#আশিয়ানা
#পর্ব_৪৭
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
____________
স্নিগ্ধ সকাল, পাখির কলকাকলি, ঝলমলে রোদ, বাতাসের উষ্ণ পরশে মন-প্রাণ শীতল হয়ে যায় যেন। মনের ভেতর সুখানুভূতিতে ছেয়ে ভরে উঠল। গভীর আলস্য ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল রোদেলা। উঠোনের দক্ষিণে শিউলি গাছটায় ফুল আসছে চারদিক ঘ্রাণে ম-ম করছে। শুভ্র সকালে এই ফুলের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রোদেলা। দু-দিন হলো সে গ্রামে আসছে, ভীষণ গরম পরেছিল এই দুদিন, সূর্যের তেজের জন্য ঘর থেকে বের হতে পারেনি সে। ঘরের বাইরে কোথাও এক টুকরো স্বস্তি নেই যেন। সকালের তাপ ততটা না হলেও দিন গড়াতে থাকলে রোদের তীব্রতাও বাড়তে শুরু করে। শিউলি গাছের নিচে বিছিয়ে আছে ঝরে পড়া ফুলগুলো, আলগোছে কয়েকটা ফুল তুলে ঘরের দিকে পা বাড়ালো রোদেলা। সেসময় পুরুষ লোকের কণ্ঠস্বর শুনে আচমকা দাঁড়িয়ে পরল সে। কণ্ঠটি পরিচিত। রোদেলা তড়িঘড়ি করে ওড়নার আঁচলে টানলো, মাথার চুল ও চোখ পর্যন্ত ওড়না টেনে জিজ্ঞেস করল, ‘ আপনি কখন আসছেন টুটুল ভাই?’
টুটুল বিগলিত হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল,
‘ এহনি আইলাম।’
‘ এত সকাল সকাল কোনো দরকারে আসছেন কী?’
টুটুল এক পা দু করে রোদেলার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। রোদেলা বুঝতে পারলো সে কয়েক কদম দূরে যায়। টুটুল ঠোঁটে পূর্বের হাসি বজায় রেখে বলল, ‘ আম্মা পাঠাইছে ফুফুরে নিতে তাই সকাল সকাল আইসা পরছি। তোমার লগে দেখ হইব ভাবি নাই। গ্রামে আইলা কবে?’
রোদেলা আড়ষ্ট হয়ে বলল,
‘ মামি পুকুরপাড় গেছেন। আপনি বসেন। আমি ডেকে নিয়ে আসছি।’
টুটুল পেছন থেকে বার দুয়েক ডাকলো। রোদেলা থামল না। সে দ্রুত পায়ে বাড়ির উঠান পেরিয়ে চলে গেল। টুটুল ক্ষিপ্ত হয়ে কর্কশ গলায় বলল, ‘যতবার ধরবার চাই টাকি মাছের মতন পিছলাইয়া যায়।’ বলে থামলো টুটুল। এরপর একটা মোড়া নিয়ে উঠানের মাঝখানটায় বসল সে। জোজো ভেতর ঘরে ছিল। সে মাত্রই বের হলো সহসা টুটুলকে দেখে ঘেউঘেউ করে উঠল। উঠানের এককোনায় কিছু বাঁশ রাখা আছে। সব থেকে ছোটটা হাতে নিয়ে জোজোকে মারার জন্য তেড়ে আসলো টুটুল। জোজো ভো ভো করে নদীর পথে ছুটে গেল। পুতুল বেগম পুকুরের সিঁড়িতে বসে কালো পাতিলগুলো মোড়াতে লাগলেন। কয়েকটা পাতিল একসঙ্গে ধুয়ে নিয়ে উঠে আসার সময় রোদেলাকে দেখে তিনি কপাল কুঁচকালেন।
‘ ঘুম ভাঙছে? সকাল আটটা পর্যন্ত ঘুমাইলে বিয়ার পর শ্বশুরবাড়ি থেকা বিচার আইবো।’
রোদেলা ওড়নার ঘোমটা শক্ত ধরে ধরল। তারপর বলল, ‘ মামি টুটুল ভাই আসছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’
পুতুল শক্ত গলায় বললেন, ‘ ওর এহন কী কাম? আওনের আগে তো কল দেয় নাই।’ বলে একটু থামলেন পুতুল চোখ ছোট ছোট করে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন, ‘ টুটুলের সামনে তুই যাবি না। ওর হাবভাব ভালা না। কেমন কেমন কইরা যেন তাকায়। ও যতক্ষণ থাকব তুই ঘরে বইসা থাকবি।’
পাতিলগুলো রান্নাঘরে রেখে আসলেন পুতুল। টুটুল কে নিয়ে ওনার ঘরে চলে গেলেন। সকাল সকাল নাস্তা বানান, আটা রুটি ও সেলাই। দুটো রুটি আর এক বাটি সেমাই টুটুলকে খেতে দিয়ে পাশে বসলেম পুতুল। ভাই, ভাবীর কথা জিজ্ঞেস করলেন। টুটুল খাবার খেতে খেতে ওর ফুপুর প্রশ্নের উত্তর গুলো দিতে লাগল। টুটুল হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘ রোদেলা কই ফুফু? আইসা যে একবার দেখছি। হেরপর আর দেখলাম না।’
পুতুল চোখ মুখ শক্ত করে বললেন, ‘ পড়তাছে। তুই খা। ওরে কী দরকার?’
