প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৪।

0
73

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪।

রেনুকে দেখা মাত্রই তেড়ে এলেন আম্বিরা বেগম। মুখে তাঁর ক্রোধ ঝলমল করছে। বাজখাঁই সুরে বললেন,

‘তুমি কার সাথে মার্কেটে গিয়েছিলে?’

তনুকা তার পাশেই। রেনু তার দিকে তাকায়। তনুকা প্রসন্ন হেসে বলে,

‘মা, আমার সাথে।’

আম্বিরাসহ বাকি সকলে হকচকিয়ে ওঠে। আম্বিরা বেগম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

‘ঘরের বউ আমাকে না জানিয়ে মার্কেটে গিয়েছিল? এত বড়ো স্পর্ধা কী করে হলো তোমার?’

তনুকা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বলল,

‘ঘরের বউকে যে ঘরেই বন্ধী থাকতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। প্রয়োজনে বাইরেও যেতে হবে। আজ প্রয়োজন ছিল, তাই বাইরে গিয়েছিলাম।’

আম্বিরা বেগম চোয়াল শক্ত করলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

‘তাই বলে আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করবে না?’

তনুকা মাথা নত করে বলল,

‘তার জন্য আমি দুঃখিত। তাড়ায় ছিলাম, তাই আর বলা হয়ে ওঠেনি।’

আম্বিরা বেগম রাগে জ্বলছেন যেন। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে সরে দাঁড়ান। তনুকা রেনুকে বলে,

‘তুমি ভেতরে যাও, রেনু।’

রেনু ত্রস্ত পায়ে নিজ কক্ষের দিকে যায়। তনুকা শাশুড়ির দিকে চেয়ে বলে,

‘ভুলের জন্য চাইলে আপনি আমাকে শাস্তি দিতে পারেন, মা।’

আম্বিরা বেগম আগুন চোখে চাইলেন। বললেন,

‘তুমি আমার চোখের সামনে থেকে যাও এখন।’

তনুকা কথা বাড়াল না। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নিজ কক্ষের দিকে।

‘দেখলে ভাবি, কী সাংঘাতিক মেয়ে! তোমাকে পাত্তাই দিল না। কত বড়ো সাহস ওর! কাউকে কিছু না বলে ননদ নিয়ে চলে গিয়েছে মার্কেট ঘুরতে, বাইরের মানুষেরা এখন কী বলবে কে জানে?’

আম্বিরা বেগম মাথায় হাত রেখে সোফায় বসলেন। চোখ মুখ গম্ভীর তার। রাহীলা খুশি হলো তাতে। উর্মি বললেন,

‘ছোট মানুষ, ভাবি; বুঝেনি।’

‘ছাব্বিশ বছরের একটা মেয়ে নিশ্চয়ই ছোট নয়,মেঝো।’

আম্বিরা বেগমের কর্কশ স্বরের প্রতিদানে চুপ রইলেন ঊর্মি। কথা বলার ভাষা তিনিও হারিয়েছেন। তনুকার কাছ থেকে এমন কাজ বিশ্বাসাতীত ছিল তাঁর।

_____

মেহতাব অন্দরে প্রবেশ করতেই আম্বিরা বেগমকে দেখলেন, সোফায় মাথা ফেলে বসে আছেন। চোখ বোজা। দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে। সে এসে তাই মায়ের শিউরে বসে। ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, আম্মা?’

আম্বিরা বেগম চোখ মেলে চাইলেন। ছেলের অপেক্ষা করছিলেন তিনি। তাকে দেখা মাত্রই উগলে দিলেন সমস্ত ঘটনা। মেহতাব সব শুনে বলল,

‘তনু তো এমন দায়িত্বহীন না, আম্মা। তাহলে এমন কেন করল? অন্তত একবার আমাকেই জানাতে পারত।’

আম্বিরা বেগম গর্জে উঠে বললেন,

‘সেটা তোমার বউকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করো না, কেন এমন করেছে।’

মেহতাব শ্বাস ফেলে বলল,

‘ঠিক আছে, আমি জিজ্ঞেস করব।’

নিজের ঘরে আসে মেহতাব। তবে ঘর শূন্য মেলে। তনুকা কোথাও নেই। গোসলখানা আর বারান্দায় চোখ বুলিয়েও তাকে পায়না মেহতাব। তাই ভাবে, হয়তো রেনুর রুমে। তার আন্দাজ সঠিকও হলো। তনুকার হদিস মেলল সেখানেই। রেনুর ঘরের দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে মেহতাব। ভেতরে রেনু এক লাল রঙের জামা গায়ে দিয়ে নেচে কুদে কী কী যেন করছে। তনুকা সেসব দেখছে, আর মজা পেয়ে হাসছে ভীষণ। তনুকার হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে নিমিষেই সব ভুলে বসে মেহতাব। অপলক চেয়ে রয় সেদিকে। মেহতাবকে খেয়াল করা মাত্রই তনুকা হাসিয়ে থামিয়ে বলে উঠে,

‘আপনি? কখন এলেন?’

