#রং-(Wrong-ভুল)
#পর্বঃ৪
#লেখনিতেঃতন্নী_তনু
হেডকোয়ার্টারের কেবিনে ইরফাদ সিনহা আর ডিআইজি প্রভাতরঞ্জণ সরকার বসে আছেন। সাথে যোগ দিয়েছেন রিজভী শিকদার। কথোপকথন চলছে রাফির কেস নিয়েই।ডিএনএ’র রেজাল্ট “নেগেটিভ”। রায়হান রাফি নিরুদ্দেশ, এখনো মুক্তিপণ নিয়ে কোনো ফোন আসেনি। উদ্দেশ্যে “কি*ড*ন্যাপ” নাকি অন্য কিছু,এখনো কোনো ক্লু বের হয়নি। লেকের ধারের সিসি ক্যামেরা গুলো অকেজো।আর আশেপাশের ফুটেজ গুলো চেক করে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি।রায়হান রাফির বড় চাচা একজন ম্যাজিস্ট্রেট! এই “ক্ষমতাকে” হাতিয়ার করে রাফির বাবা বুক ফুলিয়ে চলেন। ভালোই নামডাক তাদের। রাফি নিজেও একজন ইঞ্জিনিয়ার। ম্যাজিস্ট্রেট এর ভাতিজা নিরুদ্দেশ, অজ্ঞাত লাশ পাওয়া, কয়েকটি জেলায় পরপর নিরুদ্দেশের ঘটনা । অতিদ্রুত সমাধান বের না করলে উপরমহল থেকে চাপ আসবে। একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটলে মিডিয়া, সংবাদ, পত্রিকায় গুজব ছড়বে। সাধারণ মানুষ পুলিশের উপর আস্থা হারাবে। তাই এসবের আগেই যা করার করতে হবে। প্রায় একই বয়সী তরুণরা নিরুদ্দেশ হচ্ছে, কেনো? কি কারণে? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর নেই। কথোপকথনের একপর্যায়ে ইরফাদ সিনহা ডিআইজির উদ্দেশ্য বলেন,
— স্যার!গত মাসে যে ছেলেগুলো নিখোঁজ হয়েছে, তার সাথে রায়হান রাফির ঘটনার মিল আছে। মিসিং এর সাথে সাথে তাদেরও কোনো মুক্তিপণেরর দাবি করেনি।এদের মধ্যে সবাই আন্ডার “থারটি টু” এবং সবাই জবলেস।
ডিআইজি প্রভাতরঞ্জন সরকার বললেন,
— কিন্তু ইরফাদ! রায়হান রাফি ইজ অ্যান ইঞ্জিনিয়ার। ইউ নোউ দ্যাট?
এই কথোপকথনের মাঝে মৃদু শব্দে কেঁপে উঠলো ইরফাদ সিনহার মুঠোফোন। তিনি ফোনটা উল্টো করে ধরলেন, যাতে কথার মধ্যে ডিস্ট্রার্ব না হয়। ফোন টা থেমে গিয়ে আবার কেঁপে উঠলো। এটা তার পারসোনাল ফোন, তাই পারসোনাল মানুষগুলোই ফোন করার কথা।তবে এই মূহুর্তে কাজের চেয়ে ইমপর্ট্যান্ট কিছু নেই তার কাছে।তাই ফোনটা সাইড বাটন চেপে সুইচঅফ করে দিলেন। তারপর আবার কথায় ফিরলেন,
— ইয়েস স্যার! কিন্তু ঐ কোম্পানি থেকে ওকে আউট করে দেয়া হয়েছে প্রায় দুই তিন বছর আগে। তারমানে দাঁড়াচ্ছে তিনিও বেকার।
— আর ইউ শিউর?!
— অবভিয়াসলি! আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড ঐ একই কম্পানিতে জব করে। বাকি তথ্য খুব শিঘ্রই জানাবে।
–তাহলে তুমি কি বলতে চাচ্ছো। সাতটি ছেলে নিখোঁজের সাথে রায়হান রাফির কেস টা রিলেটেড?
— এক্টজেক্টলি স্যার!
