#প্রিয়তোষ
পর্ব ১৩
লিখা Sidratul Muntaz
শ্রীমঙ্গলে আগেই অনলাইনে রিসোর্ট বুক করা ছিল। অনিককে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়ার পর ওরা সরাসরি গিয়ে রিসোর্টে উঠল। দুইরুমের একটা ঘর। ড্রয়িংরুমে বড় বিয়াল্লিশ ইঞ্চির একটা টিভি। বেডরুম, ড্রয়িংরুম দুই জায়গাতেই এসি। বেডরুমে বিছানা, ড্রেসিংটেবিল, আলমারি আর ড্রয়িংরুমে বিলাশবহুল সোফা। দৃষ্টিনন্দন শোপিস। বাথরুমে বাথটাব শাওয়ারের অসাধারণ ব্যবস্থা আছে। নোরা আর অন্তরার জন্য একটা রুম ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
নরম গদির বিছানা পেয়েই আরামে আগে একটা ঘুম দিল নোরা। তার চোখে রাজ্যের ঘুম কারণ সে হাসপাতালে একফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি। অন্তরা গতরাতে এখানেই ছিল। তবে তারও ঠিকমতো ঘুম হয়নি। রাতে আলভীর সাথে ঘুরতে বের হয়েছিল। কিন্তু সেটা নোরাকে বুঝতে দিল না সে। দুপুরের লাঞ্চ তাদের রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকাল থেকে নোরা কিছুই খায়নি। অনিক তাকে ফোন করেছিল। সেই ফোন ধরল অন্তরা।
” হ্যালো, অনিকস্যার?”
” নোরা কোথায়?”
” ও তো ঘুমাচ্ছে। ডাকবো?”
” হ্যাঁ ডাকো। সকাল থেকে কিছু খায়নি মেয়েটা। উঠে লাঞ্চ করতে বলো।”
” অনেক ট্রাই করেছি স্যার। কিন্তু ও উঠছে না। একেবারে ম’রার মতো ঘুমায়।”
অনিক মৃদু হেসে বলল,”কাতুকুতু দাও। উঠে যাবে।”
অন্তরা চোখ বড় করে তাকাল। এই বুদ্ধি তার আগে মাথায় আসেনি কেন? সঙ্গে সঙ্গে নোরার কোমরের দুই সাইড ধরে কাতুকুতু দিতে শুরু করল অন্তরা। মেয়েটা প্রায়। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। রেগেমেগে বলল,” তোর সমস্যা কি?”
অন্তরা হাসতে হাসতে বলল,” আমার কোনো সমস্যা নেই। অনিকস্যার বলেছে তোকে এইভাবে ওঠাতে। এইতো নে কথা বল।”
নোরার কানে ফোনটা চাপিয়ে অন্তরা উঠে গেল। ওই পাশ থেকে অনিকের অট্টহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নোরা বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” আপনি শিখিয়ে দিয়েছেন তাই না?”
” হুম।”
” আপনি তো আচ্ছা শয়তান!”
” হাত-মুখ ধুঁয়ে খেতে বসো। নাহলে আরো শয়তানি দেখাবো। আর তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
” হুহ! লাগবে না আপনার সারপ্রাইজ।”
নোরা ফোন রেখে বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। অন্তরা ততক্ষণে বের হয়ে গেছে আলভীর সাথে। তারা একাকী ঘুরবে। নোরা গোসল সেরে আবারও একই পোশাক পরল। আর জামা-কাপড় সাথে আনেনি সে। চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখল অন্তরা কোথাও নেই। বিছানায় কিছু জিনিস পড়ে আছে। একটা লাল শাড়ি, কালো ব্লাউজ, লাল কাচের চুড়ি আর পুতির মালা। পাশে ছোট একটা প্যাকেটে আরো কিছু জিনিস আর একটা চিরকুট। নোরা চিরকুটটা আগে খুলল। অনিকের সুন্দর হাতের লিখা,” আজকে ইচ্ছে হল তোমাকে মনের মতো সাজাবো। তুমি শাড়ি পরতে পারো কিনা জানিনা। কোনোদিন তো দেখিনি। তবে আজ কি পরবে আমার জন্য? প্লিজ! যদি না পারো, তাহলে আমি পরিয়ে দিতেও রাজি। তখন আবার এটা জিজ্ঞেস করো না যে আমি শাড়ি পরানো কোথা থেকে শিখলাম। মুভি দেখে শাড়ি পরানো শেখা যায়না ঠিক। তবে সেটা শেখার আরও অনেক উপায় আছে। আর এটা সত্যি যে তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দেখবো বলেই আমি শাড়ি পরানোটা বিশেষ যত্নে শিখেছিলাম। তোমার জন্য লালশাড়ি কেন আনলাম জানো? কারণ এই সবুজ শহরে কৃষ্ণচূড়ার মতো সুন্দর লাল তুমিটাকে দেখার আমার বড্ড শখ। সিলেটের চা বাগানে লালশাড়ি পরে তুমি প্রজাপতির মতো উড়বে। মিষ্টিপরী থেকে হয়ে যাবে লালপরী। আমার লালপরী। সবুজের কোলে লালপরীর চঞ্চলতা এনে দিবে আলাদা মাধুর্য্য। সেই পরিপূর্ণতাকে মুগ্ধচোখে দেখার সুযোগ কি আমার হবে মিষ্টিপরী?পরবে লালশাড়িটা আমার জন্য? ”
