#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩১।
ছোট ছেলের আগমনের খবর পেয়ে আম্বিরা বেগম দোর মেললেন। আজ সারাদিন ঘরেই ছিলেন তিনি। রাদাভের খবর কানে যেতেই ছুটে বেরিয়ে এলেন। দৌড়ে গেলেন প্রধান গেইটের সম্মুখে। মেহতাবের পাশেই রাদাভ দাঁড়ানো। তিনি এসেই ঝাপটে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। শব্দ করে কেঁদে ওঠলেন। রাদাভের চোখেও জল জমে। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
‘মা, কেঁদো না।’
আম্বিরা বেগম মাথা তুলে চাইলেন। ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
‘বাবা, তুমি এসেছ? তোমার বাবাকে তো আর শেষ দেখাটা দেখতে পারলে না।’
‘চেষ্টা করেছিলাম, মা। কিন্তু, সময়মতো টিকিট ম্যানেজ করতে পারিনি। তুমি কষ্ট পেও না, মা। আমাদের বাবা ওপাড়ে ভালো থাকবেন।’
‘হ্যাঁ, সেই দোয়াই করি। তুমি ভেতরে এসো, আর কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে?’
রাদাভ বাড়ির ভেতরে পা রেখে। সদর দরজার কাছে যেতেই রেনু হামলে পড়ে তার বুকের উপর। রাদাভ জড়িয়ে নেয় বোনকে। মাথার উপর চুমু খেয়ে বলে,
‘কাঁদিস না, বোন। বাবা যে কষ্ট পাবেন।’
রেনু কান্না থামাল। বলল,
‘এতদিন পর কেন এলে না তুমি? আজ আব্বার মৃত্যুর খবর পেয়েই আসতে মন চাইল?’
‘আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, সময় সুযোগের জন্য পারিনি। এই যে, এখন চলে এসেছি; আর যাব না।’
রাদাভের আর না যাওয়ার কথা শুনে মতিব মজুমদারের কপালে ভাঁজ পড়ে।পাংশুবর্ণ ধারণ করে মুখ মন্ডল। মনে মনে বলে উঠেন, “একজন কি কম ছিল, এখন আরো একজন এসে জুটেছে।”
________
রাদাভ বসার ঘরে বসেছে। বাড়ির সকলের সাথে আলাপ শেষ তার। বাকি কেবল তনুকা। তাকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। রাদাভ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠল,
‘ভাইজান, আমাকে তো নতুন ভাবির সাথে পরিচয়’ই করালে না; কোথায় সে?’
মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসে। বলে,
‘চেনা মানুষকে আর নতুন করে চেনার কী আছে?’
রাদাভ চায়ের কাপ রেখে বলে উঠে,
‘ভাবি আমাকে নাও চিনতে পারেন। পরিচয় হওয়াটা জরুরি তাই।’
‘বস, আমি ডেকে নিয়ে আসছি।’
মেহতাব উঠে নিজের ঘরে এল। তনুকাকে পেল বারান্দায়। তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমার ছোট ভাইয়ের কথা বলেছিলাম না, রাদাভ; ও এসেছে। তোমার সাথে পরিচিত হতে চাইছে।’
তনুকা চাইল। বলল,
‘আপনি যান। আমি আসছি।’
ফিরে আসে মেহতাব। তনুকা ওড়না টেনে বড়ো করে ঘোমটা দেয়। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে যায় বসার ঘরের দিকে।
‘আসসালামু আলাইকুম।’
মেয়েলী কন্ঠ শুনে ফিরে তাকায় রাদাভ। তার সামনে দাঁড়ান রমণীকে আপাদমস্তক পরখ করে ফিচেল হাসে। সালামের জবাব দিয়ে বলে,
‘কেমন আছেন, ভাবি? আমি আপনার দেবর, রাদাভ।’
তনুকা একপলক চেয়ে আবার চোখ নামাল। মৃদু আওয়াজে বলল,
‘জি ভালো, আপনি ভালো আছেন?’
‘সদ্য বাবা হারানো কোনো এতিম ছেলে কি ভালো থাকতে পারে, ভাবি?’
তনুকা জবাব দেয় না। মেহতাব রাদাভের কাঁধে হাত রাখে। স্মিত সুরে বলে,
‘আমাদের ভেঙে পড়লে চলবে না, রাদাভ। আম্মা আর রেনুকে সামলাতে হবে, এই পুরো গ্রামকে সামলাতে হবে। তার জন্য আমাদের আগে শক্ত হওয়া প্রয়োজন।’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।’
এর মাঝেই রেনু বসার ঘরে এল। রাদাভ আর মেহতাবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ভাইজান, তোমাদের খাবার দেওয়া হয়েছে। আম্মা ডাকছেন, খেয়ে নাও গিয়ে।’
রাদাভ আর মেহতাব উঠে দাঁড়ায়। রাদাভ পা বাড়াতে নিয়েও একবার পেছনে তাকায়। তনুকার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ভাবি, আপনি খাবেন না?’
