#অনপেখিত
পর্ব ৬
লিখা: Sidratul Muntaz
“এর মানে কি আমি সুন্দর? ”
কাঁপতে থাকা কণ্ঠনালী নিয়ে মেহেক আছন্নের মতো জিজ্ঞেস করল। লজ্জার পাশাপাশি তার মনে জন্ম নিল তীক্ষ্ণ ভালোলাগার এক শিহরিত অনুভূতি।
” নিঃসন্দেহে তুমি খুব সুন্দর মেহেক!”
ফারদিনের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি শুনে মেহেকের হৃদয় আবিষ্ট কম্পনে বুঁদ হয়ে যাচ্ছিল। এরকম প্রশংসা তার জন্য নতুন কিছু না। সে আরও অনেকের কাছে নিজের রূপের প্রশংসা শুনে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকে খুব কিউট হওয়ার কারণে আদরের ভাগটাও তার বেশি ছিল। কিন্তু কথায় আছে না, অতিরিক্ত আদরে বাদর বনে যাওয়া! মেহেকের হয়েছে সেই দশা।
দাদা-দাদী,চাচা,ফুপু,মামাদের আশকারা পেতে পেতে মেহেক উচ্ছন্নে গেছে। তাই লেখাপড়াটাও ঠিক মতো হয়নি। অংকের খাতায় শূন্য পেলেও রূপের খাতায় তার মার্কস সর্বদা একশোতে একশো! মেহেক জানে সেটা। জানার পরেও ফারদিনের কণ্ঠে নিজের প্রশংসা শুনে কেন এতো ভালো লাগছে? নিজেকে খুব বিশেষ মনে হচ্ছে। মেহেক কাকাতুয়া পাখিটির দিকে চেয়ে লাজুক কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করল,” আমি কি এই কাকাতুয়াটির মতো সুন্দর? ”
ফারদিন হেসে বলল,” তুমি এইটার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। ”
এইবার যেন মেহেকের খুশিতে দম আটকে আসার পালা। নিঃশ্বাস ভারী ভারী লাগছে। এতো অদ্ভুত আনন্দ আগে কখনও অনুভব হয়নি তো! মেহেক উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,” সত্যি বলছেন?”
” হুম। সত্যিই তো।”
খুশিতে মেহেকের চোখ দিয়ে জল না বেরিয়ে যায়। আজকে মনে হচ্ছে, তার সুন্দর হওয়া সার্থক। তার মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াও সার্থক। তার তিনদিনের বিবাহিত জীবনের ভালোবাসাও সার্থক! মেহেক এইবার উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল,” তাহলে কি আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
ফারদিন এই প্রশ্নে হঠাৎ চমকে গেল, থমকে গেল! এতোক্ষণে তার সম্বিৎ ফিরে এলো। মেহেক যে তার সামান্য প্রশংসাবাক্যের এমন অর্থ খুঁজে বের করবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি। মেহেকের চোখের তারা দু’টি এই মুহুর্তে জ্বলজ্বল করছে। ফারদিনের ধারণা, এখন ভালোবাসার কথাটা অস্বীকার করলেই মেহেক কেঁদে ফেলতে পারে। বাচ্চা মেয়েটিকে কাঁদানোর কোনো মানে হয়? তাকে কষ্ট দিতে খারাপ লাগছে। চাইলে এখন মিথ্যে বলে মেহেককে খুশি করাই যায়। কিন্তু এই মিথ্যেটা তো শুধু মিথ্যে হবে না। হবে মস্তবড় প্রতারণা। কারণ ফারদিনের মনে একফোঁটাও ভালোবাসা নেই মেহেকের জন্য। যেটা আছে সেটা সহানুভূতি।
ফারদিন বলল,” অনেক রাত হয়ে গেছে মেহেক। ঘুমাতে যাও।”
ফারদিন এই কথা বলে আর দাঁড়াল না। চলে যাচ্ছিল। মেহেক ওর হাত চেপে ধরে বলল,” যাবেন না প্লিজ। আমার কথার উত্তর দিন। হ্যাঁ নাকি না? আপনি উত্তর না দিলে আমার ঘুম আসবে না।”
” উত্তর দেওয়ার সময় না এখন।”
” তাহলে কখন সময় হবে?”
