#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
১৯.
সপ্তাখানেক কেটে গেছে। এর মাঝে মেঘালয়ার ভেতরে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন এসেছে। মাঝেমধ্যে তাকে দেখতে টুকটাক খুশি লাগে, আবার বসে যায় মগ্ন হয়ে কিছু ভাবতে।
ইরাজের কিছু কাজ পড়েছে রাজশাহীতে। সে কাল সকাল সকাল রওনা হয়ে যাবে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। বারান্দার সিঙ্গেল সোফাটির ওপর বসে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কিছু কাজে ব্যস্ত সে। মেঘালয়া এই রাত করে রুমের সাফ সাফাইয়ের কাজে লেগেছে। বিছানাটা পরিপাটি করে গুছিয়ে সোফার এলোমেলো কুশন গুলো ঠিক করে রাখতে শুরু করল। সে সময় দরজায় টোকা পড়ল। মেঘালয়া তাকাল সেদিকে। এ রুমে তো কেউ আসে না। আনতারা খানম তো মোটেই না, তাহলে কি বাবাই এসেছে? দ্রুত গলা উঁচিয়ে বলে উঠল, “আরে নব ঘুরিয়ে ঢুকে পড়ো। আবার অনুমতি চাইছো?ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়ার কথায় হাসলেন। এসে বসলেন বিছানার ওপরে। মেঘালয়া এগিয়ে গিয়ে পাশে বসতে বসতে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে বাবাই? গরীবের বাড়ি হাতির কদম পড়ল যে!ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব শব্দ করে হাসলেন এবার। বললেন, “তাহলে তুই গরীব, আর আমি হাতি?ʼʼ
“আমি গরীব ঠিক আছে, তবে তুমি হাতি নও।ʼʼ
“তবে বললি যে!ʼʼ
“আরে কথার কথা ছিল। এখন বলো কী ব্যাপার?ʼʼ
“ব্যাপার তো সাংঘাতিক রে!ʼʼ
“বাবাই, শুধু শুধু সাসপেন্স ক্রিয়েট না করে জলদি বলো কি হয়েছে।ʼʼ
“তুই, কাল ইরাজের সঙ্গে যাচ্ছিস।ʼʼ
“বাবাই, তোমার প্রেসার বেড়েছে নাকি? একটু পানি ঢালব মাথায়?ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, “আমার প্রেসার লো।ʼʼ
“তুমি তোমার ওই ঘাঁড় ত্যাড়া ছেলের সাথে আমায় যেতে বলছো? রাস্তায় মেরে গুম করে দিয়ে, এসে বলবে, আমি হারিয়ে গেছি।ʼʼ
“কিছুই বলবে না। তুই তৈরী থাকবি।ʼʼ
“না বাবাই, তুমি অন্য যেকোন কিছু বলো মেনে নিচ্ছি। এটা বাদ।ʼʼ
“সব বাদে এটা।ʼʼ বলেই উঠে দাঁড়ালেন ইমতিয়াজ সাহেব।
মেঘালয়াও দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি দিন দিন নাছোড়বান্দা হয়ে যাচ্ছ, বাবাই!ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব সামনে এগোতে এগোতে বললেন, “আগেও ছিলাম।ʼʼ মেঘালয়াকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন এক প্রকার পালিয়ে। মেঘালয়ার যে যাওয়ার মত নেই তা না। সে আগে পরেই ভ্রমন প্রিয়। তবে সমস্যা হলো, যার সাথে যাবে তাকে নিয়ে। সে তো একটা, রাক্ষস!
