আশিয়ানা #পর্ব_৩৩ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
58

#আশিয়ানা
#পর্ব_৩৩
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
রোদেলা জানালার ধার ঘেঁষে বসে আছে। তার রুমের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে। রোদেলার মামা মাসুদের বাড়ির কাছেই একটা নদী। নদীর দুইপাড়ে বড়ো বড়ো নারিকেল গাছ, নারিকেল গাছের পাতাগুলো মৃদু দুলছে। নদীর তীরে বাঁধা একটা নৌকা। নদী থেকে কিছুটা দূরে এক বুড়ির কুঁড়েঘর যেটা স্বাভাবিক ভাবে জায়গাটার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। নদীর উল্টোদিকে একটা তালগাছ, গাছের নিচে একজন জেলে মাছ ধরছে। কিছুদিন আগেই ফসল কাঁটা হয়েছে। গ্রামের প্রায় অধিকাংশ লোকের বাড়ির উঠানে ধান রোদে শুঁকাতে দেওয়া হয়েছে। রোদেলার মনখানা আরও খারাপ হলো। আজ প্রায় দেড় মাস পর সে গ্রামে আসছে। অথচ রোদেলাকে দেখে মোটেও খুশি হয়নি তার মামি। রোদেলা সকাল ৫টা বাজে ঘুম থেকে উঠে মামীর হাতে হাতে কাজকর্ম করা শুরু করে। ৬টা বাজে তখন ঘরবাড়ি ঝাড়ু দিয়ে উঠানটুকু ঝাড়ু দিতে নিয়ে দেখল তার শখের ফুল গাছটা নেই। মামীকে প্রশ্ন করার পর তিনি খেজি দিয়ে উঠে, গাছের ডালপালার ছায়ার জন্য ধান রোদে শুকচ্ছিল না। এজন্যই গাছটি কেটে ফেলেছেন তিনি। রোদেলা তখন সোজা রুমে অবস্থান করে। এখানে রোদেলার নিজেকে খাঁচার বন্দি পাখির মতন লাগে। নিজের ইচ্ছামতো কোনো কিছুই করতে পারে না। রোদেলা জানালার উপর থেকে মুখ তুললো, পায়ের দিকে তাকাতে দেখল জোজো পা ঘেঁষে বসে আছে। সকালে খাবার দেওয়া হয়নি ওর। রোদেলা উঠে দাঁড়াল। এই সময় মামীর মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করল না। রুমের ভেতর পাউরুটি ছিল। কয়েক পিস ওর সামনে দিয়ে আবারও জানালার সামনে গিয়ে বসল সে। স্বচ্ছ আকাশটা একটু কালো মেঘে আকাশ ছুঁয়ে গেছে। হুট করে রোদেলার বুক ধুকপুক করতে লাগল। আজ উমাইয়ার গায়ে হলুদ এই সময় বৃষ্টি এলে হলুদের অনুষ্ঠান কিভাবে হবে? প্রশ্নটা ঘুরে-ফিরে এসে রোদেলার মস্তিষ্কে বাসা বাঁধল। ছোটোবেলার বান্ধবীর বিয়ে সে যাবে না। ভাবনাটা মস্তিষ্কে হানা দিতেই দুমড়ে মুচড়ে উঠল রোদেলার চিবুক। এতদিনে এ’ও’আই মিউজিক ব্যান্ডের সম্পর্কে টুকটাক ধারণা হয়েছে রোদেলার। তারা খুব ধনী মানুষ এবং শফিকুল চৌধুরী কে গাঁয়ের লোকজন একনামে চিনেন। ওমন বড়লোক বাড়ি বিয়ে হবে আর বান্ধবী হয়ে রোদেলা নিম্ন মানের পোশাক পরে যেতে পারবে না। বরং ওর জন্য উমাকে অপমানিত হতে হবে। লোকজন রোদেলাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে। ধনীদের অনুষ্ঠানে তার কোনো কাজ নেই। বিশাল এক কষ্ট বুকের ভেতর কত অবলীলায় চাপা দিয়ে ফেলল রোদেলা।

রোদেলা জোজোর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ টাকা, আলিসান ভাঙলো ও নামি-দামি পোশাকের কাছে অনূভুতিরা তুচ্ছ, জোজো।’