” জানি না। তুমি ঘুমাতে যাও।”
” কিন্তু..”
” মেহেক!”
পুনরায় ফারদিনের সেই গম্ভীর কণ্ঠ, কঠিন দৃষ্টি। মেহেক হালকা নিভল। ফারদিনের হাতটাও ছেড়ে দিল। মাথা নিচু করল। ফারদিন চেহারার গম্ভীরতা বজায় রেখেই বলল,” সোজা ঘরে যাবে তুমি এখন। আর একটা কথাও শুনতে চাই না।”
এই কথা বলে সে হাঁটতে শুরু করল। মেহেক পাখিটাকে ধরে মাথা নিচু করে ফারদিনের পেছন পেছন এলো। বাড়িতে ঢোকার পর দুইজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল। ফারদিন ঢুকে গেল তার রুমে আর মেহেক পূর্বিতা, সুজানা যে রুমে শুয়েছে সেই রুমের দিকে এগিয়ে চলল। তার এখনও খুব খুশি লাগছে। ফারদিনের মুখে ভালোবাসার কথা শুনতে পারেনি তো কি হয়েছে? অন্তত নিজের রূপের প্রশংসা তো শুনেছে। ফারদিনের চোখে সে হলুদ পাখিটির চেয়েও সুন্দর। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? মেহেক মনে মনে ভাবছে এই পাখিটি সে সুজানাকে নিয়ে দেখাবে। রসিয়ে রসিয়ে বলবে, ফারদিনের থেকে পাওয়া উপহার। তখন কেমন লাগবে সুজির? নিশ্চয়ই খুব জ্বলবে। জ্বলুক, মেহেক তো তাকে জ্বালাতেই চায়।
ফারদিন মাত্র দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়েছে। সারাদিন ড্রাইভ করে তার শরীর ভীষণ ক্লান্ত। তখনি দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। ফারদিনের বিরক্তির আর সীমা রইল না। এতোরাতে আবার কে? দরজা খুলে দেখল মেহেক। হলুদ পাখি হাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফারদিন যথাসম্ভব কঠিনভাবে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”
” পূর্বিতা আপুদের ঘরের দরজা বন্ধ। আমি অনেকক্ষণ ধরে নক করছি। খুলছে না।”
” দরজা খুলছে না? আশ্চর্য! ”
ফারদিন ঠোঁট টিপে কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল,” আচ্ছা, সামনের একটা রুম ফাঁকা আছে। তুমি ওইখানে গিয়ে শুয়ে পড়ো, যাও।”
মেহেক তাও দাঁড়িয়ে রইল।ফারদিন দরজা আটকে দিতে নিচ্ছিল কিন্তু মেহেককে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,” কি ব্যাপার? যেতে বললাম না?”
” ভয় লাগছে।”
” ভয় লাগছে কেন?”
” একা থাকতেই ভয় লাগছে।”
” আগে কখনও একা থাকোনি তুমি?”
” থেকেছি। কিন্তু এখানে একা থাকতে ভয় লাগছে।”
” কেন?”
” আপনিই তো বলেছেন, পেয়ারাগাছের ভূতের ঘটনা সত্যি। ”
” এসব মিথ্যা। আমি মজা করেছিলাম তোমার সাথে।”
” কিন্তু আমার মনে যে ভয় ঢুকে গেল।”
ফারদিন ঠোঁট গোল করে একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,” আচ্ছা, তাহলে আর কি করার? ভেতরে এসো।”
মেহেক সাথে সাথেই ভেতরে ঢুকে পড়ল। যেন এতোক্ষণ এই আদেশের অপেক্ষাতেই ছিল সে। ঘরে ঢুকেই সে সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করল,” পাখিটা কোথায় রাখবো?”