—
সকালে ইরাজকে ডেকে তুললেন ইমতিয়াজ সাহেব। মেঘালয়া তখন গোসল নিচ্ছে বাথরুমে। ইরাজ জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে, ড্যাড! তুমি এখানে কেন?ʼʼ
“মুখ সামলে কথা বল, রাজ! বাড়ি আমার, তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস আমি এখানে কেন?ʼʼ
বাবার কথায় যে রস ছিল তা বুঝতে ভুল হয়না ইরাজের। ভ্রু কুঁচকে বলল, “মনে রঙ লেগেছে নাকি তোমার, ড্যাড!ʼʼ
“এই এসব ড্যাড, ফ্যাড ডাকবি না তো। যতসব ঢং। আমাদের বাপদের আমরা ‘আব্বাʼ বলে ডাকতাম।ʼʼ
ইরাজ চোখ উল্টে, হা করে নিঃশ্বাস নিলো। বলল, “বলো কী সমস্যা?ʼʼ
“মেঘালয়া যাবে তোর সাথে?ʼʼ
“আব্বু! তোমার শরীর খারাপ নাকি?ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব মুখ থমথমে করে বললেন, “এমনিতে তো দেখছি দুজনের মিল ভালো। অথচ বাস্তবে নেই কেন?ʼʼ
তারপর বুঝানোর মতো বললেন, “দেখ, মেয়েটা রেজাল্ট নিয়ে এখনও বিষন্ন। তোর তো অল্প কিছুক্ষণের কাজ। সঙ্গে গেলে একটু ঘুরে আসলে, মন ভালো থাকবে। হেলালের আমানত মেঘা। আমাদের তো দায়িত্ব ওকে ভালো রাখা।ʼʼ
ইরাজ উঠে দাঁড়াল। বলল, “সকাল সকাল নীতির বাণী না শুনিয়ে, নিজের কাজে মনোযোগ দাও তো, ড্যাড। আহা কী জ্ঞানের কথা! যেন আমরা কেঁদে-কেটে আমানতটা কোলে করে তুলে এনেছি!ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব কপট রাগী মুখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। এ কি ছেলে তিনি পয়দা করেছেন!
—
ইরাজ বসার রুমে বসে বিশ মিনিটের মতো অপেক্ষারত। মেঘালয়া তৈরী হচ্ছে। ইমতিয়াজ সাহেব নরম কথায় ভিজিয়ে বসিয়ে রেখেছেন ইরাজকে।
প্রায় আধাঘন্টার মাথায় নেমে আসল মেঘালয়া। ইরাজের চোখ সিঁড়িতে যেতেই দৃষ্টি থেমে গেল সেদিকে। ভ্রুটা সামান্য কুঞ্চিত করে চেয়ে রইল। মেঘালয়া মেজান্টা ও আকাশী রঙের মিশ্রণে সাজানো একটি জামদানী কাতান শাড়ি পড়ে নেমে এসে দাঁড়াল নিচে। মাথাটা ঝুঁকিয়ে শাড়ির কুচি ধরে নেমেছে সিঁড়ি দিয়ে। নিচে নেমে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে চাইল। ইমতিয়াজ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনে আওড়ালেন, “মাশা-আল্লাহ!ʼʼ
ইরাজের ভ্রুর সাথে সাথে এবার কপাল জড়িয়ে এলো। বেশ ভালোই মেকাআপ করেছে মেঘালয়া। খুব বেশি না হলেও, কমও বলা যায় না! মাঝারী চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দেওয়া। মেঘালয়ার চুলগুলো সামান্য কুঁকড়ানো। তা খুব একটা সেভাবে যেহেতু বোঝা যায় না— দেখতে খুব আকর্ষনীয় লাগে। থ্রি কোয়ার্টার হাতার মেজেন্টা রঙা ব্লাউজের ওপর আকাশী শাড়ির আচল পড়ে আছে। হালকা গহনা, সাথে টুকটাক সাজ। খুব