#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৯।
সব শুনে অতি বিস্ময়ে তনুকা রা হারিয়ে বসে। মেহতাব এমন একটা সিদ্ধান্ত কী করে নিতে পারে? একটা মানুষের ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ কেউ তার শরীরের অংশ চায় না কি? এটা তো অন্যায়, ঘোর অন্যায়।
তার পায়ের সামনে বসে মেয়েটি সমানে কাঁদছে। তনুকা ধরে উঠায় তাকে। আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘কিচ্ছু হবে না, চলো।’
তনুকা যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আম্বিরা বেগম ডাকেন তাকে। গম্ভীর স্বরে বলেন,
‘বিচার মহলে যাওয়া বারণ, ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই।’
তনুকা ফিরে তাকায়। শক্ত আওয়াজে বলে,
‘ভুলিনি, মা। তবে কোনো অন্যায়ও আমি সহ্য করতে পারব না। ক্ষমা করবেন, আমাকে যেতেই হবে।’
‘তোমাকে ভরসা করেছিলাম, বউমা। এখন তো মনে হচ্ছে সংসারে অশান্তিটা তুমিই লাগাবে।’
‘অন্যায়ের বিরোধিতা করলে যদি সংসারে অশান্তি লাগে তবে, সেই অশান্তিতে আমার কিছু যায় আসে না।’
এই বলেই তনুকা মেয়েটার হাত ধরে ছুটল। আম্বিরা বেগম ভোঁতা মুখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। হঠাৎ কী একটা চিন্তায় কপাল কুঁচকে নিলেন। ভাবলেন, “মেয়েটার বড্ড সাহস, এত সাহসই না ভবিষ্যতে আবার…”, এতটুকুতেই থেমে গিয়ে তিনিও মাথার ঘোমটা ঠিক করে ছুটলেন তনুকার পেছন পেছন।
মেয়েটির পেছনে ছুটে আসা প্রহরী দুজন থমকে দাঁড়ায়। তনুকাকে দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে পড়ে যেন। সেদিন সকালের কথা মনে আছে তাদের। তাই ভীত হয় ভীষণ। তনুকা প্রহরী একজনকে গিয়ে বলে,
‘বিচার মহলের ভেতরে গিয়ে জমিদার বাবুকে বলুন, উনার স্ত্রী উনার সাথে এক্ষুনি দেখা করতে চান।’
লোকটি আমতা আমতা করে বলল,
‘বিচার কার্য শেষ না হওয়া অবধি বাবু আসবেন না।’
‘যা বলেছি তাই করুন, নয়তো আমিই ভেতরে চলে যাব।’
প্রহরীর ভয়ের মাত্রা বাড়ল। অস্থির স্বরে বলল,
‘যাচ্ছি যাচ্ছি।’
একজন প্রহরী ছুটে বিচার মহলে প্রবেশ করে। ততক্ষণে আঙ্গুল কাটার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। উপস্থিত জনগণ বেশ উৎসুক এসবে। একটা ছেলে তার শরীরের একটা অংশ হারাচ্ছে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই তাদের। মেহতাবের ঠোঁটের কোণে চওড়া হাসি। ইশফাক তার দিকে চেয়ে বলল,
‘হুকুম দিন, আমি প্রস্তুত।’
মেহতাব কিছু বলার আগেই প্রহরী সাহস নিয়ে বলে উঠে,
‘মার্জনা করবেন বাবু, ছোট মাতা আপনাকে ডাকছেন।’
মেহতাবের কপালে ভাঁজ পড়ে। জিজ্ঞেস করে,
‘কে? বিবিজান?’
প্রহরী নত জানু করে বলে,
‘জি, বাবু। এক্ষুনি যেতে বলেছেন, না হয় উনি ভেতরে চলে আসবেন।’
‘তুমি বলোনি, আমি ব্যস্ত?’