নোরা চিরকুটটা পরার সময় মুচকি হাসছিল। তার হাত দু’টো কাঁপছিল। সে মনে মনে বলল,” হুম পরবো। নিশ্চয়ই পরবো।”
তারপর প্যাকেটটা খুলে বাকি জিনিসগুলো দেখল। একটা কালো টিপের পাতা, কাজল, আর লাল লিপস্টিক। নোরা কখনও গাঢ় রঙের লিপস্টিক লাগায় না। তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। একবার শুধু অন্তরার জোরাজুরিতে লাগিয়েছিল, অনিকের বার্থডে’র দিন। কিন্তু তখন তো অনিক তার বয়ফ্রেন্ড ছিলনা, শুধু স্যার ছিল। তাই এতোটা লজ্জা লাগেনি। কিন্তু আজকে কিভাবে এই লাল লিপস্টিক ঠোঁটে লাগাবে ও? তাও আবার অনিকের সামনে! লজ্জাতেই তো মরে যাবে।
শাড়িটা পরে সম্পুর্ণ তৈরি হওয়ার পর আয়নাতে নিজেকে দেখে নোরা নিজেই হতবাক। বাঙালি সাজেও তাকে বাঙালি লাগছে না। মনে হচ্ছে লাল চুল আর সাদা চামড়ার কোনো বিদেশিনীর বাঙালি মেয়ে সাজার ব্যর্থ চেষ্টা। তবে নিজের রুপ দেখে আজ সে নিজেই মুগ্ধ। তার সারা শরীর কাঁপছে। এই রুপ, এই সৌন্দর্য্য কোথায় ছিল এতোদিন? নাকি নিজেকে কখনো ভালো করে দেখাই হয়নি। আয়নার দিকে তাকিয়ে নোরা অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল, ” এই মেয়ে,কে তুমি? তুমি কি সত্যিই আমি?”
তারপর নিজে নিজেই হেসে উঠল।এর আগে কখনও কারো জন্য এভাবে সাজেনি ও। আজকেই প্রথম। ভয়,ভালোলাগা,লজ্জা সবমিলিয়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি। জীবনের প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিগুলো বুঝি এমনই হয়!
হঠাৎ দরজায় খট করে শব্দ হলো। নোরা চ’মকে উঠতেই দেখল পেছনে অনিক দাঁড়িয়ে আছে৷ গ্রুপের সবাই ঘুরতে বের হয়ে গেছে। শুধু অনিক অপেক্ষায় ছিল নোরার জন্য। নোরা লাজুকমুখে তাকাল। মাথা নত করে রইল। নোরার সৌন্দর্য্য দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হতে হল অনিককে। মেয়েটাকে সত্যিই লালপরী লাগছে। যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা কোনো রাজকন্যা। এতো সুন্দর! অনিকের চোখের পলক অজান্তেই স্থির হয়ে গেল। অনেকটা দিশেহারা অবস্থায় অনেকক্ষণ যাবৎ চেয়ে রইল সে নোরার দিকে।
নোরা লাজুকহাসি বজায় রেখেই মাথা নিচু করে বলল,” শুধু কি দেখবেনই? কিছু বলবেন না?”
অনিকের যেন হুশ ফিরল। মৃদু হেসে নোরার কাছে এসে ওকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে ওর কাঁধে মুখ ঠেঁকিয়ে বলল,” তোমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে জানো?”
” কি?”
” মনে হচ্ছে আল্লাহ তোমার এই ফুটফুটে শরীরটা প্রথমে মুলতানি মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন, তারপর চন্দনের প্রলেপ মিশিয়ে দিয়েছেন। তাই তো তুমি এতো সুন্দর, পবিত্র,পরিচ্ছন্ন। ”
নোরার লজ্জা আরো বেড়ে গেল। অনিকের দিকে ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরল। অনিক হঠাৎ ঠান্ডা গলায় বলল,” এই নোরা!”