স্নিগ্ধ লাগছে মেঘালয়াকে দেখতে। ওকে দেখে ইরাজ আর নজর ফেরায় নি। বুকের ভেতরে কোথাও একটা লাফালাফি লক্ষ্য করছে সে। আজ মেঘালয়াকে একদম তার পরিচিত ছোট্রো কিশোরী লাগছে না। যুবতী নারী, শাড়িতে! পুরুষ টিকবে কী করে! ইরাজ মেঘালয়াকে আজ যেন প্রথমবার এমনকি বাবার সম্মুখে দাড়িয়ে এভাবে খুঁতিয়ে দেখল। আচমকা নজর আটকা পড়ল মেঘালয়ার বুকের ওপরে ফর্সা গলায়। সেখানে চিকন এক পেন্ডেন্ট ঝুলছে। শাড়ির আচল গিয়েছে গলার খানিক নিচের অংশকে পেচিয়ে। কি যেন হয়ে গেল ইরাজের। দ্রুত চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। এলোমেলো চোখে তাকাল চারদিকে।
মেঘালয়া বরাবরই একটু সাজগোজের দিকে আগ্রহী ছিল। যেটা ইরাজের জন্য করতে পারত না আগেও। স্কুলের ফাংশন অথবা কোথাও যাওয়ার সময়েও ইরাজের কটুক্তির ভয়ে সাজতে পারত না মেঘালয়া। আজও সেই ইরাজই তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এ ইরাজের অবশ্য তার প্রতি আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবুও ইরাজই তো!
ইরাজ মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে দাড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল, “আমার সুন্নতে খৎনার অনুষ্ঠানে যাচ্ছিস? এমন মূর্তি সেজেছিস কেন!ʼʼ
এমন একটা কথায় মেঘালয়া খিঁচে চোখ বুজে ফেলল। ইমতিয়াজ সাহেব জিহ্বা কামড়ে ধরলেন। এই ছেলের কী কোনদিন মতিগতি ভালো হবে না! মেঘালয়া কিছু সময় পর চোখ তুলে ইমতিয়াজ সাহেবের দিকে করুণ মুখে তাকাল। তিনি ঘাড় নাড়িয়ে আশ্বাস দিলেন। ইরাজ ভারী পায়ে বেরিয়ে গেল বাইরের দিকে।
মনে মনে আওড়াল, আমি যেভাবে আটকে গেছিলাম, রাস্তার লোকজনও সেভাবেই দেখবে! ভাবনাটা মাথায় আসতেই আবারও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ওভাবেই গিয়ে গাড়িতে বসল।
মেঘালয়ার ইমতিয়াজ সাহেবের কাছে এসে মুখ ফুলিয়ে বলল, “এই ক্যাকটাসের সাথে তুমি আমায় পাঠাচ্ছ, বাবাই! আল্লাহ জানে আজ ঘটে কী আছে?ʼʼ
ওভাবেই গটগটে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যেতে যেতে কপট ক্ষোভ ঝারল, “ছোটো বেলা থেকে জালাচ্ছে। কোন কিছুতেই শান্তি দিল না!ʼʼ
আনতারা খানম ইচ্ছে করে রান্নাঘরে বসে ছিলেন এতক্ষণ। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নির্বাক চেয়ে রইলেন মেঘালয়া হেঁটে অগ্রসর হওয়ার দিকে।
গাড়িতে মৃদূমন্দ বাতাসে মেঘালয়ার ঝিম ধরে যায়। চোখটা বুজে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছে। ইরাজ ড্রাইভ করতে করতে মেঘালয়ার কোন সারা শব্দ না পেয়ে একবার তাকাল।
