প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৫।

0
75

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৫।

সকালের খাবারের মাঝেই এক ভৃত্য এসে খবর দিল, মহলে পুলিশ এসেছে। হঠাৎ পুলিশের আগমনে খানিকটা অবাক হতে দেখা গেল সবাইকে। মেহতাব ভৃত্যকে বলল,

‘উনাদের বসার ঘরে বসতে বলো, আমি আসছি।’

আম্বিরা বেগম জানতে চাইলেন,

‘পুলিশ কি তুমি ডেকেছ?’

‘না, আম্মা।’

কপাল কুঁচকালেন তিনি। বললেন,

‘তাহলে বাড়িতে হঠাৎ পুলিশ?’

‘হয়তো এসেছে দেখা করতে। আপনারা খান, আমি দেখে আসছি।’

মেহতাব উঠে হাত ধুয়ে বসার ঘরে যায়। দু’জন অফিসার বসা সেখানে। মেহতাব প্রসন্ন হেসে হাত মেলায় তাদের সাথে। জিজ্ঞেস করে,

‘হঠাৎ আমার মহলে? কোনো প্রয়োজন ছিল?’

একজন অফিসার বললেন,

‘না, আসলে একটু খোঁজ খবর নিতে এলাম। সময় তো ভালো যাচ্ছে না বোধ হয়। আপনার এক লোক, সলিমুল্লাহ খু’ন হয়েছিল কয়দিন আগে। এখন আবার পরশু থেকে তার ভাই করিমুল্লাহও উধাও। ব্যাপারটা আমাদের খুব চিন্তায় ফেলেছে।’

মেহতাব চকিতে চেয়ে বলে,

‘কী বলছেন, অফিসার? করিমুল্লাহ উধাও? হুট করে একটা মানুষ উধাও কী করে হয়ে যায়?’

‘সেটাই ভাবছি। এখনো অবধি সলিমুল্লাহ’র খু’নের কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারলাম না, তার উপর এখন আবার তার ভাইও উধাও। দুই দিন ধরে ফোন বন্ধ। বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলাম, সেখানেও নেই। আপনার সাথে কি কোনোপ্রকার যোগাযোগ হয়েছিল?’

‘না না, আমি তো দুইদিন যাবত গ্রামের কাজ নিয়ে ব্যস্ত খুব। উত্তরের রাস্তাটা মেরামত করাচ্ছি, তাই এইদিকের খোঁজ খুব একটা রাখতে পারছি না। করিমুল্লাহ’র নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা তো আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে; এভাবে আবার কাছের লোকগুলোর লা পাত্তা হওয়াটা তো মোটেও স্বাভাবিক ঠেকছে না আমার।’

অফিসার ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,

‘আপনার কি কাউকে সন্দেহ হচ্ছে?’

‘সন্দেহ? সন্দেহ কাকে হবে? আমি তো কারোর সাথে কোনো অন্যায় করিনি, তবে আমার খারাপ কে চাইবে?’

‘দেখুন মেহতাব সাহেব, আপনি ভালো মানুষ। আর সত্যি বলতে, পৃথিবীতে সব খারাপ ভালো মানুষগুলোর সাথেই হয়। চোখ কান খোলা রাখবেন, আর সন্দেহজনক কিছু দেখলে সাথে সাথে জানাবেন আমাদের।’

‘জি, অবশ্যই।’

পুলিশ অফিসার দুজন বেরিয়ে গেলেন। তারা বের হতেই বসার ঘরে হুরমুরিয়ে প্রবেশ ঘটল সকলের। আম্বিরা বেগম বিচলিত সুরে বললেন,

‘কী হয়েছে, মেহতাব?’

মেহতাব গম্ভীর স্বরে বলল,

‘সলিমুল্লাহ’র ভাই করিমুল্লাহ উধাও; সেটাই পুলিশ জানাতে এসেছিলেন।’

আম্বিরা বেগম চমকে যান। মতিব মজুমদার কপাল কুঁচকে বলেন,

‘উধাও মানে? হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে কী করে?’

