প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৬।

0
70

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৬।

দুপুরে আজ আর মেহতাব ফেরেনি। সে কোথায়, কেউ জানেও না। তনুকার মনও আজ বিষন্ন ভীষণ। কোনো এক চিন্তায় অস্থির সে। শ্বশুরমশাইকে ঠিকঠাক মতো খাওয়াতে পারেনি। মানুষটার অবস্থা বেগতিক। চোখ মুখ বসে গিয়েছে যেন। সারাক্ষণ ঘুমের মাঝেই থাকেন। তনুকা ভারাক্রান্ত মনে নিজের ঘরে ফিরে আসে। বাবার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু, নাম্বার পাবে কোথায়? তখন ভাবে, হয়তো ঊর্মির কাছ থেকে পেলেও পেতে পারে। সেই ভেবে ঊর্মির ঘরের নিকটস্থ হয় সে। দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘আসব?’

ভেতর থেকেও অনুমতি আসে সঙ্গে সঙ্গে,

‘এসো।’

তনুকা ভেতরে প্রবেশ করে। ঊর্মি তাঁর ঘরে একাই। স্বামী তাঁর মেহতাবের সাথে গিয়েছেন। তনুকা জিজ্ঞেস করে,

‘আপনার কাছে বাবার নাম্বার আছে?’

ঊর্মি মাথা নাড়িয়ে বলেন,

‘না।’

তনুকা নাক ফুলিয়ে জবাব দেয়,

‘থাকলেও দিবেন না, জানি।’

‘থাকলে অবশ্যই দিতাম।’

‘তার আর প্রয়োজন নেই।’

সে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। ঊর্মি বলে উঠেন,

‘একটু আমার পাশে বসবে? কথা বলবে কিছুক্ষণ?’

তনুকা ফিরে তাকায়। গম্ভীর সুরে বলে,

‘আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না আমার। আপনিও আর সেই ইচ্ছে পোষণ করবেন না দয়া করে।’

বেরিয়ে যায় সে। ঊর্মি বিধ্বস্ত চোখে চেয়ে থাকে। সকলের এত এত ভালো চেয়েও, কোনো ভালোই সে করতে পারেনি। বরাবরই সকলের লাঞ্ছনা সহ্য করে এসেছে। অথচ, সবার প্রতি তার ব্যবহার ছিল অমায়িক।

_______

রোদের তাপদাহ কমেছে। বিকেল নেমেছে প্রকৃতিতে। মহলে হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। কালকের জন্য করা হচ্ছে সমস্ত আয়োজন। আম্বিরা বেগম ব্যস্ত পায়ে ছুটছেন। বসে নেই মেজো আর ছোটোও। রেনু নিজ ঘরে ঘুমে ব্যস্ত। তনুকারও ইচ্ছে করছে না ঘর থেকে বের হতে। তাই সে বারান্দার থাই সরিয়ে বাইরে তাকায়। বাগানের একপাশে বিশাল সামিয়ানা টাঙানো হচ্ছে। এক কোণে বাবুর্চির দল সব আয়োজন করছেন, তাদের রান্নাবান্নার। মতিব মজুমদার আর রমেজ মজুমদার সেখানেই উপস্থিত। মেহতাবকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। তনুকা ঘরে ফিরে আসে। তখনই প্রবেশ ঘটে মেহতাবের। হাতে তার একগাদা ব্যাগ। সে তনুকার দিকে চেয়ে চমৎকার হাসে। ব্যাগগুলো বিছানায় রেখে বলে,

‘তোমার জন্য শপিং করে এলাম, বিবিজান। দেখো তো, পছন্দ হয় কি না?’

তনুকা এত ব্যাগ দেখে অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,

‘এত কিছু কেন?’

‘ইচ্ছে হলো তাই। এখন তুমি দেখো আগে, পছন্দ হয়েছে কি না?’