নোরা অনিকের বুকে মাথা রেখেই জবাব দিল,” হুম?”
” চলো বিয়ে করে ফেলি।”
নোরা হেসে বলল, ” মানে?”
” মানে অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে না। আমার তো একদমই তর সইছেনা। চলো এখানেই বিয়ে করে সংসার পেতে ফেলি। আর ঢাকা ফিরে যাওয়ার দরকার নেই।”
” পাগল হয়েছেন?”
” উহুম। সত্যি বলছি। বিয়ে করবে নোরা?”
” বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি চাই না এভাবে আমাদের বিয়ে হোক। আমাদের বিয়ে তো এলাহী আয়োজন করে হবে। সাতদিনব্যাপী রাস্তা সাজানো হবে, গায়ে হলুদ,বৌভাত,বিয়ে প্রত্যেক অনুষ্ঠানে স্টেজ সাজানো থাকবে। আমার কাজিনরা নাচবে, গেইট ধরবে, আপনার জুতো চুরি করে টাকা নিবে, হৈ-হুল্লোড় হবে। আর আমার অনেক শখ জানেন? পালকিতে চড়ে শশুরবাড়ি যাওয়ার। পালকির ব্যবস্থা থাকবে, আর বিয়ের প্রথম একমাস আমি একদম নতুন বউয়ের মতো সেজে থাকবো। উৎসবের আমেজ অনেকদিন ধরে থাকবে। তবেই না বিয়ের আসল মজা!”
” বাহ! বিয়ে নিয়ে তোমার এতো স্বপ্ন?”
” কেন? আপনার স্বপ্ন নেই?”
” আছে। তবে আমার স্বপ্ন তোমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে।”
” তাই? সেটা কিরকম?”
” মানে হচ্ছে.. আমার সব স্বপ্ন শুধু বাসর নিয়ে।” কথাটা বলেই ফিচেল হাসল অনিক।
নোরা চোখ কুটি করে বলল,” ধুর, আপনিও না! তবে বাসর নিয়ে আমারও স্বপ্ন আছে।”
” তাই? কি স্বপ্ন শুনি!”
” আমাদের বাসর হবে খোলা আকাশের নিচে।”
” খোলা আকাশের নিচে কেন?”
” চাঁদ, তারা, মেঘ সবাইকে সাক্ষী রেখে এক কথায় প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া। আর যদি সেটা নৌকায় হয় তাহলে তো কথাই নেই। মাঝ নদীতে খোলা আকাশের নিচে চারিপাশে শুধু ঢেউয়ের খেলা। আর উপরে তাকালেই ভাসমান সাদা মেঘের ভেলা। কতটা সুন্দর পরিবেশ একবার ভেবে দেখুন!”
” সেক্সও কি আমরা নৌকাতেই করবো? নৌকা ডুবে যাবেনা? ”
অনিকের উত্তর শুনে নোরার সব অনুভূতি উধাও হয়ে গেল। মুখটা গম্ভীর করে আচমকাই অনিকের বুকে,পিঠে কিল দিতে শুরু করল সে। আর বলল,” ছি। আপনি এত্তো খারাপ কেন?”
অনিক হাসতে হাসতে বলল, ” আচ্ছা, আচ্ছা, সরি। আমি তো শুধু বাস্তবতার কথা বললাম।”
” এতো বাস্তবতার কথা বলতে কে বলেছে আপনাকে?”
নোরার নাকের ডগা রাগে গোলাপী হয়ে গেছে। অনিক পেছন থেকে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
” আচ্ছা স্যরি মিষ্টিপরী। তারপর বলো। আর বাসর নিয়ে তোমার আর কি কি স্বপ্ন?”
