তবু_আমারে_দেবোনা_ভুলিতে 💖 #মেহেরিন_আনজারা_নিশা 💖 #পর্বসংখ্যা-(২২)

0
56

#তবু_আমারে_দেবোনা_ভুলিতে 💖
#মেহেরিন_আনজারা_নিশা 💖
#পর্বসংখ্যা-(২২)
_________________________

কিছু বলতে নেয় শবনম,মিঠিকে আসতে দেখে চুপ হয়ে গেলো। প্রসঙ্গ পাল্টে হেসে উঠে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শেহজাদকে তাচ্ছিল্য করে বলল,”এমনিতেই তুমি কালো,তার উপরে আবার মুখে চাপদাঁড়ি রেখেছো! আয়নায় দেখেছো একবার,তোমাকে দেখতে কেমন লাগে? পুরাই জলহস্তী!”

অপমানিতবোধ করলো শেহজাদ। যদিও শেহজাদের দাঁড়িগুলো অতো বেশি বড় নয়,তবে খোঁচা খোঁচা। তিন-চারদিন হলো সেভ করেনি।

“আমি পছন্দ করি! তাই রাখতে বলেছি! সুন্দর না?”

“ওহ! হ্যাঁ খুব সুন্দর!”

ফিকে হাসলো শবনম।

“শেহজাদ কালো,কিন্তু সে নিজেকে সৃষ্টি করেনি। করতে পারলে অবশ্যই নিজেকে পৃথিবীর সবার থেকেও সুন্দর করে সৃষ্টি করতো! এটা বোধহয় সবাই করতো যদি সৃষ্টিকর্তা সেই সুযোগটা দিতেন। তাই স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা নিজেই মানুষের হাতে তাকে সৃষ্টি করতে না দিয়ে বরং নিজেই সৃষ্টি করার দায়িত্ব নিয়েছেন। যাকে যেই রূপে দেখতে উনার ভালো লেগেছিলো তাকে সেই রূপেই সৃষ্টি করেছেন। শোনো,সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির উপর সন্দেহ করতে নেই! তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে নেই! ওর জায়গায় আজ তুমিও থাকতে পারতে! হয়তো নারী বলে সৃষ্টিকর্তা করুণা করেছেন তোমায়। নয়তো একবার ভাবো কি হতো তোমার!”

অপমানিতবোধ করলো শবনম। নীরব রইলো শেহজাদ। শবনমের একটা শিক্ষার প্রয়োজন আছে। ঠিকমতোই প্রতিত্তোর করছে মিঠি! যেমন কর্ম তেমন ফল। এই শবনমকে শায়েস্তা করার জন্য একদম মিঠি পারফেক্ট!

“ধূৎ! সিরিয়াসলি নিচ্ছো কেন? আমি তো মজা করে বলেছি! আগেও এমন কতো মজা করতাম! অভ্যাস তো!”

“আগেরটা আগে চলে গিয়েছে! এখন আর সেদিন নেই শবনম। আর আমিও তো মজা করে বলেছি। তুমিও সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন?শোনো,আর আমি মুখের উপর কথা বলতে কখনো ভয় করি না,সত্য প্রকাশ করা অবশ্যই আমার দায়িত্ব। আরেকটা কথা,মানুষকে ছোট করে কথা বলার অভ্যাস বন্ধ করো! একদিন দেখবে সময় তোমাকে এমন জায়গায় ছোট করবে যেখানে তুমি সম্মান পাওয়ার অনেক যোগ্য ছিলে।”

অপমানে থমথমে হয়ে গেলো শবনমের মুখটা। এই মেয়ে বয়সে তার ছোট। কিন্তু তাকে দুই পয়সার দাম ও দিচ্ছে না। মিঠির জায়গায় আজ অন্য কোনো মেয়ে হলে তাকে সম্মান করে আপু বলে ডাকতো! কিন্তু মেয়েটা মুখের উপর তার নাম ধরে ডাকছে! কথায় কথায় তাকে নীতিকথা শোনাচ্ছে! অসন্তুষ্ট হলেও চুপ রইলো। এখানে আসাটাই তার আজন্ম চরম ভুল হয়েছে! এখন মানে মানে বের হওয়ার পালা!