মেহতাব সোজা হয়ে দাঁড়ায়। গম্ভীর সুরে বলে,

‘মাত্রই।’

ভাইজানকে দেখে স্থির হয় রেনু। ভয়ে তনুকার পাশে চুপটি করে বসে। মাথা নত করে বলে,

‘ভাইজান, বউমনির কোনো দোষ ছিল না। আমি জোর করেছি বলেই বউমনি গিয়েছিল। নাহলে কখনোই যেত না।’

‘যাওয়াটা সমস্যা না। কাউকে না বলে যাওয়াটা সমস্যা।’

তনুকা মৃদু আওয়াজে বলল,

‘আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি বুঝতে পারিনি।’

‘ঠিক আছে, ক্ষমা করে দিলাম। এবার ঘরে চলো। আর এই যে ম্যাডাম, শুধু এমন লাল পরী সেজে ঘুরলে হবে না; সামনে না এস এস সি, ভালোমতো পড়াশোনা কর। ফেইল করলে কিন্তু বিয়ে নিশ্চিত।’

রেনু কপাল কুঁচকে বলে উঠে,

‘না, মোটেও আমি বিয়ে করব না।’

‘তাহলে পড়াশোনা কর ভালো করে।’

‘আচ্ছা, তোমার রিসিপশনটা শেষ হয়ে যাক; তারপর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করব।’

_________

‘মায়ের মতো আপনিও কি রেগে আছেন?’

‘না, রেগে থাকব কেন?’

‘আসলে সত্যিই তখন অনুমতি নেওয়ার কথাটা মাথায় ছিল না। আগে তো খুব স্বাধীন ভাবে চলা ফেরা করেছি, তাই আগের মতোই কাউকি কিছু না বলে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আমি দুঃখিত তার জন্য।’

‘ক্ষমা করে দিয়েছি তো। আর কত দুঃখিত হবে?’

‘মা খাবার টেবিলে একটুও কথা বলেননি।’

‘কালকেই এই রাগ পড়ে যাবে। এখন একটু এদিকে এসো তো।’

তনুকা একটু এগিয়ে বলে,

‘কেন?’

‘আমার কোলে মাথা রেখে শোও, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’

তনুকা অবাক চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেহতাবের কথা মতো কাজ করল। মেহতাব দুপা লম্বা করে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসেছে। তার কোলের উপর তনুকার মাথা। খোঁপা বিহীন উন্মুক্ত চুল ছড়িয়ে আছে এক পাশে। মেহতাব বেশ যত্ন করে হাত বুলাচ্ছে তাতে। মাঝে মাঝে একটু চুল নাকের কাছে ধরে শুঁকছে। কেমন এক মাতাল করা ঘ্রাণ যেন পাচ্ছে সে। বারংবার সেই ঘ্রাণে শরীরে শিহরণ দিচ্ছে তার। তনুকার চোখের পাতা নিমীলিত। সে স্মিত সুরে বলে উঠে,

‘রাতেও বাবা ঠিক মতো খায়নি।’

এই অসময়ে বাবার কথা তুলাতে খানিকটা বোধ হয় বিরক্ত দেখায় মেহতাবকে। তবে মুখে তার ছায়া মাত্র পড়তে না দিয়ে জবাব দেয়,

‘শরীরটা বোধ হয় আরো খারাপ করেছে, তাই এমন করছেন।’

‘ভালো ডাক্তার দেখানো খুব জরুরি।’

‘তুমি না কাকে বললে?’

‘হ্যাঁ, শনিবারে আসবেন বললেন।’

‘উনি এসে দেখলেই বলতে পারবেন সব।’

‘কিছু মনে করবেন না, আমার মনে হয় কি বাবাকে মা’র সাথে রাখলেই বোধ হয় ভালো হতো। প্রিয় মানুষের ছায়া বাবাকে সুস্থ হতে সাহায্য করত, যেটা এখন সম্ভব হয়ে উঠছে না।’

‘আচ্ছা, ডাক্তার এসে আগে দেখে যাক; তারপর না হয় আমি এই ব্যাপারে মায়ের সাথে কথা বলব।’

‘ঠিক আছে।’

_______

হঠাৎ শো শো শব্দে ঘুম ভাঙে তনুকার। চোখ মেলে চেয়ে দেখে সে মেহতাবের কোলেই ঘুমাচ্ছে। মেহতাবও হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছেন কখন কে জানে। তনুকা আস্তে করে উঠে বসে। জানলার দিকে চেয়ে দেখে, জানলার পর্দা খুলে আসার উপক্রম। আচমকা বাইরে এত বাতাস বইছে কেন? ঝড় আসবে না কি? তনুকা দ্রুত জানলার কাছে যায়। জানলা আটকাতে নিয়েও স্থির হয়ে যায় তার হাত। দূরে আবারও ছায়া মানব দেখে সে। এবার ছায়াটা একটু স্পষ্ট। দুটো মানুষের ছায়া। কাছাকাছি অবস্থান তাদের। বিচার মহলের বাইরের অংশে যে একটা ঘর আছে, তার’ই পেছনে তাদের অবস্থান। তনুকা চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ মনে হয়, সে বোধ হয় ছায়া মানবগুলোকে চিনে ফেলেছে। মৃদু হাসে সে। আস্তে করে জানলাটা আটকে দেয়। মেহতাবের পাশে গিয়ে বসে। মেহতাবের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে কেন যেন বড্ড মায়া হয় তার। এই শ্যামলা মুখে মায়ারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সব। এই পুরুষের সমস্ত রূপ যেন এই শ্যামলা রঙেই নিহিত। প্রেমে না পড়ে থাকাটা দুষ্কর। তনুকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রেমে পড়া যাবে না। প্রেমে পড়লে ঠকানো হবে। সে যে ঠকাতে পারবে না তাকে। তনুকা অস্থির হয়। ফোনটা হাতে নিয়ে কাউকে একটা মেসেজ লেখে, “কবে আসবে?” ওপাশ থেকে উত্তর আসে না কোনো। ফোন রেখে চুপচাপ একপাশে শুয়ে পড়ে সে। মেহতাবকে আর ডাকার প্রয়োজন বোধ করেনা।

চলবে….

ছবি: রত্নাবু❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here