” এখন আর বলতে ইচ্ছে করছেনা। মুড নষ্ট হয়ে গেছে। আচ্ছা আমরা ঘুরতে কখন বের হবো? সবাই তো চলে গেছে।”
” ভেবেছিলাম তো আমরাও বের হবো। কিন্তু সেটা এখন আর ইচ্ছে করছে না। ঘর পুরো ফাঁকা। এখন শুধু মকা…”
” উফ, ফাজলামি করবেন না। আমি শ্রীমঙ্গল কখনও আসিনি। প্লিজ ঘুরতে যেতে চাই।”
” তোমাকে এই অবস্থায় বাইরে নিয়ে গেলে মানুষ আর চা বাগান দেখবে না। সবাই শুধু তোমাকেই দেখবে। সেটা কি আমার সহ্য হবে? তার চেয়ে ভালো ঘরে বসে আমি একাই দেখি।”
নোরা লজ্জায় লাল হয়ে বলল,” ধ্যাত! আমি ঘুরতে যেতে চাই। প্লিজ চলুন না।”
” যাবো তো মিষ্টিপরী। সেজন্যই তো সাইকেল ভাড়া করে এনেছি। রাতের মতো সাইকেলে করে আমরা পুরো শ্রীমঙ্গল ঘুরে বেড়াবো আজ। তুমি সামনে বসবে আর আমি পেছনে।”
নোরা চোখ বড় করে বলল,” সত্যি? ”
” সত্যি। ”
” তাহলে দ্রুত চলুন না প্লিজ প্লিজ! আমি সাইকেলে চড়বো।”
” চলো। ”
সাইকেল নিয়ে ওরা সর্বপ্রথম ঘুরতে গেল বিটিয়ারআই। যেখানে স্বচক্ষে চায়ের প্রস্তুত প্রণালী দেখা যায় এবং সেই সম্পর্কে জানা যায়। নোরার ওখানে গিয়ে মনে হল এসব শিখে তার কি লাভ? সে চা খেতে ভালোবাসে। বানানো টানানো তার সাধ্যি না। তবে জায়গাটা নোরার ভালোই পছন্দ হল। সুন্দর কিছু জায়গায় ওরা ছবি তুলল।
তারপর ওরা চলে গেল নীলকণ্ঠ টি কেবিনে। সেখানের ফেমাস সাতরঙ এর চা খেতে। এক কাপ চায়ের মূল্য পঁচাশি টাকা। দাম শুনেই নোরার ইচ্ছে হল একবার খেয়ে দেখার। তবে পঁচাশি টাকার সেই সাতরঙ চায়ের থেকে দশটাকার দুধচাটাই নোরার বেশি পছন্দ হল। ওরা ওখানকার ফুচকাও খেল। নোরার মনে হচ্ছিল এতো দারুণ ফুচকা সে জীবনে খায়নি। এই দুই জায়গা ঘুরতে ঘুরতেই বিকাল হয়ে গেছে।
অনিক তারপর ওকে নিয়ে গেল নূরজাহান টি গার্ডেনে। যাওয়ার পথে অনিক বলছিল এইটা নাকি সিলেটের সেরা উঁচুনিচু পাহাড়ী চা বাগান। জায়গাটায় গিয়ে নোরা এই কথার অর্থ বুঝল। এক কথায় চোখ ধাঁধানো সুন্দর জায়গা। চাবাগান যে এতো সুন্দর হতে পারে এইখানে না এলে নোরা ধারণা পেতো না। গ্রুপের অন্য সদস্যরা নিজেদের মতো ঘুরছে। নোরা আর অনিক ঘুরছে আলাদা। একসময় অনিক বলল,” এসেছিলাম গ্রুপ ট্যুরে অথচ হয়ে যাচ্ছে মিনি হানিমুন। ব্যাপারটা দারুণ না? থ্যাঙ্কিউ নোরা, এতো সুন্দর সময় উপহার দেওয়ার জন্য।”
নোরা জবাব না দিয়ে শুধু হাসল। আকাশটা ছিল মেঘাচ্ছন্ন। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস, একটু পর পর মেঘের গর্জন, বৃষ্টির পূর্বাভাস সম্পুর্ণ পরিবেশটা মাতিয়ে রেখেছিল। অনিক-নোরা সাইকেলটা পার্ক করে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসল। নোরা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসল আর অনিক ওর কোলে মাথা রেখে একদম শুয়ে পড়ল।
ওদের চতুর্দিকে উঁচুনিচু পাহাড়, চাপাতার তরতাজা সুগন্ধ, নীল আকাশে জমাট মেঘ আর মন-মাতানো বাতাস এক কথায় মনের মতো পরিবেশ। নোরা অনিকের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনে গান গাইছিল। তার গানের কণ্ঠ খুব একটা সুন্দর না। তবে অনিকের কাছে সেই কণ্ঠ অতুলনীয় মনে হচ্ছিল। আর নোরা এতো সুন্দর করে ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল,অতিরিক্ত আরাম পেয়ে অনিক কখন ঘুমিয়ে পড়ল নিজেও টের পেলনা। ওর ঘুম ভাঙল বৃষ্টির পানিতে।
হুট করেই শুরু হল তুমুল বর্ষণ। অনিক উঠে বসতেই নোরা একেবারে দাঁড়িয়ে লাফানো শুরু করল। চা বাগানে বৃষ্টির সৌন্দর্য্য দেখে তার ভীষণ ভালো লাগছে। বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ নোরাকে দেখতে অনিকেরও চমৎকার লাগছিল। নোরা উপভোগ করছে বৃষ্টি, আর অনিক উপভোগ করছে নোরা। লাল টুকটুকে দুষ্ট-মিষ্টি চঞ্চলাবতী নোরা।
হঠাৎ কোথ থেকে যেন বিরাট একটা কচুপাতা জোগাড় করে আনল অনিক। সেই কচুপাতার ছায়ায় নোরাকে টেনে নিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়াল। নোরা মনখারাপ করে বলল,” এখানে কেন আনলেন? ”
” ভিজে যাচ্ছিলে তো।”
” ভিজতেই তো ভালো লাগছিল।”
” বুঝেছি ভালো লাগছিল। কিন্তু এখন ভেজা উচিৎ হবে না। রাতের বেলা ভিজবে।”
” রাতের বেলা কেন? এখন ভিজলে কি হয়েছে?”
