নীলের_পরি (৪৯)

0
6

#নীলের_পরি (৪৯)

চারদিকে সুনশান নীরবতা। হঠাৎ ই ভোরের পাখিরা কিচিরমিচির করে উঠল। কালো আঁধার কে ছাড়িয়ে উদয় হলো এক নতুন ভোরের। স্নিগ্ধ এক ভোর, প্রাণোচ্ছল পরিবেশ। নীল চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল পরি তার পাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে আছে। নীল মুচকি হেসে পরিকে মুগ্ধ নয়নে অপল দৃষ্টিতে দেখে নিল।
কি স্নিগ্ধ এই মুখ। কোনো প্রসাধনী ছাড়া ঝরঝরে তেলতেলে চেহারাতে ও কাউ কে এতটা মায়াবি লাগতে পারে তা নীলের জানা ছিল না। কয়েকটা অবাধ্য চুল পরির কপালে লেপ্টে আছে। চোখের পাপড়ি গুলো স্থির। ঘুমন্ত মুখে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মোহনীয় হাসি। একদম পিচ্চিদের মতো লাগছে পরি কে। বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মে রে আছে।
অবশ্য পরির বিয়ে হলে ও পিচ্চি ই বটে আঠারো শেষ করল সবে! নীল আনমনে হেসে উঠল। নিজের থেকে সাড়ে সাত বছরে পিচ্চি একটা মেয়ে নাকি ওর বউ! ক্লাস সেভেন পড়ুয়া এক পিচ্চি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল নীল! ভাবতেই কেমন গা শিউরে উঠে। নীল ঘুমু ঘুমু চোখ ছাপিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আড়মোড়া ভে ঙে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই কি মনে করে যেন ফিরে আসে। পরির মায়াবী স্নিগ্ধ মুখ টার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে। আলতো হেসে টুপ করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। মেয়েটা বিশ্ব সুন্দরী নয়, লাখে একটা সুন্দরী এমন ও নয়। তবে পরির মুখে যে মায়া আছে তা বিশ্ব সুন্দরীদের হারাতে ও সক্ষম। নীল ভয়ঙ্কর প্রেমে পড়েছে।
এই ভয়ানক অনুভূতির কোনো সীমা নেই। নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। এক সুন্দর অনুভূতি আর হালাল সম্পর্কে আবদ্ধ তারা। তবু ও এক পূর্ণ পবিত্রতার অপেক্ষা করছে দুটি ছটফটে হৃদয়। তাদের অনুভূতি গুলো বেরিয়ে আসতে চায়। তবে নিজেদের সীমা অতিক্রম করে না তারা। নীল মৃদু হেসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।

লাল নীল রঙা আলোতে ঝলমলে পরিবেশ। সবাই বেশ কৌতূহল নিয়ে একটা বিশাল হল রুমে দাঁড়িয়ে আছে।
চারদিকে মানুষে টইটুম্বর। এক সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে। সবাই যে যার মতো মাতোয়ারা হয়ে আছে। সবার চোখে মুখে অন্যরকম অনুভূতি জেকে বসেছে। কেউ জানে না এখানে কেন এসেছে। হাজারো কৌতূহল মনের মাঝে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। নীলের অপেক্ষা করতে করতে সবাই চরম বিরক্ত। হঠাৎ ই সমস্ত আলো নিভে গেল। সবাই খানিক টা চমকে গেলে ও পরক্ষণেই এক চিলতে হাসি এসে সবাই কে রাঙিয়ে দিল।

রঙিন আলোর ঝলকানিতে নীল কে এক রাজপুত্র ই লাগছে। লাল রঙা ব্লেজার এর সাথে সাদা শার্ট। এ কি রকম ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগছে নীল কে। মনে হচ্ছে এই লাল রঙ টা শুধু মাত্র নীলের জন্য ই তৈরি হয়েছে। পরি এক ধ্যানে নীলের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন চোখ জোড়া নীলে মাঝে ই নিবদ্ধ হয়ে গেছে। মনে বয়ে চলেছে প্রেমের জোয়ার। পরি ভাষাহীন হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখে দারুণ এক খুশির ঝলকানি। পরির ভাবনার সুতো কাঁটে বাজি ফোঁটার আওয়াজে। রঙিন বাজির আওয়াজের সাথে বড় বড় অক্ষরে ভেসে আসে “Welcome to the new home, Ahmed family.”

