#তবু_আমারে_দেবোনা_ভুলিতে 💖
#মেহেরিন_আনজারা_নিশা 💖
#পর্বসংখ্যা-(১৯)
________________________
বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো শেহজাদ। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো। সাহস করে আহসান সাহেবের সামনে দাঁড়ালো। বিরক্ত হলেন তিনি। সময় বিলম্ব করায় জাস্ট বিরক্ত লাগছে শেহজাদকে। চোখ সরিয়ে নিলেন তিনি। শেহজাদ নিজেই আহসান সাহেবের বুক থেকে মিঠিকে সরিয়ে আনতেই দেখলো মিঠি কাঁদছে। চোখগুলো ফুলে লাল। ইশ! এইটুকুন সময়ের মধ্যে চোখ-মুখের কি হাল করে ফেলেছে মেয়েটা! আহসান সাহেবের সাদা শার্টের বুকের দিকটা চোখের জলে ভেসে জবজবে হয়ে গিয়েছে। ধক করে উঠলো শেহজাদের বুকটা। শেহজাদ বুঝতে পারলো মিঠিকে প্রেসার ক্রিয়েট করছে ডিভোর্সের জন্য,নিজ থেকে মিঠি ডিভোর্স চায় না! চাইলে প্রথমদিনেই চাইতো! মিঠি আবার লুকোচুরি ভণিতা করতে পছন্দ করে না। যা বলে স্টেইট বলে দেয়। অন্তত খুব বেশিদিন তাদের একসাথে থাকা না হলেও এইটুকুন সময়ের মধ্যে মিঠিকে শেহজাদ বুঝতে পারে। শেহজাদের সেই বুদ্ধিটুকু আছে। তবুও শেহজাদের অস্থির মন মানলো না। কম্পিত হাতে চিবুক তুলে মলিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”মিঠি,তুমি কি ডিভোর্স চাও?”
শেহজাদের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো মিঠি। কোনো প্রতিত্তোর করতে পারলো না। কান্নার বেগ বাড়লো। তার জন্মদাত্রী মায়ের মৃত্যুর পর তার মামা-মামীই তাকে নিজেদের সন্তানের মতো করে মানুষ করেছে। বাবার সকল আদর,যত্ন,স্নেহ,ভালোবাসা সব মামা-মামীর কাছ থেকেই পেয়েছে। কেবলমাত্র মামার জন্যই আজ তার অস্তিত্ব টিকে আছে এই পৃথিবীতে। নয়তো কবেই বিলীন হয়ে যেতো। এছাড়াও শেহজাদের সাথে না হয় তার এক সপ্তাহের সংসার। মানুষটার জন্য মনের গহীন থেকে প্রেম-ভালোবাসার উদ্রেক না হলেও মায়া সৃষ্টি হয়েছে। মনের একাংশে একটা সফট কর্ণার তৈরী হয়েছে। শেহজাদের প্রতি ভীষণ মায়া হয় মিঠির। এই শহরে মানুষটার কেউই নেই। বড় আশা নিয়ে মানুষটা তার সাথে থাকতে চায়,একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে। এখন কার জন্য কাকে নিরাশ করবে মিঠির ছোট্ট মস্তিষ্ক খুঁজে পাচ্ছে না। মামার সিদ্ধান্তকে সায় দিলে শেহজাদ কষ্ট পাবে,শেহজাদকে সায় দিলে মামা কষ্ট পাবে! কোনো ডিসিশন নিতে পারছে না সে। দু’জনের জন্যই মায়া হচ্ছে। নীরবে অঝোরে কাঁদতে লাগলো মিঠি। একপর্যায়ে হিচকি উঠলো শেহজাদকে দেখে। শেহজাদ দেখলো সুশ্রী মুখটা কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। মনের মধ্যে অগাধ সাহস যোগালো শেহজাদ। হঠাৎ বলে উঠলো,”মিঠিকে ডিভোর্স দিতে পারবো না আঙ্কেল। দুঃখিত!”
“কী বললে?”
“আমি মিঠিকে ডিভোর্স দিবো না।”
“কেন?”