আবারও সেই এলোমেলো অনুভূতি। আটকে গেল মেঘালয়া গলায়। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দেওয়া মেঘালয়া। বড্ড আদুরে লাগছে মেঘালয়াকে দেখতে। তড়াক করে নজর সরিয়ে সামনে তাকাল ইরাজ! স্টিয়ারিং থেকে এক হাত সরিয়ে হা করে হাতটা মুখে চেপে ধরে ঘাম মোছার মতো করে নাড়ল। জোরে জোরে শ্বাস নিলো ইরাজ। এই অনুভূতির সাথে ইরাজ কোনদিন আবারও পরিচিত হতে চায়নি। এখনও চাইছে না। তবে মস্তিষ্ক যেন এর ঘোর বিরোধে নেমেছে। এতদিন মেঘালয়াকে দেখেছে, এক ঘরে থেকেছে। তবে কোনদিন মেঘালয়ার প্রতি এমন অনুভূতিদের সারা পায়নি সে। বরং মেঘালয়াকে দেখলেই বুকের ব্যথারা নড়ে চড়ে উঠত। আজ অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করল ইরাজ নিজের মাঝে! যা সে বুঝেও বুঝতে চায় না, অনুভব করেও চায় সে অনুভূতিকে মিথ্যা প্রমান করতে।
—
নদীর ঘোলাটে পানি, বালিময় সেই নদীর তীর। আশেপাশে লোকজনের সমাগম যথেষ্ট। বিকেলের কয়েক দণ্ড পেরিয়েছে। সূর্য সেই নদীর দিগন্তেই যেন নিজেকে নদীর পানির আড়ালে লুকোতে ব্যস্ত।
মেঘালয়া গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। রাজশাহী জেলার পদ্মার পাড়। ইরাজের কাজ শেষ হয়েছে পাঁচ মিনিটে। এক ক্লাইন্টের সঙ্গে লেনদেনের ব্যাপারটা মেটাতে এসেছিল ইরাজ। মেঘালয়া ভেবেছিল এবার হয়ত ফিরে যাওয়ার পালা। রাস্তাঘাট তো তার চেনা নয়। একসময় ইরাজ এসে গাড়ি থামাল এই নদীর পাড়ে। মেঘালয়া সব ভুলে অভিভূত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল নদীর পানিতে চিকচিক করা অস্তমিত সূর্যরশ্মির দিকে। প্রতিটি ঢেউয়ে ঢেউয়ে সূর্যের আলো, স্রোতের বাঁকে বাঁকে কমলা-লাল প্রভা।
আস্তে আস্তে হেঁটে সে পানির দিকে এগিয়ে যায়। উঁচু হিলের চোখা প্রান্তটি বালুর মাঝে গেঁড়ে যাচ্ছে, হাঁটার তালে আবার উঠে আসছে। দারুন উপভোগ্য লাগছে ব্যাপারটা মেঘালয়ার কাছে। নদীর দিক থেকে তেড়ে আসা বাতাস মেঘালয়ার লম্বা শাড়ির আচল পতাকার মতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। সাথে চুলের বেপরোয়া জ্বালাতনকেও এই মুহূর্তে মেঘালয়া চরম উপভোগ করছে।
নদীর এই অসামান্য রূপ দেখে, নদীকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় ওর, ‘তুমি এত স্নিগ্ধ আর সুন্দর কেন? তোমার কী কোন বিষাদ নেই? তোমার যে কোন বাঁধা নেই! এত রুপ, এত মাধুর্য আর প্রবাহমান জলরাশির অহংকারে নিশ্চয়ই তুমি সর্বদিকে সমৃদ্ধ! একটু ধুয়ে দেবে আমার আমার বিষাদগুলো, তোমার বুকে খেলে বেড়ানো ওই টলমলে জলে?ʼ