_____________
অন্ধকার হয়ে আসা প্রায় জনমানবহীন সরু গলি। পিছনে তেড়ে আসা বাঘের ন্যায় মুখোশধারীর কবোল থেকে নিজেকে বাঁচাতে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ছুটছে সিনথিয়া। আর প্রাণপনে অন্তরের অন্তরস্থল থেকে একটি দোয়াই করছে। ইরফাদ সিনহা যেনো তার দেয়া মেসেজটি পড়েন। আর খুব দ্রুত যেনো এই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। সিনথিয়া প্রাণপণে দৌঁড়াচ্ছে, আবার সুযোগ বুঝে পিছনে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। মুখোশধারী লোক দুটো তাকে ধরার জন্যে মরিয়া হয়ে ছুটছে।যেনো “হিরাপান্নার” সন্ধ্যান পেয়েছে ।পথঘাটের কিচ্ছু না চেনায়,সিনথিয়া দুচোখের সামনে যে পথ দেখছে সেদিকেই ছুটছে। অন্ধকারে তলিয়ে গেছে চারদিক, চিপেচাপা গলিতে মনে হচ্ছে গভীর রাত। সিনথিয়া সামনে যেতেই দেখলো,গলির মোর ঘোরার আগেই পাশাপাশি খাড়া দুটো বিল্ডিং। মাঝখানে একটু সরু রাস্তা,ময়লা আর আবর্জনার ভরপুর। কতোক্ষণ আর এভাবে দৌড়াবে। একটু লুকিয়ে দেখা যাক কি হয়।সেই সরু রাস্তায় নিজের শরীর গলিয়ে ঢুকে যায় সিনথি। তপ্ত ভারী শ্বাস পড়ছে তার ফোঁস ফোঁস করে,দুহাতে মুখ চেপে ধরে সামলে নেয় নিজেকে। লোকদুটো দৌড়ে মোর ঘুড়ে পার হয়ে গেলেই যেনো বেঁচে যাবে সে।এটাই যেনো শেষ ভরসা তার।হলোও তাই, লোক দুটো দৌঁড়ে সামনের দিকে চলে যাচ্ছে। সিনথিয়া হাফ ছাড়ে,লম্বা করে একটা দম নেয়। হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটা দুহাতে আকড়ে ধরে সিনথিয়া। বাসায় থেকে অসংখ্যবার কল এসেছে। সিনথিয়া ফোনটা স্ক্রল করে, হারিয়ে যাওয়া বস্তুর ন্যায় একটি নম্বর খোঁজে। নাহ! কোনো কল আসেনি।দেখেই, বুকের মধ্যে খাঁচায় আবদ্ধ থাকা “সুপ্ত আশাটা” পাখির ন্যায় উড়াল দিয়ে বুকটা শূন্য করে দিয়ে চলে যায়। সে কি শতভাগ আশা করে ছিলো?ইরফাদ সিনহা কল ব্যাক করবেই?সে কি ভেবেই নিয়ে ছিলো?বিপদে পড়লে ইরফাদ সিনহা তাকে বাঁচাতে আসবেই? কিন্তু “ইরফাদ সিনহা” এমন কোনো আশ্বাস কি তাকে কখনো দিয়েছিলো? কখনোই না! কেসের প্রয়োজনে, সে শুধু মোক্ষম গুটি। তাই খেলার আগে, তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে ইরফাদ সিনহা। সেই সুবাদে “একটুখানি” তার সাথে ভালো করে কথা বলেছে। তাতেই এতো কিছু আশা করে বসলো?সে কে? তার মতো তুচ্ছ মেয়ে, মরে পঁচে থাকুক। তাকে উদ্ধার করতে, সব ইমপর্ট্যান্ট কাজ ফেলে ইরফাদ সিনহা উড়াল দিয়ে আসবে?এমনটাই কি আশা করেছিলো সে? নিজের “আশা” করার পরিধি বিবেচনা করে,মনে মনে নিজের কপালে সপাটে কতোগুলো জুতার বারি মারলো সিনথিয়া। তারপর প্রাণপনে চাইলো, ভুল করেও “ইরফাদ সিনহা” যেন, ঐ মেসেজ না দেখে। খানিকটা সময় সে নিশব্দে দাঁড়িয়ে থাকলো ওখানেই। কি করবে এখন সে? বাবাকে কল করবে? ফোনের নেটওয়ার্ক ক্রস চিহ্ন দেখাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবছে, তার বাবা আসলে যদি আরেকটা বিপদ হয়? তার সাথে যদি তার বাবাকে’ও তুলে নিয়ে যায়?না না, সে এমন রিস্ক জীবনেও নিবেনা। সে নিজে মরে যাক, পঁচে যাক তবুও পরিবার ভালো থাকুক।সে উঠে দাঁড়ায় সন্তোপর্ণে। গুটি, গুটি পায়ে উঁকি দিয়ে দেখতে চায়, আশেপাশে ঐ লোক গুলোকে দেখা যায় কি না? দু’পা বাড়াতেই, একগুচ্ছো আলোকরশ্মী মুখের উপর হায়েনার মতো ঝাপটে পড়ে। চোখ বন্ধ হয় আপনা আপনি। সে চোখ টেনে তুলে তাকায় পুনরায়।একি! সেই মানুষগুলোই তো! চিনতে অসুবিধা হয় না সিনথিয়ার। বুকের মধ্যে বিপদ সংকেত ঘন্টা বাজিয়ে ওঠে। যেচে এসে সে যেনো কুমিরের মুখের মধ্যে ঢুকে গেছে। বুকের কাপনে হৃদপিণ্ড বেড়িয়ে আসার যোগার। এইবার সে কোথায় পালাবে?
