আশিয়ানা #পর্ব_৪৯ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
206

#আশিয়ানা
#পর্ব_৪৯
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
____________
গ্রামের মেঠোপথের প্রান্তরে রাজহাঁস দাঁড়িয়ে আছে। ছোটো এক নদীর বুকের ঝাঁক ঝাঁক পাতিহাঁস দলবদ্ধ ভাবে সাঁতার কাটছে। হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক শব্দে কানে আঙুল গুঁজে দ্রুত পা চালিয়ে পথটুকু শেষ করল রোদেলা। মেঠোপথের দু’ধারে থাকা গাছগুলোর পাতার ফাঁকে ফাঁকে বাতাসের সঙ্গে দোল খাচ্ছে জবাফুল। গাছে গাছে পাখ-পাখালি কিচিরমিচির শব্দে ডেকে চলেছে। সকাল সকাল স্কুল যাওয়ার জন্য শিশুরা দলগতভাবে হেঁটে আসছে। হঠাৎ রোদেলাকে দেখতে পেয়ে সবাই হাস্যোজ্জ্বল মুখে কৌতূহল নিয়ে শুধাল,

‘ আপা! এত সকালে কই যাইতাছো?’

রোদেলা মুখে হাসি নিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ জুবিয়া শহর থেকে চাচা চাচির জন্য কিছু মালপত্র আমার কাছে দিয়ে ছিল। সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।’

ওদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে হলো না৷ দুই একটা প্রশ্ন করে ওরা চলে গেল। রোদেলা খানিক এগিয়ে যেতে দেখল এক দোকানের সামনে দুজন মানুষ জাল বুনছেন। মনটা ভারী হয়ে গেল তার। মামা বাড়ি থাকলে তিনিও এসময় জাল বুনতেন। ফসলের মাঠ শূন্য হয়ে আছে। প্রায় মাস খানেক হবে ধান কাঁটা হয়েছে। বেলা বাড়লে রোদের তাপ ও বাড়ে। তখন রোদের তেজের জন্য ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। রোদ থেকে বাঁচার জন্য সকাল সকাল জুবিয়ার বাড়ি যাচ্ছে রোদেলা। এই সময় চাচাকেও বাড়িতে পাওয়া যাবে। রোদেলা উঠানের সামনে দাঁড়িয়ে গলা তুলে ডাকলো,

‘ চাচি! ও চাচি। তুমি কোথায়?’

হাঁস মুরগির খাবার দিচ্ছেন খালেদা। রোদেলার কণ্ঠস্বর শুনে তিনি বাড়ির পেছন দিক থেকে উঠোনে আসলেন। মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কেমন আছস মা? কবে আইছস?’

‘ আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি চাচি। তুমি কেমন আছ? আর চাচা কোথায়?’

‘ আল্লাহ ভালা রাখছে। তোর চাচা এইমাত্র দুইটা হাঁস নিয়া হাঁটে গেছে। তুই ঘরে আয়।’

‘ আমি বসব না চাচি। জুবিয়া তোমাদের জন্য এই ব্যাগটা আমার কাছে দিয়েছিল। এখানে তোমাদের জন্য কিছু জামা-পোশাক আছে। এটা রাখো। আমাকে আবার তারাতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। মামা-মামি কেউ বাড়িতে নাই।’

‘ আচ্ছা। ভাবি কই গেছে?’

‘ গতকাল ওনার বাবার বাসায় গেছেন। দুদিন পর চলে আসবেন৷ আমি এখন যাই চাচি।’

‘ ঘরে আয়। কিছু খাইয়া যা।’

‘ না, না চাচি। আমি কিছু খাব না। আসলাম আমি।’

জোজো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা আসছে দেখতে পেয়ে সে ছুটে তার সামনে আসলো। রোদেলা ঝুঁকে বসে গেল, জোজোর শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। তারপর দেখল একটা ভিন্ন কুকুর ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছে। রোদেলা ঠোঁটে মাপা হাসি নিয়ে বলল,

‘ জোজো! গার্লফ্রেন্ড?’