আচমকা নিজের পাশটা ফাঁকা লাগল। বেরিয়ে এলো চট করে নদীর মুগ্ধতা থেকে। হন্য হয়ে চারদিকে তাকাতেই দেখল পেছন থেকে ইরাজ হেলেদুলে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। হাতের দিকে তাকিয়ে মেঘালয়া বিষ্মিত চোখে চেয়ে রয়। ততক্ষণে ইরাজ এসে কাছে দাঁড়াল। মেঘালয়া একদৃষ্টে চেয়ে আছে ইরাজের হাতে থাকা আকাশী আর গোলাপি রঙা রেশমী চুড়ির দিকে।
ইরাজ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “হাত এগিয়ে দে।ʼʼ
মেঘালয়া ঠিক ঠাহর করতে পারেনি কথাটা। সে বিষ্ময় কাটাতে ব্যস্ত। ইরাজ হুট করে মেঘালয়ার বাঁ হাত চেপে ধরে নিজের দিকে আনল। বাঁ হাতের ওপর শাড়ির আঁচল মেলে আছে। তা খানিকটা তুলে, দু রঙের চুড়িগুলো খুব যত্নে রঙ মিলিয়ে সাজাতে থাকল। মেঘালয়ার বিষ্ময় কাটার বদলে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে এবার। চুড়িগুলো মেলাতে মেলাতে গম্ভীর স্বরে বলল ইরাজ, “শাড়ি পড়েছিস গায়ে, আর হাতটা বিধবা বানিয়ে রেখেছিস?ʼʼ
এরকম একটা কথাও কেউ এমন ভারী কণ্ঠে বলে! তবুও শুনতে অদ্ভুত লাগল মেঘালয়ার। একটু মুখ বিকৃত করে উঠল। মুখে অস্পষ্ট স্বরে একটু আর্তনাদ করে উঠল। চুড়িগুলো হাতে পরিয়ে দিল ইরাজ। চুড়ির মাপ পারফেক্ট, যে জন্য হাতে ঢুকাতে গিয়ে একটু ব্যথা পেয়েছে মেঘালয়া।
ইরাজ বলল, “তোর শাড়ির এই রঙটা কী? একটু গাঢ় বেশি। এমন রঙা চুড়ি পেলাম না। এই হালকা গোলাপিটাই ছিল।ʼʼ
মেঘালয়া অস্পষ্ট উচ্চারণ করে, “মেজান্টা!ʼʼ এরপর আনমনে হাত ঝাঁকিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে দুর্বোধ্য মিটিমিটি হাসি। অতিরিক্তই সুন্দর বলে মনে হলো চুড়িগুলো! আসলেই চুড়ি সুন্দর, নাকি চুড়িগুলোর পাওয়ার অনুভূতিটা জটিলতম সুন্দর! মেঘালয়া জানে না! ইরাজ ওকে ছেড়ে ততক্ষণে নদীর কিনারায় গিয়ে হাত পকেটে গুজে দাঁড়িয়েছে। তখনই চোখে পড়ল মেঘালয়ার, একটি ছোট্রো ছেলে চুড়ি ভর্তি আলনা নিয়ে এদিক সেদিক নদীর পাড়েই ঘুরছে। তার চোখে পড়েনি আগে। তবে ইরাজ দেখল কখন? আর কিনতেই বা গেল কখন!
মেঘালয়া সেদিক থেকে নজর ঘুরিয়ে ইরাজের দিকে তাকায়। পেছন থেকে দেখল টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নজর নিবদ্ধ নদীর শেষে ওই দিগন্তের ধোঁয়াশায়। চোখ কুঁচকে নিচের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে ফেলল। আবার সামলে নিলো নিজেকে। ইরাজের পাশে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়াল।
কিছুক্ষণ পর ইরাজ নদীর বুকে নজর আটকে, হঠাৎ মুখ খুলল। অদ্ভুত অভিব্যাক্তিতে স্বগতক্তি করল, “বুঝলি মেঘ! জীবনটা এই প্রবাহমান নদীর মতো। যে স্রোত হারিয়ে যায় নদীর ধারাবাহিকতায়, তা ফিরে আসে না আর! নদী সেই শূন্যতার হাহাকারে আবারও ফুলে ফেঁপে ওঠে। তর্জন গর্জন করে দু কূল ভাসায়। নদীর এই আর্তনাদকে লোক সাধারণত জলোচ্ছাসের নাম দেয়।ʼʼ