” এইটা এখনও হাতে ধরে রাখার কি আছে? ছেড়ে দাও।”
” ছেড়ে দিলে উড়ে চলে যাবে তো।”
” জানালা আটকানো আছে। যাবে না।”
ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে উত্তর দিল ফারদিন।মেহেক পাখিটাকে ছাড়তেই এটা ছটফট করে উড়তে লাগল। মনে হয় পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছে। মেহেকের দেখে হাসি পাচ্ছিল। ফারদিন লাইট নেভাতেই চারদিক অন্ধকারে ডুবে গেল। কি ভয়ংকর অন্ধকার! কিছু দেখা যায় না। শরীরের লোম পর্যন্ত না। মেহেক বলল,” লাইট নেভালেন কেন? সব অন্ধকার হয়ে গেল তো।”
” অন্ধকার ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না।”
বিছানায় সটান শুয়ে হাই তুলতে তুলতে উত্তর দিল ফারদিন। মেহেকও ওর পাশে এসে শুলো। এতো অন্ধকারের মধ্যে সে জীবনেও ঘুমায়নি। কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। ফ্যানের শা শা শব্দ ছাড়া অন্যকোনো শব্দ নেই। পাখিটাও ডানা ঝাপটানো বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছিল না মেহেকের। সে খুব সাবধানে ফারদিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল,” এইযে শুনছেন? আমার একটুও ঘুম আসছে না। আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?”
ফারদিন তো ঘুমে বেহুশ। তার গরম নিঃশ্বাস মেহেকের চোখেমুখে লাগছে। সেই নিঃশ্বাসের সাথে একটা সুন্দর সুগন্ধ ভেসে আসছে। আজকে সিগারেটের গন্ধটা নেই৷ তার বদলে আছে অদ্ভুত এক নেশা নেশা সুভাষ। মেহেকের এতো ভালো লাগছিল! মনে হচ্ছিল, এই মানুষটির পাশে শুয়ে এইভাবে সে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। হঠাৎ ঘুমের ঘোরে ফারদিন মেহেকের কোমরে জড়িয়ে ধরল। মেহেক আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল। সেই মুহুর্ত থেকে নড়াচড়া পুরো বন্ধ হয়ে গেল তার। মনে হচ্ছিল একটু নড়লেই ফারদিন তাকে ছেড়ে দিবে। সে বঞ্চিত হবে স্বর্গীয় এই অনুভূতি থেকে। খুব সন্তর্পণে মাথাটা ফারদিনের বুকের উপর রাখলো মেহেক। শুনতে পেল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ও তৃপ্তিকর শব্দটি। ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ! মেহেক যেন আর এই দুনিয়ায় নেই। হারিয়ে গেছে কাল্পনিক কোনো স্বপ্নময় জগতে। চোখের পাতা ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসতে লাগল। অজান্তেই ঘুমে তলিয়ে গেল মেহেক।
মাঝরাতে কারো ফিসফিস ডাকে ঘুম ভাঙল।” মেহেক, এই মেহেক।”
মেহেক আর্তনাদের মতো শব্দ করে বলল,” আম্মা প্লিজ, ঘুমাতে দাও।”
” মেহেক আমি ফারদিন।”
নামটা শোনামাত্রই সেকেন্ডের মধ্যে মেহেকের চোখ খুলে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসে বলল,” ও আপনি? স্যরি,স্যরি। কি হয়েছে?”
ফারদিনও উঠে বসে আছে। ঘরময় আবছা আলো। ফারদিনের ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বলছে। ফারদিন জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”
মেহেক মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না। ঘুম থেকে ডেকে তুলে প্রশ্ন করা হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছিলে কি-না।অদ্ভুত! মেহেক চোখ কচলে বলল,” হ্যাঁ। ”
” এখনও খুব ঘুম পাচ্ছে?”
” না,না, আপনি বলুন। কেন ডেকেছেন?”
ফারদিন একটু ইতস্তত হয়ে বলল,” আসলে, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। খাওয়ার মতো কিছু পাচ্ছি না। তুমি কি রান্না করতে পারো?”
