#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৬।
তনুকার হাত হতে এক সূক্ষ ফুল ছিঁড়ে তার কানে গুঁজে দিল মেহতাব। তারপর হাত নামিয়ে স্পর্শ করল তার কপোল। স্মিত সুরে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
‘ফুলের রাজ্যের চমৎকার রাণীটি আজ আমার মহলে, আমার চোখের সামনে; মনে হচ্ছে আমার জন্ম বৃথা যায়নি।’
লজ্জায় মাথা নোয়ায় তনুকা। আরক্ত হয় কপোলযুগল। অল্পতেই তাকে সংকুচিত হতে দেখে মুচকি হাসে মেহতাব। বলে,
‘এত লজ্জা পাচ্ছো কেন, বিবিজান? আমি কি কিছু করেছি?’
তনুকা সুর হারাল। কথার শব্দ গুছাতে না পেরে চেয়ে রইল কেবল। মেহতাব তারদিকে আরেকটু অগ্রসর হলো। তার অন্য হাত গিয়ে ঠেকল তনুকার কোমরে। তনুকা ঢোক গিলল। শরীরের রক্ত আচমকা চমে যাচ্ছে বলে মনে হলো তার। ঠোঁট কাঁপছে মৃদু ছন্দে। হাতের ফুলগুলোকে চেপে ধরল শক্ত করে। মেহতাবের হাতের বিস্তৃতি আরেকটু সচল হতেই অস্থিরতায় গায়ে কাটা দিয়ে উঠল তার। মেহতাব আলতো স্পর্শে তনুকার চুল সরিয়ে কপালে তার ওষ্ঠ ছোঁয়াল। চোখ বুজল তনুকা। তবে কিছু বলল না। শরীরের কম্পন এতে বৃদ্ধি পেল যেন। মেহতাব ঠোঁট সরিয়ে পূর্ণ মনোযোগে দেখল তাকে। চোখ আটকাল তার। এক জোড়া রক্তিম শুষ্ক চামড়ায় যেন খুঁজে পেল নিজের সমস্ত সুখ। তবে এত কাছে থেকেও সেই সুখকে স্পর্শ করার সাহস সে পাচ্ছে না। মস্তিষ্ক মানলেও, বেহায়া মন মানতে নারাজ। সে এক ইঞ্চি এগিয়ে গিয়ে আবার পিছিয়ে যায়। মনে পড়ে, তনুকা তাকে এখনও সম্মতি দেয়নি। সে মেয়েটার সাথে জোর খাটাতে পারে না। তাই বিষন্ন মনে সরে দাঁড়ায়। নিরেট স্বরে বলে,
‘চলো ঘাটে গিয়ে বসি।’
তনুকার ভ্রু যুগলের মাঝখানে কিঞ্চিৎ ভাঁজের দেখা মেলে। সে কি তবে বিরক্ত? কেন? মেহতাব বারংবার নিকটে এসেও ফিরে যাচ্ছে বলে? সে তো এমন বেশরম ছিল না। তবে বিয়ের পর এসব চিন্তা কেন আসছে? মানুষটা তার স্বামী বলে?
তনুকা নিশ্বাস ফেলে জোরে। গুমোট সুরে বলে,
‘চলুন।’
পানি থেকে এক সিঁড়ি উপরে বসে মেহতাব আর তনুকা। তার দরুন পা তাদের দীঘির জলে ডুবন্ত। মিষ্টি বিকেল। মৃদু বাতাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে তাই। সূর্য ইতিমধ্যেই হেলে পড়েছে পশ্চিমে। ঘাটের চারদিকের নারকেল গাছগুলো থেকে থেকে শব্দ করে পাতা নাড়াচ্ছে। তাদের পড়ন্ত প্রতিবিম্ব ঢেউ খেলানো উন্মুক্ত দীঘিতে চমৎকার লাগছে তনুকার। সে এক দৃষ্টিতে পানি দেখছে। মেহতাবও তাই। দুজনের মাঝে দূরত্বও বেশ। তনুকা আরো কিছুক্ষণ সময় পাড় করে মৃদু সুরে বলল,
‘আমার সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন?’