মেঘালয়া চমকে ওঠে। সে না কিছুক্ষণ আগে নদীকে সর্বোচ্চ সুখী আর সুন্দর বলে গেল! এই স্নিগ্ধ নদীরও হাহাকার আছে! সেই পানিতে তার সমস্ত বিষাদ ধুয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে নদীকে মেঘালয়া। নদীর টলমলে পানির দিকে আবিষ্ট নজরে চেয়ে নেশাগ্রস্থের মতো জিজ্ঞেস করল, “আর যে স্রোতগুলো নদীর মাঝে, নদীর বুকে থেকে যায়, তারা কী নদীর আপন?ʼʼ
ইরাজ হাসল মনেহয় একটু! মেঘালয়া নদীর পাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে মৃদূমন্দ ঢেউ এসে কিছু কিছু বালু ধুয়ে নিয়ে মিশিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্যে।
“আপন বলতে কী বুঝিস তুই?ʼʼ
মেঘালয়া মৃদূ হেসে জবাব দিল, “বুঝিনা।ʼʼ
ইরাজও একই ভাবে বলে, “আমিও।ʼʼ
সন্ধ্যা নামবে প্রকৃতিতে খুব শীঘ্রই। ইরাজ মেঘালয়াকে তাড়া দিল, “চল হাঁটি।ʼʼ
মেঘালয়া ইরাজের আগে হাঁটছে। শাড়ির আঁচল বড়ো হওয়ায় তা মাটি ছুঁয়ে মেঘালয়ার সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে ইরাজ কপাল কুঁচকে, চট করে আঁচলটা হাতে তুলে নিলো।
আকাশী রঙা শাড়িতে শোভা পাচ্ছে এক যুবতী, সে হাঁটছে সম্মুখে, তার পেছনে তারই শাড়ির আঁচল তুলে ধরে এগিয়ে চলেছে বিরক্তিতে বুদ হয়ে ওঠা এক পুরুষ। এ দৃশ্য মনে হয় সেখানে উপস্থিত সকলেই বেশ আগ্রহের সঙ্গে উপভোগ করল। ইরাজ ধমকে উঠল, “নদীর পাড় ঝাড়ু দেওয়ার টেন্ডার নিয়েছিস? শাড়ির আঁচল ঠিক রাখতে পারিস না, শাড়ি পড়তে বলেছিল কে?ʼʼ
মেঘালয়া ছোটো ছোটো চোখ করে পেছনে ফিরে আঁচলটা নিলো ইরাজের হাত থেকে। মুখে ভেঙচি কাটল গোপনে।
মাগরিবের আজানের পর সন্ধ্যার চাদরে ঢাকা পড়া নদীর কিনারা যেন সেজে উঠল আরেক রূপে। মেঘালয়া ফুসকা, ঝালমুড়ি, কুলফি মালাই, এরকম বহুকিছু খাওয়ার পরে খেল আবার কামরাঙা মাখা। তাতে ঠোঁট মুখ লাল করে ফেলেছে ঝালে। খাওয়ার সময় ঝাল লেগেছিল বটে, তবে তাতে পরোয়া করার সময় কোথায় মেঘালয়ার। ইরাজ শুধু ভ্রু কুঁচকে দেখছে তা। শেষে খাওয়া থামানোর পর সব ঝাল এসে হানা দিল যেন এবার। মেঘালয়া ঘেমে উঠেছে। ছটফট করতে করতে ইরাজকে বলল, “পানি এনে দিন, পানি খাব। মুখ জ্বলে যাচ্ছে।ʼʼ
ইরাজ এবার বেশ আরাম করে বসল চেয়ারে হেলান দিয়ে। রিল্যাক্স মুডে আছে সে খুব মেঘালয়ার হাল দেখ। সেভাবেই বলল, “মুখ না জ্বললে এনে দিতাম। একটু উপভোগ কর ঝালটা।ʼʼ
মেঘালয়া কটমট করে তাকাল। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল, “ক্যাকটাস! দিন টাকা দিন, আমি কিনে আনছি পানি।ʼʼ
ইরাজ ভ্রু উঁচিয়ে ধরে, “হুমম! টাকা আমি দেব, পানি কিনে আনবি তুই? তুই টাকা দে, পানি আমি কিনে আনছি।ʼʼ
