তেল দিয়ে ম্যাসাজ করে দিলে মাথা ব্যথা সেরে যাবে।’

তনুকা জবাবে পুনরায় কিছু বলার আগেই মেহতাব তার হাতে তেল ঘষে তনুকার মাথায় দিতে আরম্ভ করল। তনুকা আর শব্দ করল না।
মেহতাব বেশ যত্ন করে ঘষে ঘষে তেল দিয়ে দিচ্ছে। আঙ্গুল দিয়ে চেপে চেপে ধরাতে মাথায় আরাম বোধ করছে সে। আবেশে চোখের পল্লবও নিমীলিত করে। মেহতাব আদর মাখা হাতে পুরো চুলে ভালোভাবে তেল মাখিয়ে দেয়। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘আরাম পাইতেছ, বিবিজান?’

তনুকা চোখ মেলল। মিহি সুরে বলল,

‘হ্যাঁ।’

মেহতাব অনেকক্ষণ চুলে বিলি কেটে তেল মালিশ করে দিল। তারপর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে করে দিল বেণী। ভীষণ যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে গাঁথল বেণীর প্রতিটা গাঁথন। তনুকা বিস্মিত হলো। মেহতাব তার লম্বা চুলের বেণী সামনের দিকে এনে হেসে বলল,

‘দেখোতো কেমন হইছে, বিবিজান?’

তনুকা হাত দিয়ে ধরে দেখল। চমৎকার সুন্দর মনে হলো তার। একবার মাথা ঘুরিয়ে চাইল মেহতাবের খুশি খুশি মুখের দিকে। আপ্লুত সুরে বলল,

‘আপনি এত সুন্দর করে চুল বাঁধতে পারেন? এত সুন্দর করে বেণী তো আজকাল মেয়েরাও পারে না।’

হাসল মেহতাব। সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এলো তার চকচকে দন্ত মহল। বলল,

‘আমার বিবিজানের জন্য শিইখা রাখছিলাম।’

তনুকা বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘আপনার সব কর্মকান্ড আমাকে ভীষণ অবাক করছে।’

‘কেন? এখানে অবাক হওয়ার মতো কী আছে? বেণী করতে পারা এমন কী ব্যাপার?’

‘তা না, আপনি একজন জমিদার মানুষ; সারাক্ষণ কত কাজে ব্যস্ত। এত বড়ো গ্রাম সামলান, পরিবার সামলান, অথচ এই ছোট্ট কাজগুলো কী চমৎকার ভাবেই না করে ফেলছেন। রান্নাটাও তো অসাধারণ আপনার। আপনি তো বেশ গুণী মানুষ।’

মেহতাব প্রসন্ন হাসল। চোখের মনি চকচক করছে তার। খুশ মেজাজে বলল,

‘বিবির মুখে এমন সৌভাগ্য পাওয়ার ভাগ্য যেন সব পুরুষের হয়।’

তনুকাও মৃদু হাসল। বলল,

‘প্রাণেশ্বরের মাঝে এত গুণ থাকলে, এমন সৌভাগ্যে ভাগ্যবান হওয়া কোনো ব্যাপারই না।’

মেহতাব তেল আর চিরুনি রেখে এসে তনুকার পাশে বসল। জিজ্ঞেস করল,

‘মাথা ব্যথা কমেছে?’

তনুকা কিঞ্চিৎ হেসে জবাব দিল,

‘জি, অনেকটাই কমেছে। মায়ের সাথে কথা বলেছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী বললেন মা?’

‘দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। কাল থেকে আব্বার তিনবেলা খাবারের দায়িত্ব তোমার।’

খুশি হলো তনুকা। চোখে মুখের উদ্দীপনায় প্রস্ফুটিত হলো সেটা। বলল,

‘তাহলে আমাকে বাবার খাবারের লিস্টটা দিয়ে দিবেন, কাল থেকে আমিই সব করব।’

‘পারবে তুমি?’

মেহতাবের কন্ঠস্বর চিন্তিত ঠেকে। তনুকা প্রশ্ন করে,

‘কেন পারব না? অবশ্যই পারব।’

মেহতাব হাসে এবার। বলে,

‘ঠিক আছে, ভরসা করলাম তবে।’

______________

রাতের ভোজন সম্পন্ন করতে এক সাথেই টেবিলে বসল সবাই। তনুকাও এবার বসেছে। খাবার বাড়ির ভৃত্যরাই পরিবেশনা করছে। তনুকার পাশের চেয়ারে রেনু। আর টেবিলের ঠিক সম্মুখ দিকের বড়ো চেয়ারে বসেছে মেহতাব। আগে এখানে তার বাবা, “মোহন লাল মজুমদার” বসতেন। এখন জমিদার হওয়ার সুবাধে সে’ই এই চেয়ারের কর্তৃত্ব পেয়েছে। খাচ্ছে সবাই। এর মাঝেই মেঝো কাকা, রমেজ মজুমদার এক দুঃখজনক কথা পাড়লেন। তিনি থমথমে সুরে বললেন,

‘খবর পেয়েছ, মেহতাব?’

মেহতাব খাবারের মাঝেই একবার তাঁর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,

‘কী খবর, কাকা?’

‘সলিমুল্লাহ নাকি খু ন হয়েছে?’

মেহতাব খাবারের ছন্দ হারাল ততক্ষণাৎ। বিহ্বল চোখে চাইল। অতি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কী বলেন, কাকা? আজ বিকেলেও তো আমার সাথে কথা হয়েছিল। খু ন হয়েছে মানে? কখন হলো এসব?’