“মিঠি চায় না এবং আমিও চাই না। অর্থাৎ আমরা কেউই ডিভোর্স চাই না।”
“ও তোমায় বলেছে?”
“আমায় বলেনি। কিন্তু ও কি আপনাকে ডিভোর্স চাওয়ার কথা বলেছে?”
“ও কেন বলবে?”
“হ্যাঁ,ও ডিভোর্স চায় না। ওর উপর প্রেসার ক্রিয়েট করবেন না আঙ্কেল।”
ভীষণ রেগে গেলেন আহসান সাহেব। মোশাররফ সাহেব কিছু বলতে পারছেন না। তিনিও চান ডিভোর্স হয়ে যাক। এরা একজন-আরেকজনের জন্য উপযোগ্য নয়।
“বিয়ের সপ্তাহখানিক না হতেই তুমি কর্তৃত্ব দেখাচ্ছো?”
“মিঠি আমার স্ত্রী। ওর উপর কর্তৃত্ব দেখানোর রাইট আমার আছে।”
“কোন এবিলিটি আছে তোমার? বড় বড় কথা বলছো যে?”
“কোনো এবিলিটি নেই,আর বড় কথাও বলছি না। জাস্ট সত্যিটা বলেছি! আর আমার সকল সমস্যা জেনেশুনেই মিঠি আমাকে মেনে নিয়েছে,আমার সাথে থাকতে চায় এটাই অনেক।”
“হোয়াট! মিঠি মেনেছে মানে?”
“বিশ্বাস না হলে মিঠিকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
“ও যা বলছে এইসব কি সত্যি?”
দু-ফোঁটা অশ্রু ফেলে চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ালো মিঠি। সব সত্যি! সব! কেন জানি আকস্মিক ভীষণ অভিমান হলো আহসান সাহেবের। যার ভালোর জন্য এতদূর থেকে উড়ে এলেন! যার জন্য এতো সাক্রিফাইজ! যার জন্য এতো লড়াই! এতো দুঃচিন্তা! আর সেই কিনা আগেই নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে নিলো তাও কি-না একটা ভুল মানুষের সঙ্গে। যে মানুষটার কোনো যোগ্যতাই নেই তার স্বামীর হওয়ায়। মানতে পারলেন না আহসান সাহেব। তপ্তশ্বাস ফেললেন। মিঠিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
“বেশ! তুমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছো! তোমার জীবনের ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত এখন তুমি নিজেই নিতে পারো! এখানে আমি বলার কে? ওকে ফাইন! দ্যাট’স ওকে! আসছি ভালো থেকো শুভকামনা!”
আর দাঁড়ালেন না আহসান সাহেব। সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে গটগট আওয়াজ তুলে বেরিয়ে যেতে নেয়। হঠাৎ দাঁড়ালেন। পিছু ফিরে মিঠিকে বললেন,”তোমায় একটা কথা বলতে চাই।”
মামার সামনে এসে দাঁড়ালো মিঠি। অশ্রুসিক্ত নয়নে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালো।
“মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা ভীষণ জরুরী! সম্পর্কের সমীকরণ ঠিক কখন কোথায় গিয়ে দাঁড় করাবে তা কারোর জানা নেই। নিজের একটা অস্তিত্ব তৈরী করা উচিত। পৃথিবীর সবাই ছেড়ে গেলেও নিজের কাজ কখনো কোনো দিন নিজেকে ছেড়ে যাবে না। একটা পরিচয়,যে পরিচয়টা একজন নারীকে শক্তি দেবে। লড়াই করার অনেকখানি সাহস দেবে। আমি চাই তুমি ভালো করে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের একটা অস্তিত্ব তৈরী করবে। ভালো থেকো,আসছি!”
আচমকা মামাকে ঝাপটে ধরলো। মিঠিকে ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন এবং লিফটে উঠে গেলেন। দৌঁড়ে মামার পেছনে গেলো,দেখলো লিফট নেমে গিয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো মিঠি। আহসান সাহেব গাড়িতে উঠতে নেয়। মামাকে দেখতেই হাঁফাতে হাঁফাতে দৌঁড়ে গিয়ে পেছন থেকে দু’হাতে ঝাপটে ধরলো। অনুনয়-বিনুনয় করে অসহায় কণ্ঠে বলতে লাগলো,”মামা যেও না প্লিজ! মামা শোনো! মামা প্লিজ একটু শোনো!”