তনুকা ধীর গলায় বলে,
‘খেয়েছি আমি। আপনারা গিয়ে খেয়ে নিন।’
রাদাভ স্মিত হেসে বসার ঘরের দিকে গেল। মেহতাবও গেল তার পেছন পেছন। তনুকা আর না দাঁড়িয়ে ফিরে এল নিজের ঘরে। মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মাঝেই আবার উঠে বসল। বুকের ব্যথাটা বেড়েছে। ড্রয়ার খুলে ঔষধের বক্স বের করে তাই একটা নিফেটোলল খেল সে। তারপর বক্স রেখে দিয়ে আবার এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে মেহতাব ঘরে এসে দেখে, তনুকা গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। মেহতাব তার অপর পাশে বসে। তনুকাকে দেখে বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছে। অথচ ক্লান্ত থাকার কথা তার। সেও শুয়ে পড়ল তনুকার পাশে। তনুকার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ঘুমিয়েও পড়ল কোনো এক বেখেয়ালে।
রাত এগারোটা। তনুকার ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকায়। প্রথমেই মেহতাবের ঘুমন্ত মুখটা দেখতে পায়। তনুকা নিমিষ চেয়ে দেখে। একদিনেই ভীষণ উস্কো খুস্কো লাগছে। ঠোঁট শুকিয়ে আছে। গালে দাঁড়ি বেড়েছে। তনুকা চট করে উঠে বসে। এত কিছু দেখা তার কাজ না। সে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়। তেমন কাউকে চোখে পড়ে না। সবাই কি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছে? তনুকা রান্নাঘরের দিকে যায়। মেঝ কাকী ঊর্মিকে পায় সেখানে। তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘সবার কি খাওয়া দাওয়া শেষ?’
ঊর্মি ফিরে তাকান। বলেন,
‘হ্যাঁ, তোমরা ঘুমাচ্ছিলে বলে আর ডাকা হয়নি। খাবার বেড়ে দিব এখন?’
‘না, মেহতাব উঠলে আমি বেড়ে নিব।’
ঊর্মি নিজের কাজে মনোযোগ দেন। কফি বানাচ্ছেন তিনি। তনুকা খেয়াল করে বলে,
‘কফি কার জন্য?’
‘তোমার দেবরের জন্য।’
তনুকা তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘আমি দিয়ে আসব?’
ঊর্মি জবাবে বলে উঠে,
‘প্রয়োজন নেই। আমি আছি।’
তনুকা কথা বাড়াল না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আবার নিজের ঘরে এল। ফোনটা হাতে নিয়ে সোফায় বসল গিয়ে। দেখল, তার পরিচিত ডাক্তারের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। যেখানে লেখা, “তুমি তো আমাকে আর কিছু জানালে না, তনুকা। আমার না আজ থেকে আসার কথা ছিল?”
তনুকা তাঁর মেসেজে স্যাড রিয়েক্ট দিয়ে উত্তর দেয়,
‘তার আর প্রয়োজন হবে না, আংকেল। আমার শ্বশুরমশাই আজ মারা গিয়েছেন।’
উত্তর দিয়ে মোবাইলটা পাশে রাখল সে। ভাবল কিয়ৎক্ষণ। এই মৃত্যু রহস্য বের করবে কীভাবে? কে সাহায্য করবে তাকে? মেহতাব তো তার কথা আমলেই নিচ্ছে না, আর বাদ বাকি এই বাড়ির কাউকেই সে ঠিক মতো বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে এই ব্যাপারে কে তাকে সাহায্য করবে? অনেক ভেবে মস্তিষ্ক জবাব দেয়, “একবার রাদাভের কাছে সাহায্য চাইতে পারিস, সব শুনলে ও অবশ্যই সাহায্য করবে তোকে।”
_______
‘মেহতাব, উঠুন; খাবেন না?’
মেহতাব একটু নড়ে। ঘুম জড়ানো সুরে বলে,
‘খাব না, তনু। তুমি খেয়ে এসে শুয়ে পড়ো।’
তনুকা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
‘একদম না খেয়ে ঘুমাবেন? অল্প কিছু খেয়ে নিন।’
মেহতাব ফের একই সুরে বলে,
‘উঁহু, তুমি খেয়ে নাও। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।’
তনুকা আর ডাকল না। দুই দিন লোকটা ঠিক মতো ঘুমাতে পারছে না। থাক, এখন ঘুমাক। তনুকা আলো নিভিয়ে, দরজা ভিড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাড়ির সবাই ঘুমে। বসার ঘরে ক্ষুদ্র আলো ব্যতিত আর কোথাও কোনো আলো নেই। এর মাঝেই ত্রস্ত পায়ে হেঁটে সে সামনে এগুলো। রাদাভ কোন ঘরে শুয়েছে তার কোনো ধারণা নেই। তবে এক বা দুতালায় কোনো ঘর খালি নেই সে জানে। তাহলে নিশ্চয়ই তিনতলায় তার ঘর। তনুকা সেদিকেই অগ্রসর হয়। তিনতলায় উঠতেই বরাবর ঘরে আলো দেখতে পায় সে। ইতস্তত ভঙিতে দরজার সামনে দাঁড়ায়। ভাবতে থাকে, দরজায় করাঘাত করে কি না। দুই সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেবে দরজায় টোকা দেয়। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,
‘খোলা আছে, চলে এসো।’
তনুকা দরজা মেলে ভেতরে প্রবেশ করে। ঘরের ভেতর তনুকাকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল রাদাভ। প্রশ্ন করল,
‘ভাবি, আপনি?’
তনুকা এদিক ওদিক একটু সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল। বলল,
‘আমার আপনার সাথে একটু জরুরি কথা আছে।’
রাদাভ কুঁচকানো ভ্রু সোজা করে হাসল। বলল,
‘এই সময় দেবরের ঘরে কোনো ভাবির কথা বলতে আসাটা মানুষ ভালো চোখে দেখবেন না, ভাবি। তার উপর ভাইজান জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে, পরে কথা বলব।’
তনুকা গলার স্বর শক্ত করে। বলে,
‘কথাটা জরুরি। এখনই বলা প্রয়োজন।’
রাদাভ মোবাইল রেখে উঠে বসল। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘কী কথা, বলুন তবে।’
চলবে….