শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_24
#Writer_NOVA
পরেরদিন….
ক্লাশরুমে বসে বসে হাই তুলছি আর বিরক্তি সহকারে স্যারের দিকে বারবার তাকাচ্ছি। ক্লাশ টাইমও শেষ হয় না। একবার ঘড়ির দিকে তাকাই তো আরেকবার স্যারের দিকে। বিজনেস ম্যাথ ক্লাশ চলছে। এই স্যারটা অতিরিক্ত কথা বলে। যার ফলে বেশিরভাগ সময় এর ক্লাশ করি না। পড়ার থেকে অপ্রাসঙ্গিক কথা বেশি। এই সাবজেক্টের কিছু বুঝি না। কোথায় ভালো করে বুঝিয়ে দিবে। তা না করে অযথা বকরবকর করে। পাশে তাকিয়ে দেখি শারমিনও আমার মতো বিরক্ত। আগামীকাল মাসিক টিউটোরিয়াল পরীক্ষা। কোন প্রস্তুতি নেই। এতদিন ভুলেও বই ধরা হয়নি। আজ গিয়ে একটু বই খুলতেই হবে। নয়তো পাস নাম্বারও উঠানো যাবে না। পাশ থেকে শারমিন মৃদুস্বরে বললো,
— ঐ নোভা আর কতক্ষণরে? এত বকবক তো ভালো লাগে না। এই স্যার একটু বেশি কথা বলে। আমার সহ্য হইতাছে না।
—বোইন কিচ্ছু করার নাই। এই বকবক সহ্য করতে হইবো। পারতাছি না শুধু আমি পেছনের দরজা দিয়ে দৌড় দিতে। বিশ্বাস কর কালকে টিউটোরিয়াল পরীক্ষা না হলে এই স্যারের ক্লাশ আমি ভুলেও করতাম না। আমার মাথাব্যথা উঠায় দিতেছে।
— আজকে ঘন্টাও দেয় না। সময়ও যায় না। অসহ্য লাগতাছে। উনি উনার গ্রামের বাড়ির পেঁচাল শুরু করছে। বিজনেস ম্যাথের সাথে গ্রামের বাড়ির কি সম্পর্ক বলতো?
— বোইন, বিশ্বাস কর আমাকে যদি এখন অপমান করে রুম থেকে বের করে দেয় না তাও খারাপ লাগবো না। যতটা উনার বকবকানিতে লাগতেছে।
— চুপ কর। আমাদের দিকে একবার তাকাইছে। আরেকবার দেখলে সত্যি অপমান করে বের করে দিবে।
— আমার ঘুমে ধরতাছে। চোখ দুটো বুজে আসছে।
— তাহলে ঘুমা। তাও কথা বলিস না।
কি আর করার চুপ হয়ে গেলাম। চোখ, মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ক্লাশে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মন তো বসে না। আমার ঘুমে ধরতাছে। সকালের এন্টিবায়োটিকগুলো বোধহয় এখন কাজ শুরু করে দিছে। চোখ দুটো টেনে মেলতে পারছি না। ঘুমের রেশ কাটাতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। দোতলার দক্ষিণ পাশের জানালা থেকে নিচের সবকিছু দেখা যায়। পূর্ব দিকে এক বিশাল পুকুর, পশ্চিম দিকে আরেকটি তিন তালার ভবন। আবার উত্তর দিকে আরেকটি দোতলা ভবন। এই তিনদিকের ভবনে মাঝখানে মাঝামাঝি সাইজের এক বাগান। সেই বাগানের মধ্য বিশাল এক বকুল ফুলের গাছ আছে। সেখানে গোল করে টাইলসে ঘেরা দিয়ে বসার জায়গা করে দিয়েছে। সেখানে সবসময় কিছু না কিছু ছেলে-মেয়েদের বসে আড্ডা দিতে দেখা যায়। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। এইচএসসি ১ম বর্ষের কতগুলো প্রাণোচ্ছল ছেলে-মেয়েগুলো একসাথে বসে হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছে। আমাদের সাতজনের সেই কলেজ টিমটার কথা মনে পরে গেলো। আমরাও কত আনন্দ করতাম। হঠাৎ সেখানে মোবাইল হাতে নিয়ে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার বুকটা ধুক করে উঠলো। সে মোবাইলটা হাতে ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে খুব সম্ভবত কিছু একটা খুঁজছে। যার জন্য নিজে যেচে অসুখ ডেকে আনলাম। চারদিন কলেজে এলাম না। দুইদিন হসপিটালে ভর্তি ছিলাম। আবার সে এখানে? একি আমাকে সুস্থ থাকতে দিবে না? ঘৃণাভরা চোখে সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। রাগে শরীরটা মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। আমার চেহারার অবস্থা দেখে শারমিন আমার এক বাহু ধরে ঝাঁকি মেরে বললো,
— এই কি হয়েছে তোর? তুই এমন করছিস কেন?
