প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪৪।

0
53

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৪।

তনুকা দ্রুত ছুটে গিয়ে নৌকায় বসে। বক্ষঃস্থলের আন্দোলন কমছে না এখনো। সে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। নিজেকে ধাতস্ত রাখার সবটুকু চেষ্টা সে চালিয়ে যাচ্ছে। তাও পারছে না বোধ হয়। মেহতাবের স্পর্শ আজ সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। তার পরিকল্পনায় প্রভাব ফেলছে তা। তনুকা ভাবতে না চায়লেও ভেবেই চলছে। মেহতাবও নৌকায় এসে বসে। সে স্বাভাবিক ভীষণ। বরং মেজাজ যেন আরো ফুরফুরে দেখাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করে,

‘নৌকায় বসলে যে? আজ তো আমরা ফিরছি না।’

তনুকা উদ্বেগ নিয়ে বলে,

‘কেন?’

‘ঐদিকের একটা ছোট্ট ঘরে আমাদের থাকার সব ব্যবস্থা করেছি, আজ সারাদিন সেখানেই থাকব।’

‘না না, অসম্ভব।’

তনুকাকে অস্থির দেখায়। মেহতাব ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি কি কোনোভাবে আমাকে ভয় পাচ্ছো, বিবিজান।’

তনুকা ভ্রু কুঁচকে জবাব দেয়,

‘আশ্চর্য! এখানে ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি এখানে থাকতে চাই না, ব্যস এইটুকুই।’

‘আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এখন না থেকে উপায় নেই।’

‘আপনি কিন্তু এবার একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন।’

মেহতাব হেসে বলল,

‘এখনো কিছু শুরু করিনি, বিবিজান। অপেক্ষা করো, এখনো অনেক কিছু বাকি।’

মেহতাবের কথা শুনে কেন যেন তার প্রতি বিশ্বাসটা রাখতে পারল না তনুকা। সে একবার ছুঁয়েছে মানে আবার ছুঁবে। আর সে যত ছুঁবে তনুকা ততই দূর্বল হয়ে পড়বে। আর তার এই দূর্বল হয়ে পড়া মানে সবকিছু হারিয়ে ফেলা।

তনুকা বিভ্রান্ত ভাবে এদিক ওদিক চায়। চারদিকের এই অথৈয় পানি পার হয়ে ওপাড় সে কী করে যাবে? সে তো আর নৌকা চালাতে পারে না। মেহতাব উঠে এগিয়ে আসে। তনুকার পাশে বসে। মিহি সুরে বলে,

‘ভয় পেও না, বিবিজান। আমার কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তোমার সম্মান; তোমার সম্মানে আঘাত লাগে এমন কিছু করব না।’

‘করে তো ফেলেছেন’ই।’

মেহতাব হাসে। বলে,

‘তুমিও তো আমাকে বাঁধা দাওনি। বরং স…’

তনুকা চট করে মেহতাবের মুখ চেপে ধরে। চোখ গরম করে বলে উঠে,

‘বাজে কথা বলবেন না একদম। আপনার সাথে আমি পেরে উঠতে পারব না, আপনি জানতেন; তাই ইচ্ছে করেই করেছেন সব।’

ঠোঁট স্পর্শ করা তনুকার হাতের পিঠে মেহতাব চুম্বন করে। তনুকা হাত সরায় সরায় সঙ্গে সঙ্গে। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বলে,

‘এবার কিন্তু বেশি বেশি করছেন।’

‘আচ্ছা আর বেশি বেশি করব না, এখন থেকে একটু কম কম করব। চলো এবার, ঐদিকটা তোমাকে একটু ঘুরে দেখাই।’

মেহতাব নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ায়। তনুকা বীতঃস্পৃহ ভঙিতে চেয়ে থাকে। সে নামতে চাইছে না মোটেও। মেহতাব হাত বাড়িয়ে দেয়, অগত্যাই উঠে দাঁড়ায় তনুকা। মেহতাবের হাত ধরে নৌকা থেকে নেমে আসে। তারপর আবার হাত ছাড়াতে নেয়। কিন্তু, মেহতাব হাত ছাড়বে না বলে আরো শক্ত করে সেই বাঁধন। তনুকা কিছুক্ষণ মোচড়া-মুচড়ি করেও যখন হাতখানা ছাড়াতে পারল না তখন ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত হলো সে।

মেহতাব তনুকাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা পথ চলে এসেছে। এতক্ষণ বেশ গাছগাছালি দেখা গেলেও এখন দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা বাড়িঘর। এটা বোধ হয় আরেকটা গ্রাম। এই গ্রামের নাম তনুকা একবার শুনেছিল তবে, এখন মনে নেই। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দুজন লোক সামনের ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে। মেহতাবকে দেখে হাত উঁচু করে সালাম দেয়। হেসে বলে,

‘আরে জমিদার বাবু, আপনি আমাদের গ্রামে? হায় হায়, কী সৌভাগ্য আমাদের।’

লোক দুটোর অস্থিরতা দেখে তনুকা বিরক্ত হয়। তবে, মেহতাব হেসে বলে,

‘হ্যাঁ, আমার বিবিজানকে নিয়ে ঘুরতে এলাম।’

‘তাই! তাহলে আমাদের ঘরে আসেন না, দাঁড়ান আমি ফুলির মায়েরে ডাকতেছি।’

‘না না, আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আমি কারোর ঘরে যাব না। এইদিকটা একটু ঘরে নিজের গৃহে ফিরব।’

লোক দুটি আরো কিছুক্ষণ জোর করল। তবে, মেহতাবকে রাজি করাতে পারল না ঠিক। তনুকা ফিসফিসিয়ে বলল,

‘চলুন না মহলে ফিরে যাই, আমার এখানে ভালো লাগছে না।’

মেহতাব বলল,

‘মহলে কাল সকালে ফিরব। এখানে একটা সুন্দর বাগান আছে, সেখানে গেলে ভালো লাগবে তোমার, চলো।’

তনুকাকে নিয়ে মেহতাব চলল সেই বাগানের উদ্দেশ্যে।

_____

‘খবর পাইছেন, ভাই; মেহতাব মজুমদার গ্রামে আইছে তাও আবার তার নতুন বউরে নিয়া।’

মদের বোতলটা মুখের কাছে নিয়েও নামিয়ে ফেলে। ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,

‘বলিস কী? মেঘ না চাইতেই আজ বৃষ্টি হাজির?’

