তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন পর্ব ১৬ #জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

0
56

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব ১৬

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

দীর্ঘ সাতদিন পর কলেজে এসেছে আহনাফ।

এই সাতদিন অহনা, শায়লাকে দিন রাত বুঝিয়েছে,

” বিভা ইজ নট আ রাইট চয়েজ মা!”

সংঙ্গে এও বুঝিয়েছে যে, ভাইয়ার জন্য ত্রিশাই পারফেক্ট মা, ওর বাসায় প্রপোজাল পাঠাও প্লিজ!
কিন্তু যে ধরনের পরিবারে ত্রিশা বেড়ে উঠেছে, সেখানে বিয়ের প্রস্তাব কোনো ভদ্র পরিবারের মানুষ পাঠায় না বলে বার বার শায়লা অবজেকশন দিয়েছে। কিন্তু অহনা এক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। ছোটো মানুষ হয়েও সে তার মাকে বড়দের মতো বুঝিয়েছে।
মাকে বলেছে, ” জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো” ত্রিশা এমন এক মেয়ে যার নামে কেউ একটা কুৎসা বলতে পারবে না। অত্যন্ত ভদ্র, শান্ত, বিনয়ি এক মেয়ে, যে একটা ফোন পর্যন্ত ব্যবহার করেনা। অহনার এক্ষেত্রে বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে বিভার সোশ্যাল মিডিয়ার একাউন্টগুলো। অহনা পইপই করে মাকে বিভার সোশ্যাল মিডিয়ার এক্টিভিটিগুলো দেখিয়েছে। কখনো শর্ট ড্রেসে সেলফি, কখনো ছেলে ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা মাস্তির ছবি আর কখনো একত্রে নাচানাচি, এ সকল ছবি দেখে শায়লার মনও বিভার প্রতি বিষিয়ে উঠেছে। আর তার পরিবর্তে ত্রিশার প্রতি জন্মেছে এক গভীর অনুরাগ। আর তার ছেলে যেহেতু মেয়েটাকে পছন্দ করেছে, এর চেয়ে বড় কিছু আর হতে পারে না। ছোটো থেকেই আহনাফের পছন্দের তারিফ সবাই করতো। আর বিয়ের ক্ষেত্রেও ওর পছন্দেরই জিত হবে এটাই নিশ্চিত!
শায়লা যেহেতু রাজী সেহেতু আহনাফ একে একে বোনের সব আবদারও পূরণ করতে নামলো।
কিন্তু বাবা আশফিক তালুকদার কে বুঝানো তো এক বড় যুদ্ধ। এবার মা শায়লা কে নিয়ে সেই যুদ্ধেই নামবে অহনা।

এই কয়দিনে আহনাফের ফোনে অসংখ্য কল আর ম্যাসেজ এসেছে, বিভিন্ন নাম্বার থেকে। আগে ফোন বাসায় রেখে যেতো এইসব মেয়েদের য’ন্ত্রনায়! আর গত সাতদিন হসপিটালের বেডে শুয়ে সময় কাটছিলো না বলে সবগুলো কলই সে রিসিভ করেছে, সব মেসেজই দেখেছে। সব মেয়েরাই পরিচয় গোপন রেখে কথা বলেছে। তবে সবার এক কথা, আহনাফকে দেখতে না পেয়ে সবারই মন ভীষণ খারাপ। তবে অহনার বুদ্ধি অনুযায়ী, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে নেমেছে আহনাফ। সবাইকে বলেছে, “বিভা নামের এক মেয়ে তাকে ভীষণ ই ডিস্টার্ব করছে “। আগে তো শুধু কয়েকজন জানতো যে, আহনাফের সাথে বিভার বিয়ের কথা পাকা! আর এখন যখন আহনাফ বলেছে, বিভা ওকে জোর করেই বিয়ে করতে চাচ্ছে, তখন মেয়েগুলো যার পর নাই ক্ষেপে গিয়েছে। তার মধ্যে যে একদল মেয়ে আহনাফের জন্য পাগল, সেগুলোর কয়েকজন এসে বিভাকে এসে শাসিয়ে গিয়েছে। তাদের মধ্যে এক মেয়ে যার নাম আরোহি, সে বিভার চেয়েও বড় গুন্ডি মেয়ে। আরোহির বাপ, ভাই সবাই অনেক বড় বড় সন্ত্রাস। আরোহি বিভাকে এসে ডিরেক্ট থ্রেট দিয়ে গিয়েছে এই বলে যে,

