যাতনা_আমার #সানজিদা_ইসলাম_সূচনা #পর্ব: ২

0
267

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ২

ফোনের স্কিনে স্বামীর সাথে অন্য মেয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখে স্তব্ধ হয়ে রইলো ইনায়া। ফর্সা মুখশ্রী টুকটুকে লাল হয়ে রয়েছে তার। লাল ঠোঁট গুলো তিরতির করে কাপছে তার। সব কিছু অসহ্য লাগছে তার কাছে। নাভান আর অদিতির বেশ কিছু অন্তরঙ্গ ভিডিও তার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে অদিতি। ইনায়া ভাবতে পারছেনা কতটা নির্লজ্জ হলে কেউ এইসব করতে পারে। বুকটা প্রায় জ্বলে যাচ্ছে তার। নাভান তার স্বামী, সে কি করে তার স্ত্রী এর অধিকার অন্য কাউকে দিতে পারে? কিন্তু? নাভান তো তাকে স্ত্রী হিসেবেই মানেনি। কথাটা মন হতেই নিজের জন্য বিদ্রুপের হাসি দিল ইনায়া। তার মুখটাও তো দেখেনি তার স্বামী। চকিতে চোখের সামনে একটা ক্লিপ ভেসে উঠে ইনায়ার। নাভান আর অদিতির চুম্বকীয় একটি ক্লিপ।রাগে ফোনটা দরজার দিকে ছুরে মারে সে। এতোক্ষণ ফ্লোরে হাঁটু গুঁজে বসে ছিল ইনায়া।সকালে নিধি এসে তার কাপড় বদলিয়ে একটা শাড়ী পরিয়ে দিয়েগেছিল। নিপা এসে অনেক বার খাবার জন্য জোড়াজুড়ি করলেও কিছুই মুখে দেয়নি সে। অনুভূতি শুন্য হয়ে বসেছিল পুরোটা সময়। এতকিছুর ভেতর একবারও সোহানা মির্জা ইনায়ার কাছে আসে নি। হয়তো কিছু অপরাধবোধ তাকে নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। বসা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় ইনায়া। কালকের ঘটনা কমবেশি প্রতিবেশীদের কানে পৌঁছে গেছে। তারা প্রায় দল ধরে আসছে মির্জা বাড়ির প্রাঙ্গণে। ইনায়াকে দেখার অনেক কৌতুহল তাদের মনে।
মির্জা বাড়ির এতো সনামধন্য লোকেদের এমন ঘটনা তাদের মুখে মুখে উপছে পরছে যেনো। নিচ থেকে কিছু মহিলাদের কথাও শুনতে পায় সে। হঠাৎ করেই ইনায়ার পা ধরে লুটিয়ে পরে একজন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয় ইনায়া। সামনে তাকিয়ে সোহানা মির্জাকে দেখে, তার পা জরিয়ে কাঁদছে তিনি। একটু দুরেই তার ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছেন নাহিদ মির্জা। ইনায়া চটজলদি সোহানা মির্জার সামনে বসে পড়ে কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-” এইসব কি করছো মামনি? তোমাকে এমন মানায় না। ”
-” মারে, ক্ষমা করে দে আমাকে। আমি স্বার্থপরের মত তোর জীবন টা কে নরক বানিয়ে দিলাম। ”

-” তুমি ক্ষমা কেনো চাইছো? ক্ষমা আমার তোমার কাছে চাওয়া উচিত। আমার কারনে তোমার ছেলে বাড়ি ছেড়েছে”

-” ওর কথা আর বলবেনা ইনায়া। ওকে আমি আর নিজের ছেলে বলে মানবো না। ”

সোহানা মির্জার কঠিন মুখে তাকিয়ে রয় ইনায়া, কি বলবে এই কথার প্রেক্ষিতে? আজ না কাল নাভান ঠিক বাড়িতে ফিরে আসবে। তখন কেউ আর রাগ করে থাকতে পারবে না। ইনায়া নাহিদ মির্জার দিকে তাকাতেই তার হাতে নিজের ফোন দেখতে পায় সে। কন্ঠে বিচলিত হয়ে সে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” অদিতি আপুর ব্যাপারে তোমরা আগে থেকেই জানতে? তাহলে, কেনো আমাকে আগে বলোনি? আর এই বিয়ে কেনো হতে দিলে তোমারা?”