” নিজের দিকে ভালো করে তাকাও, তাহলেই বুঝতে পারবে।”
অনিক কথাগুলো অন্যদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল।নোরা নিজের দিকে ভালো করে দেখল একবার। তার ভেজা শরীরে লাল শাড়িটা লেপ্টে আছে। দেখতে দৃষ্টিকটু লাগছে। নোরা লজ্জা পেয়ে বলল,” সরি।”
অনিক বলল,” ইটস ওকে। একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন আমিই তোমাকে নিয়ে ভিজবো। ততক্ষণ তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।”
” ঠিকাছে। কিন্তু ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেলে?”
“এই বৃষ্টি এতো জলদি থামবে বলে মনে হয়না। আর তারপরেও যদি থেমে যায় তাহলে বেডলাক।”
নোরা মনে মনে দোয়া করতে লাগল বৃষ্টি যেন কিছুতেই না থামে। বৃষ্টিতে ভিজতে না পারলেও কোনো আফসোস নেই। কিন্তু এভাবে কচুপাতার নিচে অনিককে আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে থাকতে নোরার দারুণ লাগছে। অনিক দুজনের মাথার উপরই কচুপাতাটা ধরে রেখেছে। একটু পর পর অন্যহাত দিয়ে নিজের ভেজা চোখ-মুখ আর চুল মুছছে। কি যে সুন্দর দৃশ্য! নোরার ইচ্ছে করছে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে অনিকের মাথা মুছে দিতে। কিন্তু তার শাড়ির আঁচলটা তো আরো ভেজা।
একটু পর পর দমকা বাতাসে দুজনের শরীররই কেঁপে উঠছে। অনিক একহাত দিয়ে নোরার কোমর ধরে ওকে কাছে নিয়ে আসল। নোরা আরও কাছে এসে অনিকের বুকে মাথা রাখল। বৃষ্টির ঝুমঝাম শব্দের সাথে অনিকের বুকের ঢিপঢিপ শব্দ। এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে?
সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পর চারদিকে যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার বৃষ্টি তখনও থামেনি। অনিক-নোরা চা বাগানের এবড়োখেবড়ো মেঠোপথ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। বৃষ্টির বেগ তখন আরো বেড়ে গেছে। দুজন পাগলের মতো বৃষ্টিখেলায় মেতে উঠেছে। এই বৃষ্টি যেন বৃষ্টি নয়, সুখের বর্ষণ। অনিক নোরার কোমর ধরে ওকে উপরে তোলে ঘুরাতে শুরু করল। আর নোরা ভুবন কাঁপানো হাসির স্রোতে মত্ত হল। চা বাগানে তখন তেমন কেউ ছিল না। অনিকের গায়ে লাল টি-শার্ট আর কালো জিন্স। নোরার গায়ে লাল শাড়ির সাথে কালো ব্লাউজ। ওরা প্রকৃতির সাথে পুরো মিশে যাচ্ছিল। বৃষ্টি যতক্ষণ চলল ওরা ততক্ষণই ভিজল। অতল সুখের গভীর সাগরে মাতাল হয়ে সাতার কাটছিল দু’জনেই।
সাইকেলে উঠে কাকভেজা শরীর নিয়ে রিসোর্টে ফিরে দুজনই ক্লান্ত। গ্রুপের অন্যরা তখনও ফেরেনি। হয়তো বৃষ্টির কারণে কোথাও আটকা পড়েছে। অনিক নোরাকে কোলে নিয়ে রিসোর্টের রুম পর্যন্ত এসেছে। নোরা হাসতে হাসতে বলল,” আজকের দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। আমি আজকের কথা কক্ষনো ভুলবো না।”
তারপর অনিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,” আপনাকে ধন্যবাদ। ”
অনিক ঘোর নিয়ে নোরার দিকে তাকিয়ে ছিল। নোরার ভেজা চোখে গাঢ় কাজলের ছাপ, আধরঙা লাল লিপস্টিক, ভেজা এলোমেলো চুল, পাগল হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। সে মাতাল দৃষ্টিতে বলল,” তোমাকে আই লভ ইউ।”
অনিকের কথায় নোরা খিলখিল শব্দে হেসে উঠল। তার হাসির শব্দে আরও নেশা পেয়ে বসল অনিকের। রুম সম্পুর্ণ রুম অন্ধকার। আবছা আলোয় তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। অনিক আলো জ্বালালো না। দরজা আটকে নোরাকে কোলে নিয়েই বেডরুমে চলে এলো। বিছানায় পিঠ ঠেঁকতেই নোরা অনিকের গলা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,” এই, কি হয়েছে আপনার?”