মেহতাব চাইল। এক পল ভেবে বলল,
‘যতটুকু জানলে একজন অপরিচিত মেয়েকে বিয়ে করা যায়, ততটুকুই।’
‘আমার যে বাগানবিলাস পছন্দ, সেটা কী করে জানলেন?’
‘এক দেখাতেই আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের দিন তোমার এক বান্ধবীর সাথে আমার কথা হয়েছিল, তার কাছ থেকেই জেনেছি।’
‘আমাকে এত পছন্দ কেন হলো আপনার? আমি তো আহামরি সুন্দরী নয় যে, এক দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাবেন।’
‘প্রেমে পড়তে রূপ লাগে, তবে ভালোবাসতে রূপ লাগে না। আমি তোমার প্রেমে পড়েনি, ভালোবাসায় মজেছি।’
তনুকা নিমিষ চেয়ে থাকল। জিজ্ঞেস করল,
‘এত অল্প সময়ে এত ভালোবাসা? পরে যদি আফসোস হয়?’
কিঞ্চিৎ হাসে মেহতাব। বলে,
‘আমার নিজের উপর ভরসা আছে। আজ অবধি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত আমি নেই নি।’
তনুকা মৃদু হাসল। সামনের দিকে চেয়ে বলল,
‘আমার কাছে কেন যেন মনে হয়, আপনি যতটা সহজ ভাবে নিজেকে প্রকাশ করছেন, আপনি মানুষটা ততটাও সহজ নন। আপনার ভেতরটা বেশ জটিল।’
‘এমন মনে হওয়ার কারণ?’
‘জানি না। মনে হয় কেবল। তবে এমনটা নাও হতে পারে।’
ফিচেল স্বরে মেহতাব বলল,
‘আবার হতেও পারে।’
তনুকা চকিতে চাইল। মেহতাব হেসে বলল,
‘অবাক হচ্ছো কেন? আমি তো চাই, তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো; আমার চিন্তায় মাথা ব্যথা করুক। তাও তোমার সঙ্গ আমি হারাতে চাই না।’
তনুকা নির্বাক বসে রইল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,
‘আযান দিবে, চলুন বাসায় যাই।’
‘চলো।’
_________
সন্ধ্যার চা নিয়ে তনুকা তার শাশুড়ির রুমের দরজায় আওয়াজ তুলল। বলল,
‘ভেতরে আসব, মা।’
‘এসো।’
চা নিয়ে ভেতরে আসে তনুকা। চায়ের কাপ আস্তে করে টেবিলে রাখে। প্রসন্ন স্বরে বলে,
‘সবাই বসার ঘরে চা নাস্তা করেছেন, আপনি আজ আসেননি কেন, মা?’
আম্বিরা বেগমের হাতে একটা বই ছিল। সে বইটা দুইদিকে ছড়িয়ে উল্টো করে বিছানায় রেখে বলল,
‘মনটা ভালো না, তাই বের হতে ইচ্ছে করেনি। ঘরে চা নিয়ে এসে ভালো করেছ। এখানে এসে বসো।’
তনুকা মৃদু হেসে শাশুড়ির পাশে জায়গা নিল। আম্বিরা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘চা তুমি বানিয়েছ?’