মেহেক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার জবান বন্ধ হয়ে গেল। মাঝরাতের কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করছে, রান্না করতে পারো কি-না। অথচ মেহেক জীবনে ডিমভাজি পর্যন্ত নিজের হাতে করে খায়নি। ফারদিন তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। মেহেক ঢোক গিলে বলল,” অল্প অল্প পারি।”
” চলবে। আপাতত কিছু একটা হলেই চলবে। ক্ষিদের চোটে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। বাড়িতে থাকলে ফ্রীজে নিশ্চয়ই কিছু পাওয়া যেতো। কিন্তু এখানে ফ্রীজই নেই। আমি আবার রান্না করতে পারি না। আমেরিকায় মা-ই সব করতো। কখনও নিজের করে খেতে হয়নি। তাই অভ্যাস নেই। ওয়াসীম, আনজির, পূর্বিতা, ওরা খুব ভালো রান্না জানে। কিন্তু এই মাঝরাতে তো কাউকে ডাকতে পারছি না।”
” বুঝেছি। আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন? আমি আছি না? বলেন কি খেতে চান? আমি রান্না করে দিব।”
কথাটা মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল মেহেকের। সে নিজেই রান্নার কিছু জানে না। শুধু কফি বানানোটা শিখেছিল লিয়ার কাছে। তিশার সাহায্যে দাদুর জন্য মালাই চমচম বানিয়েছিল। মেহেকের রান্নার রেকর্ড এতোটুকুই। এর বেশি সে কিছু পারে না। কিন্তু ফারদিনের সামনে এখন এই সত্য স্বীকার করা অসম্ভব!
রান্নাঘরে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। ঝুড়িভর্তি ডিম আছে। ড্রামভরা চাল আছে। আর কিছু কাঁচা সবজি যেমন- বরবটি,টমেটো,গাজর,পেয়াজ,কাঁচা মরিচ আছে। এগুলো কিভাবে কাটতে হয় সেটা পর্যন্ত মেহেকের জানা নেই। জীবনে কখনও রান্নাঘরে পা না রাখা মেয়েটি মাঝরাতে বরের জন্য রান্না করতে ঘুম থেকে উঠে এসেছে! একেই বলে পরিবর্তন। ইশশ, বিয়ের আগে যদি মেহেক মায়ের কাছে একটু রান্নাটা শিখে নিতো তাহলে আজকে এই ঝামেলায় পড়তে হতো না। এখন সে কিভাবে কি করবে? মেহেকের মন চাইছে কপাল চাপড়ে কাঁদতে। মনে মনে নিজেই নিজেকে ধমকালো,” ছি মেহেক, সামান্য একটা রান্না। এইটুকুও করতে পারিস না? তুই আসলে একটা গুড ফোর নাথিং! তাহলে বড়মুখ করে বলতে গেলি কেন? এখন কিছু রাঁধতে না পারলে মান-সম্মানটা কি আর থাকবে তোর? ”
তারপর মেহেকের মাথায় হঠাৎ করেই চমৎকার বুদ্ধিটা এলো। ছোটবেলায় যখন বাড়িতে মাছ রান্না হতো, মেহেক কাঁটার ভয়ে ভাত খেতে চাইতো না। তখন আম্মা পোলাওয়ের চাল আর ডিম দিয়ে মজার একটা ডিশ রান্না করতেন। মেহেক আম্মার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্নার পুরো প্রস্তুতিটা দেখতো।