জোজো লেজ গুটিয়ে নিল। রোদেলার পায়ের সঙ্গে আরেকটু ঘেঁষে বসল সে। রোদেলার বুক ভারী লাগছে। চৌধুরী বাড়ি যাওয়ার জন্য নিত্যদিনের থ্রিপিস ছাড়া নতুন কোনো পোশাক তার নাই। উমাইয়া বারবার কল দিয়ে রোদেলাকে ওদের বাসায় যেতে বললেও কাজের বাহানা দিয়ে না করে দেয় সে। জুবিয়া গত দুদিন আগে এসেছিল ওদের সাথে শপিংমলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রোদেলা সেখানেও যাবে না বলে, ছুতো দিয়েছিল মামীর সঙ্গে ধান তুলতে হবে। বিখ্যাত সিঙ্গারের সঙ্গে উমাইয়ার বিয়ে নিয়ে কম গুঞ্জন হয়নি। মামী অবশ্য বেশ কথাই বলেছেন। রোদেলার সেখানে যাওয়া নিয়ে ওনার আলাদা করে কিছু বলার নেই। মাসুদ বাড়ির পিছনে কয়েকটা গাছের ডাল কাটছেন। রাতে বাতাস হলে ডালপালা গুলো টিনের উপর নেতিয়ে পড়ে শব্দ করে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় টিনের চাল ফুটো হয়ে যাবে।

মিনিট দশেক পর গামছা দিয়ে মুখ, গলা মুছে নিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ালেন মাসুদ। সেসময় সাদা রঙের এক গাড়ি রাস্তায় থামল। বাড়ি থেকে স্পষ্ট দেখা যায় রাস্তাখানি। হর্নের আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন পুতুল। মাসুদ চোখ তুলে রাস্তার দিকে তাকালেন। এই পথ দিয়ে সারাদিন ভ্যানগাড়ি ও সিএনজি একটু পরপরই যায়। মাইক্রো হঠাৎ এ একটা বা দুটো যেতে দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গাড়িটা এখানে থামল কেন? সচরাচর এখানে কোনো গাড়ি থামে না।

মাসুদ চমকে উঠলেন। উমাইয়া ও জুবিয়া দুজন গাড়ি দুই দরজা দিয়ে নামল। এরপর সরুপথ দিয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে এলো। মাসুদ উৎসুক হাসলেন। বহুদিন পর ওনার বাসায় মেয়ে দু’টো এসেছে। এবং একজনের তো আজ গায়ে হলুদও। পুতুল বেগম ওদের দেখে খুশি হননি। এটা তার মুখের ভাবভঙ্গিতে টের পাওয়া যাচ্ছে। উমাইয়া সামনা-সামনি এসেই সালাম দিল।

‘ আসসালামু আলাইকুম চাচা।’

সালামের জবাব নিয়ে মাসুদ বললেন,

‘ ওয়া-আলাইকুমুস সালাম মা। কেমন আছিস তোরা? সকাল সকাল এই গরিবের বাড়ি পা পড়ল।’

উমাইয়া বলল,

‘ তুমি গরিব হলে আমরা কোথাকার বড়লোক চাচা?’

মাসুদ উমাইয়ার মাথায় হাত রাখলেন। তারপর বললেন,

‘ টাকা পয়সা দিয়ে কখনো মানুষ বিচার করতে নেই মা। দোয়া করি তোরা জীবনে অনেক সুখী হো।’

জুবিয়া বলল,

‘ চাচা রোদেলা কোথায়? ওকে ফোন করছি। কলটা ও ধরছে না।’

‘ ঘরেই আছে দেখ।’
.
.
‘ রোদু.. রোদু?’

‘ এই রোদেলা?’

চেনা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল রোদেলা। আচমকা পিছনে তাকিয়ে দেখল দরজার সামনেই উমাইয়া আর জুবিয়া দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা চমকে ওঠে দাঁড়িয়ে গেল।

উমাইয়া অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল

‘ খুব তো বলতিস আমার বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তুই থাকবি। সমস্ত আয়োজন তুই নিজ হাতে করবি। অথচ তোকে কল করেও পাওয়া যাচ্ছে না। কেন রোদু?’

রোদেলা অনিচ্ছাকৃত হাসল।

‘ আমি সময় পাচ্ছি না উমা।’

জুবিয়া তেড়ে এলো। রোদেলার দু-হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

‘ সময় কেন পাস না? কি করিস তুই?’

