#আশিয়ানা
#পর্ব_১৬
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
গোধূলি আলোয় বিকেলটা লালচে রঙের সিঁদুরে মেঘে সাজিয়ে রয়েছে। ঠিক যেন মৃদু বাতাসের আঁচল কেটে রঙের ছোঁয়াছুঁয়ি রোদ্দুর। ছাঁদের এককোণে রেলিঙের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে উমাইয়া। বিষণ্ণ মনে কয়েক ঘন্টা সে এভাবেই পার করে দেয়। বিছানার ওপর ফোনটা রেখে আসছে। রোদেলা আর জুবিয়া তাকে খুঁজবে সম্ভাবনা রয়েছে তবুও মোবাইলটা সাথে নিয়ে আসেনি সে। কেনো যেন ইচ্ছে হচ্ছিল না। সন্ধ্যা নাগাদ পা তুলে ঘুরে তাকাল উমাইয়া। আবছা অন্ধকারে একজন পুরুষ লোকের অভয়ব ঢের টের পেল সে। ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল তার। খানিক উঁচু গলায় শুধাল,
‘ কে আপনি?’
সাদাফ নিশ্চুপে এসে উমাইয়ার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়াল। উমাইয়া অভিমানে নাক মুখ কুঁচকে ফেলল। সাদাফ দীর্ঘ সময় মৌন থাকল। এরপর গম্ভীর গলায় বলল,
‘ আপনি আমার ওপর রেগে কেন আছেন উমা?’
উমাইয়া অভিমানী কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি আমার থেকে সত্য লুকিয়েছেন?’
সাদাফ ভ্রু উঁচিয়ে উমাইয়ার মুখপানে তাকিয়ে। জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি লুকিয়েছি আমি?’
উমাইয়া তার আঁখি তুলে ধরল সাদাফের আঁখির দিকে। অতি অবলীলায় দুটি চোখের মিলন ঘটল।
উমাইয়া রাগে নিয়ে বল,
‘ আপনি কে? আপনার পরিচয় কী? আপনি এই বাড়ির এই ফ্ল্যাটটাই কিনেছেন কেনো?’
সাদাফ নিষ্পলক ভাবে উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। উমাইয়ার কাতর গলা গিয়ে সাদাফের বুকে লাগছে। সাদাফের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরতে লাগল, উমাইয়া কী তাহলে এতক্ষণ কান্না করেছে? কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। সাদাফের চিন্তায় বিগ্ন ঘটিয়ে উমাইয়া কথা বলে উঠল,
‘ কথা বলছেন না কেন?’
সাদাফ শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
‘ আমি সাদাফ। পরিবারের সদস্য বলতে সবাই মৃত। আমি তখন ইতালির একটা কনসার্টে ছিলাম। সেদিন ছিল আমাদের চতুর্থ কনসার্ট। আমরা অনেক আনন্দিত ছিলাম যে লোকে আমাদের চিনতে শুরু করেছে এবং আমাদের ভালোবাসছে। দেশে তখন অনেক রাত। পরদিন সকাল বেলা খবর পেলাম রাতে আমার বাড়িতে আগুন লেগেছিল। পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে ছিল। কেউ উঠতে পারেনি। আগুনে সবাই পুড়ে মারা যায়। তখন থেকে আমি এতিম। আমার বন্ধু সেহরিশ আর তূর্ণ ছাড়া আপন কেউ নেই। দেশের অনেক জমিজমা বিক্রি করে বাবা আমাকে ইতালিতে পাঠান। আমি ওখানে যাই। ভাল কলেজে পড়াশোনা করার জন্য খরচটা ও অনেক পড়ে। যা বাবা দেশে থেকে এফোর্ট করতে পারছিল না। তখন আমি ওখানে একটা বারে জব নেই। মোটামুটি দিনকাল ভালো চলছিল। তো একদিন বারের মালিকের সঙ্গে হাতাহাতি হয়ে যায়। তিনি আমার বাবাকে নিয়ে গালমন্দ করেন। তারপর যাই থানায় সেখানে দেখা হয় তূর্ণর সাথে। তূর্ণ তার বন্ধুর গার্ল ফ্রেন্ডের জন্য মারামারি করে থানায় পৌঁছে যায়। সেখানে সেহরিশ ও উপস্থিত ছিল। পুলিশ আমাদের