সোহানা মির্জা মাথা নুইয়ে বসে থাকে। নাহিদ মির্জা তাদের পাশে এসে বসে, ইনায়ার মাথায় হাত রেখে বলে,
-” আমরা অদিতির ব্যাপারে জানতাম। কিন্তু, ব্যাপারটা যে এতো খারাপ হবে তা ঠাওর করতে পারিনি। আগে জানলে নাভানের কথাই মানতাম। ”

-” কক্ষনো না! তুমি ভাবলে কি করে ওই রকম বাজারে মেয়েকে আমি এই বাড়িতে মেনে নিতাম?

স্ত্রীর কান্নারত কঠোর চোখে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো পুত্রের প্রতি তার অসীম ঘৃনা বিরাজ করছে। নাহিদ মির্জা সোহানাকে আর কাছুই বলতে পারলো না। সোহানা ইনায়ার হাত ধরে বলে উঠে,

– আজকে থেকে তুমি আমার পরিচয়ে বাচবি, আমার মেয়ে হয়ে।নাভান শাহরিয়ারের নাম হ্রদয় হতে মুছে ফেলো। জানি কষ্ট হবে! কিন্তু তোমাকে করতেই হবে। ”

বলেই তিনি ইনায়ার হাত ধরে নিচের দিকে অগ্রসর হলেন। এতো কষ্ট কি করে ভুলবে সে। স্বামী নামক মানুষটিকে কি ভুলা এতো সহজ হবে?

-” এমন এতিম মাইয়্যা বিয়া করাইলে তো এমনই হবে আয়েশা আপা। এমন শিক্ষিত পোলার লগে এমন মাইয়্যা যায় না।”

-” এই মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিদায় করার ব্যবস্থা করেন। নাহলে নাতি সারাজীবন বিদেশেই পরে থাকবো।

দুজন মহিলা আয়েশা মির্জা কে এইসব কথা বলছিল। আয়েশারও তাই মনে হচ্ছে। ইনায়া বাড়িতে থাকলে নাভান কখনোই ফিরে আসবেনা। সে সোহানার সাথে নিশ্চয়ই কথা বলবে। নিচে নামতেই মহিলাদের কথা শুনতে পেলেন সোহানা আর ইনায়া। ইনায়া মাথা নিচু করে মেঝেতে তাকিয়ে থাকে। সবার দৃষ্টি এখন তার দিকেই নিযুক্ত। সোহানা সবার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

-” ইনায়া এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে।”

-” কোন পরিচয়ে তাকে এখানে রাখবে বউমা? যেখানে নাভান তাকে অস্বীকার করেছে।”

-” নাভানের সাথে আমাদের সম্পর্ক কালকেই শেষ হয়ে গেছে মা। আর রইল ইনায়ার কথা? সে এই বাড়ির মেয়ের পরিচয়ে থাকবে।”

আয়েশা মির্জা এবার অনেকটা রুষ্ট হলেন। এই ভাবে তো চলবে না। সোহানার অতিরিক্ত রাগের কারনেই, এসব হয়েছে বলে তার মনে হচ্ছে। গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,

-” আর পাগলামি করো না তুমি। তোমার এই জেদের কারনে আজ এই অবস্থা। নাভান ঘরের ছেলে ঠিকই বাড়িতে ফিরবে। এরচেয়ে ভালো হবে তুমি ইনায়া কে তার মামার বাসায় দিয়ে আসো।

-” ইনায়া এই বাড়িতেই থাকবে, এতে যদি কারো সমস্যা থাকে সে নিজেই জেনো নাভানের মতো চলে যায়। অন্যথায় আমি ইনায়া কে নিয়ে বেড়িয়ে যাব।