জোজো এতক্ষণ রোদেলার মুখপানে তাকিয়ে ছিল। রোদেলার ঠোঁট নাড়াচাড়া দেখে সে মাথা নুইয়ে ফেলল এরপর অন্য দিকে ঘুরে বসল। জোজোর কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল রোদেলা। সহজ গলায় বলল,

‘ তোর গার্লফ্রেন্ড থাকা দোষের কিছু না। আজ বুঝলাম শহরে গিয়ে তুই সর্বক্ষণ চুপচাপ থাকতিস কেন। এটাই কারণ। আচ্ছা তোর খুশির জন্য আজ থেকে তুই গ্রামেই থাকবি। তোদের খাবার দেওয়ার জন্য মামিকে বলে যাব। যদিও মামি বকাঝকা করবে তখন তোরা চুপচাপ থাকবি। ঠিক আছে?’

জোজো এক লাফে উঠে দাঁড়াল। এরপর রোদেলার কামিজের এককোনা মুখে নিয়ে মেয়ে কুকুরটির দিকে এগিয়ে গেল। দ্বিতীয় কুকুরটি রোদেলাকে দেখে শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। জোজো গিয়ে ঠিক তার পাশে বসল। রোদেলা তার বাটন ফোনে ওদের দু’জনার একটা ছবি তুলে রাখল। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ জোজো তোর এখানে একজন সঙ্গী আছে। এটা যদি আমি আগে জানতাম তাহলে তোকে শহরে নিয়ে বিচ্ছেদের কষ্ট কখনো দিতাম না।’

রোদেলা উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ জাম গাছটার দিকে নজর পড়ল তার। একটা কোকিল পাখি গাছের ডালে বসে অনবরত ডেকে চলেছে। রোদেলা ভ্রু কুঞ্চিত করে পাখিটিকে দেখার চেষ্টা করল। গাছের পাতাগুলোর জন্য পাখিটাকে দেখতে পেল না। ডাক যেন গাঢ় হচ্ছে। রোদেলা বাড়ির ভেতরে আসলো। জোজো ও দ্বিতীয় কুকুরটার জন্য বাটি ভরে খাবার নিয়ে এসে উঠোনের এককোনায় রাখল। রোদেলা দ্বিতীয় কুকুরটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর দুষ্টুমি করে বলল,

‘ জোজো?’

জোজো ডাক শুনে মাথা তুলে তাকাল। রোদেলা বলল,

‘ তোর সঙ্গীর একটা নাম প্রয়োজন। কী নাম দেওয়া যায়?’

জোজো পা গুটিয়ে বসল। এটা দেখে রোদেলা হাঁটুর উপর থুতনি ভর দিয়ে ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

‘ কেটী। সুন্দর না নামটা?’

জোজো তার খাবার রেখে রোদেলার পাশে এসে বসে। রোদেলার পায়ের সঙ্গে তার মাথাটা ঘষতে লাগল সে। জোজো প্রায় এমন করে, তখন রোদেলা তার হাতটি জোজোর মাথায় রাখলে সে শান্ত হয়ে যায়।
.
.
চৌধুরী বাড়ির সামনে দুটো গাড়ি অপেক্ষারত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্দরের ভেতরে মেয়ে বিদায় দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ফারিয়া বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছেন। ছোটো থেকে মেয়েকে ছেড়ে এক রাতও কোথাও থাকেননি ফারিয়া। সে মেয়ে বিয়ের পর এখন সিলেট কতদূর চলে যাবে। ভাবতে বুক চিরে কান্না আসছে। শফিকুল চৌধুরী রুমের ভেতর বসে আছেন। মেয়ের এই বিদায় নিজ চোখে দেখতে পারবেন না তিনি। সোহান ও মাইমুনার থেকে মাফ চাইল আরুশি। কতশত অপরাধ, দুষ্টুমি করেছে, কতই না জ্বালিয়েছে ভাবীকে তবু মাইমুনা চোখ রাঙিয়ে কখনও একটা কথা বলেনি। মাইমুনা নিজেকে সামলাতে না পেরে আরুশি জড়িয়ে ধরে কান্না করে ফেলল।

সেহরিশ দু-হাত পকেটে গুঁজে গম্ভীরচিত্তে অনিকের সামনে দাঁড়িয়ে উদগ্রীব কণ্ঠে জানালো,