নিজেকে ছাড়িয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন আহসান সাহেব। অভিমানে টইটম্বুর হয়ে মন আকাশে মেঘ জমেছে একগাদা! আদেও কবে কখন এই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরবে তার ইয়ত্তা নেই। গাড়িতে উঠে বসলেন। দৌঁড়ে এলো মিঠি। গাড়ির কাঁচ তুলে দিলেন। কাঁচের বাইরে থেকে অনেক বার ডাকলো মামাকে। কিন্তু কান দিলেন না তিনি,তাকালেন ও না। সামনের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসে রইলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কিছুদূর যেতেই দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো উনার গাল বেয়ে। পেছন থেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মিঠি। মামাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে। খুবউ! অনবরত চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো দু-গাল বেয়ে। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো মামার যাওয়ার পানে! কবে মলিন হবে এই অভিমান?
_____
মোশাররফ সাহেব বেরিয়ে গেলেন। বাসায় ফিরতেই মনিরা খাতুন বকাবকি শুরু করলেন। মিঠির বাসায় থাকা পছন্দ করেন না তিনি। কিন্তু মিঠি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে,তাকে এতো বড় বাসায় একা রাখা যায় না। সুন্দরী মেয়ে,এছাড়াও গায়ে-গতরেও বেশ অনেক বড় দেখা যায়। তাই ভয় হয় মেয়েটাকে নিয়ে। কে কোন সময় সুযোগ বুঝে একা বাসায় মেয়েটার সর্বনাশ করে ফেলে সেই ভয়ে! মূলত,দায়িত্ববোধ থেকেই রাতের বেলা গিয়ে থাকেন। মিঠি এখানে আসলেও সহ্য করতে পারেন না তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মোশাররফ সাহেব। দোটানায় আছেন তিনি। কোথাও শান্তি নেই। মনিরা খাতুনকে বিয়ে করার পর থেকে জীবন থেকে শান্তি নামক শব্দটি পালিয়ে গেছে। নীরব হয়ে বেডের এক কোণায় মাথা চেপে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ যাবৎ সহ্য করলেন মনিরা খাতুনের বকাবকি। শেষে শান্ত গলায় ডাকলেন,”মনিরা শোনো।”
বকতে বকতে এগিয়ে এলেন তিনি। ঝাঁঝালো গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”কেনো ডেকেছো?”
মনিরা খাতুনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
“আমার মুখ দেখার জন্য ডেকেছো নাকি?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মোশাররফ সাহেব। আচমকা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। ঠিক জানেন না এর ভবিষ্যত কোথায়! নিজেকে ধাতস্থ করলেন।
“কী হলো? কিছু বলছো না?”
