#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫১।
রোদ ঝলমলে বিকেল। মৃদু সমীরণে গাছের পাতা দুলছে। সেই ফাঁকফোকরে সোনালী রোদ এসে পড়ছে জমিনে। কিছু দীপ্ত রেখা আভার মুখেও দৃশ্যমান। হাতের তালুতে রাখা বাদামে ফুঁ দিল সে। তারপর মুখে পুরল। বাদাম চিবাতে চিবাতে বলল,
‘আপনাকে তো একটা খবর দেওয়া হয়নি। অন্বিতা প্রেগন্যান্ট।’
বেঞ্চে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল অয়ন। মাঠের দিকে চেয়ে দেখছিল বাচ্চাদের ছোটাছুটি। আচম্বিত এমন কিছু শুনে সে নড়ে বসল। অয়নের জবাব না পেয়ে তার দিকে চাইল আভা। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘খুশি হোননি?’
অয়ন জোরপূর্বক হাসল। কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আভা বলল,
‘জোর করে হাসতে হবে না। বাবা হওয়ার বদলে মামা হচ্ছেন, আপনি না বললেও সেই কষ্ট আমি বুঝতে পারছি।’
অয়ন হতভম্ব। মেয়েটা নির্দ্বিধায় সব বলে দিতে পারে। তার মধ্যে জড়তা কাজ করে না কোনো। অয়ন মাথা নুয়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘মামা হওয়াই কষ্ট পাচ্ছি না, আনন্দ হচ্ছে।’
‘তাই?’
অয়ন আভার দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘হু।’
হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল অন্বিতা। ওড়না ঠিক করে বলল,
‘চলুন তবে, অন্বিতার সাথে দেখা করে আসি।’
অয়ন বিস্মিত হয়ে বলে,
‘কেন?’
‘ওকে শুভেচ্ছা জানানো হয়নি। আপনি, আমি, দুজন একসাথে জানাব। চলুন, আপনাকে দেখলে অন্বিতা খুশি হবে।’
অয়ন অন্যদিকে চেয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
‘আজ না, অন্য কোনোদিন। আজ আমার কোচিং এ যেতে হবে একবার।’
‘আধ ঘন্টা সময় লাগবে শুধু। ঐটুকু’তে কিছু হবে না, চলুন।’
অস্থির দেখাল অয়নকে। সে অন্বিতার মুখোমুখি হতে চাইছে না। অন্বিতা মা হতে চলছে, কথাটা মোটেও তাকে আনন্দ দেয়নি। আজকাল আভাকে নিয়ে মনে দূর্বলতা টের পেলেও অন্বিতাকে সে ভুলতে পারেনি পুরোপুরি। তাই অযথাই তার সম্মুখে গিয়ে পুরোনো ঘা এ লবণ ছিটাতে চায় না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আপনি গেলে যান। আমার কাজ আছে।’
এই বলে হাঁটা ধরতেই আভা তার হাত ধরে। প্রথম স্পর্শ আভার। অয়ন অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকায়। আভা হাত ছেড়ে দেয়। বলে,
‘এত ভীতু কেন আপনি? মনের বিরুদ্ধে কেন লড়তে পারেন না?’
অয়ন বুঝল না। আভা তার সমীপে এসে দাঁড়াল। সূর্যকরের সোনালী আলোয় আভার মুখটা চকচক করছে। নাকের ছোট্ট পাথরটা ঝিলিক দিচ্ছে বারবার। আভা বলল,
‘আর কত পালিয়ে বেড়াবেন? আমি জানি, অন্বিতাকে আপনি এখনও ভুলতে পারেননি। ভুলে যান, তা বলবও না। প্রথম ভালোবাসা যে ভুলে যায়, সে নিষ্ঠুর। আপনি নিষ্ঠুর হোন সেটা আমি চাই না। তবে চাই, নিজের মনের ভয় থেকে যেন বেরিয়ে আসতে পারেন। অন্বিতার মুখোমুখি দাঁড়ান, বাস্তবতা মেনে নিন। এভাবে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলে কষ্ট কমবে না, বরং বাড়বে।’
অয়ন আর্তস্বরে বলল,
‘একটু একটু করে যে শক্ত খোলস দিয়ে মন বেঁধেছি উনার সামনে গেলে তা আবার ভেঙে যাবে।’
‘যতবার ভাঙবে ততবার তৈরি করবেন, তাও ভয়ে পিছিয়ে যাবেন না।’
অয়ন মলিন হেসে আভার গালে হাত রাখল। অয়নের পুরুষালী হাতের নরম স্পর্শে বুকের কম্পন বাড়ল আভার। ঢোক গিলল সে। অয়ন বলল,
‘যদি কখনও আপনাকে গ্রহণ না করি, তাও আমাকে এভাবে ভালোবাসবেন তো, আভা?’
আকুতি উপচে পড়ল এই সুরে। যেন সে ভয় পাচ্ছে, ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার ভয়। আভা তার হাতের উপর হাত রেখে তাকে অভয় দিয়ে বলল,
‘মৃত্যুর আগ অবধি আমি আপনাকেই ভালোবাসব। মরে গেলেও ভূত হয়ে ঘাড়ে চাপব আপনার, তাও নিস্তার দিব না।’
অয়ন হাসল। বলল,
‘আমার নিস্তার চাই না।’
______________
শশী অন্বিতার রুমে আসে। অন্বিতা শুয়ে ছিল তখন। শশী আস্তে করে ডাকল তাকে। বলল,
‘অন্বিতা, তোমার বান্ধবী এসেছে।’
চোখ মেলে তাকাল অন্বিতা। আস্তে করে উঠে বসল। গায়ে ওড়না জড়িয়ে বলল,
‘কে আপু? আভা?’