‘ আরু আমাদের একমাত্র বোন। ভাবতেই পারছ সে আমাদের কত আদরের। ওঁকে সব সময় যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখো। আর একটা কথা ওঁর চোখ দিয়ে যদি কখনও একফোঁটা অশ্রু ঝরে, তোমার চোখ দিয়ে হাজার অশ্রু ঝরাবো।’

অনিক আশ্চর্য্য হলো এরপর সহজ গলায় বলল,

‘ আমাদের জন্য দোয়া করবেন ভাই। পৃথিবীর সম্ভব সুখ আপনার বোনের নামে করব।’

আরুশি পায়ে পায়ে হেঁটে সেহরিশের সামনে আসলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে তারপর বলল,

‘ ভাইয়া আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছি দেখে ভাববি না আমি তোকে জ্বালাবো না। আমি কিন্তু রোজ তিনবার করে তোকে কল দিবো।’

আরুশি কান্না করে সেহরিশের বক্ষে মুখ লুকালো। সেহরিশ আদুরে হাতটি আরুশির মাথায় রাখে। ব্যথিত গলায় বলল,

‘ নিজের খেয়াল রাখবি।’

দখিনা বাতাস দোলা দিচ্ছে, গাছের মর্মরে পাতাগুলো আলগোছে ডাল থেকে মাটিতে ঝরে পড়ল। ইছামতী নদীর ব্রিজের উপর বাইক থামিয়ে একপাশে দাঁড়াল সেহরিশ। একটা নৌকা ভেসে ভেসে ব্রিজের নিচ দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে। আঁকা বাঁকা নদীর দু’তীরে অবারিত সবুজ মাঠ। গ্রামের সারি সারি গাছপালা, আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ ও ফসলের ক্ষেত গুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেহরিশ। একটা বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ, বাচ্চারা সেখানে খেলাধুলা করছে। সেহরিশ ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হাসল। এরপর বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুটা এগিয়ে আসার পর হঠাৎ একটা কুকুর দেখে বাইক থামাল সেহরিশ। প্রথমত ভাবলো ওটা জোজো তারপর মনের ভুল ভেবে চলে যেতে উদ্যত হলো। সড়কের পাশে টিনের সারিবাঁধা ঘর ও বিশাল বড় বড় গাছপালা। একটা গাছের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো রোদেলা। দু-হাত ভরা লেবু রোদেলার, মাত্রই গাছ থেকে পারছে। রোদেলার পাশে এগারো বছরের একটা ছেলে এসে দাঁড়াল। রোদেলা তার হাতে তিনটা লেবু দিয়ে বলল,

‘ এগুলো তোর।’

ছেলে বলল,

‘ আমার লেবু লাগব না। তুমি শরবত বানাইয়া আমারে দিও।’

রোদেলা কুটিল হেসে বলল,

‘ আচ্ছা। এখন তাহলে বাড়ির ভেতরে চল।’
.
.
চারপাশ থেকে নেমে আসে সুনসান নীরবতা রাতের আকাশের ঝলমল করা হাজার হাজার তাঁরা সেহরিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিল। সাধারণত কাজের ভেতর ব্যস্ত থাকার কারণে কখনো জ্যোৎস্না সেভাবে মুগ্ধ করতে পারেনি সেহরিশকে বা সময় হয়নি আকাশের তাঁরা দেখার। আজ এক অপরূপ রাত, রূপময় জ্যোৎস্না রাত। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার জন্য পুরো গাঁয়ে অন্ধকার নেমে আসে। গরমের উপর বিরক্ত হয়ে এমন সময় ছাঁদে আসে সেহরিশ। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় অভিভূত সে। চারপাশে আলো না থাকায় চাঁদের আলো দেখে মনে হচ্ছে, স্বচ্ছ ঝরনার মতো একফালি চাঁদের আলো যেন নদীজলের মতন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। আকাশে মেঘগুলো ছুটে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে বোধ হয় চাঁদের সৌন্দর্য বাড়তে লাগল। এমন মায়াবী একখানা চাঁদ দেখে হঠাৎ মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। এত এত ভালোলাগার মাঝখানে হঠাৎ এসে বাসা বাধলো নাম অ-জানা বিষণ্নতা। সেহরিশ ছাঁদ থেকে নামল। তার হঠাৎ এমন লাগার কারণ খুঁজে পেল না সে। শরীর খারাপ হচ্ছে ভেবে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, হসপিটালে গিয়ে কিছু রিপোর্ট করবে। বুকে ব্যথা কী জন্য করছে? রিপোর্ট করার পর বুঝতে পারবে বলেই এত রাতে হাসপাতালের উদ্দেশ্য ছুটে চলেছে।

