প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩০।

0
72

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩০।

আরেকটি নতুন দিনের আগমন ঘটল সূর্য উদয়ের মাধ্যমে। বাইরে বাড়ল পাখির কিচিরমিচির শব্দ। কোলাহল নেই কোনো। প্রকৃতি শান্ত পরিশ্রান্ত।
তনুকা চোখ মেলতে নিজেকে পেল বসা অবস্থাতেই। খাটে হেলান দিয়ে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। চোখ কচলে উঠে বসে, সময় বোঝার চেষ্টা করে। ঘড়িতে দেখে ছয়টা ত্রিশ। ঘরের দরজা খোলা। রাতে কি আর একবারও মেহতাব ঘরে আসেননি? তনুকা উঠে বারান্দায় যায়। বাইরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তাই ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে। কারোর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে শাশুড়ির ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজা ভেতর থেকে আটকানো। তনুকা করাঘাতের জন্য হাত উপরে তোলার আগেই রাহীলা এসে হাজির হন সেখানে। কর্কশ সুরে বলে উঠেন,

‘এই যে মেয়ে, শাশুড়িকে ডাকতে এসেছ না কি?’

তনুকা ফিরে তাকায়। বলে,

‘জি, মা কি রুমে নেই?’

‘আছেন। ঘুমাচ্ছেন উনি।’

তনুকা খানিক অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,

‘ঘুমাচ্ছেন? বাবার কি শবদাহ হয়ে গিয়েছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, হয়ে গিয়েছে। আপনি পড়ে পড়ে ঘুমান আরো, বাড়ির বড়ো বউয়ের কাজ থেকে তো এটাই আশা করা যায়।’

তনুকা হতভম্ব হয়। শবদাহ শেষ? কখন হলো এসব? কেউ তাকে ডাকল না একবার? সে অস্থির গলায় বলে,

‘আমাকে কেউ ডাকেনি কেন?’

‘আপনার স্বামীর বারণ ছিল। ভীষণ বউ পাগল হয়েছে কিনা, বউয়ের ঘুম নষ্ট হবে বলে ডাকতে এসেও আর ডাকেনি; আর কাউকে ডাকতে দেয়ও নি।’

তনুকাকে অসহায় দেখায়। রাহীলা ঠোঁট নাড়িয়ে আরো কী কী যেন বলছেন। তনুকা আর দাঁড়ায় না। ধীর পায়ে রেনুর ঘরের দিকে যায়। দরজাটা ভিড়ানো ছিল। তাই আস্তে খুলে ঢুকে।
মেয়েটা হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। তনুকা তার শিউরে বসে। মাথায় আলতো হাত ছোঁয়ায়। রেনু মাথা তুলে তনুকাকে পেয়েই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হুহু করে কেঁদে ওঠে। বলে,

‘বউমনি, আব্বা আর কোনোদিন ফিরবেন না; তাই না, বউমনি? আব্বা আর ফিরবেন না, এই বিভৎস সত্যটা যে আমি মানতে পারছি না। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে, বউমনি। বুকে ভীষণ ব্যথা করছে।’

তনুকা হাতের বাঁধন শক্ত করে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে। মাথার উপর চুমু খেয়ে বলে,

‘এভাবে কেঁদো না, আমরা কেউই আজীবন বেঁচে থাকব না। একদিন সবাইকেই ম’রতে হবে। কেউ আগে, কেউ পরে, তফাৎ শুধু এইটুকুই। এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই, রেনু। কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে।’

রেনু ফোঁপাচ্ছে। তনুকা এটা ওটা বলে বোঝাচ্ছে তাকে। একপর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা। তনুকা আর জাগাল না তাকে, আস্তে করে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর দরজাটা ভিড়িয়ে চলে এল নিচে।
সদর দরজা পাড় হয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। বাইরে তেমন কোনো লোক নেই এই মুহূর্তে। তনুকা এগিয়ে যায়। বাগান পাড় হয়ে বিচার মহলের সামনে দাঁড়ায়। মহলের দরজায় তালা দেওয়া। গেল কোথায় সব? আশেপাশে কাউকে না পেয়ে সে আবার যায় বড়ো গেইটের সামনে। প্রহরী একজনকে জিজ্ঞেস করে,

‘মেহতাব কোথায় জানেন?’

