#আশিয়ানা
#পর্ব_২২
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
আজাদ আলীর বাড়ির পিছন দিকে ফাঁকা জায়গা জুড়ে প্রচুর ফুল গাছ লাগানো। বাড়ির সামনে জায়গা নাই, শখের বসে ছাঁদে এবং পিছনে ফুলের গাছ লাগিয়েছে উমাইয়া। বাড়িওয়ালা আজাদ আলী আপত্তি করেন নি। মেয়ে দু’টো দু’বছর ধরে তার এই বাড়িতে আছে। এতদিনে বেশ আপন হয়ে উঠেছে। আজাদ আলীর একজন ছেলে সন্তান, সাত বছর আগে বেলজিয়াম গিয়েছে পড়াশোনা করার জন্য, তারপর দেশে আসেনি। মাসে একবার দুবার কল করে খোঁজ খবর নেয়। এই যা। জুবিয়া সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় হঠাৎ আজাদ আলীর সঙ্গে দেখা হলো।
আজাদ আলী হেসে বললেন,
‘ এত তারাহুরো করে কোথায় যাচ্ছিস রে মা?’
জুবিয়া আকর্ণ হেসে বলল,
‘ বাড়ির পিছনে যাচ্ছি চাচা! গাছ গুলোয় সকালেও পানি দিতে পারিনি।’
‘ শোন গোলাপ চারার নিচে লাল পিঁপড়া বাসা বাঁধছে। সাবধানে, পিঁপড়ার বাসায় পা রাখলে কিন্তু কামড়াইবো।’
‘ ঠিক আছে চাচা। আমি দেখেই পা রাখব।’
জুবিয়া বাড়ির পিছন দিকে চলে গেল। যত্ন করে গাছ গুলোয় পানি দিয়ে তারপর হাফ ছাড়ল। চার তলার ওপর থেকে নেমে পা কেমন মচমচ করছে। দক্ষিণ দিকে দোলনা রয়েছে। সেখানে গিয়ে বসল জুবিয়া। সহসা ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর ফুরফুরে হয়ে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ পর এদিকটায় এলো তূর্ণ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে জুবিয়াকে দেখতে পায়। তারপরই তার এখানে আসা। জুবিয়া চোখ দুটো বন্ধ করে রাখছে। তূর্ণ ত্রস্তপায়ে হেঁটে এসে জুবিয়ার পাশে বসল। দোলনা আগের চেয়ে হালকা ভারী হলো। জুবিয়ার পায়ের দুলানোয় নড়ছে না। জুবিয়া হঠাৎ চোখ খুলে তাকাল। তূর্ণ কে দেখে সে ইতস্তত বোধ করল।
তূর্ণ মৃদু হাসি হাসল। এরপর তার হাতের চুড়ির ঝুলিটা জুবিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। সরু কণ্ঠে বলল,
‘ এগুলো আপনার জন্য।’
জুবিয়া বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ আপনি আমার জন্য মেলায় চুড়ি কেনার জন্য গিয়ে ছিলেন?’
তূর্ণ স্মিথ হাসল। বলল,
‘ চুড়ি গুলো দেখার পর প্রথমে আপনার কথাই মাথায় এসেছিল।’
নির্বাক বসে রইল জুবিয়া। তূর্ণকে সে কিছু বলল না। কেন যেন, আজ ছেলেটাকে তার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। দোলনা থেমে রয়েছে। তূর্ণ পা তুলে দোল দিতে লাগল। একটু পর হুট করেই তূর্ণ প্রশ্ন করে,
‘ মানুষের চারিত্রিক দিক কয়টা জানেন?’
জুবিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বলল, ‘ উঁহু! কয়টা?’
সহসা নড়েচড়ে বসে তূর্ণ।
‘ আমিও জানি না।’
জুবিয়া কিঞ্চিৎ রাগ মিশ্রিত গলায় বলল,
‘ আপনি নিজেই জানেন না। অথচ আমাকে প্রশ্ন করছেন।’
তূর্ণর হাসি পেল। হাসিটা চেপে ধরে শুক্ল গলায় বলল,
‘ ওমা। নিজে না জানলে প্রশ্ন করা যাবে না৷ এমন কথা কোথাও লেখা আছে নাকি?’