_______
চোখ বন্ধ করে ধোয়া ওঠা কফিতে চুমুক দেয় ইরফাদ সিনহা। চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছেন তিনি,
— স্যার! উত্তরবঙ্গে একই জেলার দুই বন্ধু একই সাথে নিখোঁজ।রিজভী শিকদার সকাল থেকে একটি কেসের পূর্ণাঙ্গ নিউজ নিতেই হিমশিম খাচ্ছেন।তাই কাজটি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে,আমি নিজেই স্বশরীরে সে জায়গা গুলোতে যেতে চাই।
—- তুমি যেটা ভালো মনে করো।তোমার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে।
–ও,কে স্যার! আমার অনুপস্থিতিতে তো রিজভী শিকদার কাল থানায় থাকছেন’ই। তিনি ওদিকটা যেনো হ্যান্ডেল করেন।
–ওকে।বেস্ট অফ লাক।
________
মৃত্যুর দোরগোড়ায় থেকেও যেনো শেষ চেষ্টাটা করে সিনথিয়া।খারাপ সময়ে, নিজের মৃত্যু কামনা হয়তো সবাই করে। কিন্তু সত্যি সত্যি কেউ মরতে চায় না। সিনথিয়াও প্রাণ বাঁচাতে, উল্টো ঘুড়ে দৌঁড় দেয়। দু’পাশের চাপা দেয়ালের ধারালো ঘর্ষণে জন্তুর মতো খুবলে খুবলে খেয়ে নেয় ডানার মাংস। জুতো ভেদ করে ঢুকে যায় কাচের টুকরো।পেছনের মানুষ দু’টি চাপা দেয়ালের মধ্যে পথ আগাতে পারছে না। সেই সুযোগে সিনথিয়া একছুটে বেড়িয়ে যায়। বিল্ডিং এর পেছনে বড়সড় একটা গলি।তার পাশে একটি ডোবা। হলদে লাইটের আলোয় পথটার শেষপ্রান্ত অবধি দেখা যাচ্ছে। এপথে গেলে দৌড়ে পার পাবে না সে।তাই সিনথিয়া আর সরু রাস্তা ধরলো না। সাপ-বিচ্ছু কোনো কিছুর পরোয়া না করে পুকুরে নেমে পড়লো। রাস্তা থেকে অনেক নিচুর দিকে পুকুরটি হওয়ার আলো নেই। লতা-পাতা আর আগাছায় ভরা। থোকায় থোকায় কচু গাছগুলো সংসার বেঁধেছে, অনেক খানি জায়গা জুড়ে। উপায়ন্তর না দেখে সিনথিয়া ঘন কচু গাছের আড়ালে দাঁড়ালো। তারপর পানিতে সর্বাঙ্গ। ডুবিয়ে মাথাটুকু বের করে রইলো।
***
অনিমার কপালে যেনো শনির দশা। এ যেনো কাঁচা বাঁশে ঘুন ধরার মতো অবস্থা। খাঁ খাঁ জ্যোস্নার মধ্যে তার ঘরে নেমেছে অমবস্যা।বিয়ের একদিন পরেই রাফি তাকে নিয়ে পারি জমিয়েছিলো ঢাকায়। সুখের সাগরে ভাসতে গিয়ে এখন তো সে সাগরের কুল কিনারাই হারিয়ে বসেছে। স্বামী নিখোঁজ, কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল, আর থানায় যেতে যেতে পায়ের বল সব ই এখন ফুরিয়ে এসেছে। তবে এই দূর্দিনে যে রোজ একবার ফোন করে,সে হলো সিনথিয়া। তবে আজ তার একটা ফোন ও আসেনি। তার সাথে কথা বললে মনটা একটু হলেও হালকা হয়। তাকে একবার ফোন করা দরকার।অনিমা টেবিল হাতরে ফোনটা নিজের কাছে টেনে নেয়।