জ্যোৎস্নার উজ্জ্বল আলোয় গাড়ি ড্রাইভ করছে সেহরিশ। রোদেলার বাড়ির কাছাকাছি আসার পর স্পষ্ট হলো চারপাশ থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ। সেহরিশ গাড়িটা ব্রেক কষে পাশে সাইড করে রাখে। এই ডাকটি তার পরিচিত! এইখানে আশেপাশে রোদেলার বাড়ি, কুকুরের আওয়াজটা জোজোর। এই নিকষকালো রাতে জোজোর এমন ডাকে মনে প্রশ্ন জাগলো সেহরিশের। জোজো ঠিক আছে কী না। দেখার জন্য বাড়ির দিকে যেতে নিল। লেবু নিয়ে সকালে রোদেলা কোন বাড়িতে ঢুকেছিল দেখতে পেয়েছিল সেহরিশ । রোদেলার বাড়িটা তার অচেনা নয়। বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে সেহরিশ। বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ জোজো?’

অন্ধকার আচ্ছন্ন চতুর্দিক ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত ডেকে চলেছে জোজো। সেহরিশের কণ্ঠস্বর শুনে সেহরিশের পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। প্যান্টের এককোনা কামড়ে ধরে ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য টানতে লাগল। জোজোর এমন করার কারণ সেহরিশ বুঝতে পারল না। সে হাঁটু ভাজ করে বসে গেল। জোজোর মাথায় হাত রেখে বলল,

‘ তুই ঠিক আছিস। এটা দেখার জন্য আসছি। এখন আমাকে যেতে হবে।’

রোদেলা চিৎকার করে বলল,

‘ বাঁচাও।’

আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর কিছু পরে যাওয়ার শব্দ হলো। দস্তা দোস্তির আওয়াজ শুনতে পেল সেহরিশ। চোয়ালদ্বয় শক্ত করে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক বার দরজায় আঘাত করার পর ঘরের দরজাটা ভেঙে পড়ল। দরজা ভাঙার শব্দে পুরুষ লোকটি পেছনে ঘুরে দেখল, অন্ধকারে তেমন কাউকেই দেখতে পেল না সে। সেহরিশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে। আন্দাজ করে খাটের দিকে এগিয়ে গেল। এরপর অন্ধকারে কাউকে ধরার চেষ্টা করল। ব্যর্থ হলো সে। দরজা ভাঙার শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লোকটি। উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় নেমে উচ্চকিত গলায় আশপাশের মানুষদের ডাকতে লাগল,

‘ কে কোথায় আছ? মাসুদ মিয়ার ভাগ্নী এতরাইতে ঘরে ব্যাটা মানুষ ঢুকাইছে। তোমরা কে আছ? জলদি আসো।’

প্রায় অনেক মানুষের ঘুম ভেঙে গেল। তাছাড়া গরমের জন্য অনেক মানুষ সজাগ ছিলেন। ডাকটি কানে আসামাত্র ওনারা সবাই দরজা খুলে বের হলেন। সবাই একসাথে মাসুদের বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ান। অন্ধকারে চাপা পড়ে গেল সে পুরুষ লোকটির কণ্ঠ। দুজন লোক দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকলেন। রোদেলা বিছানার উপর বসা ও সেহরিশ তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। রাতের আঁধারে ঘরে ব্যাটা ছেলে ঢুকানোর জন্য সবাই রোদেলাকে গালাগালি করতে লাগল। পাঁচ ছয়জন লোক সেহরিশকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের সঙ্গে ওর হাত পা বেঁধে ফেলল। মনিরউদ্দিন সিদ্ধান্ত জানালেন মাসুদকে কল করার জন্য। সে যেখানেই থাকুক সকালের ভেতর যেন বাড়ি চলে আসেন। দু’বার কল করার পরও কল রিসিভ করেননি মাসুদ। এরপর মাসুদের স্ত্রীকে কল করার জন্য আদেশ করলেন। সেহরিশকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে না তারা। কয়েকজন মহিলা সুতি কাপড়ের আঁচল টেনে নাক ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের মধ্যে একজন বললেন,