“আরও একটা কথা শোনো,প্রাক্তন বলতে আমরা একজন প্রতারক,ভন্ড,লোভী,খারাপ মানুষ হিসাবেই বুঝি! আমাদের এই অসুস্থ চিন্তা থেকে বের হয়ে আসা উচিত! মনে রেখো,সম্পর্ক থাকুক আর না থাকুক! কষ্ট দিক আর যাই করুক; কাউকে অসম্মান করো না। শেহজাদ তোমার প্রাক্তন ছিলো,তাকে কখনো অসম্মান করবে না তুমি। আরো একটা কথা শোনো,স্বামীর উপর স্ত্রীর যাবতীয় ভরনপোষন ফরজ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী হাতখরচকে করা হয়েছে সুন্নাহ। যেন নারী অনুগত থাকে এবং কোনোভাবেই হীনমন্যতায় না ভোগে। যে ব্যক্তি এসব নিয়ে স্ত্রীকে খোঁটা দেয়,কথা শোনায় নিঃসন্দেহে সে কাপুরুষ। তদ্রূপ স্বামীর কম উপার্জন নিয়ে দিন-রাত অভিযোগ করার আগে স্ত্রীর উচিত নিজের যোগ্যতাকে যাচাই করা,তার কি এমন আছে যাতে করে আরো ভালো কিছু পেত! এবং আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করা। কারণ শুকরিয়ায় নিয়ামত বেড়ে যায়!”

কিছু বলতে পারলো না শবনম। তার মানে মিঠি সব শুনেছিলো। মাথা নুয়ে বসে রইলো শেহজাদ। তারও বুঝতে বাকি নেই সব শুনেছে মিঠি।

“শোনো,আরো একটা কথা। মানুষকে মানুষ অসুন্দর বানায়,সৃষ্টিকর্তা নয়। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির তুলনা হয় না! সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নিয়ে যে সন্দেহ করে সে মুমিন নয়! তাই আমাদের সবসময়ই শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর কাছে চাওয়া উচিত,হে আল্লাহ! আপনি আমার চেহারাকে যেভাবে সুন্দর করেছেন; সেভাবে আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দিন। কেবল চেহারা সুন্দর হলে হয় না,চেহারার মতো চরিত্র এবং আচার-আচরণ ও সুন্দর হতে হয়।”

“হ্যাঁ,অবশ্যই ঠিক বলেছো!”

শেহজাদের উদ্দেশ্যে বলল,”নিজের সৌন্দর্য নিয়ে কখনোই হতাশ হবে না শেহজাদ! আপনি যেমনই হোন না না কেন কালো,খাটো,মোটা,কুৎসিত কিংবা চিকন,সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই আপনার সৃষ্টি হয়েছে মানুষের জন্য না! তাই মন খারাপ করবেন না।”

প্রসন্ন হলো শেহজাদ। চট করে শবনমকে বলল,”আচ্ছা এনাফ! কেনো দাঁড়ি রাখতে বলেছি তার কারণটা শুনবে না?”

মাথা নাড়ালো শবনম।

“সেদিন উনার ফোনে আমাদের অনেকগুলো সেলফি তুলেছিলাম। পরে সেলফিগুলো দেখতে গিয়ে বার-বার উনার একটা ছবি বেশ কয়েকবার ঘুরে-ফিরে চোখের সামনে পড়েছিলো। যতবারই পড়েছিলো ততবারই একটু সময় নিয়ে দেখেছি আর ভেবেছিলাম,দাঁড়ি একজন পুরুষের সৌন্দর্য কতোটা বাড়িয়ে দেয়। সেখান থেকেই রাখতে বলেছি! কিন্তু উনি শোনেন না,ছেঁটে ফেলেন। এজন্যই মাঝেমধ্যে মনখারাপ হয় উনার প্রতি।”

