#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৭।
অতি প্রত্যুষেই মেহতাব তনুকাকে নিয়ে রওনা হলো মহলের উদ্দেশ্যে। মহলের কাউকেই এত ঝামেলার কথা জানানো হলো না। তনুকার মনে বিষন্নের ছায়া। কালকের মুহূর্তগুলো সে ঠিক ভুলতে পারছে না। মেহতাব সকাল থেকেই চুপচাপ; খুব একটা কথা বলেনি কারোর সাথে। শুধু জানিয়েছে, আজ কিছু গরীব খাওয়াবে সে। তার কথা মতো ইশফাকও সব ব্যবস্থা করেছে।
তনুকা গোসল সেরে আসতেই ঘরে রেনুকে দেখে। রেনু হেসে বলে,
‘শুভ জন্মদিন, বউমনি।’
তনুকাও প্রসন্ন হাসে। বলে,
‘সে তো কালই চলে গিয়েছে।’
‘হ্যাঁ, জানি তো। ভাইজান বলেছিলেন। তোমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে আমিও আর উইশ করিনি। কালকের সারপ্রাইজটা কেমন লেগেছে তোমার?’
তনুকা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই আবার কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলে,
‘ভালো। এভাবে কেউ আমাকে কখনো সারপ্রাইজ দেয়নি।’
‘দেখেছো, ভাইজান তোমায় কত ভালোবাসে।’
তনুকা জবাবে নির্বাক থাকে কেবল। রেনু আফসোসের সুরে বলে উঠে,
‘তোমাকে ভাইজান কী চমৎকার সারপ্রাইজ দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল আর ঐ ইশফাক তো আমার জন্মদিনের কথাই মনে রাখে না, উইশ তো দূরে থাক।’
তনুকা হাসে। রেনুর গাল টেনে বলে,
‘কষ্ট পেও না, ননদিনী; সময় আসলে সব মনে রাখবে।’
রেনু আগ্রহ নিয়ে শুধায়,
‘সেই সময় কবে আসবে, বউমনি?’
‘আসবে, খুব শীঘ্রই।’
রেনু ভীত সুরে বলে,
‘ভাইজান কখনোই মানবেন না।’
‘আমি আছি তো। তোমার ভাইজানকে আমি রাজি করাব।’
রেনু খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে তনুকাকে। বলে উঠে,
‘তুমি খুব ভালো, বউমনি। খুউব খুউব খুউব ভালো।’
_________
সন্ধ্যা হতেই মহলে খবর আসে পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে রাজীব ভূইয়া কাল রাত থেকে উধাও। পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে কোথাও পাওয়া যায়নি। খবরটা তনুকার কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই বিচলিত হয়ে পড়ে সে। দ্বিধাহীন চিত্তে সে ভেবে নেয়, এই কাজ অবশ্যই মেহতাবের। মেহতাব মহলে ফিরেনি এখনও। তনুকা তার পথ চেয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছে। আসলেই রাজীবের খোঁজ নিতে হবে যে।
মেহতাব ফিরেছে কিছুক্ষণ হবে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসে। তনুকা সেই মুহূর্তেই হাতে এক চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হয় সেখানে। মেহতাবের পাশের ছোট টেবিলটাতে চায়ের কাপ রেখে তার পাশেই বসে। ভাবছে, এবার জিজ্ঞেস করবে। মেহতাব চায়ের কাপ হাতে নেয়, চুমুক বসিয়ে বলে উঠে,
‘আজ একটু বেশিই মিষ্টি দিয়ে ফেলেছ।’
সাজানো কথাতে তাল হারায় তনুকা। এই মুহূর্তে মেহতাবের এই কথা তার ভাবনাতে ব্যাঘাত ঘটায় বেশ। তাও সে তাল মিলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আবার বানিয়ে নিয়ে আসব?’
‘না না, এইটুকু মিষ্টি আমি ঠিক হজম করে নিতে পারব।’
তনুকা এক পল নীরবতা পালন করে বলে উঠে,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘করো।’
‘রাজীবকে আপনি গুম করেছেন, তাই না?’
মেহতাব এমন প্রশ্ন হয়তো আশা করেনি। তাই একবার ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চায়ের কাপ রেখে সোজা হয়ে বসে। তনুকার দুই হাত নিজের হাতের ভাঁজে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘তোমার এমনটা কেন মনে হলো?’
‘শুধু মনে হয়নি, আমি নিশ্চিত এটা আপনার কাজ।’
মেহতাব হাসল। তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেল সেই হাসিতে। তনুকা বোধ হয় বিরক্ত হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘হাসছেন কেন?’
‘কাজটা আমি করেছি, শুনলে খুশি হবে?’
তনুকা জবাব না দিয়ে সন্দিহান চোখে চাইল। মেহতাব ফের হেসে বলল,
‘ওভাবে কী দেখছ? আমাকে প্রেমে ফেলার ধান্ধা!’
‘বাজে বকবেন না একদম। রাজীবকে কোথায় রেখেছেন আপনি? ঐ গ্রামের মানুষ এসব জানতে পারলে কী ঝামেলা হবে বুঝতে পারছেন?’