‘বলেছি। শুনেননি, উল্টো ভেতরে চলে আসার হুমকি দিয়েছেন।’
মেহতাব চেয়ারের হাতল চাপড়ে কী ভাবল কিয়ৎক্ষণ। তারপর বলল,
‘যাও, আমি আসছি।’
প্রহরী বেরিয়ে যায়। মেহতাব দাঁড়িয়ে বলে,
‘কিছুক্ষণের জন্য বিচারকার্য স্থগিত করা হলো। আমি ফিরে আসার পর পুনরায় সব শুরু করা হবে।’
মেহতাব বেরিয়ে যেতেই মহলে শুরু হয় এক চাপা গুঞ্জন। সবাই কানাঘুষা করছে, তাদের জমিদার বাবু আজকাল একটু বেশিই বউকে মান্য করে চলছেন। নয়তো, যেই ব্যক্তি বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে কেয়ামত হয়ে গেলেও এক চুল নড়তেন না, তিনি শুধুমাত্র বউয়ের ডাকে এভাবে সব ফেলে ফুলে ছুটে চলে গেলেন? তাহলে কি জমিদার বাবুও হয়ে গেলেন বউয়ের গোলাম?
মতিব মজুমদার মেঝো ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন,
‘দেখলেন ভাই, ছেলেটা কেমন বউয়ের ন্যাওটা হয়েছে? এমন চলতে থাকলে তো এই ছেলে একদিন বউয়ের হাতে সব দায়িত্ব দিয়ে জমিদারী ভাসাবে।’
মেঝ কাকা গুমোট স্বরে বললেন,
‘প্রত্যেক পুরুষ’ই কম বেশি বউয়ের ন্যাওটা হয়ে থাকে, এ আর এমন কোনো বড়ো ব্যাপার না।’
মতিব মজুমদারের মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করল। এই এক কারণেই মেঝ ভাইকে তাঁর পছন্দ না, কখনোই লোকটাকে সে মেহতাবের বিরুদ্ধে নিতে পারে না যে।
________
তনুকার পাশে দাঁড়ান মেয়েটাকে আপাদমস্তক পরখ করে মেহতাব জিজ্ঞেস করে,
‘ডেকেছ কেন, বিবি?’
তনুকা শান্ত গলায় বলল,
‘এটা কেমন সিদ্ধান্ত? কারোর ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ আপনি তার আঙ্গুল কাটতে পারেন না।’
‘ছেলেকে জোর করা হয়নি, সে স্বেচ্ছায় সম্মতি দিয়েছে।’
‘আপনি আদেশ দিয়েছেন বলেই তো দিয়েছে। আদেশ ফিরিয়ে নিন, এটা অন্যায়।’
‘ন্যায় অন্যায় বোঝার মতো ক্ষমতা আমার আছে, বিবি।’
‘থাকলে এমন একটা আদেশ দিতেন না।’
‘নাহলে মেয়ের বাবা কখনোই ঐ ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হবেন না।’
‘আমি বিয়ে করমু না, বাবু। তাও তার আঙ্গুল কাইটেন না।’
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল।
‘ঠিক বলছো? বিয়ে করবে না?’