ঠাণ্ডা মাথায় আচমকা মনিরা খাতুনের মুখের উপর তিন তালাক বলে দিলেন মোশাররফ সাহেব। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি। ব্যপারটা বোধগম্য হতেই আচমকা চিৎকার দিয়ে উঠে সেন্সলেস হয়ে লুটিয়ে পড়লেন ফ্লোরে। মনের দুঃখে বেরিয়ে গেলেন মোশাররফ সাহেব। আজ থেকে মনিরা খাতুন ও মুক্তি! উনিও এই বেড়াজাল থেকে মুক্তি! এছাড়াও আজকের পর এই বাড়িতে তিনি আর পা রাখবেন না বলে শপথ করেন। এই অপশন ছাড়া উনার কাছে আর কোনো উপায় ছিলো না। বাসা থেকে বেরিয়ে শেহজাদকে ফোন করলেন। রিসিভ হতেই বললেন,”তোমার সব ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা জেনেশুনেই যেহেতু আমার মেয়ে তোমাকে মেনে নিয়েছে,তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। তবে তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ; আমার অবর্তমানে আমার অনুপস্থিতিতে আমার মেয়েকে তুমি দেখেশুনে খেয়াল রাখবে। ওর দায়িত্ব আপাতত তোমাকে দিলাম। সামনে ওর পরীক্ষা,আপাতত তোমার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কোনো বাসা নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। মিঠির কাছেই থাকো এবং তার পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া অব্ধি এখানেই থেকো। পরেরটা পরে ভাবা যাবে। আগে মিঠির পরীক্ষা সম্পূর্ণ হোক। তারপর কিছু একটা ভেবো। আর কোনমতেই মিঠিকে একা ছেড়ো না। ছোট এবং জেদী মানুষ,রাগ উঠলে ভুলভাল কাজ করে ফেলবে। তাই সাবধানে থেকো,সাবধানে রেখো। রাখছি।”
শেহজাদকে কিছু বলতে না দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন। তবে নীরবে সায় দিলো শেহজাদ। মিঠিকে খেয়াল তো সে অবশ্যই রাখবে। তবে একটা বিষয় মানতে পারলো না। মিঠির মামার বাসায় থাকতে তার নিজেকে খুব ছোট মনে হবে। কিন্তু মিঠির ভালোর জন্য থাকতে হবে। মিঠির পরীক্ষা শেষ হলে সে ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে নিবে। মিঠির সঙ্গে বাসার ব্যপার নিয়ে কথা বললো শেহজাদ। মিঠি জানালো,সে যদি এখন এই বাসা ছেড়ে চলে যায় তাহলে তার মামা ভীষণ কষ্ট পাবে। মনে মনে ভাববে,বিয়ে না হতেই মামার সবকিছুকে এখন অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে! স্বামীই এখন সব। এতে তার মামার মনঃক্ষুণ্ন হবে,কষ্ট পাবে। কিন্তু মিঠি এমনটা চায় না। আর অনন্যাও আগের মতো এই বাসায় আসে না। খুব ব্যস্ততা দেখায়। বলা যায় মিঠি কিছুটা একা হয়ে গেছে। তাই শেহজাদকেই বাধ্য হয়ে থাকতে হবে।
_____
পার হয়ে গেলো তিনমাস। ৩০ শে জুন থেকে মিঠির এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সব ভুলে মিঠি পড়াশোনায় গভীর মনযোগ দিয়েছে। যেভাবেই হোক তার প্ল্যান সাকসেসফুল করতে হবেই! সেই দৃঢ় সংকল্প করে মনোবল বাড়িয়ে পড়াশোনায় গভীরভাবে মন দিয়েছে এবং সব টেনশন দূরে রেখে পরীক্ষা দিতে লাগলো। মিঠির পরীক্ষার সময় ছুটি নিয়েছে শেহজাদ। নিজ দায়িত্বে মিঠিকে নিয়ে যায়,পরীক্ষা শেষ হওয়া অব্ধি বসে থাকে এবং নিয়ে আসে। আজও মিঠির পরীক্ষা। কলেজের পাশের একটা ক্যাফেতে বসে রইলো শেহজাদ। শেষ ঘন্টা পড়তেই ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেলো। সবে হল থেকে পরীক্ষা দিয়ে বান্ধবীদের সাথে একসাথে বের হয়েছে মিঠি। বিদেয় জানিয়ে যার যার গার্ডিয়ানের সাথে তারা চলে গেলো।।শেহজাদকে দেখতে হাস্যজ্জ্বল মুখে এগিয়ে এলো মিঠি।
“পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
“ভালো।”
“চলো।”
সায় দিলো মিঠি।
“নিশ্চয়ই তোমার খুব খিদে পেয়েছে!”
“ওতোটাও না।”
“রেস্তোরাঁ থেকে লাঞ্চ করে একসাথে বাসায় যাই চলো।”
“আচ্ছা।”
বেশ কিছুক্ষণ পর দু’জনে রেস্তোরাঁ থেকে লাঞ্চ করে বেরুলো।
“আজ রিকশায় চড়বো একটু।”
“ওকে।”
“ড্রাইভারকে চলে যেতে বলি?”