সবাই চুপ হয়ে যায় সোহানার কথায়। বাড়ির প্রতিটি সদস্য বুঝতে পারছে না সামনে কি হতে চলেছে।
কিন্তু নাভানকে যে সোহানা সহজেই মাফ করবেনা৷ ঢের বুঝতে পারছে তারা। ইনায়া সোহানার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে, এই একটা মানুষ কতক্ষণ তার জন্য একাই লড়াই করবে? এর চেয়ে তার চলে যাওয়াই ঠিক।

স্টার নাইট ক্লাব, কানাডা

ক্লাবের ভিতর খোলা মেলা পোশাকে কয়েক দল যুবক যুবতীরা আনন্দে মেতে উঠেছে, জমকালো আয়োজন চারপাশে নানা রকমের লাইটিং হুইস্কির বোতল আর মিউজিক। সব মিলিয়ে এক অন্য রকম সন্ধ্যা। বার টুলে বসে ইচ্ছে মতো ড্রিংক করছে নাভান শাহরিয়ার। ফর্সা গায়ে জরানো কালো শার্ট শরীরে এটে আছে, তাতে তার পেশি বহুল হাত বিদ্যমান। চুল গুলো সুবিন্যস্ত ভাবে কপালে ছিটিয়ে আছে। আশেপাশের মেয়েরা এক প্রকার তাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। এখানে সে মোস্ট হট ব্যাচেলর হিসেবে পরিচিত।

একের পর এক ড্রিংকস করেই চলেছে নাভান। চোখ দুটো তার টুকটুকে লাল হয়ে আছে। বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই অশান্তিতে আছে সে। অফিস কাজ কিছুই ভালো লাগে না তার। মায়ের সাথে বেশিই রুড হয়ে গিয়েছিল এবার। কিন্তু তার কাছে আর কিছু করার ছিল না। পিঠের উপর কেউ হাত রাখতেই পিছনে ফিরে তাকায় নাভান। একটা ছোট ওয়েস্টান ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে আছে অদিতি মুখে তার চমৎকার হাসি। নাভানের হাত থেকে ড্রিংক গ্লাস টা নিয়ে নাভানের উরুর উপর বসে সে। দুই হাত দিয়ে অদিতির কোমড় জরিয়ে ধরে নাভান। অদিতি নাভানের গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে ওঠে,

-” কি হলো তোমার? বিডি থেকে ফিরে এসে একদম বদলে গেছো তুমি। ”

-” আই ডোন্ট নো! কেমন জানি অস্থির লাগছে সবকিছু। ”

গাল থেকে অদিতির হাত সরিয়ে বলে উঠলো নাভান অদিতি কুটিল হেসে নাভানের কানে কানে স্লো ভয়েজে বলে উঠে,

-” ওকে, লেট্স গো!”.
-” কোথায়? ”
-” তোমার অস্থিরতা কমাতে। ”

নাভান অনেকটা বিরক্ত হয়ে অদিতি কে নামিয়ে দিল। দাড়িয়ে অস্থির ভঙ্গিতে মাথা চেপে ধরে বলে,

-‘ এসব ভালো লাগছে না অদিতি। চলো বাড়ি যাই। ”

-” এই অস্থিরতা কি তোমার বউয়ের জন্য নাভান?”

চকিতে সামনে তাকিয়ে অদিতির মুখে গভীর দৃষ্টি ফেললো নাভান। অদিতি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সহজে উত্তর দিতে পারলো না নাভান। মনে করলো সেদিন রাতের গগনবিহারী এক মেয়ের কান্না। যা তার পুরুষ মনেও নড়িয়ে দিয়েছিল তৎক্ষনাৎ। তারপরও নিজের এ্যারোগ্যান্ট মনোভাব তাকে থামতে দেয়নি। ওটা ওই মেয়ের প্রাপ্য ছিল।