মেঘালয়ার ঠোঁট জ্বলছে, ঠিকমতো ঝগড়াটা করতে পারছে না ঠিক। তবুও নাক ফুলিয়ে,গম্ভীর মুখে বলল, “আচ্ছা! তো আপনার মানিব্যাগ ফাঁকা? জেনে কষ্ট হলো। আগে বলবেন তো! একটু কম খেতাম।ʼʼ
ইরাজ চোখটা চারদিকে ঘুরিয়ে আবার দৃষ্টিপাত করল মেঘালয়ার দিকে। একটু এগিয়ে বসে মেঘালয়ার দিকে ঝুঁকে আস্তে করে শান্ত কণ্ঠে বলল, “এই পাবলিক প্লেসে থাপ্পড় খেলে কেমন লাগবে তোর?ʼʼ
মেঘালয়াও ইরাজের মতো করেই বলল, “সে এক মোহনীয় অনুভূতি!ʼʼ
এমন পরিস্থিতিতে এরকম একটা পাল্টি খাওয়া কথায় ইরাজ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। মুখটা গম্ভীর করে উঠে পড়ল চেয়ার থেকে।
মেঘালয়া নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার সম্মুখে এসে দাঁড়াল দুটো ছেলে। তারা অবশ্য এখনও কিছু বলে নি। মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এখানে সামনে এসে এভাবে দাঁড়ানোর কারন কি? ছেলেদুটোর মাঝে একজন জিজ্ঞেস করল, “একাই নাকি? কেউ আসেনি সাথে?ʼʼ
ইরাজ এসে পাশে দাঁড়াল। হাতে পানির বোতল। মেঘালয়ার অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ইরাজের বাহু জাপটে ধরে, গা ঘেষে দাঁড়াল। যেন বিনা বাক্যে বুঝিয়ে দিল, ‘উহু, একা আসিনি। আমার ক্যাকটাস এসেছে আমার সঙ্গে!ʼ
ছেলেগুলো মেঘালয়ার বয়সেরই। এদিকে ইরাজ তো জলজ্যন্ত পুরুষ। সন্ধ্যার আধো আলোতে স্পষ্ট ইরাজের জলন্ত চোখ আর শীতল চেহারা খানা। দুজন আস্তে করে কেটে পড়ল। মেঘালয়া চেয়ে রইল সেদিকে। কয়েক মুহূর্ত পার হলে আচমকা নিজের দিকে খেয়াল যেতেই ঝাড়া দিয়ে হাত বের করে এনে দুরে ছিটকে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে ফেলল। সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হলো, মনে হলো মেঘালয়ার চেয়ে ইরাজ বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে ঘটনাটিতে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে এদিক ওদিক অগোছালো দৃষ্টি ফেলছে। তড়িঘড়ি মেঘালয়ার হাতে বোতল ধরিয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।
মেঘালয়া বোতল হাতে ধরে হঠাৎ-ই ভাবে, ইরাজ কী লজ্জা পেয়েছে! ছেলে মানুষের আবার এসব ছোটোখাটো বিষয়ে লজ্জা? তবে ইরাজ এমনই। সে জানে, আগেও ইরাজ কোনদিন তার দিকে আকর্ষন অনুভব করেছে, এমন কিছু তার আচরণে প্রকাশ পায়নি। ইরাজের মুখের সেই অপ্রস্তুত ভাব মনে পড়তেই মাথাটা নত করে নিয়ে ফিক করে ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল মেঘালয়া। কপালে হাত ঠেকিয়ে মুখটা আড়াল করে ফেলল।
চলবে..
[ ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। ২২০০+ শব্দ লিখেছি। আমার হাত🙂]