আম্মা তার প্রিয় কিছু রান্না করলেই মেহেক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। শেখার জন্য না, অপেক্ষা করার জন্য। তার ধারণা ছিল অপেক্ষা করলেই রান্না দ্রুত শেষ হবে। কিন্তু এখন পোলাওয়ের চাল কোথায় পাবে? মেহেক পুরো রান্নাঘরে খুঁজেও পোলাওয়ের চাল পেল না। তবে ড্রামে বাসমতী চাল ছিল। এটা দিয়েও রান্না করা যায়। ডিনারে তারা বাসমতী চালের ভাতই খেয়েছিল। খেতে মন্দ না। কিন্তু মেহেকের ভয় লাগছে। এই চাল কি সে রাঁধতে পারবে? শেষমেষ সিদ্ধান্ত হলো রান্নাটা সে বাসমতী দিয়েই করবে। তাছাড়া অন্যকোনো উপায়ও নেই। মান-সম্মান বাঁচাতে হলে রান্না তো করতেই হবে।
মেহেক চুলায় বাসমতী চাল সিদ্ধ বসিয়ে দিল। আম্মা সবসময় যতটুকু চাল তার দ্বিগুণ পানি দিয়ে চাল সিদ্ধ বসান। মেহেকও তাই করল। তারপর বসলো সবজি কাটতে। মজার ব্যাপার হলো, রেসিপিটা রান্না করতে যা কিছু প্রয়োজন সবই এখানে আছে। মেহেক গাজর আর বরবটি টুকরো করে হালকা আঁচে সিদ্ধ করল। তারপর টমেটো,পেয়াজ আর কাঁচামরিচ কেটে ঘি দিয়ে ভেজে নিল। হালকা সিদ্ধ গাজর আর বরবটিও ঢালল মিশ্রণে। তারপর লবণ আর হলুদের গুড়া মিশিয়ে ভালোমতো নেড়ে ভাজল সবকিছু। তিনটা ডিম ভেঙে দিল। এরপর সিদ্ধ করা বাসমতী চাল পুরোটাই ভাজা সবজীর সাথে মিশিয়ে দিল। উপরে ধনেপাতা ছড়িয়ে,একটু গোল মরিচ মিশিয়ে ভালো মতো নেড়েচেড়ে তৈরী করে ফেলল তার পছন্দের খাবার। আহ! কি সুন্দর গন্ধ! খেতেও নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। মেহেক খাবার নিয়ে ফারদিনের ঘরে গেল।
ফারদিন বিছানায় হেলান দিয়ে বসে মোবাইল টিপছে। খাবারের গন্ধ শুনেই চোখ বন্ধ করে বলল,” ওয়াও,স্মেলস গুড! কি রান্না করেছো এটা?”
” ভাত, ডিম আর সবজীর মিশ্রণ। তাৎক্ষণিক কিছু মাথায় আসছিল না।”
” দেখি।”
মেহেক ফারদিনের হাতে খাবারের প্লেট দিল। ফারদিন বলল,” চামচ?”
” আচ্ছা নিয়ে আসছি।”
মেহেক এক দৌড়ে রান্নাঘর থেকে চামচ এনে দিল। ফারদিন চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগল। কোনো কথা বলছিল না। এদিকে মেহেক চিন্তায় শেষ। খাবার ফারদিনের কেমন লেগেছে বোঝা যাচ্ছে না। ভালো-খারাপ কিছু একটা তো বলবে। এমন চুপ করে থাকার মানে কি? না পারতে মেহেক নিজেই জিজ্ঞেস করল,” রান্না কেমন হয়েছে?”
” খুব ভালো। কিন্তু লবণ একটু বেশি লাগছে। ঝাল দিয়েছো নাকি?”
” কাঁচামরিচ দিয়েছিলাম। আর একটু গোলমরিচের গুঁড়াও দিয়েছিলাম।”
” হুম। এজন্যই স্পাইসি লাগছে। লবণের পরিমাণটা ঠিক থাকলেই পারফেক্ট হতো।”
মেহেকের মনখারাপ হয়ে গেল। সামান্য লবণটা পর্যন্ত ঠিক করে দিতে পারল না সে। তার ভুল আন্দাজের জন্য এতো সুন্দর রান্নাটা কি নষ্ট হয়ে গেল? ফারদিন কি তাহলে কষ্ট করে খাচ্ছে? মেহেকের মনখারাপ করা চেহারা দেখে ফারদিন হেসে বলল,” আসলে রান্না খুবই ভালো হয়েছে।”
” সত্যি বলছেন?”