অনিক মাতাল কণ্ঠে বলল,” জানি না।”
তারপর এলোপাথাড়ি চুমু দিতে শুরু করল নোরার গলায়, ঠোঁটে। নোরা ভ্যাবাচেকা খেল। বাঁধা দেওয়ার সুযোগটুকুও হলো না৷ এর আগেই অনিক তাকে ঘায়েল করে ফেলেছে। নোরা কেবল টি-শার্ট খামচে ধরল অনিকের। নোরার বুক থেকে শাড়ির আঁচল সরাতেই মৃদু শব্দে চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা,” না প্লিজ।”
অনিকের হুশ ফিরল, সে কি করছে এসব নোরার সাথে? নিজের কাজে লজ্জিত হয়ে খুব দ্রুত উঠে বসল। নোরা দুইহাতে নিজেকে ঢেকে গুটিয়ে আছে। তার চোখে অশ্রু। অনিক কোনমতে নিজেকে সামলে বলল,” আ’ম স্যরি নোরা।”
নোরা কোনো জবাব দিল না। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। সে এমন আচরণ আশা করেনি অনিকের কাছে। তার এই প্রথম ভ*য় হচ্ছে মানুষটার সঙ্গে একা ঘরে অবস্থান করতে।অনিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কয়েক বার ঢোক গিলল। তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,”বেশিক্ষণ ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠান্ডা লাগবে। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি ডিনারের ব্যবস্থা করছি।”
অনিক এ কথা বলেই উঠে দাঁড়াল। তারপর তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নোরা কিছু সময় শুয়ে থেকে উঠে বসল। তারপর সময় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হলো। শাড়ি পাল্টে আগের পোশাক পরে নিল। অনিক ততক্ষণে রিসোর্ট থেকে বের হয়ে গেছে। বাকিটা সময় নোরা একাই কাটাল। রাত নয়টার মধ্যে সবাই রিসোর্টে ফিরে এলো। অন্তরাকে খুব হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। সারাদিন তারা কত মজা করেছে সেই বিষয়ে গল্প জুড়ে দিল এসেই।
নোরা কিছুই বলছিল না। সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে আছে। অন্তরা তার কাঁধে হাত রেখে বলল,” কি সমস্যা তোর? ভূতে ধরেছে? এমন থম মেরে আছিস কেন?”
” ভালো লাগছে না।” বিষণ্ণ মুখে কথাটা বলেই বারান্দায় চলে গেল নোরা।
কিছুক্ষণ পর অন্তরাও বারান্দায় ঢুকল। সন্দেহী চোখে বলল,” সত্যি করে বলতো, কি হয়েছে? অনিকস্যারের সাথে ঝগড়া করেছিস?”
নোরা আ’চমকা কেঁদে উঠল। তার কান্না দেখে হতভম্ব অন্তরা। নোরা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁপে কেঁপে বলতে লাগল,” আমার নিজেকে খুব বাজে মেয়ে মনে হচ্ছে অন্তু। আমি বাবার সাথে মিথ্যা বলেছি। তার বিশ্বাস ভেঙেছি। আর… ”
নোরা কথা শেষ করল না। অন্তরা বলল,” কি হয়েছে তোর?”
নোরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” জানি না। খুব খারাপ লাগছে কেন যেন।”
” অনিক স্যারের সাথে কিছু হয়েছে?”
” না। উনার দোষ নেই। দোষ আমার। এভাবে হুট করে এখানে চলে আসা ঠিক হয়নি। আমরা কাল সকালেই চলে যাবো অন্ত।”
” কি বলছিস? কালই? কত সুন্দর জায়গা! আমার তো আরও ঘুরতে মন চাইছে। প্লিজ আর একটা দিন থাকি নোরা।”
নোরা কঠিন মুখে বলল,” আমি থাকব না। এটা ফাইনাল। এবার তোর ইচ্ছে হলে তুই থাক। তোর ব্যাপার।”
এটুকু বলেই বারান্দা থেকে চলে গেল নোরা। রুমে ঢুকতেই দেখল অনিক দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে সযত্নে। নোরা কি করবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসল। অন্তরাও বারান্দা থেকে ছুটে এলো,” স্যার আপনি এখানে?”