রোদেলা ইতস্তত করে বলল,

‘ মামী সারাদিন একা কত কাজ করে। আমি একটু সাহায্য করার চেষ্টা করছি।’

রোদেলার কথার মাঝখানে ঘরে প্রবেশ করল পুতুল বেগম। তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে রোদেলার সব কথা শুনতে পেলেন। নিজের দোষ নামাতে বললেন,

‘ ওসব বাহানা কিচ্ছু না। ও মেয়ের জামাকাপড় নাই।’ বলে থামলেন পুতুল। এরপর উমাইয়ার উদ্দেশ্য বললেন, ‘ তোর বড়োঘরে বিয়ে হচ্ছে সেখানে কমদামি জামা পরে গেলে তোকে সবার কাছে ছোটো হতে হবে। এটা ভেবেই ঘরে সেঁটে বসে আছেন মহারাণী।’

রোদেলা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। পুতুল বেগম কিছু জিনিস নিতে এসে ছিলেন। নিয়ে চলে যান। উমাইয়া ক্ষীণ সুরে রোদেলা কে ডাকলো,

‘ রোদু?’

রোদেলা কেঁদে ফেলল। জুবিয়া ও উমাইয়া জানে এই মেয়েটা সহজসরল সামান্য কিছুতেই কেঁদে ফেলে। দু’জন একসাথে ওকে জড়িয়ে ধরল। একটু পর উমা রোদেলার থুতনিতে হাত রেখে মাথা খানিক উঁচু করে। এরপর একহাতে ওড়না নিয়ে রোদেলার চোখের জলটুকু মুছিয়ে দেয়। রোদেলা একটু স্বাভাবিক হলে উমা বলল,

‘ আমরা তো আছি। আমরা কি তোর নামের বন্ধু না-কি? বন্ধু মানে হচ্ছে সকল সুখ-দুঃখের সঙ্গী। তুই কী ভাবছিস? তুই আসবি না আর আমি ধেইধেই করে বিয়ে করে ফেলব? কখনোই না।’

রোদেলা নিষ্পলক চোখে তাকাল। উমা জুবিয়াকে কিছু দেওয়ার জন্য ইশারা করে। এরপর জুবিয়া একটা বিশাল ব্যাগ উমার দিকে এগিয়ে দিল। উমাইয়া আকর্ণ হাসল। তারপর ব্যাগটা রোদেলার হাতে থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ আমার বিয়ের জন্য তোর শপিং। আমি যেমন ইনকাম করেছি তেমন সেভিংস ও করেছি। আমি আর জুবিয়া মিলে তোর জন্য এই ড্রেস গুলো কিনে নিয়ে আসছি। যদিও অনেক মার্কেট করার জন্য কিছুটা ডিসকাউন্ট পেয়েছি। কিন্তু কোনো ব্যাপার না, চলবে।’

রোদেলা গাল ভরে হাসল। দু-হাত দু’জন কে জড়িয়ে ধরে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। হাসি-কান্নার মাঝে ঘরে আসলেন মাসুদ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

‘ তোরা দুপুরে খেয়ে যাবি তো মা? তাহলে আমি একটু মার্কেট গিয়ে তোদের জন্য একটা মুরগী নিয়ে আসতাম।’

উমাইয়া বলল,

‘ দরকার নাই চাচা। আমরা এখুনি চলে যাব। কিছুক্ষণ পরই হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। আমি আসছি রোদেলাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দেখছেন না আপনাদের জামাই গাড়ি সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন যাতে দেরি না হয়।’

মাসুদ হাসলেন,

‘ আচ্ছা আচ্ছা।’

উমাইয়া আরও তিনটা ব্যাগ মাসুদের হাতে দিয়ে বলল,

‘ আপনাদের হবু জামাইয়ের তরফ থেকে উপহার চাচা। এগুলো নিলে খুশি হবে সে। সময়ের জন্য আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেনি। কিন্তু আমার কাছে পইপই করে বলেছে আপনাদের হলুদের অনুষ্ঠান থেকে বউভাত পর্যন্ত থাকতে হবে। চাচা আপনি চাঁচি আর ছোট্টু টাকে নিয়ে বিকালে চৌধুরী বাড়ি চলে যাবেন কিন্তু। আর আমরা রোদেলাকে এখুনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব।’

মাসুদ কি বলবেন? ভাষা খুঁজে পেলেন না। চোখ দুটো ভিজে আসলো। এমন ছেলে এ-যুগে আছে? ভেবেই তিনি আনন্দে কান্না করে ফেললেন। মাসুদ বললেন,

‘ সে মস্ত বড় গায়ক। তারপরও হৃদয়ে একফোঁটা অহংকার নেই। মানুষটা সত্যি ভালো রে মা। কখনো তাকে কষ্ট দিস না। এমন ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here