#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫০।
হাতের কিট’টার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে অন্বিতা। হাতটা কেমন কাঁপছে যেন। নিশ্বাসের গতি বাড়ছে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল সে। বিছানার দিকে একবার চেয়ে দেখল, মাহির উপুড় হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চোখ ছলছল করছে তার। চারদিকে কেমন সুখ সুখ ঘ্রাণ পাচ্ছে যেন।
কিট’টা রেখে মাহিরের শিউরে এসে বসল অন্বিতা। বিছানায় হেলান দিয়ে তার মাথায় হাত রাখল। বিলি কেটে দিল তার ঘন চুলে। আরাম পেয়ে ঘুমটা চেপে বসল বোধ হয়। মুচকি হেসে অন্বিতা মাহিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘শুভ সকাল, ডাক্তারসাহেব।’
তার ডাক্তারসাহেব নড়ল না। সে আবারও আগের মতো করে বলল,
‘উঠুন, ডাক্তারসাহেব। আর কত ঘুমাবেন?’
চ কারান্ত শব্দ হলো। মাহির বিরক্ত হচ্ছে বুঝতে পেরে অন্বিতার মজা লাগল ভারী। তাকে আরো একটু বিরক্ত করার লক্ষে চুল দিয়ে কানে সুরসুরি দিল। এবার নড়ে উঠল মাহির। চোখ বন্ধ করেই ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কী শুরু করলে?’
‘উঠো।’
‘উঁহু, একটু পর।’
‘অনেক বেলা হয়েছে।’
‘কয়টা বাজে?’
‘দশটা।’
‘সাড়ে দশটায় ডেকো।’
এই বলে সে অপর পাশে ফিরে ঘুমের প্রস্তুতি নিল আবার। উঠে দাঁড়াল অন্বিতা। এভাবে উঠানো সম্ভব নয়। এদিকে পেটের ভেতর তার মোচড় দিচ্ছে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় এমন হচ্ছে বোধ হয়। সে কিট’টা এনে আবারও আগের জায়গায় বসল। মাহিরের দিকে হালকা ঝুঁকে তার চোখের সামনে কিট’টা ধরে বলল,
‘চোখ খুলুন, ডাক্তারসাহেব।’
মাহিরের সারা পাওয়া গেল না। অন্বিতা উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না। সে ফের বলল,
‘তাকাও না।’
পিটপিট করে এবার তাকাল মাহির। অন্বিতার দিকে চেয়ে ভারী স্বরে বলল,
‘কী?’
‘আমার দিকে না। আমার হাতের দিকে তাকাও।’
ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না বেচারা। তাও বউয়ের কথা রাখতে তার হাতের দিকে তাকাল। প্রথমে বুঝতে না পেরে বলল,
‘কী এটা?’
‘চোখ মেলে ভালোভাবে তাকান, ডাক্তারসাহেব।’
মাহির জোর করে চোখের পাতা মেলে ধরল। ভ্র উঁচিয়ে বোঝার চেষ্টা করল জিনিস’টা কী। কিছু একটা বুঝতেই মস্তিষ্ক সজাগ হলো অচিরাৎ। দুর্বার গতিতে উঠে বসল সে। অন্বিতার হাত থেকে কিট’টা নিয়ে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল কতক্ষণ। অন্বিতা ঠোঁট কামড়ে লাজুক মুখে মাহিরকে দেখছে। মাহিরের প্রতিক্রিয়া কী হবে তা ভেবে বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছে তার। হাত ঘামছে। মাহির কয়েক মুহূর্ত কিট দেখে এবার অন্বিতার দিকে চাইল। অন্বিতার চোখ মুখের উচ্ছ্বাস, আর উত্তেজনা ঠাহর করতে পারল বেশ। মাহির কম্পিত স্বরে বলল,
‘আমি কি বাবা হতে চলছি, অন্বি?’
অন্বিতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ডাক্তার হয়েও কিটের দুই দাগের অর্থ বুঝতে না পারলে তুমি কেমন ডাক্তার?’
মাহির অধৈর্য গলায় বলল,
‘আমি তোমার মুখে শুনতে চাই।’
এবার লজ্জা পেল অন্বিতা। গাল লাল হলো তার। চোখ নামাল। মাহির ফ্যালফ্যাল করে অন্বিতার লজ্জা পাওয়া দেখছে। অন্বিতা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হ্যাঁ।’
ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটে মাহিরের। নিজেকের পৃথিবীর সবথেকে সুখী পুরুষ মনে হয়। অন্বিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। মাহিরের বক্ষের উষ্ণতায় নিমিষেই অন্বিতার সমস্ত উত্তেজনা কমে যায়। শরীর, মন শীতল হয়। পৃথিবীর সব সুখেরা বোধ হয় আজ ডান মেলে তাদের জীবনে চলে এসেছে। এত সুখানুভূতি আগে কখনও হয়নি।
মাহিরকে নীরব দেখে অন্বিতা ক্ষীণ সুরে বলল,
‘তুমি কি খুশি হওনি?’