জুবিয়া ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। বিরবির করে বলল,
‘ অসহ্য।’
তূর্ণ হুট করে তার বা-হাতখানা জুবিয়ার অভিমুখে তুলে ধরল। মৃদু আওয়াজে বলল, ‘ আপনার হাতটা আমার হাতের ওপর রাখুন।’
জুবিয়া জড়তা নিয়ে তার হাতখানা রাখে তূর্ণর হাতের ওপর। তূর্ণ বেশ কয়েকটি চুড়ি জুবিয়ার হাতে পড়িয়ে দিল। চুড়ি ঠিকঠাক মতো বসে রইল। অবাক হলো জুবিয়া শুধাল,
‘ আপনি আমার হাতের সাইজ কিভাবে জানেন?’
তূর্ণ কুটিল হাসল।
‘ প্রিয় মানুষের সব কিছুতেই নজর রাখতে হয়।’
______________
গভীর রাত। আঁধার রাত ঘনিয়ে দুই একটা জোনাকিপোকা বন জঙ্গল ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসছে। হলদে-সোনালি আলো ছড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। রাতের এই নিস্তব্ধতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে গাড়ি চলার শব্দ। সেহরিশ সন্ধ্যা বেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল উমাইয়ার বাবার সঙ্গে দেখা করা। দু গায়ের লোকজন ভীড় করে দাঁড়িয়ে রয় তাকে দেখার জন্য। সেখান থেকেই ফিরতে রাত হয়ে যায়। সেহরিশ তার স্বভাব মতো আজও বডিগার্ড কিংবা তার ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে আসেনি। রাত হয়ে যাওয়ায় সে রাস্তা চিনে উঠতে পারেনি। ভুল করে অন্য একটি রাস্তায় গাড়ি নিয়ে এলো। রাস্তার দুপাশে বিশাল বড়বড় গাছপালা। যেন প্রকৃতির বুক চিঁড়ে বয়ে গেছে মসৃণ রাস্তা। এদিকে ল্যাম্পপোস্ট নেই। গাড়ির হেডলাইটে যতটা দেখা যায়। সহসা সেহরিশের মনে হলো তার গাড়ি থেকে একটু দূরে কোনো গাড়ি রয়েছে। রাতের ফায়দা উঠিয়ে তার পিছু নিচ্ছে। পিছন দিকে অন্ধকার, গাড়ির হেডলাইট বন্ধ। সেহরিশ তার গাড়ি যেদিকে ঘোরাচ্ছে পিছনের গাড়িটাও সেভাবে ঘুরছে। চাকার আওয়াজ মন দিয়ে শুনলো সেহরিশ। এরপর ধাতস্থ হয়ে বসল। জঙ্গলের কাঁচা রাস্তার দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে গেল সেহরিশ। দ্বিতীয় গাড়িটা হঠাৎ থমকে যায়। গাড়ির হেডলাইট অন করার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হলো সেহরিশ গাড়ি। ঠিক তার গাড়ির সামনেই। গাড়ির ভেতর বসা লোকের মনে উৎকণ্ঠা ও ভয় বাড়ছে। সে গাড়ি থেকে নামলো। হাতের পিস্তল সোজা তাক করে সেহরিশের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গুলি চালালো। কিয়ৎকাল পর গাড়ির দরজা খুললো সে। গাড়ির ফ্রন্ট সিট ফাঁকা। লোকটা নিরর্থক দাঁড়িয়ে গেল। শীতল বাতাস বয়ে গেল তার বক্ষস্থল জুড়ে। সহসা ঘুরে দাঁড়াল সে। মুহূর্তেই এক ঘুষি এসে পড়ল তার মুখমণ্ডলে। হাত থেকে পিস্তল ছিটকে পড়ল। অন্ধকারে আক্রমণ হওয়ায় লোকটা নিজেকে সামলাতে পারলো না মাটিতে উপচে পড়ল। সেহরিশ লোকটা কে মেরে আহত করে ফেলল। এরপর তাকে গাড়ির সঙ্গে চেপে ধরে শক্ত গলায় শুধাল,
‘ কে পাঠিয়েছে?’