তনুকা একে একে ব্যাগ সব খুলতে বসে। বড়ো ব্যাগটা আগে খুলে। ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে খুলে ধরতেই সহসাই হাসি ফুটে তার ওষ্ঠ কোণে। মেয়ে জাতি, শাড়ি দেখলে বুঝি আপনা আপনিই খুশি হয়ে যায়। গাঢ় সবুজ রঙের পাথরের কাজের এক ভারী শাড়ি। তনুকা তাতে হাত বুলিয়ে বলে,

‘চমৎকার হয়েছে তো।’

মেহতাব পাঞ্জাবীর হাতা গুঁটিয়ে কনুই অবধি নিয়ে তার শিউরে বসে। জিজ্ঞেস করে,

‘পছন্দ হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, খুব।’

আরেকটা ব্যাগে এবার হাত দেয় সে। একটা বক্স বের করে খুলে দেখে, তাতে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা গয়না। অন্যটাতে চুরি। আরেক ব্যাগে জুতা। ম্যাচিং পার্স আনতেও ভুল করেনি সে। মেহতাবের এত দায়িত্ববোধ দেখে খুশি হয় তনুকা। বলে,

‘আপনার মতো স্বামী মেয়েরা হাজার সাধনা করেও হয়তো পাবে না।’

মেহতাব হেসে বলে,

‘আর তুমি তো ফ্রি’তেই পেয়ে গেলে।’

‘জানেন তো, ফ্রি পাওয়া জিনিসের মূল্য থাকে না।’

‘যেমনটা তোমার কাছে আমার।’

তনুকা তাকায়। জবাব দেয় না কোনো। মেহতাব উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ফ্রেশ হয়ে আসছি, টেবিলে খাবার দিও।’

___________

ব্যস্ততার মাঝেই বাকি দিনটা কেটে গিয়ে আসে পরদিন সকাল। শুক্রবারের সকাল। সকাল থেকেই শুরু হয় রান্নাবান্না। নাম করা বাবুর্চি এনেছে মেহতাব। গ্রামের লোকেরা আজ সব আঙ্গুল চেটে খাবে।

তনুকাকে খুব সকালে মেহতাব ঘুম থেকে ডেকে তুলে। চোখ মেলতে পারছিল না সে, তবুও চাইল কোনোমতে। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘এত সকালে কেন ডাকলেন?’

‘তৈরি হতে হবে না?’

‘আরো পরেও তো হওয়া যাবে। সকাল সাতটায় কে তৈরি হতে বসে বলুন তো?’

‘পরে আর সুযোগ পাব না আমি। এখনই সময় আছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।’

তনুকা চোখ কচলে বলল,

‘আপনার সময় দিয়ে কী হবে? মনে হচ্ছে যেন, আপনি আমাকে তৈরি করাবেন।’

‘তো আর কে করাবে?’

তনুকা আচমকা চকিতে তাকায়। অবিশ্বাস্য সুরে বলে,

‘মানে? আমি নিজে তৈরি হব।’

‘উঁহু, আমি তোমায় আজ নিজের হাতে সাজিয়ে দিব।’

‘কেন?’

‘আমার ইচ্ছে, তাই।’

তনুকা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। মেহতাব তাকে তাড়া দিয়ে জোর করে পাঠায় ফ্রেশ হতে। বেরিয়ে এসে মেহতাবের কাছে পরাস্ত হয়। মেহতাব’ই আজ সাজাতে আরম্ভ করে। তনুকা ভীত হয়। ভাবে, লোকটা হয়তো আজ ভরা গ্রামে তার মান সম্মান নিয়ে ছাড়বে।

অথচ, নিজেকে দেখে বিস্মিত হয় তনুকা। শাড়িটাও মেহতাব ঠিক করে দেয় তাকে। এত সুন্দর করে গুছিয়ে পরিয়ে দেয় যেন, এসবে কত পারদর্শী সে। কপালের মাঝ বরাবর ছোট্ট এক সবুজ রঙের টিপ। চোখে লেপ্টানো মেহতাবের হরহামেশা প্রিয় কাজল। ঠোঁট রাঙানো রক্তিম রঞ্জকে। চুলের মাঝ বরাবর দিয়ে যে সিঁথি পড়েছে, তাতে স্থান পেয়েছে ছোট্ট এক টিকলি। তাছাড়া গলা, কান, হাত সব ভর্তি গয়নায়।