পায়ের তলায় গিজগিজে কাঁদা,আর পানির চিটচিটে গন্ধ সিনথিয়ার নাড়ি-ভুড়ি ওলোট পালোট করে দিচ্ছে। কচুর পাতা শরীরে ঘষা লেগে লেগে কামড়ে ধরছে। তবুও দাঁতে দাঁত পিষে রয়েছে সে। জান বাঁচানোতো ফরজ। লোকদুটো ডোবার ধার ধরেই এদিক সেদিক হাঁটছে। তাদের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, সে কোন দিকে গেছে বুঝতে পারছে না তারা। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা বলা বলি করছে। তারা ফোনের ফ্ল্যাস জ্বেলে ডোবার দিকে চোখবুলিয়ে নিলো।নাহ! নেই। দুজন যেনো হাল ছেড়ে দিলো। ডোবার দিকে তাকিয়ে থেকেই একজন অপরকে ইশারা দিলো সামনের দিকে চলে যাওয়ার। সিনথিয়া যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। তবে আটকে থাকা ঘন শ্বাস আর ফেলা হলো না।তার আগেই ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে তার ফোনের স্ক্রিনের আলো জ্বলে উঠলো। ফোনের আলো মুখের উপর পড়ে মুখটা আলোকিত হয়ে গোবরে পদ্ম ফুলের মতো ফুটে উঠলো।
__________
ড্রাইভিং সিটে এক হাতে স্ট্রিয়ারিং ধরে, অন্যে হাতে মোবাইলের সাইড বাটনে চাপ দিলো ইরফাদ সিনহা। মোবাইল অন হয়েই কানেক্ট ইন চার্জার লেখা উঠলো। তারপর টুপ করে আলো নিভে গেলো। প্যান্টের পকেট থেকে আরেকটি ফোন বের করে নিলো। তারপর প্রতিদিনের অপেক্ষারত সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার নাম্বাটিতে ডায়েল করলেন,
— আসসালামু আলাইকুম, বাবা।
— ওয়ালাই কুমুসসালাম। কোথায় আছো?
— গাড়িতে, আজকে ঢাকার বাইরে যেতে হবে বাবা।
— এখন? কাল সকালে গেলে হয় না?
— না বাবা,অনেক কাজ। তুমি ডিনার সেরে নিও। টুম্পা কি ঘুমিয়েছে?
— কে টুম্পা? রং নাম্বার..
— হাহাহা!
–ফোন রাখেন। টুম্পার নাম্বারে কল দ্যান।
–টুম্পাকে তুমি এতো হিংসে কর কেনো? তুমি তো আমার জন্য পুরো একটা জান্নাত। ও শুধু জানবাচ্চা।
— আহ্!কারো জান বাচ্চা হতে পারলাম না! আফসোস!
— ঐটুকু বাচ্চার সাথে তুমি নিজেকে কম্পেয়ার করো । দিন দিন তুমি কিন্তু টুম্পার চেয়েও ছোট হয়ে যাচ্ছো।
— হ্যাঁ,তাতে কি? তুমি তো আমার “আব্বা”। আব্বার কাছে সন্তান কোনোদিন বড় হয়?
ইরফাদ সিনহা বাবার পাগলামিতে মৃদু হাসে। প্রয়োজনের বাইরে এই একটা মানুষের সাথে নিয়ম করে কথা বলতে হয়।আর ঐ সময় টুকুই তার কাছে পৃথিবীর সেরা সময় হয়ে ওঠে। ফোনের ওপাশ থেকে গাজী আসরাফ শীতল কন্ঠে তাকে ডাকেন,
— আব্বা….