মেহতাবের তীক্ষ্ণ প্রশ্নের জবাবে, মেয়েটি সোজা শব্দে আওড়াল,
‘না, করমু না।’
‘ঠিক আছে, ভেতরে গিয়ে এই কথাটাই বলবে। চলো।’
মেহতাব যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। মেয়েটাও সাথে চলে। তনুকা পা বাড়াতেই মেহতাব ফিরে চায়। গম্ভীর সুরে বলে,
‘তুমি ভেতরে যাও, তনু। তোমাকে যেন মহলের আশেপাশেও না দেখি।’
তনুকার চোখ মুখ বিষন্নতাই ছেয়ে যায়। সে হতাশ সুরে বলে,
‘এসব কাটাকাটি ছাড়াও তো বিয়েটা হতে পারে। আপনার হুকুমে সব সম্ভব।’
‘মেয়ের বাবা রাজি না, এক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই।’
তনুকা মেয়েটির দিকে চাইল। মেয়েটার চোখগুলো কেমন যেন ছলছল করছে। যেন এক অফুরন্ত ভালোবাসাকে না পাওয়ার আক্ষেপ ঐ অক্ষিযুগল বেয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার। সে ফের তাকায় মেহতাবের দিকে। অসহায় সুরে বলে,
‘আপনি একবার চেষ্টা করে দেখুন, মেহতাব। আমার অনুরোধ।’
মেহতাব স্মিত হাসল। তনুকার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে বলল,
‘চেষ্টা করব।’
তারপর মহলে চলে এল সে। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটল। উৎসুক জনতার মাঝে ফের এসে উৎসাহের স্রোত ভর করল। মেহতাব গিয়ে বসে তার আসনে। মেয়েটি একটু আঁড়াল হয়ে দূরে দাঁড়ায়। তার সম্মুখে ছেলেটি, একটা টেবিলে বসা। সেই টেবিলে সাজানো বেশ কয়টা ধারালো ছু ড়ি। ইশফাক পাশেই দাঁড়ানো। টানটান হয়ে আছে তার প্রশ্বস্থ বুক। উজ্জ্বল ফরসা গা জড়িয়ে রাখা কাবলি পাঞ্জাবীটা ঘামে ভিজে আছে। সে নিরস মুখে চেয়ে আছে মেহতাবের দিকে। মেহতাব জোরে শ্বাস ফেলে। প্রশ্ন ছুড়ে,
‘কাজী ডাকা হয়েছে?’
একজন সেবক বলে উঠে,
‘জি বাবু, কাজী চলে এসেছেন। আঙ্গুল কাটার পরপরই বিয়ে পড়ানো হবে।’
‘কাজী সাহেবকে ডেকে আনো; বিয়ে এখনই পড়ানো হবে।’
উপস্থিত জনতার মাঝে ক্ষীণ চাঞ্চল্যতা তৈরি হয়। একজন প্রশ্ন করে বসে,
‘তাহলে কি আঙ্গুল কাটা হবে না?’
মেহতাব সহসাই বলে উঠে,
‘না।’
এতে পুনরায় ক্ষিপ্ত হয় মেয়ের বাবা। বলে,
‘তাইলে আমি মেয়ের বিয়ে দিমু না। আমার প্রমাণ লাগবই।’
মেহতাব চোয়াল শক্ত করে লোকটার দিকে চাইল। তারপর হুকুমের সুরে বলল,
‘ইশফাক, আমার কথা যে অমান্য করবে আঙ্গুল তার কেটে নিয়ে আসবে।’
ইশফাক মাথা কাঁত করে বলে,
‘জি।’
এরপর বৃদ্ধ লোকটি আর কিছু বলার সাহস পায়নি। তবে উপস্থিত জনতা খুশিই হয়েছে এতে। ছেলে মেয়ে দুটো ভালো থাকলেই হলো, এত ঝামেলা করে কী লাভ?
তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। এই খবর চলে গেল অন্দরমহল পর্যন্ত। তনুকা যখন জানতে পারল যে, আঙ্গুল কাটা ছাড়াই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, তখন খুশি আর ধরে রাখতে পারছিল না সে। মেহতাব তার কথা রেখেছে। তার মানে মেহতাবের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার মতামত। এতটুকুতেই ভীষণ তৃপ্ত হলো সে। অবশেষে মনে হলো, জীবনে একজন ভালো মানুষ পেয়েছে, যার কাছে তার মূল্য অত্যধিক।
আম্বিরা বেগমের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। মহলের বাইরেই একটা কক্ষে বসে ছিলেন তিনি। ছেলের কাজে অধিক বিরক্ত হলেও প্রকাশ না করে হাসলেন কেবল। ভাবলেন, “নারী জাতির চেয়ে ভয়ংকর কোনো জাতি হতেই পারে না।” অথচ তিনি ভুলে গেলেন, তিনিও সেই জাতির’ই অংশ।
চলবে….
ছবি: রত্নাবু❤️