“বলো।”
একটা রিকশা নিলো শেহজাদ। দু’জনে রিকশায় করে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলো। হঠাৎ দূর থেকে কেউ একজনের দৃষ্টি আঁটকে গেলো ওদের উপর। ওরা লক্ষ্য করলো না এতোকিছু। মানুষটি ওদের ফলো করতে শুরু করলো। ঘুরাঘুরি শেষে ওরা বাসায় ফিরে গেলো। কিছুক্ষণ রেস্ট করে মিঠি শাওয়ার নিলো। মিঠি বেরুতেই শেহজাদ ঢুকলো শাওয়ার নিতে। আগন্তুক মিঠির বাড়ির সামনে এসে থামে। উপরের দিকে একপলক তাকালো। একটা বহুতল ভবন! ঠিক বিশ কি একুশ তলা ভবন। দুটি বাড়ি সম্মিলিত একটি বাড়ি করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা টুইনটাওয়ার। বাড়ির ভেতরে ঢুকে মিঠির কথা জিজ্ঞেস করতেই কেয়ারটেকার থেকে যতটুকু জানতে পারলো,সাততলায় মিঠির ফ্ল্যাট। লিফটের সিক্স ফ্লোরের বাটন স্পেস করে অপেক্ষা করে। মিঠির ফ্ল্যাটের সামনে আসতেই লিফট থেকে বেরিয়ে এসে ডোরের সামনে দাঁড়ায়। সর্বপ্রথম চোখ পড়লো দেয়ালোর সাথে লাগিয়ে রাখা একটি নেইম-প্লেটের মধ্যে। সেখানে খুব সুন্দর করে লেখা,”মিঠিপরীর রাজ্য।”
গাল বাঁকালো শবনম। চতুর্দিকে অস্থির দৃষ্টি বুলালো। ভীষণ সুন্দর করে সাজানো এই বাড়িটির বাহির-ভিতর। দেখে বোঝাই যায় কয়েক কোটি টাকার একেকটা ফ্ল্যাট! একেক ফ্লোরে দু-পাশে দুটো করে বাসা। ফ্ল্যাটের সামনে লন করা,দোলনা আছে। নানান রকমের লতানো সহ হাবিজাবি আউটডোর এবং ইনডোর প্লান্টে ভরা। ভাবতে লাগলো ফ্ল্যাটের বাইরেই এতো সুন্দর না জানি ভেতরে কতো সুন্দর! এইসব ভাবতে ভাবতে কলিংবেলের সুইচে চাপ দেয়। মিঠি তখন মাথার চুলগুলো মোছায় মন দিলো। কলিংবেলের শব্দ হতেই চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে নেয়। লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলো শাড়ি পরিহিত একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ময়বিমূঢ় হয় মিঠি। ডোর খুলতেই শুনতে পায়,”তুমি মিঠি শিউর?”
“হ্যাঁ! তুমি শবনম রাইট?”
“হুম।”
“আমাদের ফোনে কথা হয়েছিলো।”
“হ্যাঁ,মনে আছে। নাইচ টু মিট ইউ।”
মৃদু হাসলো শবনম। তবে শবনমকে দেখে চমকালেও স্থির রইলো মিঠি। মিঠিকে দেখতেই তাকিয়ে রইলো শবনম। এমনিতেই মারাত্মক সুন্দর! তার উপরে গোসল করে আসায় আরো স্নিগ্ধ,সতেজ,ফুরফুরে লাগছে! সুন্দর মায়াবী মুখটায় বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা ছড়িয়ে আছে। কানের পাশ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। যেনো সাত সকালের ফুটন্ত টকটকে তাজা গোলাপের উপর শিশির বিন্দু পড়ে আছে। আবার সাত সকালে বিলের জলে উঁকি দেওয়া সদ্য ফোটা শালুক ফুলের মতোও স্নিগ্ধ লাগছে। শিশুদের মতো কি সুন্দর নরম,কোমল ত্বক! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না শবনম। চোখ ঝলসে এলো। যেনো সদ্য আসমান থেকে নেমে আস্ত এক ফুটন্ত পরী। স্বভাবগত মৃদু হাসলো।
“শেহজাদ আছে?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায় ও?”
লাজুক হাসলো মিঠি।
“শাওয়ারে গেছে একটু আগে। নিউ কাপল বুঝোই তো!”