-” ডোন্ট টেইক ইট টু হার্ট।

-” হাহ্, মনে হচ্ছে নাভান।

বলেই উলটো ঘুরে ক্লাবের বাইরে বেড়িয়ে যায় অদিতি। নাভান বড় কর নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় তার সব কিছুই অসহ্য লাগছে। নাভান গাড়ি পার্কিং এড়িয়ায় যেতেই দেখতে পায়, অদিতি রাগ করে পিছনের সিটে বসে আছে। নাভান গাড়ি স্টার্ট দেয়। কিছু দূর যেতেই আচমকা গাড়ি ব্রেক কষলো সে। গাড়ি থেকে নেমে পেছনের সিটে বসে অদিতির দিকে তাকালো সে। অদিতি বিরক্ত স্বরে বলে ওঠে

-” হোয়াট? গাড়ি বন্ধ করলে কেনো?”
-” ডোন্ট মেস্।

বলেই অদিতির অতি সন্নিকটে চলে আসে নাভান। একজনের নিঃশ্বাস অন্যজনের মুখে বারি লাগছে।
একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্লিপ্তে। রাগ পরে যায় অদিতির। এই দূরত্ব টুকু ঘুচে দেয় অদিতি। মিলিত করলো এক অপরের ওষ্ঠদ্বয়। দু’হাতে আকরে ন্যায় নাভান অদিতিকে। নীরব শুনশান রাস্তায় একপাশে দার করানো নাভানের কালো মার্সিডিজ। মাঝে মধ্যে দু একটা গাড়ি আসা যাওয়া করছে। অদূরেই বন থেকে শোনা যায় কিছু অচেনা পাখির কলরব। তার সাথে শোনা যায় এক জোড়া নরনারীর শীৎকার। যা এই শুনশান রাত গম্ভীর করে তুলে।

ইনায়ার জন্য একটা নতুন রুম ঠিক করেছেন সোহানা। সে তাকে এখন নাভানের রুমেও থাকতে দিবেনা পর্যন্ত। সোহানার ধারনা, এই রুমে থাকলে নাভানের কথা আরও বেশি করে মনে পরবে ইনায়ার। নাভানের রুমের দেয়াল জুড়ে বেশিরভাগ ছবিই নাভানের। বিভিন্ন এঙ্গেলের ছবি ঝুলানো আছে। ছেলে আসবে বলে সব মন দিয়ে সাজিয়ে ছিলেন সোহানা মির্জা। এতক্ষণ ধরে রুমটা ঘুড়ে দেখছিল ইনায়া। রুমে মিডলবেড রাখা, এক পাশে কাবার্ট ও ফ্লোর টাচ বড় মিরর অার অন্যপাশে বুকশেলফ আর টেবিল। সাথেই বিশাল ফ্লোর লাগোয়া গ্লাসের বারান্দার দরজা। বেডের সামনাসামনি নাভানের বিশাল বড়ো একটা ছবি বাধিয়ে রাখা হয়েছে। ইনায়া সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। ছবিতে ফর্মাল ড্রেসে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে নাভান। ইয়ানা মুচকি হেসে হাত বাড়ায় বা পাশটায়। আস্তে করে মাথা রাখে সেথায়, স্থানটাতো তারই। সেতো এই বা পাঁজরের তৈরি। এই জায়গা শুধু মাত্র তার। অবুজ মেয়ের মতো এক অষ্টাদশি কন্যা স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকার জানতে ব্যাস্ত। বেকুল কন্ঠে অবুঝ ভাবে সুধায়,

-” আপনি শুধু আমার নাভান। তাই না?

-“আপনার বুকের বা পাশটা আমার জন্য বরাদ্দ, শুধু আমার জন্য। ”

বিরবির করে বলে ওঠে ইনায়া। অথচ,সে কি জানে? তার বরাদ্দকৃত জায়গায় অন্য নারীর ঠাঁই দিয়েছে তার স্বামী। সে নারীকে বুকে নিয়েই সে এক আদিম খেলায মত্ত। জানা হয় না ইনায়ার।

চলবে…………….

( ভুলত্রুটি মার্জিত, আশাকরি গঠনমূলক কমেন্ট করে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here