#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩।
আরেকটি সকালের সূচনা। ব্যস্ত অন্বিতা এদিক সেদিক ছুটছে নিজেকে তৈরি করতে। এরই মাঝে আসিয়া বেগম অন্বিতার রুমে এলেন। হাতে খাবারের প্লেট। সেটা অন্বিতার চোখে পড়তেই সে ততক্ষণাৎ অনুরোধ জানাল,
‘মা, আমি খাব না কিছু।’
‘পাগল না-কি? খালি পেটে গেলে সারাদিন কাজ করার শক্তি পাবি কী করে?’
‘সেখানের ক্যান্টিন থেকে কিছু একটা খেয়ে নিব।’
‘ওহ, আজকাল বুঝি মায়ের হাতের রান্না আর পছন্দ হচ্ছে না?’
অন্বিতা তার সমস্ত তোড়জোড় থামিয়ে দিয়ে মায়ের দিকে চাইল। হতাশ সুরে বলল,
‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলগুলো রেডি থাকে সবসময়, তাই না?’
আসিয়া বেগম আলু-ভাজা সমেত রুটি’টা তার মুখ বরাবর ধরে বলল,
‘হ্যাঁ, বুঝিস’ই যখন তবে খেয়ে নে।’
মা’কে বোঝানো দায়। শত ব্যস্ততার মাঝেও ঠিকই তাকে খাইয়ে দিবে, এটা সে জানে। তাই সেও সহজে খেয়ে নিল পরে।
মাহির আশহাব, শহরের একজন স্বনামধন্য কার্ডিওলজিস্ট। এই তো বছর খানিক আগে হৃদরোগের উপর পুরো ডিগ্রি রপ্ত করে দেশে ফিরেছে সে। তারপর থেকেই চলছে নিজের নার্সিংহোমে সাধারণ মানুষদের সেবা দেওয়া। কত শত মানুষের হৃদয়ের ব্যধি শেষ করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ ডাক্তার সাহেব যে নিজেই ভয়ানক এক হৃদরোগে আক্রান্ত সেটা হয়তো তিনি নিজেই জানেন না।
‘স্যার, ইন্টার্নশিপের ডাক্তারা সবাই চলে এসেছেন। উনারা মিটিং রুমে আছেন।’
মাহির এপ্রোন’টা গায়ে লাগিয়ে বলল,
‘চলুন।’
মিটিং রুমের ভেতরে ঢুকতেই উপস্থিত ডাক্তার’রা দাঁড়িয়ে পড়ে সবাই। সালাম দেয়। মাহির সালামের জবাব দিয়ে বসতে বলে তাদের। সে বসে সকলের সামনে, মুখবরাবর। তার আন্ডারে ছয়জনের মতো ডাক্তার আছে। তবে আজ সেখানে তার সম্মুখে উপস্থিত পাঁচজন। মাহির ভ্রু কুঁচকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘আরেকজন কোথায়?’
তার সহকারী বলে,
‘স্যার, উনি এখনো আসেননি।’
‘কেন, আপনি সবাইকে বলে দেননি যে, আমি সময় নিয়ে কতটা স্ট্রিক্ট?’
সহকারী মাথা নুইয়ে বলল,
‘জি স্যার, বলেছি।’
‘তাও সেই একজনের লেইট হলো কেন?’
‘স্যরি স্যার, রাস্তায় জ্যাম ছিল।’
আগন্তুককে দেখতে সকলের দৃষ্টি দরজার দিকে যায়। ছুটে আসাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অন্বিতা হাঁপাচ্ছে আপাতত। তাকে আপাদমস্তক পরখ করে মাহির। তারপর গম্ভীর সুরে বলল,
‘রাস্তায় কি শুধু আপনার জন্য জ্যাম? উনারা তাহলে কী করে আসলেন?’
অন্বিতা সবাইকে একবার দেখে বলল,
‘স্যার, আসলে আমাদের ঐদিকে গাড়ি পাওয়া যায় না ঠিকমতো। গাড়ি পেতে সময় লেগেছে বেশি, তারউপর আবার সিগন্যালে পড়েছিলাম, সব মিলিয়ে..’