মেহতাব তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে,

‘সেটা তো আমিও ভাবছি, কাকা। হঠাৎ করে একটা মানুষ কী করে উধাও হয়ে যেতে পারে? নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে এর পেছনে, এমনি এমনি তো কেউ আর উধাও হয়না।’

মেহতাবের সূচালো দৃষ্টি দেখে ভীত হলেন মতিব মজুমদার। চোরের মতো মুখ চুপসে দাঁড়ালেন। মেহতাব ফের গম্ভীর স্বরে বলল,

‘আমি নিরাপত্তা বাড়াব। আমার আঁড়ালে কেউ নিঁখুত ষড়’যন্ত্র আঁটছে। তাকে ছাড় দেওয়া যাবে না। একবার ধরতে পারলে, ঘাড় থেকে গর্দান আলাদা করতে আমি কিঞ্চিৎ পরিমাণ মায়াও দেখাব না।’

মতিব মজুমদার ঢোক গিললেন কেন যেন। চোখ তুলে চাইতেই মেহতাবের চোখে চোখ পড়ল। চোখ নামাল। ব্যস্ত গলায় বলল,

‘আমি করিমুল্লাহ’র বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখছি।’

তিনি দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। মেহতাব তাঁর যাওয়া দেখল এক পলকে। তারপর মায়ের দিকে চেয়ে বলল,

‘আম্মা, পুরো গ্রামের মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি বাকি সব আয়োজন করছি।’

আম্বিরা বেগম চিন্তা মিশ্রিত ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করে বললেন,

‘ঠিক আছে, দেখছি আমি। মেঝো, ছোট, আমার সাথে আমার ঘরে আয়।’

সবাই ভেতরে চলে গেল। দাঁড়িয়ে রইল কেবল তনুকা। সে অবাক চোখে চেয়ে আছে মেহতাবের দিকে। মেহতাবের চোখ পড়ে তাতে। জিজ্ঞেস করে,

‘কিছু বলবে, বিবিজান?’

‘প্রথমে একটা খু’ন, এখন আবার মানুষ উধাও? কে করছে এসব?’

‘পুলিশ তদন্ত করছেন, তনু। অপরাধী বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে না।’

‘ততদিনে যদি সে আপনার কোনো ক্ষতি করে বসে?’

‘আমার ক্ষতি কেন করবে?’

‘আপনার কাছের মানুষদের ক্ষতি করছে কি সাধে? সে নিশ্চয়ই আপনার ক্ষতি করতে চায়।’

মেহতাব হাসে। এগিয়ে এসে দু হাত ঠেকায় তনুকার গন্ডস্থলে। আমোদ গলায় বলে,

‘তুমি আছো না, আমার রক্ষাকবজ হিসেবে।’

তনুকা আপ্লুত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘আমি আপনার রক্ষাকবজ?’

‘হ্যাঁ।’

বলেই ছোট্ট করে সে চুমু খায় তনুকার কপালে। তনুকার স্তব্ধ হয়। নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ভাবে, সে মেহতাব মজুমদারের রক্ষাকবজ? বাস্তবে কি তাই হবে? না কি হবে তার উল্টো?

__________

শ্বশুরমশাইকে জোর করে কয়েক চামচ খাইয়ে তনুকা যায় রেনুর ঘরে। দরজায় টোকা দিয়ে বলে,

‘আসব, রেনু?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এসো বউমনি।’

তনুকা ভেতরে ঢুকে। রেনু পড়ার টেবিলে বসা। তনুকা গিয়ে বসে বিছানার এক পাশে। জিজ্ঞেস করে,

‘পড়ছিলে বুঝি?’

‘হু।’

তনুকা এক পল ভেবে বলে,

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’

কোনোপ্রকার বনিতা ছাড়াই তনুকা বলে উঠল,

‘গত রাতে বিচার মহলের পেছনের বাগানে তুমি ছিলে, তাই না?’

রেনু চমকে তাকায়। ঢোক গিলে। ইতস্তত সুরে বলে,

‘ন-না, আমি কেন থাকব?’

‘পাশে কে ছিল? ইশফাকুর রহমান?’