— কিছু হয়নি।
— কিছু তো একটা হয়েছে। মনে হচ্ছে কারো ওপর রেগে আছিস। বল না কি হয়েছে?
— ক্লাশ শেষ হতে আর কয় মিনিট বাকি আছে?
— এখুনি বেল দিয়ে দিবে।
— তারপর কি ক্লাশ?
— এক ক্লাশ গ্যাপ। তারপর একটা ক্লাশ আছে।
— তাহলে কফি হাউসে যাবো।
— আচ্ছা। কিন্তু বললি না কি হয়েছে?
আমাদের কথার মধ্যেই ঘন্টা বেজে উঠলো। আমি সবকিছু গুছিয়ে সাইড ব্যাগে ভরতে ভরতে বললাম,
— কফি হাউসে চল। তারপর বলবো।
— ওকে।
স্যার ক্লাশ থেকে বের হতেই আমরাও বের হয়ে গেলাম। বের হয়ে বড় করে একটা হাফ ছাড়লাম। এতক্ষণ জীবনটা অসহ্যকর ছিলো। এখন শান্তি আর শান্তি। তন্বীদের রুমে গেলাম। তন্বী বললো ওর নাকি একটা ক্লাশ আছে। তাই আমাদের সাথে আসতে পারবে না। আমরা দুজন তাই ভবন থেকে বেরিয়ে এলাম। কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম। মূলত শারমিন কথা বলছিলো। আর আমি ওর সাথে হু হা হুম বলে সায় দিচ্ছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
— রাই !!!
নামটা শুনে এক মিনিট থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কত দিন পর সেই চিরচেনা ডাকটা। তবে বৈইমান মানুষের মুখে। আমি পিছু ঘুরলাম না। দ্রুত পা চালাতে চালাতে শারমিনকে বললাম,
— শারমিন জলদী চল এখান থেকে।
— কেন?
— বেশি কথা বলিস না তো। যা বলেছি তা কর।
শরমিন কথা বাড়ালো না। আমরা দ্রুত পায়ে গেইট পার করে ফেললাম। আড়াল থেকে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থুম মেরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
💖💖💖
— এই যে মিস টিডি পোকা, এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখা হচ্ছে? তাও আবার উঁকি ঝুঁকি মেরে?
আচমকা কানের সামনে এনজিও সংস্থার কন্ঠ পেতেই চমকে পেছনে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি এনাজ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। তাকে এই সময় কলেজ গেইটের সামনে দেখে ভীষণ অবাক হলাম।আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি এখানে কি করছেন?
— আমি আগে প্রশ্ন করেছি। তাই আগে আমার উত্তরটা আশা করছি।দয়া করে আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন।
— উঁকি ঝুঁকি মেরে কিছুই দেখছি না।
— আমি তো দেখলাম তুমি দেখছো।
— একটুও না। আপনি বেশি দেখছেন।
আমাদের কথার মাঝে তওহিদ ভাইয়া এসে হাজির হলো।এক হাতে এনাজের গলায় জড়িয়ে ধরে, শারমিনের দিকে তাকিয়ে তওহিদ ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— তা ক্লাশ না করে কোথায় যাচ্ছো নোভা?