‘বাহ, অজুহাত সব আগে থেকে রেডি করেই এসেছেন দেখছি।’
অন্বিতা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। বলল,
‘অজুহাত দিচ্ছি না, স্যার। যেটা সত্যি সেটাই বলছি।’
‘ঠিক আছে, মেনে নিলাম। প্রথমদিন বলে মাফ পেলেন। পরে আর একদিনও লেইট হলে আপনাকে লাইসেন্স ব্যতিত’ই বিদায় হতে হবে।’
‘মনে থাকবে স্যার, এবার ভেতরে আসি?’
‘জি, আসুন।’
অন্বিতা ভেতরে এল। বসল চেয়ারে। মাহির এখনো তাকেই দেখছে। পরে মনে পড়ল, সে সিনিয়র ডাক্তার হয়ে এভাবে কোনো জুনিয়রের দিকে তাকিয়ে থাকাটা বেমানান। তাই চোখ সরিয়ে স্বাভাবিক করল নিজেকে। বলল,
‘একে একে আপনারা আপনাদের পরিচয় দিন।’
সবাই তার কথামতো নিজেদের পরিচয় দিতে আরম্ভ করল। সর্বশেষ পালা এল অন্বিতার। উঠে দাঁড়াল সে। বলতে আরম্ভ করল,
‘হ্যালো স্যার, আমি অন্বিতা জামান। রাশেদুল জামান এবং আসিয়া বেগমের একমাত্র মেয়ে।’
‘আর আমার ভালোবাসা, আমার হবু বউ।’
নিজ মনেই আওড়াল মাহির। তারপর বলল,
‘ঠিক আছে অন্বিতা, বসুন।’
অন্বিতা বসল। তারপর উঠে দাঁড়াল মাহির। ইন্টার্ন ডাক্তার হিসেবে নিজেদের সমস্ত দায়িত্ব তাদের বুঝিয়ে দিল। কে কী করবে না করবে, সবকিছু। শেষে বলল,
‘আমার অনুমতি ছাড়া আপনারা কোনো পেশেন্টকে ট্রিটমেন্ট করবেন না। আর যদি করেন, তারপর পেশেন্টের কোনো ক্ষতি হলে তার দায়ভার কিন্তু এই নার্সিংহোম নিবে না। মনে রাখবেন কথাটা।’
সবাই মাথা হেলাল। মনে থাকবে তাদের।
মাহির তার জায়গায় বসল। ফাইল ঘাটতে ঘাটতে বলল,
‘একজন ডাক্তার লাগবে, যিনি পুরোটা সময় আমার পাশে পাশেই থাকবেন। এক্ষেত্রে দায়িত্বের চাপটা বাড়বে তার। কারোর কি আগ্রহ আছে?’
মাহির এই বলে সামনে তাকায়। সেই গ্রুপে অন্বিতা ছাড়াও আরো দুজন মেয়ে আছে; সেই আরো দুজন মেয়েসহ একজন ছেলে হাত তুলে। মাহির অন্বিতার দিকে তাকায়। অন্বিতা চুপচাপ বসে আছে। মনে হচ্ছে, এসবে বিন্দুমাত্র কোনো আগ্রহ নেই তার। মাহির নাকের পাল্লা ফুলাল। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘বাকি তিনজনের আগ্রহ নেই কেন? এখানে কি আপনারা পিকনিক করতে এসেছেন যে, দায়িত্বের কথা শুনে আগ্রহ দমে গিয়েছে?’