” নোরার জন্য ডিনার নিয়ে এসেছিলাম।”
” শুধু নোরার জন্য? আমার জন্য আনেননি?”
“তোমার জন্য আলভী বাইরে ওয়েট করছে। তোমাকে জানাতে বলেছিল।”
” ওহ, আচ্ছা, আচ্ছা। আমি যাচ্ছি।”
ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় চুলটা একটু ঠিক করেই অন্তরা বের হয়ে যাচ্ছিল। তারপর আবার ফিরে এসে বলল,” স্যার একটা কথা, ওকে না ভূতে ধরেছে। কাল সকালেই চলে যেতে চাইছে। অথচ আমাদের তো আরও একটাদিন থাকার কথা ছিল। প্লিজ ওকে আপনি বোঝান৷ আমি যাচ্ছি বাই।”
নোরা অন্তরার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে অন্তরা বের হয়ে গেল।অনিক নোরার প্লেট টেনে নিয়ে বিরিয়ানি সার্ভ করছে শান্ত ভঙ্গিতে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল মৃদু গলায়,” রাগের কারণটা জানতে পারি?”
নোরা অপ্রস্তুত হলো। সংকোচিত গলায় বলল,” আমি কি একবারও বলেছি আমি রাগ করেছি?”
” তুমি তো বলবে না। কিন্তু বুঝে নেওয়ার দায়িত্বটা তো আমার।”
” এতোই যখন দায়িত্ব বুঝেন, তাহলে রাগের কারণটাও নিজ দায়িত্বে খুঁজে বের করুন। আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
” তোমার সবসময় উত্তর রেডি থাকে তাই না?”
একথা বলে অনিক নোরার পাশাপাশি বসল। চুপচাপ খাচ্ছে নোরা। অনিকও খাওয়া শুরু করল। খাবার শেষে নোরা প্লেট রেখে উঠে যাওয়ার সময় অনিক তার হাত ধরল। তারপর বলল,” চলো।”
” কোথায়?”
” একটা জায়গায়।”
” আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি ঘুমাবো।”
” মাত্র রাত সাড়ে নয়টা বাজে। এখন কি ঘুমাবে নোরা? সিলেটে কি ঘুমাতে এসেছো?”
নোরা জবাব দিল না। অনিক ওর হাত টেনে বলল,”চলো প্লিজ।”
” বললাম তো যাবো না। আমার ভালো লাগছে না।”
অনিক কোনো কথা না বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেল। নোরা ভাবল অনিক রাগ করে চলে গেছে। এখন ওর নিজের কাছেই আফসোস হতে লাগল। এতোটা রুড বিহেভ না করলেও হতো। অনিক হঠাৎ আবার ফিরে এলো। নিজের ব্যাগ থেকে একটা বড় শাল এনে ওর গায়ে জড়িয়ে দিল। নোরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি করছেন?”
” চুপ।”
এটুকু বলেই নোরাকে কোলে নিয়ে ফেলল অনিক। নোরা আর কিছু বলার আগেই ওকে নিয়ে রিসোর্টের বাইরে চলে এলো। নোরা বুঝে গেল বাঁধা দিয়ে লাভ নেই। তাই চুপ করে রইল। অনিক জীপ ভাড়া করে এনেছে। ওইটাতেই নোরাকে ওঠাল। তারপর ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। অনিক-নোরা পাশাপাশি বসে আছে। একটু পর নোরা বলল,” আচ্ছা আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?”
অনিক রহস্যময় হাসি দিয়ে শুধু বলল,” সারপ্রাইজ। ”
নোরা তারপর আর কোনো প্রশ্নই করলনা। জীপ থামল চৌঙ্গাইঘাটে। ওখানে নেমেই অনিক নোরাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। গ্রাম গ্রাম পরিবেশ,আশেপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নোরা ভয়ে অনিকের একহাত জড়িয়ে ধরে আছে। অনিক ওকে নিয়ে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে চলে এসেছে। আরো কিছুটা সামনে যেতেই নোরা দেখল ঘাটে একজন মাঝি নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছে। অনিক মাঝিকে বলল,” মাঝিভাই! সব রেডি?”
মাঝি দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে বলল,” হো ভাই, আয়া পড়েন।”
এই ঘুটঘুটে অন্ধকারেও মাঝির ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পেল নোরা। তার সবকিছুতেই কেমন ভয় ভয় লাগছে। হঠাৎ সারা নৌকা আলোকিত হয়ে উঠল। সোনালী রঙের ছোট ছোট লাইট পেঁচিয়ে নৌকাটা সাজানো হয়েছে। নদীর পানিতে লাইটগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশের তারাগুলো মুক্তভাবে পানিতে ঝরে পড়ছে। কি যে অমায়িক! কি যে মোহনীয়!