” হুম। বিশ্বাস না হলে তুমি খেয়ে দেখো।”
ফারদিন চামচ দিয়ে খাবার তুলে মেহেকের মুখের সামনে ধরল। মেহেক অবাক হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই তার মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। বরের হাত থেকে খাওয়ার সুযোগ কি মিস করা যায়? সে এক চামচ খেল। সত্যিই লবণ বেশি হয়েছে। হালকা তিতকুটে স্বাদ লাগছে। কিন্তু জিনিসটা একেবারে অখাদ্যও হয়নি। ফারদিন খুব আরাম করে খাওয়া শেষ করল।
মেহেক বলল,” আরেকটু খাবেন?”
” আছে?”
” হুম। অনেক আছে।”
” তাহলে নিয়ে এসো।”
মেহেক যেই পাতে রান্না করেছিল পুরো পাতটাই তুলে আনল। এরপর ঘটলো সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনাটি। মেহেকের সামনে বসেই ফারদিন পুরো হাফকেজি চাল একাই খেয়ে ফেলল। মেহেক অবাক হয়ে শুধু দেখছিল। একটা মানুষ এতো দ্রুত কিভাবে খেতে পারে? এও কি সম্ভব? আর খাবারগুলো যাচ্ছে কোথায়? ফারদিনের পেট তো ফুলছে না। প্রথমদিকে যেমন ছিল এখনও পেট তেমনই আছে। ষাঁড়ের মতো এইভাবে খাওয়ার পরেও তার শরীরে মাংস নেই। কি আশ্চর্য না ব্যাপারটা? খাবারগুলো যায় কই আসলে?
মেহেক মনে মনে ভাবল,” এমন রাক্ষসের মতো যে হাফকেজি চাল সাবাড় করতে পারে সে তো যেকোনো সময় তোকেও গিলে খেয়ে ফেলতে পারে মেহেক! সাবধানে থাকিস।”
খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফারদিন আরাম করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মেহেককে থ্যাঙ্কিউ জানালো। ভালো খাওয়ার পর ভালো ঘুম হয়। ফারদিনের ঘুমে চোখ লেগে আসছে। এদিকে মেহেকের হঠাৎ হলুদ পাখিটির কথা মনে পড়ল। সারা ঘর খুঁজেও সে পাখিটিকে যখন পাচ্ছিল না তখন ফারদিনের কাছে এসে বলল,” এইযে শুনছেন।”
ফারদিন ঘুমের ঘোরে জবাব দিল,” হু?”
” পাখিটি কোথাও পাচ্ছি না।”
” উড়ে গেছে মনে হয়।”
” কিভাবে উড়ল? জানালা আটকানো ছিল না? ”
“দেয়ালের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে হয়তো। তাতে কি হয়েছে মেহেক? পাখি কি আটকে রাখার জিনিস? সুযোগ পেলে তো যাবেই।”
” কিন্তু পাখিটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল।”
ফারদিন কোনো উত্তর দিল না। মেহেক আবার ওকে ডাকল,” এই আপনি শুনছেন?”
” বিরক্ত করো না তো মেহেক। ঘুমাতে দাও।”
ধমকটা দিয়েই ফারদিন অন্যদিকে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মেহেক চুপচাপ হেঁটে বারান্দায় চলে এলো। তার মন একদম খারাপ হয়ে গেল। না পাখির জন্য নয়। তার প্রতি ফারদিনের উদাসীন মনোভাবের জন্য। তার যে মনখারাপ হলো এতে যেনো ফারদিনের কিচ্ছু যায় আসে না। তার কাছে ঘুমটাই বড় হয়ে গেল? সেই রাতে আর ঘুম আসলো না মেহেকের। সারারাত সে বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিল। সকালে ফারদিন ঘুম ভেঙে মেহেককে বিছানায় না পেয়ে বারান্দায় এলো। দেখলো মেহেক মেঝেতে বসে আছে চুপ করে। ফারদিন ওর পাশে বসলো।
” তোমার কি হয়েছে মেহেক? রাতে ঘুমাওনি?”
” ঘুম আসেনি।”
” কেন?”