লোকটা কিছু বলার আগে গুলির শব্দ হলো। সেহরিশ ধারণা করেছিল এ একা নয়। এর সঙ্গে আরও অনেকে রয়েছে। শত্রুকে চিহ্নিত না করে লড়াই করা বোকামি। মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আকাশে থুতু ফেলার মতো। সেহরিশ দৃঢ় চোখে এদিক ওদিক তাকাল। এরপর লোকটাকে অন্ধকারেই ছুঁড়ে ফেলল সে। গাড়ির চাকা এক গর্তে পড়ে আছে। বের করা যায়নি। গাড়ির ভেতর থেকে ফোনটা নিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটে গেল সেহরিশ। ঘন্টা দুয়েক পর এক জায়গায় এসে থামল সে। অন্ধকারে তেমন কিছুই নজরে আসছে না। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করল সে। ঘড়িতে সময় ২:৩০মিনিট।
সাদাফ বিছানার ওপর বসে রয়েছে। এপ্রিল মাসের ৭তারিখে বাংলাদেশে তাদের একটি কনসার্ট রয়েছে। এই কনসার্ট শেষ হলেই দুই বা তিনদিন পর ইতালি ফিরে যাবে ওরা। কনসার্টের জন্য নতুন গান লিখছে সাদাফ। বিছানার ওপর তার ফোন হঠাৎ বেজে ওঠে। ফোনের স্কিনে সেহরিশ নামটি দেখামাত্র ভ্রু কুঁচকে গেল সাদাফের। ফোন হাতে বারান্দায় আসলো সাদাফ। প্রকৃতির হিমশীতল বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিল সে। কল রিসিভ করে সেহরিশের উদ্দেশ্য বলল,
‘ দুইদিন হয়েছে গ্রামে গিয়েছিস। আর তুই কল করার জন্য এখন সময় পেলি?’
সেহরিশ গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে, অস্ফুট আওয়াজে বলল,
‘ আমার ওপর অ্যাটাক হয়েছে।’
আঁতকে উঠল সাদাফ। গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে গেল তার। শক্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে শুধাল,
‘ তুই ঠিক আছিস? এখন কোথায় তুই?’
সেহরিশ চারিদিকে তাকাল। ‘ জানি না। অন্ধকারে কিছু ঠাহর করতে পারছি না।’
সাদাফ হুংকার দিয়ে বলল,
‘ তোকে কতবার বলেছি, বাড়ি থেকে বের হলে বডিগার্ড সঙ্গে রাখার জন্য। কখনো আমার কথা শুনিস না।’
‘ ফোনে চার্জ শেষের দিকে। যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যাবে।’
সাদাফ বলল,
‘ কে ছিল?’
‘ জানি না। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি আমাকে ট্র্যাপে ফেলার জন্য আগে থেকে প্ল্যানিং করা ছিল।’
‘ আমাকে তোর লাস্ট লোকেশান সেন্ট কর। আমি এখুনি বের হচ্ছি।’
তূর্ণ পাশের রুমে ঘুমিয়ে আছে। সাদাফ দ্রুত তার ঘরে ছুটে এলো। তূর্ণ কে জাগিয়ে তুলতে কিছুটা বেগ পেতে হলো সাদাফের। বেডের পাশে ছোটো টেবিলের গ্লাস ভরা পানি রয়েছে। কয়েক ফোঁটা পানি তূর্ণর মুখে ছিটিয়ে দিতেই তূর্ণ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলে ওঠল,
‘ পানি দিলি কেন?’
সাদাফ উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
‘ সেহরিশের ওপর অ্যাটাক হয়েছে। এবং সে কোনো এক জঙ্গলের ভেতর রয়েছে। ওর গাড়ি সাথে নেই। আমাদের এখুনি সিরাজগঞ্জ যেতে হবে।’
তূর্ণ বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে এলো। সাদাফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,
‘ আমাকে সারাক্ষণ কথা শোনায় এটা করবি না, ওটা করবি না। তাহলে ও কেন এমন জ্ঞানহীন কাজ করে? কেমন আছে ও? কোনো চোট লাগেনি তো ওর?’
তূর্ণর কার্নিশ ভিজে এলো জলে। সাদাফ গাল থেকে জলটুকু মুছে নিয়ে বলল, ‘ স্টিফেনকে কল কর। সবাইকে এখুনি বের হতে বল।’
চলবে….