‘হ্যাঁ।’
হাসি ফুটল অন্বিতার মুখে। সে ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল। শশী সাহায্য করল তাকে। তারপর গায়ে ভালোমতো ওড়না জড়িয়ে ভারী শরীর টেনে গেল বসার ঘরে। আভাকে দেখে যতটা না সে খুশি হলো তার থেকেও বেশি অবাক হলো আভার পাশের মানুষটাকে দেখে। যদিও আভা তাকে সব’ই বলছে, তাও আজ এখানে এভাবে অয়নকে সে একেবারেই আশা করেনি। আভা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল অন্বিতাকে। বান্ধবীকে পেয়ে ভীষণ খুশি হলো অন্বিতা। আভা তার গাল টেনে দিয়ে বলল,
‘মাশাল্লাহ, কী গোলুমোলু হয়েছিস দোস্ত।’
অন্বিতা মিষ্টি হাসল। আভা তার ভরাট পেটে হাত রেখে বলল,
‘আমার খালামনিরা কেমন আছে?’
‘ভালো। খালামনিকে পেয়ে আরো বেশি ভালো হয়ে গিয়েছে।’
আভা হাসল। অয়ন দেখছে অন্বিতাকে। কী আশ্চর্য পরিবর্তন মেয়েটার মাঝে। হ্যাংলা পাতলা মেয়েটার এখন কী ভারী শরীর! গালগুলো ফুলে টসটসে। না চাইতেও অয়নের চোখ গেল অন্বিতার পেটের দিকে। উঁচু ভরাট পেট দেখে কিঞ্চিৎ হাসল সে। আভা অয়নের দিকে চেয়ে হেসে বলল,
‘আপনাকে তো আরো একটা কথা বলা হয়নি, অন্বিতার কিন্তু টুইন হচ্ছে।’
অয়ন এই পর্যায়ে হাসল। অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘কেমন আছেন?’
অন্বিতা হেসে জবাব দিল,
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’
অন্বিতা প্রসন্ন সুরে বলল,
‘ভালো না থেকে উপায় আছে? আমার বান্ধবী যার সাথে আছে, তার ভালো না থেকে কোনো উপায় নেই।’
অয়ন উত্তর না দিয়ে ঈষৎ হাসল। শশী বলল,
‘অন্বিতা, তুমি উনাদের নিয়ে বসো। আমি খালাকে বলে নাস্তা পাঠাচ্ছি।’
রান্নাঘরের দিকে গেল শশী। আভা অন্বিতাকে ধরে সোফায় বসাল।
‘ভাইয়া কোথায়? নার্সিংহোমে?’
‘হ্যাঁ। একটু পরেই চলে আসবে।’
‘ওহ।’
আভা একবার আশেপাশে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘এই শশী দেখি একেবারে সোজা হয়ে গিয়েছে।’
অন্বিতা মৃদু হেসে বলল,
‘হ্যাঁ। শশী আর ফুপি দুজনেই বদলে গিয়েছেন। দুজনে আমার অনেক যত্ন করেন, নয়তো মা কতবার বলেছেন ঐ বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু উনারা রাজি’ই হোন না।’
‘বাহ, শুনে ভালো লাগল। আর তাইভিদ ভাইয়া আর শশী আপুর বিয়ে কত তারিখ?’
‘আগামী মাসের সাত তারিখ। শশী আপু বলেছিলেন যদিও, আমার ডেলেভারির পর ডেইট দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, শুভ কাজে দেরি করতে নেই, তাই আগামী মাসেই ডেইট দিয়ে দিয়েছে।’
‘তোর ডেলেভারিও তো আগামী মাসেই?’
‘হ্যাঁ, শেষের দিকে।’
‘যাক, এক মাসে দুই দুইটা খুশির সংবাদ।’
‘তুই বিয়েটা লাগিয়ে ফেললে তো আরো একটা খুশির সংবাদ হয়ে যেত।’
আভা ঠোঁট উল্টে বলল,
‘সেটা উনাকে বল না, উনি বললে আমি তো আজ’ই রাজি।’
এতক্ষণ আস্তে কথা বললেও এটা আভা একটু জোরেই বলল। অয়নের মনোযোগ অন্যদিকে ছিল। আভার কথা শুনে সেদিকে চাইল সে। অন্বিতা হেসে বলল,
‘অয়ন, আপনি তো ভারী অন্যায় করছেন। আমার বান্ধবীকে আর কত অপেক্ষা করাবেন?’
নির্মল হাসল অয়ন। বলল,
‘কেন? আপনার বান্ধবীর ধৈর্য্য শক্তি বুঝি এখনই ফুরিয়ে গিয়েছে?’
‘মোটেও না। আমার ধৈর্য্য শক্তি আকাশসম, তা কখনোই ফুরাবে না।’
আভার কথা শুনে খুশি হলো অন্বিতা। আভার ভালোবাসায় খাদ নেই, এই বিশ্বাসটুকু আরো দৃঢ় হলো তার। সে অয়নের দিকে চেয়ে বলল,
‘জীবনের এক চমৎকার অধ্যায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, অয়ন। আমার বিশ্বাস, আপনি আপনার সেই অধ্যায়কে নিঁখুত ভাবে উপভোগ করবেন।’
সুপ্রসন্ন চিত্তে অয়ন বলল,
‘অবশ্যই, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব।’
অন্বিতা তার দিকে চেয়ে থেকে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলল।
চলবে…..