উত্তরে সে বলে,

‘বড়ো বাবুর শবদাহ দিয়ে জমিদার বাবু আর মহলে ফিরেন নাই; এখন কোথায় তাও জানি না।’

তনুকা আশাহত হয়ে মহলের দিকে পা বাড়াল। সোজা গেল নিজের ঘরে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসল। ভাবল, একবার মেহতাবকে কল দিবে। পরে মনে পড়ে, তার কাছে তো মেহতাবের নাম্বারও নেই। এখন আবার নাম্বারটা কার কাছ থেকে নিবে? উপায় না পেয়ে সে যায় ঊর্মির ঘরে। বরাবরের মতো অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ঊর্মি বারান্দায় দাঁড়ান ছিলেন। তনুকাকে দেখে বসতে বলেন। তনুকা গম্ভীর সুরে বলে উঠে,

‘বসতে আসেনি। মেহতাবের নাম্বার নিশ্চয়ই আপনার কাছে আছে? এবার আবার তাতেও না করবেন না।’

ঊর্মি ঘরে এসে বললেন,

‘আছে।’

‘দিন তবে।’

ঊর্মি নাম্বার দিল তাকে। তনুকার ফিরে আসার সময় আবার একবার ঘুরে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘বাবার শবদাহের সময় আপনারা সকলে সেখানে উপস্থিত ছিলেন?’

‘মহিলারা কেউ শ্মশান ঘাটে যায়নি। বাড়ির পুরুষেরাই সব করেছেন।’

‘এখন কোথায় সবাই?’

‘জানি না আমি।’

তনুকা আর কথা বাড়াল না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। নিজের ঘরে গিয়ে কল দিল মেহতাবের নাম্বারে। কল রিসিভ হয় না। তনুকা পরপর দুবার কল দিয়ে আর কল দেয়া না। ফোন রেখে চুপচাপ শুয়ে পড়ে বিছানায়। হঠাৎ কী ভেবে যেন আবার উঠে বসে।

এই মুহূর্তে মোহন লাল মজুমদারের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তনুকা। কাল অবধি মানুষটা এই ঘরেই ছিল, অথচ আজ ঘর খালি। দরজায় আজ প্রহরীও নেই। তনুকা পুরো ঘরে একবার চোখ বুলায়। ডানদিকে একটা ছোট কেবিনেটের উপর বাবার ঔষধের বক্সটা নেই। সে পুরো ঘর খোঁজে, পায় না। ঔষধের বক্স তো সবসময় এখানেই থাকে তবে, আজ গেল কোথায়? তখন মন বলে, নিশ্চয়ই মায়ের রুমে। মা যেহেতু ঔষধ খাওয়াতেন সেহেতু আজ হয়তো ঔষধের বক্সটা সেখানেই রয়ে গিয়েছে। একবার বাবার ঔষধগুলো দেখা প্রয়োজন। মন বলছে, কিছু একটা অবশ্যই পাবে সে।

________

ঘড়িতে দুইটা বেজে পনেরো মিনিট। ফ্লাইট থেকে নেমে মাত্রই দেশের মাটিতে পা রাখল সে। চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানল। অনুভব করল, অন্যরকম এক সোঁদা গন্ধ। অতঃপর এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। এয়ারপোর্টের মেইন গেইটের অভিমুখে পৌঁছাতেই পরিচিত মুখ দেখে হাসল। পরক্ষণেই আবার সেই হাসি গায়েবও হয়ে গেল। চোখে মুখে ফুটিয়ে তুলল বিষন্নতা। ছুটে বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল মেহতাবকে। মেহতাবও জড়িয়ে নেয়। আবেগাপ্লুত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ভাই, কেমন আছিস?’