‘জি, মা।’
‘ভালো হয়েছে।’
প্রশংসা শুনে খুশির মাত্রা বাড়ল তার। শাশুড়ি মা আরেক চুমুক চা খেয়ে বললেন,
‘শুনো বউমা, আমার অবর্তমানে এই মহল তোমার। এই মহলের উপর শকুনের চোখ কিন্তু আরো আগ থেকেই ছিল, এতদিন আমি আগলে রেখেছিলাম। এখন বয়স হয়েছে, বুদ্ধি কমেছে; সব সামলাতে কষ্ট হয়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ থেকে সব দায়িত্ব আমি তোমাকে দিব।’
এই বলে তিনি নিজের আঁচলের কোণ থেকে এক বিশাল চাবির গোঁছা খুলে হাতে নিলেন। তনুকা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখছে। তিনি আলগোছে তনুকার এক হাত তুলে চাবির গোঁছা রাখলেন সেখানে। বললেন,
‘আমার মহল সামলানোর দায়িত্ব আজ থেকে তোমার।’
তনুকা বিস্ফোরিত চোখে চাবির গোঁজা খানা দেখল। হাতে নিয়েই মনে হলো, ভীষণ ভার। যেখানে সে এই সামান্য চাবির ভার সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে সে এই বিশাল মহল কী করে সামলাবে? তাই সে ইতস্তত সুরে বলল,
‘মা, আমি পারব না।’
‘পারব না বলে কোনো শব্দ হয় না, তনুকা। মানুষ চাইলে সব পারে। তোমাকেও পারতে হবে।’
‘কিন্তু, মা..’
‘উঁহু, আর কোনো কথা নয়। এটা কিন্তু আমার অনুরোধ না, আমার আদেশ। আর তুমি নিশ্চয়ই আমার আদেশ অমান্য করবে না।’
তনুকা পড়ল মহা বিপদে। একটা স্বাধীন মুক্ত পাখিকে খাঁচায় বেঁধে তার মাথায় বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিলে কি সে সামলাতে পারবে? তনুকা কি এতকিছু সামলেছে কখনো? নিজের আলাদা একটা স্বাধীন জীবনে পড়াশোনা ব্যতিত আর কোনো চিন্তা ছিল না তার। অথচ, এখন এক পাহাড় সমান দায়িত্ব কাঁধে বয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে। এই দুঃখ কাকে বোঝাবে সে?
‘কী হলো, আমার আদেশ শুনবে না।’
উপায়ান্তর না পেয়ে রাজী হতে হলো তাকে। আম্বিরা বেগম খুশি হলেন খুব। তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
‘আমি জানি তুমি পারবে। আমার পরে এই মহলের একমাত্র যোগ্য উত্তরাধিকারী কেবল তুমি।’
তনুকা মৃদু হেসে মাথা নোয়াল। ভাবল, আদৌ পারবে তো সে। আম্বিরা বেগম অনেক কিছু বোঝালেন তাকে। কথার মাঝে সাবধান বাণীও ছুড়লেন বেশ। চোখ কান খোলা রাখতে বললেন। শকুনদের থেকে নিজেকে রক্ষা করার বিভিন্ন কৌশল শেখালেন। সেসব মাথার উপর দিয়ে গেল তনুকার। কিছু না বুঝেই, হু হা করে সমানে তাল মিলিয়েছে শুধু। কথা শেষ হতেই মনে হলো, মাথা ভার ভার লাগছে। একটু পরে নির্ঘাত মাথা ব্যথাও শুরু হবে।
আম্বিরা বেগম স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন,
‘তোমার উপর সব দায়িত্ব নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত। এবার রুমে যাও তুমি। রাতের খাবারের সময় কথাটা আমি বাড়ির বাকি সবাইকেও জানিয়ে দিব।’
তনুকা উঠে দাঁড়াল। বিছানা থেকে চায়ের কাপটা তোলার সময় হঠাৎ সেখানে রাখা বইয়ে চোখ আটকাল তার। বইয়ের নাম, “খু’নের সাতকহন”। বইয়ের নাম দেখে অবাক না হয়ে পারল না তনুকা। এই বয়সে এসে তার শাশুড়ি মা এমন খু’ন টুন নিয়ে বই কেন পড়ছেন, আশ্চর্য।
চলবে…
(উল্লেখিত নামে কোনো বই আছে কি না জানা নেই। নামটি কাল্পনিক,গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই দয়া করে, বাস্তবের সাথে মেলাবেন না।)