” আর কোনোদিন যদি তোরে আমার আহনাফের একশ গজের মধ্যেও দেখি তাইলে তোর পা ভাইঙ্গা হাতে ধরায়া দিমু”

এই কথা শুনে বিভার হাত পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে।

আজ আহনাফ ক্লাশে ঢুকার পর বিভা আর কোনো কথা বলারই সাহস পেলো না আহনাফের সাথে।

ওদিকে আহনাফের উৎসুক দৃষ্টি অপেক্ষা করছিলো, ত্রিশাকে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু না! ত্রিশা আজ আর কলেজে এলো না।

.
.

বাড়ি থেকে বের হয়ে ত্রিশা একা একাই নদীর তীর ঘেঁষে হেঁটে বেড়িয়েছে আর সারাদিন শুধু চিন্তা করেছে, কোথায় যাবে? কি করবে? কোথায় একটু আশ্রয় নেবে? বান্ধবীদেরও সে সমস্যায় ফেলতে চায় না, আর আহনাফ স্যারকে তো বলাই যাবে না, তাহলে সে ভাববে মেয়েটা নিশ্চয় আমাকে ভালোবাসে, সেজন্য বিপদে আমার কাছেই আশ্রয় নিতে এসেছে।

এসব ভাবতে ভাবতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।

সারা দিনের পানাহার ও বিশ্রাম বিহীন শরীর ঢলে পড়া সূর্যের মতই ঢলে পড়ছিলো ত্রিশার।
নদীর দক্ষিন পার্শ্বের লম্বা কুল গাছ নামি বটগাছ টাকে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু ওখানে সে যাবে না! কোনো পিছুটানের আর তার জীবনে ঠাঁয় ই নেই!
কোনো ক্রমে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। সাতশ কোটি মানুষের এই গোটা পৃথিবীকে ওর শূণ্য মনে হচ্ছিলো।

ঘাসের মধ্যে ধপ্ করে স্থিত হলো ত্রিশার দুর্বল শরীর।

এমন সময় সামনে আসতে লাগলো এক অবয়ব। এই গরমেও তার গায়ে ওভারকোট! কে সে?

মিনিট পাঁচ সে চেয়ে থাকার পর, অবয়ব একদম সামনে এলো। ত্রিশার চোখে অন্ধকার!

” কি রে ত্রিশা, এখানে একা একা?”

ত্রিশা চোখ মেলে চাইলো, ত্রিশা চিনতে পারলো, ছেলেটা রোমেল। তিন বছর ছেলেটা সামনে আসেনি। এই সেই ছেলে যে তাকে দীর্ঘ তিন বছর আগে এক থ্রেট দিয়েছিলো,

“আমারে ভালোবাসলি না রে ত্রিশা, তবে ভবিষ্যতে কোনোদিন যদি দেখি কারো লগে প্রেম করছিস তবে তার খবর করে ছাড়বো”

ছেলেটা কই থাকে কি করে এসব সম্পর্কে জানে না ত্রিশা। তবে একবার শুনেছিলো, ছেলেটা নষ্ট পথে চলে গিয়েছে। ছেলেটা একটা পানির বোতল ত্রিশার দিকে এগিয়ে ধরলো, ত্রিশা খাবে না, খাবে না ভেবেও ঢকঢক করে পানি গিলে খেলো, পিপাসা হয়তো কোনো বাঁধই মানে না, এজন্যই!

রাতুল হেসে বললো,
” এদিকে তো কেউ কাপল ছাড়া আসে নারে ত্রিশা, তুই এখানে একা? নাকি কারো জন্য অপেক্ষা করছিস?