নিয়ে কি করবেন? চিন্তা করছিল তখনি একজন ভদ্রলোক আমাদের দেখে এগিয়ে আসেন এবং আমাদের পুলিশ স্টেশন থেকে সোজা ওনার বাড়ি নিয়ে যান। আমাদের খেতে দেন এবং থাকার জায়গা দেন। তিনি এবি বেজিয়ান কোম্পানির মালিক ছিলেন। তিনি আমাদের নিয়ে একটা গানের দল তৈরি করতে চান। আমি আর তূর্ণ প্রথমে ওনার প্রস্তাবে রাজি হইনি। কিন্তু সেহরিশ। সে ছিল চমৎকার বুদ্ধিমান, ওঁ চিন্তা ভাবনা করে রাজি হয়। এবং আমাদের সেভাবেই প্রাকটিস শুরু করি। প্রথম আমাদের কেউ পছন্দ করেনি। অনেক কষ্ট স্ট্রাগল করে আমরা সামান্য ফ্যান ফলোয়ার তৈরি করতে পারি। চতুর্থ কনসার্টে আমাদের গান ও গানের সাথে পরিবেশিত ড্যান্স রেকর্ড তৈরি করে। তখন থেকে আমাদের আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। আমরা সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। সাফল্যের মাঝে হাড়ভাঙা খাটুনি ছিল পরিবার হারানোর কষ্টও ছিল। সব কিছু তখন পিছনে ফেলে এগিয়ে যাই। আমার সাধারণ ছিলাম তারপর লোকে আমাদের ভালোবেসে একটা চূড়ায় উঠালো। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকজন আমাদের চিনে না। যারা আমাদের সম্পর্কে কিছু জানে না বা আমাদের নামটাও কোনোদিন শুনেনি আপনি তাদের মধ্যে পরেন। আপনার সাথে প্রথম দেখা নার্সারিতে হয়। হালকা ভয় পেয়ে যাই, আপনি যদি সেলফি নিয়ে চান বা অটোগ্রাফ চান। সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করলে আমরা জন সম্মুখে এসে যেতাম। এই সামান্য কারণে আপনাকে প্রথম দেখে খানিক ঘাবড়ে যাই। পরবর্তীতে যখন দুই তিনটা কথা বলি তখন বুঝি আপনার বাহিরের জগৎ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। মূলত আমিও এমন একজন জীবন সঙ্গী চাচ্ছিলাম। যে আমাকে সাধারণ মানুষের মতো করে ভালো বাসবে। আমি সেলিব্রিটি, ধনী এসবের জন্য কেউ কাছে আসুক আমি চাইনি৷ আপনার সাথে আলাপ আমার ভালো লাগত। সে থেকেই আপনাকে পেতে চাই। যদিও এক তরফা কোনো কিছুই সম্ভব না। আমি জানি। গ্রামে যাওয়ার পর বা নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলে আমাকে একা থাকতো হত। এজন্য দেশে আসার পর তূর্ণর সাথে ওর ফ্ল্যাটেই থাকি। সেদিন আপনার বাড়ির ঠিকানা পেয়ে আমি বাড়িওয়ালার সাথে দেখা করি। বাড়ির দামের চেয়েও দুই ডাবল টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনি। শুধু আপনার কাছাকাছি থাকার জন্য। আমি আপনাকে সবই জানাতাম তবে একটু দেরি করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আপনি জানতে পারলেন।’
বলে থামল সাদাফ। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর আবারও বলল,
‘ আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি আপনাকে জোর করব না আমাকে ভালোবাসার জন্য। আমি সেহরিশের সঙ্গে ওর গ্রামে যাব। সেহরিশের বোন আরুর বিয়ের জন্য। আপনি নিজের খেয়াল রাখবেন।’
উমাইয়া নির্বাক চেয়ে রইল। সাদাফ হেঁটে ছাঁদের দরজা পর্যন্ত এসেছে। তারপর হঠাৎই তার পা থেমে গেল। সাদাফ ঘুরে এসে উমাইয়ার সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে গেল। অসহায় কণ্ঠে অনুরোধ করল,
‘ আপনি কি আমার হবেন?’
আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে লাগল উমাইয়া। বারংবার সাদাফের কথাগুলো মনে পরছে তার। সহসা আয়নার দিকে তাকাল সে। বিষ্ময়ে একদফা চমকে উঠল সে। আয়নায় সাদাফের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা ভেসে ওঠে। সাদাফ উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন ভাবে হাসলো। রোদেলা ঘরে এলো। উমাইয়ার ভিতু চেহারা পর্যবেক্ষণ করে শুধাল,
‘ কি হয়েছে তোর? এভাবে হা করে কি দেখছিস আয়নায়? মনে হচ্ছে ভূত দেখেছিস।’
‘ রোদু?’
‘ হুহ। বল।’
‘ আমরা যাদের কথা বেশি ভাবি তাদের কি সব জায়গায় দেখতে পাই? মানে তাদের চেহারা চোখে চোখে ভাসতে থাকে?’
রোদেলা সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকাল। শুধাল,
‘ কার মুখ ভাসছে তোর চোখে?’
উমাইয়া ব্যস্ততা দেখিয়ে দ্রুত হাতে চিরুনীটা ড্রেসিংটেবিলের ওপর রেখে রুম ত্যাগ করে বারান্দায় চলে গেল। রোদেলা রুম থেকে সোজা রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। একটা প্যাকের থেকে শুঁকনো খাবার নিয়ে জোজোর কাছে এসে বসে। খাবারের থালা জোজোর সামনে দিয়ে বলল,
‘ একসাথে সব খাবি না। রাতের জন্য কিছু বাঁচিয়ে রাখবি। রাতে যখন ক্ষুধা লাগবে তখন খাবি। শুধু শুধু ঘেউ ঘেউ করে কারো ঘুম নষ্ট করবি না।’
____________
জুবিয়া তার রুমের দরজা বন্ধ করে রাখছে। বাহির থেকে বার কয়েক ডেকে চলে গেল রোদেলা। জুবিয়া বিছানার ওপর বসে এক দৃষ্টিতে তূর্ণর দেওয়া উপহারটার বাক্সের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তূর্ণর দেওয়া গিফটটার কথা জুবিয়া বেমালুম ভুলে যায়। দুদিন ধরে ব্যাগের ভেতরেই ছিল। দুদিন আগে তূর্ণ অবশ্য জিজ্ঞেস করে মনে করিয়ে দিয়েছিল। তবুও ঘরে আসতে ভোলা মন ভুলে যায়। আজ ব্যাগ থেকে কলম বের করতে নিয়ে হাতের সাথে খোঁচা লাগে। বাক্সটা বের করে সামনে নিয়ে বসে আছে জুবিয়া। একবার ভেবেছিল ফেলে দিবে। পরোক্ষণেই ভাবলো, কারো গিফট করা জিনিস ফেলতে নেই। জুবিয়া খানিক ঝুঁকে এলো। তারপর বাক্সের ওপরে পেঁচানো কাগজ খুললো। ভেতরে লাল রঙের এক বাক্স। বাক্সটার উপরের অংশ সরাতে দেখতে পেল কিছু চিরকুট। জুবিয়া কুটিল হেসে চিরকুট হাতে নিল। খুলে দেখল গুটিগুটি হাতে লিখা রয়েছে,
‘ এই বাক্সের ভেতর কি রয়েছে জানতে চাও?’
জুবিয়া চিরকুটটা সরিয়ে বিছানার ওপর রাখল। এরপর অন্য একটা চিরকুট তুলে নিল।
‘ উঁহু, এর মধ্যে কি রয়েছে তুমি এত সহজেই জানতে পারবে না।’
জুবিয়া হালকা হাসলো। এরপর আরও কয়েকটা চিরকুট খুলল সে। সেগুলোতে লিখা,
‘ বাক্সের ভেতর কি রয়েছে জানতে চাইলে এর পরের চিরকুটটা পড়ো।’
এভাবে চারটা চিরকুট পড়ে শেষ করল জুবিয়া। অবশেষে শেষ চিরকুট হাতে নিয়ে বসে রইল। অনেক ইতস্তত নিয়ে চিরকুটটা খুলল জুবিয়া।
শেষ চিরকুটে তূর্ণ ইটালিয়ান শব্দে লিখেছে,
‘ আমোরে মিও!’ (আমার ভালোবাসা!)
চলবে….