ইরফাদ সিনহা নিরবে অনুভব করে স্পর্শকাতর সেই ডাক। বরফের চেয়ে শীতল,হৃদয় স্পর্শ করা ডাক শোনার লোভে, তিনি নিস্তব্ধ হয়ে থাকেন আরো কিছুক্ষণ । সারাদিনের ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা যেনো এই শব্দেই প্রশমিত হয়। প্রশান্তিতে ভরে ওঠে বুকের আনাচকানাচে ।ওপাশ থেকে আবার ভেসে আসে একই শব্দ,
— আব্বা, আব্বা,,,ও আব্বা,,,,
ইরফাদ সিনহা শীতল কন্ঠে করে বলেন,
— হুম..
— কাউকে সাথে নিয়েছো আব্বা?
–না বাবা,, আমি একাই পারবো।
— কতো বলি দূরে কোথাও যেতে নিজের সিকিউরিটি অন্তত নিশ্চিত করে নিস।
— তোমার মতো বাবা যার কাছে আছে, এই পৃথিবীতে তার কি সিকিউরিটি লাগে?
–বিপদ কিন্তু বলে কয়ে আসে না জয়।এতো সাহস ভালো না।
— টেনশন কোরো না বাবা।
— ওকে,সাবধানে!যেয়ো।
— ওকে, বাবা।
–টেক কেয়ার, মাই সান।
— ও.কে।
_______________________
সিনথিয়া একবার নিজের ফোনের দিকে তাকালো,তারপর ধরা পরে যাওয়া চোরের ন্যায় লোক দু’টোর পানে তাকালো।লোকদুটো কিছু একটা আঁচ করে কচুগাছের দিকে তাকালো। হুহু করে কেঁপে ওঠলো সিনথিয়ার আত্মা।ঘন হয়ে হয়ে আসা শ্বাস আর আলো জ্বলে ওঠা হাতের ফোন নিয়ে নিজের মাথাটাও পানিতে ডুবিয়ে ফেললো সিনথিয়া।
*
*
*
লোকদু’টি চলে যাওয়ার পর সিনথিয়া ভেজা জবজবে কাপড়, কাঁদা-মাটি মেখে অনেক রাস্তা পারি দিয়ে একটা মসজিদের সামনে চলে আসে। সেখানকার কিছু মানুষের সহযোগিতায় একটা বোরকা নিয়ে রাত দশটা নাগাদ রিকশা করে নিজের বাসায় ফেরে। চারতালা পারি দিয়ে পাঁচ তলায় গিয়ে দেখে বাসার দরজা খোলা। সোফায় বসে আছে তার চাচী, ফুপি, কাজিনসহ আরও অনেকেই। সিনথিকে দেখে তার মা ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরে মেয়েকে।
— শরীর ভেজা কেন মা? কাঁদা-মাটি কোথা থেকে লাগলো?
সোফায় থেকে তার চাচী,ফুপি সবাই উঠে এলো। সবার মুখে এক কথাই,
–সব ঠিক আছেতো সিনথি?