ফিকে হাসলো শবনম।

“খুব ভালো।”

শবনমের চুপসানো মুখ দেখে শেহজাদ বুঝতে পারলো এরা দু’জন উপর দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে কথা বললেও ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। একজন বুনো ওল তো আরেকজন বাঘা তেঁতুল! শবনম যেভাবে হেয় করে প্রশ্ন করছে,মিঠিও তার উপর দিয়ে প্রতিত্তোর করছে। শবনম যতবারই তাকে অপদস্ত করার চেষ্টা করছে,মিঠি ততবারই তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে হ্যান্ডেল করছে! তবে এরা কেউই কারো থেকে কম যায় না। বুঝাই যাচ্ছে স্বাভাবিক থেকে ভেতরে ভেতরে দু’জন জেতার কম্পিটিশন করছে! মলিন হাসলো শেহজাদ। কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়! আল্লাহ তার জীবনে দুইটা বউ দিয়েছেন,দু’জনের মধ্যেই হিংসায় ভরা। ভাগ্যিস শবনম আগেই সরে গিয়েছে,নয়তো দু’জন সারাক্ষণ চুলোচুলি করতো! বিশেষ করে মিঠি! আচমকা শেহজাদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো মিঠি। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে মাথা রাখলো বুকে। যদিও মিঠি এমনটা প্রতিদিন করে,তবে শবনমের সামনে একটু অপ্রস্তুত হলো শেহজাদ। নিশ্চয়ই শবনমের মনে ভেতরে ঝড় বইছে! বুকের ভেতর জ্বলন শুরু হয়েছে! খুব আদুরে আহ্লাদী গলায় বলল,”আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন তো ভুঁড়িওয়ালা সাহেব। খুব ঘুমাতে ইচ্ছে করছে!”

“ভুঁড়িওয়ালা সাহেব! বাহ! ভালোই নাম।”

মনে মনে বললো শবনম। মিঠির চুলের গভীরে হাত ডোবালো শেহজাদ। কিন্তু চোখ বুজলো শবনম। শেহজাদ তাকেও এমন করতো! খুব আদর,যত্ন সব করতো। কেনো যেনো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। হুট করে চোখ মেললো। মনে হচ্ছিল তার মাথায়ই হাত বুলাচ্ছিলো শেহজাদ। আনমনা হলো শবনম।

“ভালোবাসো?”

“একটু একটু।”

“কষ্ট দাও?”

“আগে খুব দিতাম! এখন দিই না।”

“কেন?”

“খুব কষ্ট হয়! আর উনি আমার অর্ধাঙ্গ। উনাকে আমি কষ্ট দিই না! কষ্ট দিতে গিয়েও কষ্ট হয়,মায়া হয়!”

“কেন?”

“যাকে নিয়ে পূর্ণ হবো,তাকে আঘাত দিই কী করে? আমরা দু’জন তো এখন একজনই! দুই দেহে একই প্রাণ! আপন সত্তাকে কী আক্রমণ করা যায়? নিজেকে কী হ’ত্যা করা যায়? আমিই তো সে! সেই তো আমি! আমি মানে তিনি! তিনি মানেই তো আমি! আর আমরা দু’জনই তো একজন।”

শ্বাস আঁটকে রইলো শবনম।

“অনেক ভালোবাসা!”

“হুম! একদম! জানো,পুরুষ তার জীবনে আসা প্রথম নারীর চেয়ে দ্বিতীয় নারীকে বেশি ভালোবাসে! শেহজাদ আমাকে অনেক ভালোবাসে! তাই কষ্ট দিতে পারি না!”

হুট করে শবনমের কেমন যেনো অসুস্থ লাগছে! এখানে আসাটাই ঠিক হয়নি তার। শরীরে দূর্বল অনুভব করলো।

“আমি বরং আজ উঠি।”

“থেকে যেতে পারতে! অনেক গল্প করতাম! তোমার সাথে এখনও অনেক অনেক গল্প করা বাকি!”