শবনমের কেমন যেনো লেগে উঠলো। শেহজাদ তার ছিলো। এখন মিঠির। শেহজাদকে সে-ই সন্তান না দিতে পারার অপরাধে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। কিন্তু এখন কেনো যেনো মানতে পারছে না মিঠির সাথে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরলো। ভাবলো,বাবা রে! এই ভরদুপুরেও সুন্দরী বউয়ের সাথে রোমান্স! শবনমকে অন্যমনস্ক হতে দেখে বাঁকা হাসলো মিঠি।
“ভেতরে আসো শবনম। দাঁড়িয়ে কেনো!”
“আমি তোমার বয়সে অনেক বড়।”
“জানি,তুমি আমার দশ-এগারো বছরের বড় মেইবি।”
“জানতে?”
“হ্যাঁ।”
“শেহজাদ বলেছিলো নিশ্চয়ই!”
“ঠিক ধরলে।”
ভেতরে ঢুকলো শবনম। আচমকা তার সারা শরীর জুড়িয়ে গেলো। না এসির শীতলায় নয়,বাসার সৌন্দর্য দেখে। লিভিং স্পেস দেখতেই বোঝা যাচ্ছে,দুনিয়ার ভীষণ নামী-দামী আসবাবপত্রে সাজানো-গুছানো। হতেই পারে ইম্পোর্টেড ফার্নিচার। ছোট্ট ছোট্ট শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু এবং স্কুল-কলেজের নানারকমের পদক দিয়ে সাজানো শোকেশ কর্ণারগুলো। ওয়েল ডেকোরেটেড ড্রয়িংরুম থেকে ভেতরে যাওয়ার দরজায় অব্ধি নানারকমে স্টোনের ঝুল মালা দিয়ে সাজানো! শবনম ভেবে পায় না,কিভাবে শেহজাদের মতো কালো,ডিভোর্সি,সন্তান জন্মদানে অক্ষম একটা পুরুষ এতো সুন্দর,বিত্তবান ফ্যামিলির মেয়েকে বিয়ে করলো? সুন্দর মানে এতো সুন্দর! ছবির চেয়েও বাস্তবে বেশি সুন্দর! তার থেকেও সুন্দর! মিঠিকে দেখতেই ভীষণ জেলাশফিল হলো। কল্পনাও করেনি তার চেয়েও এতো সুন্দর বউ পাবে শেহজাদ। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সব কপাল। এই তিন মাসে খবর নিয়ে শবনম যতটুকু জানতে পারলো তা হলো,তারা যে বাসায় ভাড়া থাকতো সেই বাড়িওয়ালার একমাত্র মেয়ে মিঠি। আর মালিকানা সূত্রে সেই বাড়িটাও মিঠির মায়ের হলেও কিছুদিন পর মিঠিই হবে সেই বাড়ির একমাত্র মালকিন। আর সেই মেয়ে এতো বড় বাড়ি রেখে এখানে এক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সাজিয়ে বসবাস করছে!
“বসো,তোমার জন্য চা-কফি করতে বলি। আমরা দু’জন বাইরে থেকে লাঞ্চ করে এসেছি।”
খুব ঈর্ষা হলো শবনমের। সুন্দরী বউকে নিয়ে এখন রেস্টুরেন্টেও লাঞ্চ করে! এমন নয় যে তার সাথে করেনি! অনেক করেছে! কিন্তু তাকে ছাড়া অন্যকারো সাথে করতে শবনমের ভীষণ ঈর্ষা জাগে।
“খালা কফি দিয়ে যাও তো গেস্ট এসেছে।”
“দিতেছি।”
“তো বলো,কি মনে করে? আর আমার বাসার খোঁজ পেয়েছো কীভাবে?”
“রিকশায় দেখলাম দু’জনকে।”
“ওহ! তার মানে তুমি ফলো করছিলে আমাদেরকে?”
“না। তা কেনো করবো!”
“বাই দ্যা ওয়ে,সাংসারিক জীবন কেমন চলছে তোমার?”
“ভালো।”
_____________
চলবে~
কপি নিষেধ।