সিনথিয়া নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু মাথা নাড়ে। যা ভেবে এতো চিন্তা করছে, সেরকম কিছুই হয় নি, সেটি নিশ্চিত করে সে। কি কারণে এমন হলো এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। সে শুধু জানে তার এখন বিশ্রাম দরকার।
সিনথিয়ার বাবা, চাচা, মামা সবাই মিলে হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে গেছে এতোক্ষণ। থানায় গিয়ে নিজের মেয়ের জন্যে কোনো সাহায্য পাননি তিনি। হয়রানির শেষ প্রান্তে, দম ফুরাবার মুহূর্তে বাসায় থেকে তাকে জানানো হয় সিনথিয়া ফিরেছে। পরে তারাও বাসায় ফেরেন।
________
গোসল সেরে, জামা পাল্টে সোজা বিছানায় চলে যায় সিনথিয়া। ব্যাথায় টনটন করছে শরীর, মাথা ঝিমুনি আর ছুলে যাওয়া অংশের জ্বলুনিতে সে কাতর। বাইরের তার বাবার গলা শোনা যাচ্ছে। চিৎকার, চেচামেচি করছেন আরিফ আহমেদ। কয়েকদিন যা হয়েছে তা কেবল দূর্ঘটনা বলে ধরে নিয়েছিলেন। প্রেম -ভালোবাসা, এখন খুব কমন। তাই মেয়ের ভুল সত্যেও মেয়ের পাশে থেকেছেন। তবে আজ থানায় গিয়ে মেয়ের জন্যে অপমানিত হতে হয়েছে তাকে। রিজভী শিকদার যা নয় তা বলে অপমান করেছেন। আরিফ আহমেদ সব কথা খুলে বলে, মেয়ের জন্যে সাহায্য চাইলে তিনি সরাসরি নাকোচ করে দেন। নাটকবাজী, বানানো মনগড়া গল্প, আবেগের গল্প শুনিয়ে তাকে ভেজানো সম্ভব নয়। এরপর যা তা অপমান করেন। আরিফ আহমেদের গলায়, “থানার” কথা শুনে সিনথিয়া উঠে দাঁড়ায়। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে। সিনথিয়ার মা গ্লাসে পানি এগিয়ে দিচ্ছেন আরিফ আহমেদের দিকে।ঘেমে নেয়ে তিনি একাকার। সিনথিয়ার মা ধীর গলায় বললেন,
— এসপিকে জানাতে পারলেন না?
আরিফ আহমেদ চোখ গরম করে তাকায়। একটু আগে হওয়া অপমানে তার কান দিয়ে এখনো ধোঁয়া উঠছে। তিনি গর্জন দিয়ে বলে,
— “এসপি” কি বাপ দাদার কেনা গোলাম? এসপির সাথে গেলেই দেখা হয়? অতো সহজ?
— আমি কি তাই বলেছি?
— তোর কথায় তো মনে হচ্ছে, সারাদিন এসপি তোদের মা- মেয়ের প্যানপ্যানানি শোনার জন্য বসে থাকে।
— বাচ্চাদের সামনে অন্তত তুই তোকারি করবেন না।
— “তোর কাছে আমার শিখতে হবে?” বলেই আরিফ আহমেদ সজোড়ে পাঁচ আঙ্গুল বসিয়ে দেয় সানজিদা বেগমের গালে। তারপর গলা ফাটিয়ে বলেন,
— সারাদিন করিসটা কি? মেয়ে কোথায় কি করে দেখিস না। আর দুনিয়ায় মানুষ নাই নাকি? বান্ধবীর জামাইয়ের সাথে কি?বিয়েতে কি ও জামাই দেখেনি? ওর সাথে হাজার হাজার বছরের প্রেম থাকলেও, এখন তো সে অন্যের বর। কি নির্লজ্জ! মেয়ে আমার, অন্যের বরের সাথে দেখা করে তাও আবার শাড়ি পড়ে। ও তো নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গেছে।মেয়ে সারাদিন থাকে তোর কাছে, মেয়েকে কি শিক্ষা দেস? গন্ডমূর্খ! হচ্ছে দিন দিন। “এসপি” দয়া দেখিয়েছে বলে রক্ষা। না হলে চৌদ্দ শিকে ভরে রাখতো এতোক্ষণে। তারপর গর্জে উঠে বললেন,
— অপদার্থটা কোথায়? খেয়েছে কিছু!