” জানি না।”
” মনখারাপ?”
” হুম।”
” পাখির জন্য?”
” হুম। পাখিটা হারিয়ে গেছে। কোথায় গেল?”
ফারদিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা,” পাখি কোথায় গেল আমি কিভাবে জানবো বলো? আমি নিজে পাখি হলে হয়তো জানতাম।”
মেহেক কোনো উত্তর দিল না। ফারদিন তাগাদা দিয়ে বলল,” আচ্ছা বাদ দাও৷ এখন উঠো, রেডি হও। আমরা ঘুরতে যাচ্ছি তো।”
” আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। ”
” সত্যি যাবে না?”
” উহুম।”
” ঠিকাছে। তুমি তাহলে বাড়িতেই থাকো। রেস্ট নাও। প্রয়োজন হলে ফোন করো। ওহ, তোমার কাছে তো মোবাইল নেই। আচ্ছা আমিই জামাল চাচার মোবাইলে ফোন করে খোঁজ নিবো। ঠিকাছে? যাচ্ছি।”
ফারদিন বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল। মেহেকের সত্যি এবার খুব রাগ হলো। এই মানুষটা এত্তো উদাসীন কেন? মেহেক যখন বলল সে কোথাও যেতে চায় না তখন ফারদিনের কি উচিৎ ছিল না মেহেককে জোর করে নিয়ে যাওয়া? তা না করে কি বলল? বাড়িতে থাকো, রেস্ট নাও, ফোন করে খোঁজ নিবো। কি আশ্চর্য! একদম আব্বার মতো কথাবার্তা। ওহহো, মেহেক তো ভুলেই গেছিল। ফারদিনের তো এখন সুজি আছে৷ তাহলে মেহেককে তার কেন দরকার হবে? মেহেককে তো শুধু তখন দরকার যখন মাঝরাতে ক্ষিদে পাবে। আর রান্না করে দেওয়ার জন্য সুজি থাকবে না। এখন তো মেহেক ঝামেলা। মেহেককে নিয়ে ঘুরতে গেলে সুজির সাথে প্রেমটা হবে কিভাবে?
মেহেক নিজেই নিজেকে ধমকালো,” বোকা মেহেক,গাঁধী মেহেক! তুই কেন বললি যাবি না? নিজের দোষে বরকে অন্যমেয়ের সাথে প্রেম করার সুযোগ করে দিলি। তোর মতো হাবলা এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।”
মেহেকের সত্যি ওদের সাথে ঘুরতে যাওয়া হলো না। মেহেক খুব অপেক্ষায় ছিল যেন ফারদিন অন্তত আরেকবার এসে তাকে জিজ্ঞেস করে,” তুমি কি যাবে মেহেক?” কিন্তু ফারদিন এলো না। জিজ্ঞেস করলো না। মেহেকেরও যাওয়া হলো না। মনখারাপ নিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল সে।
বিকালে ঘুম ভাঙল জামাল চাচার বউ হোসনেয়ারা চাচীর ডাকে। তিনি মেহেকের জন্য একটি পাখির খাঁচা এনেছেন। খাঁচার ভেতর দুইটি পাখি একসাথে বন্দী। লভ বার্ডস। একটার রঙ হলুদ অন্যটা সবুজ। মাথা আর লেজ দুইটারই লাল। মনে হচ্ছে যেন টসটসে দুইটা পাকা আম। এতো সুন্দর! মেহেক খুশিতে হাসতে লাগল। হোসনেয়ারা চাচী বললেন একজন লোক এসে এই খাঁচাটা দিয়ে গেছে। ফারদিন অনলাইন থেকে মেহেকের জন্য এই পাখিগুলো কিনে পাঠিয়েছে। মেহেকের যেন আনন্দ আর ধরে না।সে নাচতে নাচতে পাখি নিয়ে মাঠে চলে এলো। খুশিতে ঝলমল করছিল তার চেহারা। পাখি দু’টোর নাম রাখা হলো,” মেহেক আর ফারদিন।”
চলবে