‘আমি একটু আগেই খবরটা পেয়েছি। ওর ছোট ভাই এসে বলে গিয়েছে। লা’ শের অবস্থা নাকি বীভৎস, খাবারের সময় বলে আর কিছু বলছি না।’

মেহতাবের চোখে মুখে প্রগাঢ় চিন্তার ছাপ পড়ল। আম্বিরা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

‘মেহতাব, তোমার সাথে যে কাজ করত সেই সলিমুল্লাহ?’

জবাবে রমেজ মজুমদার বললেন,

‘জি ভাবি, ও’ই।’

আম্বিরা বেগমও চিন্তায় পড়লেন যেন। ছেলেটা ভালো, হঠাৎ খু ন হলো কেন তবে? মেহতাব জিজ্ঞেস করল,

‘লা শ কোথায় পেয়েছিল?’

‘মনোহর নদীর পূর্ব পাশের জঙ্গলে।’

‘পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, ওর ছোট ভাই তো বলল, ওরা সব করছে। লা’শের যা অবস্থা, ময়নাতদন্ত করেও তো বোধ হয় কিছু বের করতে পারবে না।’

মেহতাবের চওড়া কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ। বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বলল,

‘সলিমুল্লাহ আমার খুব বিশ্বস্ত লোক ছিল। ওকে কে মারতে পারে? ওর সাথে কার কী এমন শত্রুতা যে, একদম জানে মেরে দিয়েছে?’

রমেজ মজুমদার বললেন,

‘আমিও তো তাই ভাবছি।’

‘চিন্তা নেই, আমি খোঁজ নিব। শত্রু যেই হোক, আমার চোখের আঁড়াল হতে পারবে না।’

সবাই ফের খাবারে মনোযোগ দেয়। মেহতাবের বাক্য বিনিময়ের পুরোটা সময় তনুকা তাকে ফ্যালফ্যাল করে দেখেছে। তখন মেহতাবের চোয়াল শক্ত ছিল, কথা বলার সময় চোয়াল টানটান হয়ে উঠছিল বারবার। কপালে ভাঁজ পড়েছিল তিনখানা। ভাঁজ ছিল দুই ভ্রু এর মাঝেও। লোকটা রেগে গেলে মুখের অবয়ব পাল্টে যায়। তখন চেনা যায় না তাকে। কেমন অদ্ভুত ভয় কাজ করে যেন। তনুকার এতসবের মাঝেও হঠাৎই মাথায় এল,

‘লোকটাকে তবে কে মারল? উনার শত্রুপক্ষের কেউ? কিন্তু, উনার শত্রু’টাই বা কে?’

________

সবকিছু সেরে রুমে আসতে একটু বিলম্ব হলো তনুকার। মেহতাব বিছানায় বসা। পা যুগল ঝুলছে। দু হাত দিয়ে বিছানা চেপে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। তনুকার উপস্থিতি টের পেতেই মাথা তুলে তাকায় সে। অধৈর্য গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,

‘এতক্ষণ লাগে আসতে?’

‘মা খাবার গুছিয়ে রাখা শিখাচ্ছিলেন।’

‘আচ্ছা, বসো এদিকে এসে।’

তনুকা ছোট পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসল। তারপর পূর্ণ মনোযোগে মেহতাবকে দেখে প্রশ্ন করল,

‘আপনার শত্রু কারা?’

মেহতাব চাইল। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। কঠিন স্বরে জবাবে বলল,

‘আমার আম্মা বাদে সবাই।’

খানিকটা ভড়কাল তনুকা। ভ্রু যুগল কুঁচকে বলল,

‘মা বাদে সবাই আপনার শত্রু? রেনু, বাবা আর আমিও?’

থামল মেহতাব। গভীর মনোযোগে তনুকাকে পরখ করল। এগিয়ে এসে তার শীতল হাত ছুঁয়াল তনুকার গন্ডস্থলে। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,

‘তুমি কি তবে আমার শত্রু নও? সুযোগ পেলে আঘাত করবে না আমায়?’

তনুকার অদ্ভুত লাগল। সে বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘আশ্চর্য, আমি কেন আপনাকে আঘাত করতে যাব? কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে কখনোই আঘাত করে না।’

‘যদি কখনো ভুল বুঝে করে ফেল?’

‘ভুল বোঝার মতো কিছু করবেন না, তাহলেই তো হয়।’

‘আর যদি করে ফেলি, তবে ক্ষমা করতে পারবে তো?’

তনুকা স্তব্ধ হয়। চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেহতাবের চোখের দৃষ্টি অস্থির। বারবার চোখের পাতা পিটপিট করে। তনুকা তার গালের উপর রাখা হাতে নিজের হাত রাখে। অতঃপর বলে,

‘আমি সবকিছু ক্ষমা করতে পারলেও, কারোর মিথ্যে বলার বিনিময়ে চাওয়া ক্ষমা গ্রহণ করতে পারি না। তাই একটাই অনুরোধ থাকবে, কখনো আমাকে ঠকাবেন না। আমি ঠকতে চাই না, ভালোবাসা চাই। ভালোবাসতে পারলে আমি নিজেকে সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আপনার সাথে মানিয়ে নিতে পারব, তবে কখনো ঠকালে আমি আর আপনাকে সহ্য করতে পারব না। তাই দেরি করে হলেও, ভালোবাসাটা যেন খাঁটি হয়। আমি সেই ভালোবাসায় কোনো খাঁদ চাই না, মেহতাব।’

চলবে…

(“ফলো দিলে ফলো ব্যাক পাবেন”, এই ধরনের কমেন্ট না করার অনুরোধ রইল; নয়তো পরবর্তীতে ব্লক করা হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here