‘ দরকার আছে ফুফু। ফুফায় তো শহরের হাঁটে গেছে। দুই তিনদিন আগে আইত না। তুমিও আমার লগে যাইবা। ছেড়ি মানুষ একলা রাইখা যাইবা কার ভরসায়? এরচেয়ে ভালা সঙ্গে কইরা নিয়া লও। ঘরের সম্মান লগে লগেই থাকব।’
পুতুল গম্ভীর চিন্তায় পরে গেলেন। তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, ‘ তুই ঠিকই কইছস। এলাকায় মাতাল পোলাপান বাড়ছে। একা বাড়ি পাইয়া যদি সুযোগ লয়?’
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ জানালার দ্বার খুলে দিল রোদেলা। বাহিরে সূর্যের তাপ বেশি এজন্য জানালার পর্দাগুলো টেনে দিল সে। বাতাসে পর্দাগুলো হাল্কা উড়ছে। পুতুল দুপুরের জন্য রান্না করছেন। ছেলেটা স্কুল থেকে আসার পর বিকেলে রওনা দিবেন। রোদেলা ওনার সঙ্গে যাবে কথাটি শুনে বিষম খেয়েছিল রোদেলা। পুতুল এর আগে কখনও রোদেলা কে তার বাপের বাড়ি নিয়ে যাননি বা কখনও ইচ্ছাও প্রকাশ করেননি। রোদেলা মনে মনে খুশি হলো, টুটুল এর আগেপিছে ঘোড়া দেখে সে নিজেকে গুটিয়ে নিল। রোদেলা ওর সবচেয়ে ভালো দুটি থ্রিপিস ভাজ করে বিছানার উপর রাখে। ঠিক করে এগুলো সে নিয়ে যাবে। গতবছর দুই ঈদে মাসুদ তাকে এই দুটো থ্রি-পিস কিনে দেন। এগুলো খুব কম পরেছে সে, প্রায় নতুনের মতোই আছে।
দুপুরের খাবার একসঙ্গেই খেতে বসল। কিছু একটা ভেবে রোদেলা পুতুলের মুখের দিকে তাকাল এরপর জিজ্ঞেস করল, ‘ মামি জোজো কি আমাদের সঙ্গে যাবে?’
পুতুল চোখ পাকিয়ে তাকালেন। কড়া গলায় বললেন, ‘ না। ওরে নিয়া গেলে ভাই ভাবী নানান কথা কইব। ওরে বাড়িতে রাইখা যাওয়া লাগব।’
রোদেলা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ‘জোজো একা এখানে কার কাছে থাকবে? ওঁ খাবে কী? ঘুমাবে কোথায়? ওঁকে দেখবে কে? আমি তোমার সঙ্গে যাব না। আমি জোজোর সঙ্গে থাকব।’
পুতুল কণ্ঠস্বর আরও শক্ত করে বললেন, ‘তুই বাড়িতে একা থাকবি। রাতে চোর ডাকাত আসলে কী করবি?’
রোদেলা বলল,
‘ তবুও আমি যাব না।’
পুতুল বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ যা ইচ্ছে তাই করস। আমার একটা কথাও শুনস না। শুনবি কেন? আমি কে? যে সব কথা শুনতে হইব।’
.
.