______________
কোনো দূর্নিতি না থাকলে “এএসপি” থেকে “এসপি” হতে সর্বনিম্ন সময় লাগে আট বছর। বিসিএস দিয়ে প্রথম বারে টিকে যাওয়া ইরফাদ সিনহা “এএসপি”তে যোগ দেন।তিনি তার কর্মদক্ষতা,বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে একাধিক বার নিজেকে প্রমাণ করে,উপর মহলের ডিআইজি থেকে আইজিপির মনে জায়গা করে নিয়ে নিজের প্রমোশনের পথ সিথিল করেছেন। এরপর সব সিনিয়রদের টেক্কা দিয়ে সবার সহযোগিতায় ও নিজের কর্মদক্ষতায় আট বছরের আগেই নিজের যোগ্যস্থান দখল করে নিয়েছেন। এই মানুষটাকে টেক্কা দেয়া তো সহজ কথা নয়। তবে রিজভী শিকদার যে এইবার অন্যেচাল চালবেন । যাতে সাপও মরে লাঠিওনা ভাঙ্গে।ইরফাদ সিনহার অনুপস্থিতে, রিজভী শিকদারের মাথায় একটি দুষ্টুবুদ্ধি খেলা করে। জীবনে বহুবার, বহুভাবে তিনি ইরফাদ সিনহার কাছে অপমানিত হয়েছেন, ছোট হয়েছেন।তিনি মনে মনে ভাবছেন সুযোগ যখন যেচে এসে ধরা দিয়েছে। এই সুযোগ তো সে ছাড়বেনা।বড় বড় কেস হলে হেডকোয়ার্টার থেকে ইরফাদ সিনহাকে পাঠানো হয়। তাই এমন কোনো কাজ তার হাতে আসেনি যাতে তিনি সুনাম অর্জন করতে পারেন। তবে যেসব কেস হাতে পেয়েছিলেন,তার জন্যে আরো নিজের পোষ্টের অযোগ্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন। তবে ইরফাদ সিনহার অনুপস্থিতে আজ তার হাতে আসা কেসটির ক্রেডিট নিজের করে নিবেন। যাতে হেড লাইন জুড়ে তার নাম থাকে। ম্যাজিস্ট্রেটের একমাত্র ভাতিজা কয়েকদিন যাবৎ নিরুদ্দেশ। থানায় ইনফর্ম করলে “এসপি”র সাহায্যে ছাড়াই তদন্তের ভিত্তিতে মেইন কালপ্রিটকে গ্রেফতার করেছেন রিজভী শিকদার।
রায়হান রাফির বাড়ির লোকদের ডাকেন রিজভী শিকদার। তারপর সিনথিয়ার পুরো ঘটনা খুলো বলেন। তিনি জানান বিনা ওয়ারেন্টে সাতান্ন ধারায় আমলি কেস অনুযায়ী সিনথিয়াকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা তার থাকলেও “এসপি”র কারণে তিনি তা পারবেন না। ইরফাদ সিনহা এই মেয়ের বিষয় ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। তিনি আরও বলেন,
— শুনুন! চোধুরী সাহেব। আপনি হলেন ম্যাজিস্ট্র্যাটের ছোট ভাই। আপনার পাওয়ার কিন্তু অনেক বেশী। কিন্তু আমাদের পক্ষে “এসপি” কে সামনাসামনি টেক্কা দেয়া সম্ভব না। তাই একটা ভালো পরামর্শ দিচ্ছি।এই মেয়ের কোনো তথ্য উপর মহল জানে না।তারা সব এসপির উপর ফেলে রেখেছেন। কিন্তু মেয়ে যেহেতু আপনাদের পরিচিত।সকল তথ্যের উপর ভিত্তি করে তাকে দোষী করে, একটি এজাহার লিখুন।তার উপর ডিপেন্ড করে এফআইআর হবে। এবং আপনার ভাইকে দিয়ে উপর মহলে চাপ দেন।যাতে যেনো ইমার্জেন্সি ওয়ারেন্ট আসে মেয়েটিকে গ্রেফতার করার। আজকে “এসপি” অনুপস্থিত। তার অনুপস্থিতিতে কেসটার দায়িত্ব আমার। আমি তাকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে তুলে আনবো। এতে আপনারাও তাড়াতাড়ি ফয়সালা পাবেন,আমারও দোষ হবেনা। আবার “এসপি” ইরফাদ সিনহা আইজিপি,ম্যাজিস্ট্রেট এর কথাও ফেলতে পারবেন না।
সব নিরবে শুনে রাফির বাবা বলেন,
— সব ই তো বুঝলাম। কিন্তু এখানে আপনার লাভ?
— কি যে বলেন, আমার আবার কিসের লাভ?মানব সেবাই তো আমার পরম ধর্ম। তবে ধরেন একটু মিডিয়া ফিডিয়া হলো। ক্যামেরার সামনে পড়লাম, একটু আলোচনা হলো। কেসের ক্রেডিট টা পেলাম। এই আর কি!