‘ মাইয়াটা কে ভালোই জানতাম। চরিত্র খারাপ আগে বুঝি নাই।’

রোদেলা মাথা নিচু করে কান্না করছে। সে বার বার বলেছে, এখানে সেহরিশের কোনো দোষ নাই। সে তাকে বাঁচানোর জন্য আসছে। কিন্তু মহিলারা সেটা মানতে চাচ্ছেন না। তারা মূহুর্তেই রোদেলার গাঁয়ে কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে দিল।

রাত তিনটা ছুঁইছুঁই। পুতুল বেগম তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ি আসলেন। রাস্তায় কোনো ভ্যান বা রিকশা পাননি। পুরো রাস্তা ছুটে ছুটে আসছেন। রোদেলাকে আপাদমস্তকে দেখে পুতুল এগিয়ে গেল। এরপর রোদেলার গালে কোষে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন। রাগ চেপে উঠোনে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

‘ আমি কইছিলাম এই মাইয়া আমাদের নাক কাটবো। আজ তাই হইল, আমার কথা উনি যদি তখন শুনত তাহলে এই দিন দেখতে হত না।’

সেহরিশ অবাক না হয়ে পারল না। গাঁয়ের লোকদের মুখের দুটো কথা শুনে নিজেদের মেয়েকে অবিশ্বাস করা মানুষ এই প্রথম দেখল সে। রোদেলা কান্না থামিয়ে পুতুলের পা জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ মামি। বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু করিনি। কেউ একজন আমার ঘরে আসছিল। উনি দরজা ভেঙে আমার উজ্জ্বল বাঁচিয়েছেন। তাছাড়া সে লোকটা কোথায় যেন পালিয়ে গেছে।’

পাশের বাড়ির একজন মহিলা বললেন,

‘ তোর ঘরে কেউ ঢুকছে আমরা শুনতে পাই নাই। আর সে শুনতে পেয়ে বাঁচাতে আসছে। আমাদের বোকা বানানো হচ্ছে? অন্যায় করে আবার শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা ভালোই।’

পুতুল বেগমের বড় ভাই বললেন,

‘ এই ছেলেকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়া উচিত। আমি পুলিশকে কল দিচ্ছি।’

মনিরউদ্দিন তাকে থামতে বললেন৷ এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘ থানা পুলিশ করে কি হইব? মেয়ের ইজ্জত কি ফিরা পাইবা? এসব বাদ দাও। আর লোকজন জানানোর দরকার নাই। আমি যা বলি তাই শুনো, কাজী মোবারকের বাড়ি যাও। কাজী সাব কে নিয়ে আসো তারপর দুজনের বিয়ে দিয়ে দেই। মাইয়াটার ইজ্জত বাঁচবো।’

সেহরিশ শান্ত ভঙ্গিতে চাইল, হাত পা বাঁধা অবস্থায় বিয়ে? এটা যদি সাংবাদিক জানতে পারে তাহলে হয়তো ইতিহাসের পাতায় লিখা হবে, বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী’কে রাতের আঁধারে ধরে এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোকজন শুনলে হাসিঠাট্টা করবে। কাজী এলো মিনিট দশ পর। বিয়ের সব তর্জমা করে আসছেন। বিদ্যুৎ নেই, এজন্য আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজী বসে কাগজপত্র ঠিক করছেন। এরমধ্যে মনিরউদ্দিন একবার সেহরিশের দিকে তাকালেন, সেহরিশের চোখ দুটো দেখে তিনি ভারী নিঃশ্বাস ফেললেন। রোদেলার কান্না এখনও থামেনি। সে বিয়ে করবে না। কেউ তার কথা কানে তুলছে না। বার বার বিয়েতে অমত করার জন্য পুতুল আরও একটা চড় মেরে দিলেন। রোদেলার বুক চিরে কান্না আসছে।