রেনু আকাশ থেকে পড়ে যেন। তনুকা বুঝে গেল কী করে? ধরা পড়ার চোরের মতো চুপসে যাওয়ার মুখ লুকানোর কোনো জায়গা পাচ্ছে না সে। তাই ঠাই বসে থেকে হাত কঁচলে বলল,

‘ইয়ে মানে, তুমি আগে ওয়াদা করো কাউকে বলবে না?’

‘করলাম ওয়াদা। বলো এবার।’

রেনু অস্বস্তি নিয়ে জবাব দেয়,

‘হ্যাঁ, আমরাই ছিলাম।’

‘আগের রাতের ঐ ছায়াযুগলও তোমরাই ছিলে, তাই না? আমি জানলা দিয়ে দেখেছিলাম তোমাদের।’

রেনু অবাক হয়ে শুধায়,

‘অত দূর থেকে দেখেও চিনে ফেলেছ?’

‘প্রথমবার দেখে চিনিনি তবে, কাল দেখে চিনতে পেরেছিলাম। তো কতদিন ধরে চলছে এসব?’

রেনু বোকার মতো হেসে বলে,

‘কী ভাবছ? আমাদের প্রেম চলে? মোটেও না। ঐ বদলোক আমার প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।’

‘কেন কেন?’

‘আমার ভাইজান মানবেন না বলে।’

‘কেন মানবেন না? ইশফাক তো ভালো ছেলে।’

‘সেটা তো আমিও অনেক বুঝিয়েছি উনাকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভাইজানের ভয়ে লোকটা কুপোকাত। কোনোভাবেই আমার প্রস্তাব গ্রহণ করবেন না। আমিও ছাড়ার পাত্রী না, ঝেঁকে বসে আছি উনার মাথায়। সারাদিন খুব জ্বালায় কিন্তু, সবটা লোক চক্ষুর আঁড়ালে। রাতে জোর করে দেখা করাই, ভীতু ছেলে, কেউ জেনে যাবে এই ভয়ে আমার সব কথা শুনে।’

এইটুকু বলে ফিক করে হাসে রেনু। তনুকা নিষ্পলক চেয়ে থেকে ভাবে,

‘এই নিষ্পাপ ভালোবাসাগুলোর মাঝে একমাত্র বাঁধা হলো এই ভয়। ভয় যদি না থাকত, তবে আজ সেও পেত এক অন্তরীক্ষ ভালোবাসার প্রহর।’

তনুকা এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রেনুর গালে হাত রেখে বলে,

‘চিন্তা করো না, আমি তোমার ভাইজানকে রাজি করাব।’

রেনু লাফিয়ে উঠে বলে,

‘সত্যি, বউমনি?’

তনুকা হেসে বলে,

‘হ্যাঁ, সত্যি।’

তারপর দুজনের গল্প জারি রয় আরো কিছুক্ষণ। রেনু তার ভালোবাসার প্রহরগুলো ব্যক্ত করে। প্রকাশ করে নিজের সুপ্ত অনুভূতিগুলোকে। তনুকাকে এত সব বলতে আর বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ কাজ করে না তার। তনুকাকে যেন ভাবির চেয়েও অধিক বোন ভাবতে শুরু করেছে মেয়েটা।

________

গোসল সেরে এসে ফোনটা হাতে নেয় তনুকা। ভাবে, এতক্ষণে হয়তো উত্তর একটা এসেছে। তবে তাকে আশাহত করে দিয়ে, ওপাশ থেকে উত্তরের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। তনুকা ফোনটা রেখে উঠে দাঁড়ায়। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে দুইটা বাজতে চলল। নামাজ পড়বে আজ। সে খুব একটা নামাজী না তবে, মনে খুব অশান্তি দেখা দিলেই নামাজে দাঁড়ায়। আজ মনে ফের অশান্তির স্রোত বইছে, নামাজ পড়ে সেই স্রোত কমাতে হবে। জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। নামাজ শেষ করে মোনাজাতে দুই হাত তুলে দোয়া করে,

‘যে আমার না, তাকে কখনো আমার হতে দিও না, খোদা। আমি যে কারোর ভালোবাসাকে অসম্মান করতে চাই না। তুমি তো বোঝো আমায়….’

চলবে….

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here