রিজভী শিকদারের দেয়া প্ল্যান মোতাবেক কাজ শুরু হলো।
তিনি শেষে শুধু বললেন,
— যা করবেন আজকের মধ্যেই। আর মিডিয়া, ফিডিয়ার ব্যবস্থা করবেন। তাহলে কেসটি আরও শক্তপোক্ত হবে। আর শক্তপোক্ত কেস না হলে “এসপি” তুরি মেরে এই মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন।
—–
জানালার পর্দা চুইয়ে আসছে বৃষ্টির ছাট। ভোর বেলা থেকে শুরু হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। ইরফাদ জানালার থাই গ্লাস চাপিয়ে দেয়।তারপর গোসল সেরে ইজি চেয়ারে আরাম করে বসে।যে জায়গায় সে গতকাল গিয়েছিলো,ঐজায়গায় নেটওয়ার্ক খুব দূর্বল। বলতে গেলে নেটওয়ার্কের বাইরেই ছিলো।আরেকটা ফোন তো বন্ধ ই। রাতে ফিরে চার্জে দেয়া হয়েছে। কাল অনেক প্রেশার যাওয়ায় রাতে ফিরে, ফ্রেশ হয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি।একঘুমে রাত পার হয়ে গেছে।সে একহাতে জানালার পর্দা একপাশে সরিয়ে থাই খুলে দিলো। ইজি চেয়ারে আরাম করে বসলো। কফির মগে চুমুক দিয়ে ফোন স্ক্রল করতে থাকলো। ঠিক তখনি চোখ দুটো আটকে গেলো একটা নিউজে। পুরো নিউজফিড জুড়ে একটাই নিউজ। ভিডিওর হেডলাইনে চোখ পড়লো তার,
“প্রেমিকাকে না জানিয়ে, প্রেমিকের অন্যত্র বিয়ে। অতঃপর প্রেমিককে অপহরণ করে, এই বাইশ বছর বয়সী তরুণী।”
ভিডিও অন করে ইরফাদ সিনহা,
শত শত মানুষের ভিড়! ক্যামেরা!মাইক্রোফোন! সাংবাদিক! তারমাঝে হাতকড়া পড়ে দাঁড়িয়ে আছে পাতলা গরনের সিনথিয়া। উৎসুকজনতার উপচে পড়া ভীর।কারণ একটাই! কি করে মেয়ে হয়ে একটি পুরুষকে গুম করে দিলো? এই প্রশ্নে পুরো শহর যেনো তোলপাড়। রাতের অন্ধকার রাস্তায় ক্যামেরার ফোকাসে চারদিক আলোয় আলোকিত। হাজার হাজার প্রশ্ন, কি করে করলো? রায়হান রাফি এখন কোথায়?সে বেঁচে আছে কি না? সেই প্রশ্নের সম্মুখে মেয়েটি শুকনো মুখে,দূর্বল শরীরে, নিস্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। যেনো পৃথিবীতে সে আর নেই। সবাইকে ঠেলেঠুলে সরু রাস্তা বের করে দিচ্ছে কর্মরত পুলিশ সদশ্য। মানুষের ফাঁকফোকর মেয়েটিকে বাহু ধরে বের করে আনছে মহীলা পুলিশ। আর সিনথিয়া তাদের সাথে তালমিলিয়ে এলোমেলোভাবে হাঁটছে।চোখ দুটো রক্তলাল, টকটকে রক্তজবার ন্যায় লাল হয়ে আছে নাকের ডগা।শরীরের রক্তকণা যেনো নোনতা জল আকারে চোখ ফেটে ঠিকরে পড়ছে।
এরকম অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয়, অসম্ভাব্য ঘটনার বাস্তব চিত্র নিজের স্বচক্ষে দেখে সমুদ্রের উচ্ছাসের মতো অসংখ্য প্রশ্ন তীব্র গতিতে মাথায় এসে বাড়ি খেলো ইরফাদ সিনহার। সমগ্র দৃশ্য যেনো পৌষমাসের হাড়কাঁপানো হীমশীতল বাতাসের ন্যায় তাকে একবার মৃদু করে কাঁপিয়ে তুললো। পরোক্ষণে আগুনের লার্ভার ন্যায় উত্তপ্ত হয়ে উঠলো।
তারপর…….
## সবাই বেশী বেশী মেনশন দিবেন। ভুল ধরিয়ে দিবেন। কোথায় কেমন হচ্ছে জানাবেন।গল্পের জন্য আমাকে কোনো প্রেশার দিবেন না।পরবর্তী পর্বের জন্যে ধৈর্য্য ধরবেন। সবাই পাশে থাকবেন।