“না। আজ অনেক লেট হয়ে গেছে। বাসায় ফিরবো।”

“মাঝে মাঝে এসো কেমন! জমিয়ে সুখ-দুঃখের গল্প করবো তিনজনে।”

মলিন হাসলো শবনম।

“দেখি।”

বেরিয়ে গেলো শবনম। মিঠির বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটতে লাগলো। যেটার জন্য এসেছিলো লাভ হয়নি। উল্টো একবুক জ্বালা নিয়ে ফিরে এলো। এখানে আসাটাই ভুল ছিলো তার। বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। পা-জোড়া ভেঙে আসছে। তাদের কথার ব্যস্ততার মাঝেও তার মন শেহজাদের দিকে পড়েছিলো। বার-বার আঁড়চোখে ঘুরে-ফিরে তার দিকে তাকিয়েছিলো। খুব চেনা মানুষটাকে অচেনা রূপে দেখতেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো তার,জেলাশফিল ও হয়েছিলো বটে। শুধু ভালোবাসলেই যে জেলাশফিল হয় ব্যপারটা একেবারেই ভুল,যখন কারও জীবনে নিজের মূল্যটা অন্যকেউ পায়,তখনও অন্তরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়াও নিজের ভালোবাসার মানুষ অন্য কাউকে ভালোবেসেছে! এটা দেখার মতো জঘন্য অনুভূতি আর কোনোটাই হতে পারে না! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শবনম। মানুষটার চোখে-মুখে একটা অদ্ভুত আনন্দ এবং তৃপ্তি দেখতে পেয়েছিলো সে। ভালোবাসা কি অদ্ভুত! যাকে এতোগুলো বছর ভালোবেসেছিলো,নিজের বলে জেনেছিলো,কতশত কল্পনা করেছিলো,যে মানুষটার বুকে মাথা রেখে হাজারো স্বপ্ন সাজিয়েছিলো,কত প্ল্যান করেছিলো তাদের দু’জনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। একটা সময় এই মানুষটাকে নিয়ে কত দিবা স্বপ্ন দেখেছিলো! যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে সে এখন অন্যের আর সেও এখন অন্যের। আর সেই মানুষটা এখন অন্যকারো! সেই মানুষটার কোলে,বুকে আজ অন্যকারো মাথা! বুক চিরে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সময় কত দ্রুত চলে যায়! দু’জনেই আছে,কিন্তু পথটা শুধু আলাদা হয়ে গেছে। ভালো থাকুক কিছু ভালোবাসা। একটা রিকশা নিয়ে উঠে বসতেই চলতে শুরু করলো।
______

খুব ক্লান্ত থাকায় মিঠির চোখ ভেঙে এলো। আলতো করে মাথায় চুমু খায় শেহজাদ। আধোঘুমে দু-হাতে কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো শেহজাদের। ভুঁড়ির মধ্যে মুখ গুঁজলো। মৃদু হাসলো শেহজাদ। মিঠির কানে ঠোঁট দুটো এগিয়ে নিলো। ফিসফিসিয়ে বলল,”তুমি আবার জন্ম নিও সুনেত্রা!”

ঘুমু ঘুমু গলায় জিজ্ঞেস করলো,”কেন?”

“আমি তোমার প্রেমে পড়বো!”

“এখনও পড়েননি?”

“পড়েছি তো!”

“কতটুকু?”

“একটু! একটু!”

“একটু একটু না! খুব বেশি করে পড়ুন।”

“না পড়ে উপায় নেই সুনেত্রা! খুব মায়ায় জড়িয়ে ফেললে!”

মৃদু হাসে মিঠি।

“বোধহয়!”

