আশিয়ানা #পর্ব_২৮ #শারমিন_সামাইরা_ধৃতি

0
59

#আশিয়ানা
#পর্ব_২৮
#শারমিন_সামাইরা_ধৃতি
_____________
রাত দশটা বাজে। এই সময় তিনজন মেয়ের ফ্ল্যাটে গিয়ে তাদের উত্যক্ত করার বিষয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়ে ড্রয়িংরুম ত্যাগ করে নিজ রুমে চলে গেল সেহরিশ। ইচ্ছে ইচ্ছে এই মূহুর্তে নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার। উপায় নেই বলে বাধ্য হয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে। সাদাফ তূর্ণর উষ্কখুষ্ক মুখখানা পর্যবেক্ষণ করে নির্মূল স্বরে বলল,

‘ তোর কি হয়েছে? খাচ্ছিস না কেন?’

তূর্ণ মলিন কণ্ঠে বলল,

‘ গলা দিয়ে নামছে না। এমন কি বললাম যে সেহরিশ রাগ করে চলে গেছে?’

সাদাফ বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। এরপর ভাবনা চিন্তা করে বলল,

‘ আমি রোদেলাকে কতবার করে বললাম খাবারের প্যাকেট সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে নিলেন না। এদিকে তোর কথায় ও যুক্তি রয়েছে। আমরা যদি খাবার সমেত ওনাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হই, তাহলে নিশ্চিত ওনারা ফিরিয়ে দিবেন না। কিন্তু সেজন্য সেহরিশ কখনো রাজি হবে না। ওঁকে কোনো ভাবে রাজি করাতে হবে।’

‘ কিন্তু কিভাবে?’

সাদাফ এগোল। তূর্ণর পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসে ফিসফিস আওয়াজে কিছু বলল। সহসা তূর্ণ উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে বলে,

‘ এইবার কিভাবে না করবে বাচ্চু?’

সাদাফের ফ্রিজ সবসময় খাবারে ভরপুর থাকে। ফ্রিজের ভেতর থেকে রসমালাইয়ের বাটিটা খুঁজে বের করে নিয়ে টেবিলের ওপর রাখে তূর্ণ। ছোটো পিরিচে কিছুটা বেড়ে নিয়ে চলে গেল সেহরিশের রুমে। অন্ধকার রুম। কোনোক্রমে লাইট অন করামাত্র রুমটি ফাঁকা পেল। রুমের ভেতর ছোটো টি-টেবিলের ওপর পিরিচটা রেখে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল তূর্ণ। রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেহরিশ। তূর্ণ তাত্ক্ষণিক ছুটে এসে ঝাপ্টে ধরলো তাকে। অকপটে কিছু কথা বলে তূর্ণর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে সেহরিশ। তূর্ণ জোড়ালোভাবে জড়িয়ে ধরে আছে সেহরিশ কে। তারপর অনুনয় বিনয় করে বলল,

‘ চল না। প্লিজ প্লিজ। ওখানে গিয়ে তো তোর কিছু করতে হবে না। চুপচাপ বসে থাকবি। কোনো কিছুর ভয়ও নেই। এই খবর মিডিয়ায় পৌঁছাবেও না।’

সেহরিশ রাগে গজগজ করে বলল,

‘ আমি তোদের সাথে এই ফ্ল্যাটে থাকছি কেন? তোদের কি মনে হয়, তোদের বাঁদরামিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য? রাতের বেলা তিনজন কুমারী মেয়ের ফ্ল্যাটে যাবি। লোকজন কি ভাববে? তারা কি বিষয়টি স্বাভাবিক নিবে? আমি তোদের সঙ্গে কোথাও যাবো না।’

তূর্ণ তার একপা দিয়ে সেহরিশের পা পেঁচিয়ে নিল। এরপর বিরসমুখে বলল,

‘ যাবো আর চলে আসবো। প্লিজ চল না! তুই থাকলে আমরা একটু ভরসা পাই। তাছাড়া বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে।’