রাদাভ ব্যথিত সুরে বলে,

‘এমন একটা খবর পেয়ে কী করে ভালো থাকি, বলো? শেষ পর্যন্ত বাবার মুখদর্শনটাও করতে পারলাম না।’

‘তোর জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম তবে, কাকারা কেউ রাজি হননি।’

‘না, ভালো করেছো। আমার জন্য অপেক্ষা করে লাভ হতো না। আমি তখনও ফ্লাইটের টিকিট ম্যানেজ করতে পারছিলাম না। ভাগ্য ভালো যে, বেশি কষ্ট করে হয়নি; অল্পতেই ম্যানেজ করে ফেলেছি। বাবার আত্মার শান্তি কামনা করছি, এর থেকে বেশি আর কিছু চাই না।’

মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখে। বলে,

‘হ্যাঁ, এখন বাকি কাজ সব তোকেই করতে হবে। আম্মা আর রেনু ভেঙে পড়েছেন ভীষণ। তোকে দেখে যদি এবার একটু বল পান।’

রাদাভ বিষন্ন মুখেও কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,

‘চিন্তা নেই, ভাইজান। এখন আমি চলে এসেছি, মা আর রেনুকেও সামলে নিব।’

‘চল এবার, গাড়িতে গিয়ে বস। কাকারাও গাড়িতেই আছেন।’

মনোহর গ্রামের দিকে রওনা দেয় তারা। পথিমধ্যে ফোনে তনুকার মিসড কল দেখে তাকে মেহতাব আবার কল ব্যাক করে। তনুকা রিসিভ করে কল। জিজ্ঞেস করে,

‘কোথায় আপনি?’

‘ঢাকা এসেছি।’

তনুকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘হঠাৎ ঢাকা?’

‘কাজে এসেছিলাম; বাড়ি এসে বলছি সব।’

‘আচ্ছা, আসুন সাবধানে।’

কল কাটল তনুকা। ভেবে পেল না, মাঝরাতেই এত তাড়াহুড়ো করে বাবার শবদাহ করে মেহতাবকে আবার ঢাকা কেন যেতে হলো? কী এমন জরুরি কাজ তার, যেটার জন্য আজ এমন একটা দিনেও ঢাকায় ছুটে যেতে হলো তাকে?

_______

দীর্ঘ বারো বছর পর নিজ গ্রামে উপস্থিত হয় রাদাভ। কত কিছু বদলে গিয়েছে। কত যোজন বিয়োজন যে ঘটেছে তার কোনো
ইয়ত্তা নেই। গ্রামের রাস্তায় গাড়ি ঢুকতেই আশেপাশের মানুষের ভিড় জমে। এত বছর পর জমিদারের ছোট ছেলেকে দেখার আগ্রহে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয় সকলে। রাদাভও গাড়ির কাচ নামিয়ে সকলকে দেখছে নিমিষ। মনে পড়ছে, ছোটবেলার হারানো স্মৃতিগুলোর কথা। মনে পড়ছে, কিছু প্রিয় মুখ। আরো মনে পড়ছে, অযাচিত কিছু কষ্টের মুহূর্তও। রাদাভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সিটে হেলান দিয়ে বসে। দেখতে দেখতেই গাড়ি এসে থামে তাদের মহলের সামনে। সকলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। রাদাভ দাঁড়ায় ভাইয়ের পাশে। নিজের মহলের দিকে চেয়ে থাকে নিষ্পলক। মেহতাব প্রহরীকে বলে উঠে,

‘ভেতরে গিয়ে খবর দাও, বাড়ির ছোট ছেলে এসেছে; আম্মা যেন এসে বরণ করেন।’

প্রহরী আদেশ মোতাবেক দৌড়ে মহলের ভেতরে যায়। বসার ঘরেই রেনু আর তনুকা ছিল। রেনু সারাদিন কিছু খায়নি বলে তনুকা খাইয়ে দিচ্ছিল তাকে। প্রহরী এসে তাদের দেখেই খবর দেয়,

‘ছোট মাতা, বরণের ব্যবস্থা করেন; ছোট বাবু আসছেন।’

তনুকা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

‘ছোট বাবু কে?’

রেনু সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠে,

‘ছোট ভাইজান? রাদাভ ভাইজান?’

প্রহরী মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘জি জি। রাদাভ বাবু।’

চলবে…..

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here