মৃদু হাসে শেহজাদ। ভারী শ্বাস পড়ে মিঠির। ঘুমিয়ে যায়। মিঠিকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওইভাবেই বসে রইলো। তুলতুলে নরম মেয়েটাকে বুক থেকে সরাতে ইচ্ছে করছে না! তার ইচ্ছে করে সারাজীবন ওইভাবেই বুকের মধ্যে আঁটকে রাখতে! কেন জানি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বেশ কিছুসময় অতিবাহিত হতেই বুক থেকে সরিয়ে খুব যত্নে পাঁজাকোলে তুলে নিলো মিঠিকে। ঘুমের ঘোরে গলা আঁকড়ে ধরলো মিঠি। মুচকি হাসলো শেহজাদ। তুলতুলে বেডে নিয়ে সুন্দর করে আরাম করে শুইয়ে কোলবালিশ দিলো বুকের সাথে। আধশোয়া হয়ে মিঠির পাশে বসলো। তাকিয়ে রইলো মিঠির লাবণ্যময়ী মুখটার দিকে।
______

তাদের দু’জনের নতুন বাসায় ফিরে এলো শবনম। দীর্ঘসময় ব্যয় করে শাওয়ার নিলো মনটাকে শান্ত করার জন্য। কিন্তু আসার পর থেকে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলো না শবনম। এতোগুলা দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও এতো গভীর টান রয়েছে শেহজাদের প্রতি তা আগে কখনো অনুভব করেনি! দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। সেদিন ডিভোর্স লেটার ধরিয়ে দিতেই শবনম লক্ষ্য করেছিলো শেহজাদের চোখে পানি। শেহজাদ কেঁদেছিলো তার বিয়োগে। শবনম জানে শেহজাদ এখনও তাকে ভালোবাসে। সত্যি বলতে,একজন মানুষের জীবনে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসার মতো একটা মানুষ খুব কমই আসে! তার জীবনে তাকে ভালোবাসার মানুষ ছিলো শেহজাদ। ভাবুক হলো,ঠিক কতোটা কষ্ট পেলে,কতোটা ভালোবাসলে একজন পুরুষ একজন নারীর জন্য কান্না করে! কেন জানি খুব আফসোস হলো,এতো ভালোবাসা পেয়েও সে মাত্র একটা সন্তানের অযুহাত দেখিয়ে অফিসের কলিগের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে চলে এলো শেহজাদ থেকে। চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললো মানুষটাকে! আহা প্রেম! আহা জীবন! আহা ভালোবাসা! আহা মায়া! এইজন্যই বোধহয় হুমায়ুন ফরিদী বলেছিলেন,“আমার এই জন্মেও তোমাকে ভালোবাসার স্বাদ মিটবে না।”

ততক্ষণে বিকেল ঘনিয়ে গোধূলি-সন্ধ্যা নামলো। তাকিয়ে রইলো কমলাভ ওই আকাশের পানে। ভাবলো,কিছু কিছু নেয়ামতকে কদর না করতে জানলে সৃষ্টিকর্তা বোধহয় ভাগ্য থেকে উঠিয়ে নেন! তেমনি তার ভাগ্য থেকেও উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে! কিন্তু সেও বা জেনেশুনে কি করতো! মাতৃত্বের স্বাদ কেইবা না চায়? তার চাওয়াটা কি অপরাধ! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার আর শেহজাদের কিছু সুন্দর মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি! কিছু ভালোবাসা বোধহয় অপূর্ণতার মাঝেও পূর্ণতা পায়! একসময় এক পূর্ণতার নাম ছিলো,“শেহজাদ-শবনম” আর আজ “শেহজাদ-মিঠি।” কদর করতে না জানলে বোধহয় পূর্ণতা একেকবার একেকজনের দুয়ারে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যায়। যে লুফে নিতে পারে সেই বোধহয় আজন্ম সুখী! আর যে পেয়েও কদর করতে জানে না সে আজন্ম দুঃখী!