‘জি, ভাই।’

‘তা, জমিদার সাহেব এখন কোথায়? তাকে আমার গৃহে আমন্ত্রণ জানাও।’

ছেলেটা মাথা চুলকে বলে,

‘আপনি আমন্ত্রণ জানাইলে কি উনি আসব?’

‘কান টানলে মাথা এমনিই আসে। গাড়ি বের কর, জমিদার বউরে একবার দেখে আসা উচিত।’

_____

বাগানটা আসলেই চমৎকার। বিশাল বাগান। চারদিকে কত কত ফুলের গাছ। কী দৃষ্টি নন্দন এক দৃশ্য। এখানে এসে মেহতাব তনুকার হাত ছেড়ে দেয়। তনুকাও ছাড়া পেয়ে খুশিতে এদিক ওদিক ছুটছে। ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। এক দুটো ফুল ছিড়েও নিয়েছে। এত ফুল পেয়ে সমস্ত দুশ্চিন্তা তার নিমিষেই উবে গিয়েছে যেন। সে ভুলেই গিয়েছে সব। আপন মনে বাগানের চারদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেহতাব দূরে দাঁড়ান। তার বিবিজানকে অপলক চোখে দেখতে ব্যস্ত। যেন ছুটে চলা এই দুস্তর তরুণীকে আজ এক ষোড়শী কিশোরী মনে হচ্ছে তার। মেহতাব অতীত ভাবে, এইভাবে বেণী দুলিয়ে ছুটে চলত মেয়েটা। খিলখিলিয়ে হাসত। ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে কেঁদে কেটে ভাসিয়েছে কত, সেগুলোর এখন একটা চমৎকার স্মৃতির দেয়ালে আটকানো সব প্রতিচ্ছবি কেবল। মাঝে মাঝে মেহতাব আনমনে সেসব ভাবে, লুকিয়ে লুকিয়ে হাসে আবার কখনো বিষন্ন চোখে চেয়ে থাকে সেই মেয়েটার দিকে।

একজন লোক আসে। মেহতাবকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কেমন আছেন, জমিদার বাবু?’

মেহতাব লোকটাকে চেনে না ঠিক। তাও সৌজন্যবোধের খাতিরে জবাব দেয়। লোকটা জবাব পেয়ে আমোদ গলায় তার প্রশংসা করতে আরম্ভ করে। নিজের প্রশংসা সবারই পছন্দ, মেহতাবও তাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে সব। তনুকা এর মাঝেই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে অনেকটা দূরে। এত দূরে এসে ভাবল, এবার ফিরে যাওয়া উচিত। সেই ভেবে ঘুরতে নিলেই আচমকা কেউ একজন একটা রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরে তার। কিছু বুঝে উঠার আগেই সহসাই সে ঢলে পড়ে।

চোখ খুলে আবিষ্কার করে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। তনুকা নিজেকেও দেখতে পাচ্ছে না ঠিক মতো। মাথাটা ব্যথা করছে ভীষণ। ভয় করছে, বুক ধরফর করছে। সে আস্তে করে উঠে বসে। হাত বাড়িয়ে আশেপাশে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু, তাও বোঝে উঠতে পারে না কিছু। তার ভয়ের মাত্রা বাড়ে। অযাচিত এক আশঙ্কায় বুকে মোচড় দেয় তার। তাই কিছু না ভেবেই “মেহতাব” বলে চেঁচিয়ে উঠে। তার চেঁচানোর বিকট শব্দ প্রতিটা দেয়ালে বারি খেয়ে বেড়াচ্ছে। তনুকা উঠে দাঁড়ায়। দরজা জানালা কিছুই পাচ্ছে না সে। খুব কষ্টে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে একটা জানলা খুঁজে পায়। পর্দা সরাতেই অল্প কিছু আলো ঘরে এসে প্রবেশ করে। সে সতর্ক দৃষ্টিতে বাইরে চেয়ে বেশ কিছু গাছপালা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। সে অস্থির হয়ে ওঠে। কে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে, কী তার উদ্দেশ্য? তনুকা উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক চায়। অল্প আলোতে একটা বিছানা আর একটা দরজা ব্যতিত আর কিছুই নেই। দরজা দেখে তনুকা ছুটে যায় সেদিকে। হাতলে টান দিয়ে দেখে লক করা। সে ধাক্কাতে আরম্ভ করে,

‘কেউ আছেন? কে আমাকে আটকে রেখেছেন? দরজা খুলুন, কে আমার সাথে এমন করছেন? সামনে আসুন বলছি।’

তনুকা নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাতে আরম্ভ করে। কিছুক্ষণ বাদেই দরজাটা খুলে যায় আপনা আপনি। তনুকা সরে দাঁড়ায়। দরজার সম্মুখে প্রকট হয় একজন ব্যক্তি। তনুকা ভ্রু কুঁচকায় তাকে দেখে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,

‘আপনি!’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here