ত্রিশা দুর্বল স্বরে বললো,
” না, আমি এখনি চলে যাবো”

রাতুল নিজের স্বর ভারি করে বললো,
” নতুন প্রেম করছিস নাকি? আহনাফ ভাইয়ের লগে তোরে এখন প্রায়ই দেখা যায়! ”

ত্রিশা বেশ সবলভাবেই উত্তর দিতে চাইলো, ” তুই ভুল বুঝছিস, এসব কিছু না! ”

কিন্তু আর কোনো কথা বলতে পারলো না সে, ঢলে পড়লো মাটির কোলে।

রোমেল দৌড়ে ত্রিশাকে কোলে তুলে নিলো। আজ একটা ভালো ভোজন হবে, এই ভেবে ওর জিহবায় জল চলে এলো।

এমন সময় মাথায় আচমকা আঘাত খেয়ে চিৎ হয়ে পড়লো মাটিতে। ত্রিশা অন্যত্র ছিঁটকে পড়লো।

রোমেল ক্রন্দনরত স্বরে ক্ষমা চাইলো,
” মাফ করেন আহনাফ ভাই, আপনের এত হায়াত, নাম নিতেই চইলা আইছেন?”

কিন্তু আহনাফ মা’রতে মা’রতে ওকে মাটি হতে তুলে পুনরায় মাটিতে আছড়ে ফেললো।

” ব’দমাইশ, মনে করছিস আমি তোরে চিনি না?”
বলে রোমেলের হাত দুটো দেহের পেছনে বেঁধে ফেললো। সাথে চোখও।

ফোন করে দ্রুত কয়েকজনকে এদিকে আসতে বললো।

আহনাফের বন্ধু রায়হান, অমিয়, আশিষ সবাই বাইক নিয়ে দ্রুত চলে এসে ত্রিশাকে নিয়ে মেডিক্যালে গেলো। রোমেল চোখ বাঁধা অবস্থায়ই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে রইলো।

ডাক্তার বললো,

” ত্রিশাকে পানির সাথে চেতনা নাশক পান করানো হয়েছে, তাছাড়া শরীর দুর্বল থাকায় ঔসধটাওকে দ্বীগুন দমিয়ে ফেলেছে।

রাত আটটার সময় ত্রিশা চোখ মেলে চাইলো।

প্রথম দর্শনেই আহনাফকে দেখে ও চমকে উঠলো।
” লোকটা কিভাবে প্রতিবারই দেবদূতের ন্যায় আমার বিপদে এসে আমাকে বাঁচিয়ে নেয়?”

আহনাফ গুটিপায়ে এসে ত্রিশার বেডের পাশে একটা চেয়ারে বসলো। মৃদু স্বরে বললো,

” তোমার বাসার নাম্বার দাও, আমি ফোন করে দিচ্ছি, এসে নিয়ে যাবে”

ত্রিশা ক্ষাণিকক্ষণ নিরব থেকে বললো,

” আমি ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি”

কথাটা প্রথমে নিতে না পারলেও পরক্ষণে আহনাফ ভাবলো,
” মেয়েটা একদম ঠিক করেছে”। কয়েকটা নামেমাত্র সম্পর্ক, বহুমাত্রায় অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য! ওখানে ভিত্তিহীনভাবে পড়ে থাকার কি মানে হয়? তার চেয়ে মেয়েটাকে লড়ে বাঁচতে দেওয়া উচিত।

আহনাফ একটু ভেবে বললো,

” আচ্ছা, আমার বন্ধু অমিয় তোমাকে একটা গার্লস হোস্টেলে এডমিট করে দিচ্ছে, আর কয়েকটা স্টুডেন্ট পড়াতে পারবে? ও থেকে তোমার খরচ চলে আসবে? ”

ত্রিশা খুশি হয়ে মাথা নাড়লো!

পরের দিন সকালে একটা ছাত্রী হোস্টেলে ত্রিশাকে এডমিট করে দিলো আহনাফ আর ওর বন্ধুরা।

আহনাফ ত্রিশাকে বুঝে গেছে। এ মেয়ে যে তার সাহায্যকে দয়া বলে চালিয়ে দিয়ে তা নিতে রাজী হবেনা তা সে ভালো করেই জানে। তাই মাথা চুলকিয়ে ত্রিশাকে বললো,

” ভেবো না মেয়ে, তোমাকে যা দিচ্ছি, তা আমি নই আমার এক ডাক্তার বন্ধু নাম রাতুল, সে দিয়েছে। সম্পূর্ণ ধার হিসেবে, তাকে যখন পারো দিয়ে দিও, আমি শুধু কলেজে তোমাকে ফুল ফ্রি পড়ার একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি আরকি! ”

ত্রিশার দু:শ্চিন্তা ভারী মুখে স্বস্তি চলে এলো।

ছাত্রী হোস্টেলে শুরু হতে চললো, ত্রিশার এক নতুন জীবন।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here