মাহির ঢোক গিলল। শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা জুড়ে যে আন্দোলন চলছে তা যদি একটু প্রকাশ করতে পারত! সে প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,
‘সুখে কেউ মারা যায়, অন্বি? আমার কেন মনে হচ্ছে আমি এখন মারা যাব?’
জবাব পেয়ে অন্বিতা মাহিরকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে। তার বুকে নাক ঘঁষে। নরম গলায় বলে,
‘এভাবে বলবে না। তোমার, আমার, আমাদের একসাথে আরো অনেক মুহুর্ত কাটানো বাকি।’
‘সৃষ্টিকর্তা আমাদের সেই ইচ্ছে পূরণ করুক।’
‘আমিন।’
অন্বিতা মাথা তুলে চাইতেই তার কপালে চুমু আঁকল মাহির। তারপর চোখের পাতায়, গালে, নাকে, ঠোঁটে। সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ ফুলের ন্যায় আড়ষ্ট হলো অন্বিতা। লজ্জায় আবারও মুখ লুকাল তার ডাক্তারসাহেবের প্রশ্বস্ত বক্ষে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মাহির বলল,
‘আমাকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী পুরুষ বানানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, অন্বি।’
‘শুধু ধন্যবাদে হবে না, ডাক্তারসাহেব। আমার উপহার লাগবে।’
‘কী লাগবে বলো। তুমি আজ যা চাইবে তাই দিব।’
চট করে উঠে বসল অন্বিতা। চনমনে হয়ে উঠল তার মন। বলল,
‘সত্যি তো? যা চাইব, তাই দিবে?’
‘একবার চেয়ে’ই দেখো।’
অন্বিতা আর জড়তা না দেখিয়ে বলল,
‘শশী আপু আর তাইভিদ ভাইয়া একে অপরকে পছন্দ করেন। কিন্তু তাইভিদ ভাইয়া তোমার ভয়ে বিষয়টা আগাতে পারছেন না। আমি চাই, তুমি উনাদের বিয়ের ব্যবস্থা করো।’
আচম্বিত এমন কিছু শুনবে মাহির আশা করেনি। সে হতভম্ব, হতবাক। শশী, তাইভিদের সম্পর্ক হতে পারে কল্পনাতেও আসেনি তার। অন্বিতা উদ্বিগ্ন সুরে বলল,
‘তুমি কিন্তু বলেছ, আমি যা চাইব তাই দিবে। এখন না করতে পারবে না।’
মাহির এক পল সময় নিয়ে বলল,
‘ফুপি জানেন এসব?’
‘হ্যাঁ। শশী আপু তার পছন্দের কথা ফুপিকে জানিয়েছেন। এখন শুধু তুমি দাদুর সাথে কথা বলে ব্যাপারটা আগালেই হবে।’
মাহির চিন্তিত সুরে বলে,
‘শশী তো প্রথম দিকে তাইভিদকে সহ্য’ই করতে পারত না। ওদের মাঝে সম্পর্ক তৈরি হলো কীভাবে?’
‘এতকিছু তো আমি জানি না। তবে উনারা যে একে অপরকে পছন্দ করেন সেটা তাইভিদ ভাইয়া আমাকে বলেছেন।’
‘আচ্ছা, আমি ভেবে দেখব।’
‘ভেবে দেখার কী আছে? তাইভিদ ভাইয়া তো যথেষ্ট ভালো ছেলে।’
‘তাইভিদ নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে। শশীও এখন বদলেছে। তবে আগের ব্যাপারটাও একেবারে ভোলা যাচ্ছে না। হুট করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে তো হবে না। বিয়েটা সারাজীবনের সম্পর্ক, ভেবে চিন্তে তারপর আগানো উচিত।’
মনঃক্ষুন্ন হলো অন্বিতার। মাহির তা দেখে স্মিত হেসে বলল,
‘তোমার চাওয়া পূর্ণ হবে। তবে সময় দাও একটু। আমি সবকিছু দেখে শুনে তারপর কথা আগাব।’
অন্বিতা প্রসন্ন হেসে মাথা নাড়াল। মাহির বলল,
‘এখন আগে যেটা প্রয়োজন সেটা করতে হবে। নার্সিংহোমে গিয়ে আগে টেস্ট করাতে হবে তোমার।’
অন্বিতা উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘আচ্ছা। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।’
_______________________
মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে আভা। গোলগাল মুখ বিধায় গালগুলো একটু বেশিই ফোলা লাগছে এখন। ভ্রু যুগলের ভাঁজ আর শাণিত দৃষ্টি বলে দিচ্ছে মেজাজ বেশ তুঙ্গে তার। আর হবে না’ই বা কেন! নিজের প্রাণপ্রিয় পুরুষের সাথে অন্য নারী হেসে খেলে কথা বললে মেজাজ তো বিগড়াবেই। এখন তো মনে হচ্ছে এখানে এসেই ভুল হয়েছে তার।
কলিগের সাথে কথা শেষ করে আভার সামনে গিয়ে দাঁড়াল অয়ন। কিঞ্চিৎ হেসে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি হঠাৎ এখানে?’