নিজেকে আয়নায় দেখে অবাক হয় তনুকা। একজন পুরুষ মানুষ কী করে এত নিঁখুত ভাবে সাজাতে পারে? কী চমৎকার লাগছে তাকে! মেহতাব নিজেও বিস্মিত। আপ্লুত সুরে বলে উঠে,

‘এই অনিন্দ্য সুন্দর হতে আমি এখন চোখ সরাব কী করে, বলো তো বিবিজান। আমার যে বড্ড বেহায়া হতে ইচ্ছে করছে।’

তনুকা অস্বস্তিতে পড়ে হয়তো। আয়নার সামনে থেকে সরে এসে বলে,

‘সাজার মাঝখানে আমার খাওয়া হলেও, আপনি কিছু খাননি। খেয়ে আসুন গিয়ে।’

মেহতাব তনুকার কাঁধে হাত রাখে। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,

‘এত নির্দয় কেন তুমি? আর কত অগ্রাহ্য করবে আমায়?’

তনুকা কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

‘অগ্রাহ্য কোথায় করলাম? আমি তো আগেই বলে দিয়েছি, চাইলেই আপনি আপনার অধিকার খাটাতে পারেন, আমার আপত্তি নেই।’

‘স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যখন কেবল এক ঠুনকো অধিকারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন ভালোবাসা সেখানে হয়ে পড়ে এক রঙিন ফানুস। যেটা দূর থেকে দেখতেই সুন্দর, কাছে নিলে এক প্রাণহীন বস্তু বৈ আর কিছুই না।’

তনুকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

‘আমাকে ভালোবাসার কী দরকার?’

‘মানুষ দরকারের জন্য ভালোবাসে না, তনু। বেঁচে থাকার জন্য বাসে।’

তনুকা নিষ্পলক চেয়ে থাকে। এই অতি নিরুপম প্রেমকে কী করে অগ্রাহ্য করবে সে? এত ক্ষমতা কি আদৌ তার আছে? যদি হেরে যায়, তবে তার হৃদয়ের আরেক খন্ডকে কী জবাব দিবে? তার সাথে বেঈমানী করা হয়ে যাবে না?

তনুকা দ্বিধায় পড়ে। মারাত্মক রকমের দ্বিধা। এই দ্বিধা কাটিয়ে উঠা সহজ নয়। সেও পারবে না। হয় একজনের হয়ে আজীবন আফসোস করবে, নয় মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হবে। এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তার।

তনুকার নিশ্চল ভঙি দেখে মেহতাব ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অশান্ত মন নিয়ে আর খেতে ইচ্ছে হয় না তার। তাই সোজা যায়, বাবুর্চিদের কাছে। সব রান্না শেষ তাদের। এখন মাংস বসাবে। মেহতাব ইশফাককে ডেকে বলে,

‘মাংস এনেছ না?’

‘জি, ভাইজান। ঐ ঝুরিতে রাখা আছে।’

মেহতাব বাবুর্চিকে গিয়ে বলে,

‘মাংস দিয়ে বিরিয়ানি করে ফেলুন। আর শুনুন, ঝুরি হিসেবে আলাদা করা মাংস। বড়ো ঝুরির মাংস সব গ্রামবাসীর জন্য। আর ছোট ঝুরির মাংস হলো মহলের জন্য। আলাদা ভাবে রান্না করবেন সব।’

‘জি, আইচ্ছা।’

বিরিয়ানি রান্না শুরু হলো। মেঝো কাকা খেয়াল করে বললেন,

‘দুই ঝুরির মাংসের রং আলাদা কেন? একই গরুর মাংস না দুইটা?’

মেহতাব জানাল,

‘এক গরু দিয়ে কী করে হবে, কাকা? এখানে তিন গরুর মাংস আছে।’

মেঝ কাকা বললেন,

‘না, রংটা একটু আলাদা লাগছে তো তাই।’

ইশফাক বলল,

‘গরু আলাদা তো, তাই একটু বেশ কম লাগছে হয়তো।’

চলবে……

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here