অন্বিতা এখনো স্বাভাবিক। সে এই দায়িত্ব চায় না, হয়তো ঝিম মেরে বসে থেকে এটাই বুঝাতে চাইছে সে। মাহিরও ক্ষুব্ধ হলো। কর্কশ সুরে বলল,
‘বেশ, যারা হাত তুলেনি আমি এবার তাদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিব।’
এই কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় অন্বিতা। চোখ মুখ উপচে পড়ে তার বিরক্তির ছটা। সে জানে, মাহির তাকেই বেছে নিবে। হলোও তাই। মাহির বলল,
‘এই যে অন্বিতা, আজ থেকে আমার পাশে থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব আপনি পালন করবেন।’
অন্বিতা বিনয়ের সুরে বলার চেষ্টা করল,
‘স্যার, এই দায়িত্বটা যাদের আগ্রহ আছে তাদের দিলে হয়না?’
‘না, যাদের আগ্রহ নেই, তাদেরকেই করতে হবে। যেন ভবিষ্যতে আর কিছুতে আগ্রহ দেখাতে পিছপা না হয়।’
অন্বিতা দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল,
‘অসভ্য লোক, আপনি যে আমাকে জব্দ করার সুযোগ খুঁজছেন সেটা তো আমি বেশ বুঝতে পারছি।’
মাহির বলল,
‘আর কারোর কোনোকিছু নিয়ে কোনো অসুবিধা থাকলে আমার থেকে জেনে নিবেন। আবারও বলছি, নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন না। মনে রাখবেন, আপনার একটা ছোট্ট ভুলে কিন্তু একটা মানুষের জীবন চলে যেতে পারে।’
অন্বিতা আগ বাড়িয়ে বলল,
‘ঠিক বলেছেন, স্যার। আমাদের করা একটা ছোট্ট ভুলে অন্য একটা মানুষের জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তাই কোনো কিছু করার আগে হাজারবার ভেবে করা উচিত, এই কথা আমাদের সবার মনে থাকবে।’
মাহির চোয়াল শক্ত করল। অন্বিতার চোখে দীপ্ত শিখা। তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়ার জন্য ঐটুকুই যথেষ্ঠ। মাহির স্বাভাবিক করল নিজেকে। বলল,
‘ভালো বলেছেন, অন্বিতা। এখন কথাটা মাথায় রাখলেই হয়।’
‘জি, অবশ্যই মাথায় থাকবে। অন্তত আমরা কারোর জীবন ধ্বংসের কারণ হতে চাই না।’
মাহিরের মাথা গরম হচ্ছে। অন্বিতার এসব কথা মোটেও সহ্য হচ্ছে না তার। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার সহকারীকে বলল,
‘উনাদের সবাইকে একবার ওয়ার্ডে নিয়ে ঘুরিয়ে আনুন। আমি কেবিনে যাচ্ছি।’
এই বলে বেরিয়ে যায় সে। অন্বিতার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। এই লোকটাকে এভাবেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে পারলে মনে বড়ো শান্তি পেত সে। তবে আপাতত যতটুকু পেরেছে তাতেও মন তৃপ্ত হলো বেশ।
ওয়ার্ডে এক রাউন্ড শেষ করার আগেই একজন নার্স সেখানে এসে বলে,
‘এখানে মিস অন্বিতা কে? উনাকে ড. মাহির স্যার উনার কেবিনে ডাকছেন।’
এই কথা শুনে বুকের ভেতর ধক করে উঠে অন্বিতার। পাশ থেকে একটা মেয়ে বলে,
‘আহারে, মেয়েটার অতিরিক্ত দায়িত্ব শুরু তবে।’
অন্বিতা অসহায় চোখে তাকাল। অন্য একটা মেয়ে বলল,
‘আমি তো যেচে চাইছিলাম এটা। অন্তত এর উছিলায় ঐ হ্যান্ডসাম ডাক্তার স্যারের একটু কাছাকাছি থাকা যেত।’
অন্য মেয়ে মুখ চেপে হেসে বলে,
‘আস্তে বলো, স্যার যা রাগী, দেখা গেল ছোট্ট একটা কথা ধরে তোমার লাইসেন্স’ই ক্যানসেল করে দিল।’
অন্বিতা বলল,
‘আচ্ছা, তোমরা থাকো। আমি গিয়ে আমার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে আসি।’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/