সেহরিশ তার শক্তির জোরে তূর্ণর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রুমে চলে এলো। পিছু পিছু রুমে ছুটে এলো তূর্ণ। সেহরিশের আগেপিছে ঘুরঘুর করতে লাগল সে। অতিষ্ঠ হয়ে রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল সে। সেহরিশ সে নিজেও জানে, কেন? সে এই ছেলেটার কোনো কথা ফেলতে পারে না। বাচ্চাদের মতো পাগলামো করছে দেখে অজ্ঞতা জানি হয়েই গেল। তূর্ণ আনন্দে আপ্লূত ছুটে গেল রসমালাইয়ের পিরিচ থেকে দু’টো পিস নিয়ে এসে সেহরিশের মুখে পুড়ে দিল। ঘটনাটি এত তারাতাড়ি ঘটে যা বুঝে উঠতে পারেনি সেহরিশ। অবাক চোখে তূর্ণর দিকে তাকিয়েই রসমালাই চিবোতে লাগল। তর্জনী আঙুলে ঠোঁট মুছে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াল সে। সাদাফ আর তূর্ণ হাতে হাতে খাবারের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে নিয়েছে। এরপর তিনজন পোশাক পরিবর্তন করে একসাথেই এসে ওদের বিপরীত ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়াল। কলিংবেল চাপার কিছুক্ষণের ভেতর রোদেলা এসে দরজা খুলে দেয়। দরজার পাশেই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায় রোদেলা। সেহরিশকে দেখামাত্র তার হৃৎস্পন্দন তীব্রভাবে ছুটতে শুরু করে। হার্টবিট সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।

ভেতর রুমে থেকে উমাইয়ার আওয়াজ ভেসে এলো,

‘ এই রোদু, একরাতে কে এসেছে রে?’

রোদেলার কণ্ঠনালী শূন্য। কোনো জবাব বেরিয়ে এলো না। নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফ শুধাল,

‘ আমরা কি ভেতরে আসতে পারি রোদেলা?’

সেহরিশ এতক্ষণ তূর্ণর পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার দৃষ্টি তার ফোনের স্কিনে সংযত করা। সাদাফের মুখে রোদেলা নামটি তার শ্রবণাঙ্গে প্রবেশ করামাত্র সে মাথা তুলে তাকাল। সেহরিশের তাকানো মাত্র দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল রোদেলা। মেঝের উপর দৃষ্টি স্থির করে মাথা উপর-নিচ নাড়িয়ে বলল,

‘ জি আসুন।’

রোদেলার জবাব না পেয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ড্রয়িংরুমে পা রাখল উমাইয়া। সাদাফের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। উমাইয়াকে দেখে তূর্ণ একগাল হাসলো। বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম।’

উমাইয়া সালামের জবাব নিয়ে ধীরগতিতে হেঁটে রোদেলার পাশে দাঁড়াল। কানে কানে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ এতরাতে ওনারা কেন আসছেন?’

রোদেলা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

‘ আমি জানি না।’

রোদেলার উত্তর শুনে একবার ফের সেহরিশ রোদেলার দিকে তাকাল। রোদেলা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে লক্ষ্য করে মাথা নিচু করে ফেলল। উমাইয়া হঠাৎ রোদেলার মাথায় টোকা মেরে বলল,

‘ আস্তে বলতে পারিস না? ওনারা শুনে ফেলল তো।’

রোদেলা এবার আস্তে আস্তে বলল,

‘ আমি জানি না।’

বেশ কয়েকটি কণ্ঠস্বর শুনে দ্বিতীয় রুম থেকে খুঁড়াতে খুঁড়াতে বেরিয়ে এলো জুবিয়া। আকাশ থেকে পড়ল এমন ভাব করে জিজ্ঞেস করল,

‘ তোরা এত চেচামেচি করছিস কেন?’