আভা ঠোঁট গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। পণ করল উত্তর দিবে না। আগে অয়ন তার রাগ ভাঙাবে তারপর উত্তর দিবে সে। অয়ন বুঝতে পারল, আভা রেগে আছে; তবে কারণ কী তা বুঝতে পারল না। তাই ফের জিজ্ঞেস করল,
‘কী হলো, উত্তর দিচ্ছেন না কেন?’
আভা চোখ তুলে তাকাল উপরে। নাক মুখ কুঁচকানো তার। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল, তাই এখানে এসেছি।’
একটু জোরেই বলল আভা। অয়ন খানিকটা চমকে আশেপাশে তাকাল, কেউ শুনল কি-না দেখার জন্য। আভা তা দেখে আরো ক্ষেপল। টিটকারি মেরে বলল,
‘চিন্তা করবেন না, আপনার সেই সুন্দরী ললিতা শুনেনি।’
কপাল কুঁচকাল অয়ন। শ্যামবর্ণ পুরুষটা কপাল কুঁচকালে মারাত্মক লাগে। আভার তখন নতুন করে প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। তবে আপাতত সে অনুভূতি জোয়ারে না ভেসে শক্ত করল নিজেকে। অয়ন জিজ্ঞেস করল,
‘কে সুন্দরী ললিতা?’
‘কেন, একটু আগে যার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলেন। এত হেসে এই ছয় মাসে তো আমার সাথে একবারও কথা বলেননি।’
অয়ন বুঝল এতক্ষণে। মেয়েলী ব্যাপার। হিংসা তাদের অস্থিমজ্জায় বাহিত। হাসি পেল তার। তবে প্রকাশ করল না। বলল,
‘আপনি তো আর আমার কলিগ না। আপনি হলেন আমার ছাত্রী, আপনার সাথে হেসে হেসে কথা বলার তো সম্পর্ক না আমার।’
বুকের ভেতরে ছ্যাঁৎ করে উঠল। সেই ছয়মাস আগে লোকটা সময় নিয়েছিল তার কাছে। বলেছিল, একদিন সে তাকে অবশ্যই গ্রহণ করবে। তবে সেই সময় এখনও আসেনি। আর মেয়েটা সেই সময়ের অপেক্ষা করতে করতে দিশেহারা প্রায়। তার অভিমান হলো বড্ড। তার সাথে হেসে হেসে কথা বলার মতো সম্পর্ক নেই, অন্য মহিলার সাথে ঠিকই সেই সম্পর্ক আছে। রাগে, অভিমানে আর কথা বলল না আভা। চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই অয়ন বলল,
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘চলে যাচ্ছি।’
‘আমাকে দেখা হয়ে গিয়েছে?’
আভা চোখ তুলে তাকাল। ক্ষুব্ধ সুরে বলল,
‘হ্যাঁ।’
অয়ন কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,
‘কিন্তু আমার তো হয়নি।’
এই বলে সে আভার কপালের টিপটা চেপে ঠিক করে দিয়ে বলল,
‘টিপ উঠে আসছিল কেন? হয়তো নষ্ট হয়ে গিয়েছে, সেদিনও দেখেছিলাম। চলুন, আপনাকে এক পাতা টিপ কিনে দেই।’
বিষম খেল আভা। আদতে কথাগুলো অয়ন বলছে কি-না বুঝতে পারছে না। সে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। অয়ন ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কী হলো, যাবেন না?’
ত্বরিতে মাথা নাড়াল আভা। অবশ্যই যাবে। এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে না-কি?
চলবে…..