— আমাদের এক ক্লাশ গ্যাপ আছে। তাই ভাবলাম কফি হাউস থেকে ঘুরে আসি।
— চলো তাহলে আমরাও যাই।
— আপনাদের কেন নিবো?
ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করতেই তওহিদ ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— আমাদের কেন নিবে তা জানি না। তবে আমাদের না নিলে তোমার খালাতো ভাইয়ের কাছে বিচার দিবো। বলবো নোভা ক্লাশ না করে কফি হাউসে ঘুরতে যায়।
— ইস, আমি যেন তায়াং ভাইয়াকে ভয় পাই। বলুন গিয়ে আমি কি ভয় পেলাম নাকি?
— আচ্ছা তাই নাকি? তাহলে এখুনি বলছি। মোবাইলটা আবার কোথায় রাখলাম?
এনাজ মুচকি হেসে তাওহিদ ভাইয়াকে বললো,
— আরে বুঝিস না কেন আমাদের নিলে তো ওদের ভাগে কম পরে যাবে। তাই নিতে চাইছে না। সমস্যা নেই, চলো আমরাই ট্রিট দিবো।
আমি মুখ ভেংচে বললাম,
— আমরা ওতো নিচু মন-মানসিকতার মানুষ নই। আপনারাই এমন তাই আপনাদের এমনটা মনে হচ্ছে।
তওহিদ ভাইয়া পকেট থেকে মোবাইল বের করে সত্যি
সত্যিই তায়াং ভাইয়াকে কল দিলো। এখন ভাইয়ার কাছে বিচার দিলে ভাইয়া তো সত্যি বিশ্বাস করে নিবে। আর আমাকে আচ্ছা করে ধোলাই দিবে।তাই চট জলদী নরম সুরে তওহিদ ভাইয়াকে বললাম,
— ভাইয়া চলেন না। একসাথেই কফি খেয়ে আসি। এসব কথা আবার তায়াং ভাইয়াকে জানানোর কি দরকার? আমরা আমরাই তো। আপনারা ট্রিট দিবেন আমরা কি মানা করতে পারি বলুন।
তওহিদ ভাইয়া কানের থেকে মোবাইল সরিয়ে কল কেটে দিয়ে ভিলেন টাইপের হাসি দিয়ো বললো,
— এই তো লাইনে আসছো🤓।
এনাজ গলা মিটমিট করে হেসে বললো,
— তা চলো সবাই।
সবাই একসাথে কফি হাউসের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এখান থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই বিশাল বড় একটা কফি হাউস। ভেতরে ঢুকে কোণার দিকে এক টেবিলে বসলাম। রাস্তায় এনাজ ও তওহিদ ভাইয়ার সাথে শারমিনের পরিচয় করে দিলাম। কফি হাউসের ভেতরে কাপলদের জন্য যে দিকটা আছে সেদিকে নিয়ে এলো।ছোট একটা টেবিল। আর মুখোমুখি দুটো করে চেয়ার। ভেতরে ডিম লাইটের আলোয় রোমান্টিক একটা পরিবেশ। সাথে মৃদু শব্দে সাউন্ড বক্সে রোমান্টিক গান বাজছে। আমাদের বয়ফ্রেন্ড নেই বলে কখনো এদিকটায় আসা হয়নি। সচারাচর বাইরে বসতাম।
এদের হাব-ভাব ভালো ঠেকছে না। এখানে আনার মানে কি? আমি আর শারমিন বসতে চাইলেই এনাজ দ্রুত এসে চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি বসে পরলো। এর কান্ড দেখে আমি বেকুবের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। শারমিনকে তাই বাধ্য হয়ে দুই টেবিল পর তওহিদের সাথে বসতে হলো। এনাজ ওয়েটারকে কফি অর্ডার দিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর একগালে হেসে বললো,
— নিশ্চয়ই আমাকে তোমার মুখোমুখি এভাবে বসতে দেখে অবাক হয়েছো?