অনিক নোরাকে নিয়ে নৌকাতে উঠল। আর মাঝি বৈঠা বাইতে শুরু করল। নোরা প্রথম কয়েক মিনিট কিছু বলতেই পারলনা। মুগ্ধচোখে শুধু আশেপাশের সৌন্দর্য্য দেখছে। প্রকৃতির এই রুপ আর অনিকের হঠাৎ সারপ্রাইজ তাকে কিছুসময়ের জন্য বাকরুদ্ধ করতে পুরোপুরি সক্ষম। নোরা নিজ থেকেই বলে উঠল,” এতো সুন্দর কেন? সব কিছু কেন এতো ভালো লাগছে? আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
অনিক হেসে বলল,” তোমার এই পাগল হওয়া রুপটাই তো দেখতে চেয়েছিলাম। আর এই পাগল করা হাসি।”
নোরা তাকিয়ে বলল,” আপনি এতোকিছু কখন করলেন? কিভাবে করলেন?”
” তুমিই না বলেছিলে, তোমার নৌকায় উঠে খোলা আকাশ দেখার শখ। দেখো খোলা আকাশ!”
অনিক উপরে তাকাল, নোরাও তাকাল। কিন্তু আকাশ দেখা যাচ্ছে না, বড় বড় সবুজ গাছ নীল আকাশটা ঢেকে রেখেছে। তবুও সুন্দর লাগছে। অতুলনীয় সুন্দর। অনিক বলল,” ওহ! সরি, এখন আকাশ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটু পরেই যাবে, যখন আমরা মাঝনদীতে চলে আসবো।”
” খোলা আকাশ দরকার নেই। এভাবেই ভালো লাগছে। উফফ এই জায়গাটা এতো সুন্দর কেন?”
” শুয়ে শুয়ে দেখো, আরো বেশি সুন্দর লাগবে।”
দুজন একসাথে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। অনিক নোরার একহাত ধরে রইল। নোরার দুইচোখ ঝলমল করছে। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি! নৌকা ধীরগতিতে বয়ে চলেছে, টলটলে পানিতে ঢেউ খেলা করছে,একটুু পর পর নদীতে ভাসমান বিশাল গাছগুলো সামনে চলে আসছে। মনে হচ্ছে ওরা এখনি গহীন জঙ্গলে হারিয়ে যাবে। কিন্তু মুহুর্তেই আবার উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে সব। একটু পরেই সবুজ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো বিশাল আকাশ। খন্ড খন্ড মেঘের দৃশ্য। নোরা মাথা উঠিয়ে নদীর পানির দিকে তাকাল। অনিক বলল,” কি করছো নোরা? পড়ে যাবে তো।”
নোরা হেসে বলল,” পড়ে গেলে কি হবে? মরে যাবো?”
অনিক অবাক হয়ে তাকাল। নোরা আবার হাসল। বলল,” এখানে মরতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। এতো সুন্দর দৃশ্যের স্মৃতি নিয়ে মরে গেলেও শান্তি। খুব শান্তি।”
অনিক কিছু বললনা। শক্ত করে নোরার হাতটা ধরে রাখল। নোরা নদীর পানিতে দেখল নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য। একটু পর পর নদীতে ঢেউ উঠছে, মনে হচ্ছে যেন আকাশেই ঢেউ খেলা করছে। আকাশ-নদীর একরুপ। আহা! নোরা চোখ বন্ধ করল। নীরব পরিবেশে নদীর কুলকুল ধ্বনি শোনার অব্যর্থ চেষ্টা। একটু পর নোরা জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা আমরা এখানে কতক্ষণ থাকবো?”
” এইতো দেড়-দুইঘণ্টা। তুমি চাইলে আরো বেশিক্ষণও থাকা যাবে।”
” নৌকাটা সারাজীবনের জন্য ভাড়া করে নেওয়া যায়না? আমরা না হয় সারাজীবন ভেসে বেড়াবো!”
অনিক হেসে ফেলল। নোরাকে এতো খুশি দেখে নিজের উপর ভীষণ গর্ব হচ্ছে তার। নোরার এই আনন্দের জন্য সে দায়ী। একথা ভাবতেই গর্বে বুক ফুলে উঠছে। অনিক একজীবনে আর তেমন কিছু চায়না। শুধু সারাজীবন নোরাকে এভাবেই খুশি রাখতে চায়।
চলবে