তূর্ণকে দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিল সে। সন্ধ্যাবেলায় তূর্ণর যে রূপ সে দেখেছে তারপর থেকেই কেমন যেন তূর্ণর কথা ভাবতেও তার ভয় লাগছে।

সাদাফ খাবারের প্যাকেটগুলো দেখিয়ে বলল,

‘ আমার একটা ইন্টারভিউ ছিল। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় সবার জন্য রেস্ট্রন্টে থেকে খাবার নিয়ে আসছি। ওখানকার খাবারগুলো খুবই ভালো। ভাবলাম সবাই একসাথে খেলে এর স্বাদও দ্বিগুণ পাওয়া যাবে। তাই সব নিয়ে আপনাদের ফ্ল্যাটে চলে আসলাম। আশা করছি আপনারা বিরক্ত হননি, উমা।’

তূর্ণ তাড়া দিয়ে বলল,

‘ এগুলো বাড়ার জন্য প্লেট নিয়ে আসুন না বড়আপু।’

তূর্ণ কথাটি উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলেছে। উমাইয়া প্রত্যুত্তরে বলল,

‘ আমার বাড়িতে যেসব প্লেট আছে সেগুলো আপনাদের পছন্দ হবে না।’

তূর্ণ এবার মুখে কিছু বলল না। উঠে দাঁড়াল। এরপর এগিয়ে গেল উমাইয়ার দিকে। জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ কিচেন কোন দিকে?’

রোদেলা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল। তূর্ণ নিজহাতে প্লেট নিয়ে আসে এরপর এক এক করে সব কিছু প্লেটে করে টেবিলে সাজায়। জুবিয়া হঠাৎ বেঁকে বসে। বলল,

‘ আমার ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।’

রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা নিষিদ্ধ। কখন কি হয়ে যায়? বলা তো যায় না। এজন্য উমাইয়া কোনোরুমের দরজা বন্ধ করতে দেয় না। হালকা করে চাপানো থাকে। ইতস্তত করে চেয়ার টেনে বসল রোদেলা। ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। এই সময় সাদাফ বলে উঠল,

‘ রোদেলা আপনার সামনে যে মাটনের বাটিটা আছে ওটা একটু সেহরিশ এগিয়ে দিবেন?’

রোদেলা মলিন হাসল। কেউ কিছু বলার পর মুখের ওপর না বলার স্বভার তার নেই। ভয়কে উপেক্ষা করে সেহরিশের কাছে গেল। রোদেলার হাত দুখানা কাঁপছে। সেহরিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য হুট করেই বলল,

‘ কুকুরটা কোথায়?’

রোদেলা বলল,

‘ বারান্দায়।’

‘ এখন আসবে না তো?’

‘ না।’

তূর্ণ খাবার রেখে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,

‘ আমরা সবাই খাব। জুবিয়া রুমে একা থাকবেন। বিষয়টি কেমন দেখায়। আপনারা শুরু করুন আমি ওনাকে এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’

রাতের আঁধারে অসম্ভব ভয় জুবিয়ার। রুমের লাইট অন করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে তূর্ণ। রুমে ঢুকতেই দক্ষিণের দেয়ালে তার দৃষ্টি পড়ল। খুব সুন্দর ভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এক মরা ফুলের তোরা। তূর্ণর ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। সে খুব কাছ থেকে ফুলের তোরাটা দেখতে আরম্ভ করে। মূহুর্তেই মনে পরে গেল, এটা সেই তোরা যেটা সে জুবিয়ার জন্য চিকেনশপে পাঠিয়ে ছিল। তূর্ণর ওষ্ঠকোণে দূর্লভ হাসির রেখা ফুটে উঠল। পরোক্ষণেই তার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া দ্বিগুণ কুঁচকে গেল। আজও জুবিয়ার সব কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। জুবিয়া বলেছিল, সে ফুলের জন্য চিকেন শপে যায়নি। এবং ফুলটাও সে রিসিভ করেনি। মনে মনে প্রশ্ন করল, ‘ মিথ্যে কেন বলেছিলেন জুবিয়া?’

বিছানার উপর কাঁথা জড়ানো শরীরের দিকে তাকিয়ে তূর্ণ মৃদু কণ্ঠে বলল,

‘ নারীদের বোঝার ক্ষমতা পুরুষের নেই।
যেখানে দেশের বিখ্যাত লেখকগণ নারীদের বুঝতে পারেন নি। সেখানে আমি কী ঢেঁড়স?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here