— না হওয়ার মতো কোন কারণ দেখছি না।
— আসলে তওহিদ সেদিন তোমার বান্ধবীকে দেখে পছন্দ করেছে। তাই আমাকে আগের থেকে বলে রেখেছে ওর সাথে একটু কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে। তাই এমনটা করলাম।তাছাড়া তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।
এনাজের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলাম। যদিও আমি তওহিদ ভাইয়ার বিষয়টা একটু আচ করতে পেরেছিলাম। তবে বিষয়টা যে এতদূর গড়াবে তা বুঝিনি।যার কারণে একটু বেশি অবাক লাগছে। এনাজ একবার মাথার পেছনটা চুলকে বোকা বোকা ফেস করে বললো,
— আসলে আমি সেদিনের বিষয়টার জন্য লজ্জিত। এক্সিডেন্টলি যে এমনটা হয়ে যাবে আমি বুঝতে পারিনি।
আমি মাথা নিচু করে মিটমিট করে হাসলাম। বেচারা এখনো লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জা পেলে তার নাকের ডোগা মেয়েদের মতো হালকা লাল হয়ে যায়। যেটা আমি আজ খেয়াল করলাম। হালকা ডিম লাইটের আলোয় থাকলে বুঝতাম না। এনাজ এদিকের জানালা হালকা খুলে দিয়েছে বলে অনেকখানি আলো প্রবেশ করেছে।সেই আলোতে তার লাল হওয়া নাকের ডোগা দেখে আরেকদফা মিটমিট করে হাসলাম।তাকে আরো লজ্জা দেওয়ার জন্য আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— কোন বিষয়টা?
এনাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি ভুলে গেছো টিডি পোকা?
— হ্যাঁ, মনে করে দিন।
— ঐযে এক্সিডেন্টটা
— কোন এক্সিডেন্ট?
আমাকে মিটমিট করে হাসতে দেখে এনাজ চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,
— তুমি আমাকে লজ্জা ফেলতে এমনটা করছো তাই না? আমি কিন্তু তোমার চালাকি ধরে ফেলেছি।
তার কথায় আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। অনেক কষ্ট করে হাসি চেপে রেখেছিলাম। এই প্রথম দেখলাম কোন ছেলে এসব বিষয় নিয়ে লজ্জা পাচ্ছে। তাই তাকে লজ্জা দিয়ে আরেকটু মজা নিতে চেয়েছিলাম। আমার হাসির শব্দে আশেপাশের টেবিলের কাপলরা বিরক্তি নিয়ে তাকালো। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে মুখে হাত দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম।তারপর নিচু স্বরে এনাজকে বললাম,
— আরে বাদ দিন তো এই টপিক। আমি জানি সেটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে। তাই তো চুপচাপ আছি।
— Thanks Allah. আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম। তুমি না জানি কি মনে করো। তোমার সামনে আসতেও আমার ভীষণ লজ্জা করছিলো। অনেক কষ্টে মনটাকে স্থির করে আজ তোমার মুখোমুখি হয়েছি।
— ইস, কি লজুকলতা😁! হয়েছে এখন স্বাভাবিক হোন। এতো লজ্জা পেতে হবে না।
এনাজ মাথা নিচু করে পেছনের চুলগুলো বেশ কয়েকবার ঝাড়া দিলো। সম্ভবত লজ্জা রাঙা মুখটা লুকালো। ছেলে মানুষ নাকি এতো লজ্জা পায়। যা দেখে আমারই হাসি আসছে। ওয়েটার কফি দিয়ে গেলো। আমরা দুজন কফির কাপে চুমুক দিলাম। আড় চোখে তওহিদ ভাইয়া ও শারমিনের টেবিলের দিকেও তাকালাম। তওহিদ ভাইয়া একা একা বকবক করছে। শারমিন চুপচাপ তা সহ্য করছে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে এনাজ বললো…..
#চলবে