‘ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি বরং তোমার জন্মদিনের উপহার নিয়েই ভাব। উকিলের সাথে কথা বলেছি আমি, খুব শীঘ্রই ঐ জমি তোমার হতে চলেছে।’
তনুকা এই মুহূর্তে এই ব্যাপারে কথা বাড়ানোর আর কোনো আগ্রহ পায় না। সে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘আমি কোনো ঝামেলা চাই না, মেহতাব। দেশে পুলিশ আছে, আইন আছে, অযথা নিজ হাতে আইন তুলে নিবেন না। আশা করছি আমার কথাটা রাখবেন।’
তনুকা বেরিয়ে যায়। মেহতাবের ঠোঁটের কোণে প্রশ্বস্থ হাসি ফুটে। তৃপ্তির হাসি বোধ হয়। দেশের পুলিশ আর আইনের পোরোয়া সে আগে কখনো করেছে নাকি যে এখন করবে। মেয়েটা বোকা বড্ড! বোঝেনা কিছু। যে মানুষ পেটে চলে গিয়েছে সেই মানুষকে কোথ থেকে আনবে সে।
______
রাদাভের মেজাজ ঠিক নেই। রাতে খেতে আসেনি সে। তার মেজাজ বিগড়ানোর কারণ সম্পর্কে কেউ অবগত নয়। সবাই খেয়ে দেয়ে যার যার মতো ঘরে চলে গিয়েছে। তনুকা নিজ ঘরে না গিয়ে গিয়েছে ঊর্মির ঘরে। দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে সে। ঊর্মি তাকে দেখে জিজ্ঞেস করেন,
‘হঠাৎ এই ঘরে?’
তনুকা ততক্ষণাৎ কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠে,
‘বাবার খোঁজ নিতে এসেছি।’
রমেজ মজুমদার বিছানায় আধ শোয়া তখন। তিনি কপালে ভাঁজ ফেললেন। বললেন,
‘তোমার বাবার খোঁজ আমাদের কাছে নেই।’
‘অবশ্যই আছে। আর কত মিথ্যে বলবেন আপনারা? আমি আপনাদের আর বিশ্বাস করি না। এবার ভালোই ভালোই বাবার খোঁজ দিন আমায়, নয়তো আমি মেহতাবকে সব বলতে বাধ্য হব।’
ঊর্মি হকচকিয়ে উঠে বলেন,
‘তুমি আমাদের ভয় দেখাচ্ছ, তনু। আমরা কি তোমার খারাপ চেয়ে কিছু করেছি?’
তনুকা বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,
‘খবরদার, একদম ভালোবাসা দেখাতে আসবেন না। আপনাদের আমার চেয়ে ভালো কেউ চেনে না। স্বার্থের জন্য সব পারেন। দুইদিন সময় দিলাম, এর মাঝে যদি আমাকে বাবার খোঁজ না দিতে পারেন তবে মেহতাবকে আমি সব জানাব। আর সব জানার পর মেহতাব আপনাদের কী অবস্থা করবে সেটা নিশ্চয়ই আমাকে বলে দিতে হবে না?’
তনুকা ফিচেল হেসে বেরিয়ে যায়। রমেজ মজুমদারের চোখ ভিজে ওঠে। বিধ্বস্ত সুরে তিনি বলে উঠেন,
‘মেয়েটা কি কখনোই আমাদের ক্ষমা করতে পারবে না, ঊর্মি?’
ঊর্মি হতাশ সুরে বলেন,
‘হয়তো না।’
.
আচমকা কোমরে কারোর হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে সে। আগন্তুককে চিনতে না পেরে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে নেয় কিন্তু, পরক্ষণেই এক চেনা ঘ্রাণ নাকে ঠেকতেই শান্ত হয় বক্ষঃস্থল। পেছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলে উঠে,
‘তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।’
আগন্তুক তার কাঁধে চিবুক ঠেকায়। মৃদু আওয়াজে বলে উঠে,
‘কালকের দিনটাও আমায় দিলে না।’
‘কী করব বলো? আমি বুঝতে পারিনি উনি এত কিছু করবেন।’
‘তা উনি আর কী কী করেছেন? অতি আবেগে তোমার উপর অধিকার খাটিয়ে বসেননি তো?’
এমন প্রশ্নে দ্বিধায় পড়ে সে। তবে তাকে বুঝতে না দিয়ে বলে উঠে,
‘উঁহু, একদমই না। তবে, এসবের মাঝে আমাদের পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন হয়েছে। জমিটা আর কিছুদিনের মাঝেই আমার হয়ে যাবে।’
অজ্ঞাত ব্যক্তি খুশি হয়ে হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে। কাঁধে চুমু খেয়ে বলে উঠে,
‘সত্যি বলছো?’
‘হ্যাঁ, একদম।’
মেহতাব তনুকার অপেক্ষায়। অথচ তার আসার নাম গন্ধ নেই কোনো। বিরক্ত হয়ে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আনমনে এদিক ওদিক দৃষ্টি বুলায়। তখনই এক দৃশ্যে দৃষ্টি থমকায় তার। চোখের সেই দৃষ্টি সরু হয় সঙ্গে সঙ্গেই। দুই জন ছায়া মানব দেখে আচমকা বক্ষঃস্থলের কম্পন বাড়ে তার। সঙ্গে ভর করে এক তীব্র আতঙ্ক। মস্তিষ্ক জেগে উঠে। স্নায়ু থেকে সংকেত আসে, আজ তাদের হাতে নাতে ধরা উচিত। মেহতাব সেই সংকেত অগ্রাহ্য করতে পারে না। প্রচন্ড রাগে কপালের রগ ফুলে উঠে তার। আজই হয়তো এই লুকোচুরি শেষ করবে সে। সেই প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে আসে। যাওয়ার পথে আলমারি থেকে তার সবথেকে ধারালো ছুড়িটাও নিয়ে আসে। সিদ্ধান্তে অটল সে, আজ সেই ব্যক্তির বক্ষচ্ছেদ না করে ক্ষান্ত হবে না, একদমই না।
চলবে….
(এখন থেকে গল্প রেগুলার দেওয়া হবে, ইনশাল্লাহ)