রাতে পড়তে বসলো মিঠি। খুব স্বাভাবিক রয়েছে সে। শবনমের বিষয়ে কোনো কথাই বললো না,আর না কোনো ঝামেলা। শেহজাদ চিন্তিত এবং ভয়ে ভয়েই ছিলো। এই বুঝি মিঠি রেগে উঠবে! আচমকা কিছুটা ছুঁড়ে তাকে আক্রমণ করে বসবে! এই মেয়ের তো আবার জিনিসপত্র খুব ছোঁড়াছুঁড়ির অভ্যাস রয়েছে। কখন না জানি তার মাথা-টাথা ফুলে আলু হয়ে যায়। আতঙ্কগ্রস্থ থাকলেও সেই সবের কিছুই হলো না। বরং সেই আতঙ্ক মনের ভেতরে থাকলেও প্রকাশ না করে মিঠিকে পড়াতে বসলো।

প্রাইভেট টিচারের পাশাপাশি রাতে বেশ সময় নিয়ে মিঠিকে পড়ায় শেহজাদ। মিঠিও বাধ্য মেয়ের মতো তার কাছে পড়ে। শেহজাদ খুব উপভোগ করে সময়টা। অনেকক্ষণ পড়ানোর পর শেহজাদ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না সে,স্বাস্থ্যবান মানুষ; তাই কোমড়ে ব্যথা হয়। রাত সাড়ে এগারোটা অব্ধি পড়বে মিঠি। পরীক্ষা তো তাই সন্ধ্যার নামাজের পর-পরই পড়তে বসে এবং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। আবার প্রাকৃতিক নিয়মে আযান হতেই দু’জনে জেগে যায়। তবে এটা কেবল পরীক্ষার সময় নয়,এটা মিঠির ডেইলি রুটিন। এরপর সূর্যোদয়ের পূর্বেই দু’জন একসঙ্গে উঠে শাওয়ার নেয়,একসাথে নামাজ আদায় করে,আবারও মিঠি পড়তে বসে। শেহজাদ এক ধাপ স্ট্রং ব্ল্যাক কফি করে আনে মিঠির জন্য। কফি পান করতে করতে মিঠি পড়ে,ততক্ষণে রহিমা খালা আসেন। সমস্ত বাসা ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে-মুছে কিচেনে ঢুকে যায়। এরপর ব্রেকফাস্ট তৈরী হয়ে যায়। দু’জনে খেয়ে-দেয়ে তৈরী হয়ে নেয়। মিঠিকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যায়। তাদের দু’জনের দৈনন্দিন জীবন-কাল খুব সুন্দরভাবে নিয়মানুযায়ী চলছে। শেহজাদ চায় আজীবন এমনই চলুক! তাদের কোনো সন্তান লাগবে না। সন্তান ছাড়াও সুখে থাকা যায়,যদি সেভাবে থাকতে পারে আর কি! তবে মাঝেমধ্যে মিঠি মন খারাপ করে সন্তানের কথা বলে। সেই সময়টায় শেহজাদ চুপ থাকে। কোনো শান্তনা দিতে পারে না কিইবা বলার আছে তার! আল্লাহ’র হুকুম না থাকলে সে কি করবে? ভাবে যদি কোনো একটা মিরাক্কেল হয় আরকি! এছাড়াও তার বয়সের তুলনায় মিঠি অনেক ছোট। তাই এইসব বিষয়ে কথা বলতে দেয় না,যথাসম্ভব ইগনোর করে।

পড়তে বসলে মিঠি বেশ কয়েক মগ কফি পান করে। এটা তার নিত্যদিনকার অভ্যাস। নয়তো তার মাথা ভার ভার হয়ে থাকে,ব্যথা উঠে,ঝাপসা দেখে। কফি খাওয়া মাত্রই তার মনটা চাঙা হয়ে যায়,দ্রুত পড়া ঢুকে মাথায়। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে রহিমা খালা চলে যায়। তিনি আসেন ভোর সকালে,সারাদিন থাকেন আর রাতের বেলা সব গুছিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যান। এই তো একটু আগে ডিনার করার পর,তিনিও খেয়ে-দেয়ে সব ধুয়ে-মুছে,গুছিয়ে ফিরে গেলেন। এখন বাসায় কেবল তারা দু’জন। মিঠি পড়ছে। তার জন্য কফি করবে।
___________

চলবে~
কপি নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here