খোলা চারপাশ! দুইপাশে বিশাল বিল, ঘাটে ঘাটে নৌকা দাঁড়িয়ে আছে। বিলের বুকে একঝাঁক শাপলা ও পদ্ম ফুলের বাস। বিলের বুকে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকজন, তাদের ভেতর একটি নৌকায় আছে তূর্ণ। ওর সুরক্ষার জন্য সাথে চারজন বডিগার্ড রয়েছে। চোখের উপর থেকে কালো রঙের সানগ্লাসটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়াল সেহরিশ। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখন তূর্ণর উপর স্থির। সাদাফ পিছন থেকে আওয়াজ দিয়ে ডাকলো,
‘ এখানে এসে বোস। তূর্ণ নৌকা থেকে পরবে না। বডিগার্ডরা তো আছে।’
সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। এই জায়গাটা একটু গ্রামের ভেতরে পরেছে। এখানে তারা সেইফ আছে। সাংবাদিক এর মুখোমুখি হওয়ার ভয় নেই। হঠাৎ এক কল পেয়ে এখানে আসতে হয়েছে। কাজ মিটিয়ে দ্রুত চলে যাবে সে। কিন্তু তূর্ণর জন্য এখানে আঁটকে গেল। হঠাৎ বাচ্চাদের মতন জেদ ধরে সে নৌকায় উঠবে। সেহরিশ দেখল তূর্ণর নৌকা তীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেহরিশ ও সাদাফ জলকুটির থেকে বেরিয়ে ওদের গাড়ির কাছে দাঁড়াল। তূর্ণ উঠে আসামাত্র ওরা গাড়িতে উঠবে।
তূর্ণ বিলের মাঝখানে নৌকা থামালো। এরপর পানি হাতিয়ে একটা টকটকে লাল রঙের পদ্ম তুলে নিল। ঘাটে এসে নৌকা থামে। ত্বরিতগতিতে নৌকা থেকে নেমে তীরে উঠে এলো এরপর সেহরিশ কে দেখে একগাল হাসল তূর্ণ। ডান হাতে থাকা পদ্ম ফুলটি আকাশের দিকে তুলে সেহরিশ কে দেখালো, উচ্চকিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ সেহরিশ!’
তূর্ণ ছুটে এলো! সেহরিশকে শক্ত করে আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘তোর জন্য।’
সেহরিশ তূর্ণকে একহাতে জড়িয়ে নিল। এরপর শান্ত কণ্ঠে শুধাল, ‘ এত রিস্ক নেওয়ার কী দরকার ছিল? যদি পরে যেতিস।’
তূর্ণ চোখ বন্ধ করে একগাল হাসি উপহার দিল। মুগ্ধ হয়ে বলল,
‘ কিছু হয়নি তো।’
সেহরিশ গাড়িতে উঠে বসল। হাতের ফুলটা পাশে রাখে এরপর স্টিয়ারিং এ হাত রাখল। সাদাফ ফ্রন্ট সিটে বসে ও তূর্ণ পেছন সিটে বসে ফোনে কিছু দেখতে লাগল। সেহরিশ একবার লুকিং গ্লাসে তূর্ণকে দেখল এরপর গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ জুবিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে?’
তূর্ণ হাত থেকে ফোনটা পাশে রাখল। এরপর সহজ স্বীকারোক্তি করল, ‘ না। আমার নার্ভাস লাগে। জুবিয়া সামনে আসলে মনে হয় শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে যায় আর আমার চিন্তাশক্তি দূর্বল হয়ে পড়ে।’
সেহরিশ ঠোঁটজোড়া উল্টিয়ে ফেলল। এরপর ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে বলল, ‘ দুদিন সময় দিচ্ছি। জুবিয়াকে প্রপোজ করবি সে যদি রাজি হয় তাহলে বিয়ে। এরমধ্যে সে তোকে রিজেক্ট করুক বা না করুক দুদিন পর তুই আমার সঙ্গে ইতালি ব্যাক করবি।’
তূর্ণ চমকায়িত কণ্ঠে বলল,
‘ এত কম সময়?’
সাদাফ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
‘ দুদিন কম নয় তূর্ণ।’
সেহরিশ বলল,
‘ আমি দু-দিনের জন্য সিরাজগঞ্জ যাচ্ছি। গতকাল রাতে মা কল দিয়ে ছিলেন, আরুশি ও ওর বর অনিক আগামীকাল একবারের জন্য শ্বশুরবাড়ি সিলেট যাবে। এরপর আবার কবে আসবে তার ঠিক নেই। আরুশি যাচ্ছে চলে যাওয়ার আগে একবার আমার সঙ্গে দেখা করবে। আমি সন্ধ্যার পরপর রওনা দিবো। দুদিন বললাম কারণ, এবার যাওয়ার পর মা সহজে আসতে দিবেন না।’
সাদাফ তটস্থ গলায় বলল,
‘ আরু চলে যাবে। আর তুই একা যাবি কেনো? আমরা ও তোর সঙ্গে যাব।’
সেহরিশ চাপা ধমক দিয়ে বলল,
‘ প্রয়োজন নেই। এখানে থাকাটা অধিক জরুরি, আগামীকাল একজন লোক একটা বক্স ডেলিভারি করবে এবং অতি সাবধানে তোরা সেটা রিসিভ করবি।’
তূর্ণ শুধাল,
‘ বক্সে কী আছে?’
সেহরিশ শক্ত ও চাপা গলায় বলল,
‘ হোয়াইট হাউসের চাবি।’
চলবে….