কাজী বিয়ের জন্য ছেলের নাম ও তার বাবা-মার নাম জানতে চাইল। ছেলের নাম পরিচয় কেউ জানে না। মনিরউদ্দিনের আদেশ শুনে একজন এগিয়ে গেল সেহরিশের দিকে। এরপর মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে ফেলল। সেহরিশ গম্ভীরচিত্তে বসে আছে। কাজী বার দুয়েক জিজ্ঞেস করার পর, শক্ত ও গম্ভীর গলায় নাম বলল,

‘ সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী। বাবা শফিকুল চৌধুরী, মা ফারিয়া চৌধুরী।’

মনিরউদ্দিন চমকায়িত চোখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। চৌধুরী বাড়ির নাম শুনে সবাই থতমত খেয়ে গেলেন, থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হলো। সকলে বুঝতে পারলেন তারা ভুল করছেন। চৌধুরী বাড়ির ছেলে এমন আচরণ করতেই পারে না। বিয়ের ব্যবস্থা যেহেতু হয়েই গেছে তাই তারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না। রোদেলার কথা বিশ্বাস করা ছাড়া তাদের আর উপায় নেই। যে পুরুষটি তাদের ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙিয়েছিল আসলে সে পালানোর সময় ইচ্ছে করে এদের ফাঁসিয়ে গেছে। মনিরউদ্দিন চেয়ার ছেড়ে উঠে আসলেন। সেহরিশের সামনে বসে তিনি বললেন,

‘ আমাদের ভুল হয়েগেছে বাবা। তুমি এই মেয়েটার ইজ্জ্বত ও তাকে কলঙ্কিত হওয়ার থেকে বাঁচিয়ে নাও। আমরা সবাই তোমার সামনে হাত জোর করছি।’

অশ্রুসিক্ত মুখখানায় চড়ের দাগ স্পষ্ট ফুটে আছে। পুতুল বেগম দু-হাত দিয়ে আলতোভাবে চোখের জল মুছে দিচ্ছেন। কাজী ওর সামনেই বসে কাগজপত্র সই করিয়ে নিলেন। এরপর কাবিনের এমাউন্ট উচ্চারণ করে রোদেলাকে বললেন,

‘ শফিকুল চৌধুরীর ছোটো ছেলে সেহরিশ ফাতিন চৌধুরীকে বিয়ে করতে রাজি থাকলে, বলো মা কবুল।’

সারা গায়ে ভয়ৎকর যন্ত্রণা নিয়ে রোদেলা বিষণ্ণ মুখে মামির দিকে তাকিয়ে। পুতুল কড়া চোখে তাকানোর পর রোদেলা তিনবার কবুল বলে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মাথা নিচু করে রাখল। কাজী আলহামদুলিল্লাহ বলে সেহরিশের দিকে এগিয়ে যান। সেহরিশ রাগ ও ক্ষোভে ফুঁসফুঁস করছে। কবুল বলার পরোক্ষণে বিদ্যুৎ চলে এলো। সহসা চারপাশ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে। সেহরিশের হাতের বাঁধন সে একাই খুলে ফেলল। এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মনিরউদ্দিনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগান্বিত স্বরে বলল,

‘ এমন কোনো রশি নেই যা আমাকে বেঁধে রাখবে।’

মনিরউদ্দিন কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন। বিদ্যুতের কারণে চারদিকে আলোকিত হওয়ায় চাঁদের আলোটা মলিন হয়ে গেল। সেহরিশ সবার সামনে দিয়ে হেঁটে রোদেলার সামনে এসে দাঁড়াল। রোদেলার ডান হাতখানা নিজ শক্তপোক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে রাগে ফুপিয়ে উঠে বলল,

‘ আমার স্ত্রীকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। কারো কোনো আপত্তি আছে?’

পরমুহূর্তেই সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ রোদ।’

[প্রথম খণ্ডের সমাপ্তি]….

(কাহিনী ও প্লট আমি যেভাবে চিন্তা ভাবনা করে রাখছি সেভাবেই আগাবে। আপনারা শুধু প্রতিটা পর্ব উপভোগ করুন। সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। ভালোবাসা অবিরাম!)’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here