সবাই অবাক হয়ে নীলের দিকে তাকায়। সবার চোখে মুখে উপচে পড়া কৌতূহল। নীল মুদু হেসে সবাই কে জানায়।
এই টা নীলের বাড়ি। সবাই বেশ অবাক হয়। কিন্তু পরির মাথা ঘুরে উঠে যখন শুনে এইটাই সেই গুলশানের বাড়িটা।
যা দেখে পরি মুগ্ধ হয়ে ছিল। নীল তখন বলে নি কেন?
নীল যেন পরির মনের কথা বুঝে যায়। হেসে পরির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল
“সারপ্রাইজ মিসেস নীল।”

পরির চোখ দুটো রসগোল্লার আকার ধারন করেছে। পরি মৃদু স্বরে বলল,”আমরা পেছন দিক দিয়ে এসেছি বলে বুঝতেই পারি নি। আপনি আজকাল চমকের উপর চমক দিয়ে যাচ্ছেন। কি ভয়ঙ্কর আপনি।”

নীল মুচকি হেসে বলল,”আর এই ভয়ঙ্কর মানুষটার গভীর প্রেমে পড়েছ তুমি। আর আমি মাতোয়ারা হয়ে বারং বার হাড়িয়ে যেতে চাই তোমার প্রেমে।”

নীলের কথাতে পরি সামান্য লজ্জা পায়। নীল মৃদু হেসে বলল,”সতেরো আর আঠারো তলায় আমাদের জন্য ঘর করেছি। তোমার স্বপ্নের মতো করে। যেমন টা তুমি পোস্ট দিতে।”

নীলের কথাতে পরির চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠে। এই মানুষ টা পরির প্রতি টা ইচ্ছে কে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে।
এই মানুষটির চোখে লেগে থাকে স্নিগ্ধ মায়া। পরির ইচ্ছে হচ্ছে নীল কে জড়িয়ে বলতে আমার এই সব,কিচ্ছু চাই না নীল। আমি শুধু আপনাকে চাই। পরি নীলের চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। নীলের চোখ যেন হাসছে। কি অপরূপ সে দৃশ্য।

পরির ভাবনার মাঝে নীল বলল,”কি ভাবো এত?”

পরি মুচকি হেসে বলল,”এত বড়ো বাড়ি দিয়ে কি হবে।”

নীল একটু ভাব নিয়ে বলল,”আহ কি যে বলো না। আমার বাঁচ্চা, নাতি নাতনি সবাই মিলে থাকতে গেলে তো লাগবেই।”

নীলের কথা তে পরি সামান্য লজ্জা পেল। পরি মাথা নিচু করে বলল,”আপনি চুপ করুন তো।”

নীল মুচকি হাসতেই পেছন থেকে অনিক আর হাফসা কেশে বলল,”বাহ বেশ প্রেম হচ্ছে তো। আমাদের ই কপাল বিয়ে কবে হবে তা নিয়ে অজানায় ভুগছি, ইস।”

নীল চোখ রাঙিয়ে বলল,’শা লা ব জ্জা ত তুই। লুকিয়ে লুকিয়ে কথা ও শুনছিস! তোর মাথায় দুটো থা প্প ড় দিলে ও কম হয়ে যাবে। নির্লজ্জ কোথাকার!”

অনিক অবাক হয়ে বলল,”কেমনে কি মাম্মা। আমি তোর শালা কেমনে ? পরি তো আমার ছোট।”

নীদ অনিকের পিঠ চাপরে দিয়ে বলল,’বেশি বুঝিস। তোর এই সব বোঝা বুঝি হাফসা ঝেড়ে ফেলে দিবে দেখে নিস।
ভালোই হলো তোর গলাতে পেত্নি টাকে ঝুলিয়ে দিব।”

নীলের কথা শুনে হাফসা রেগে বম। কিছু বলবে তার আগেই একজন সার্ভেন্ট এসে বলল,”স্যার ডিনার রেডি। গেস্ট দের নিয়ে যাব?”

নীল সম্মতি জানাতেই সার্ভেন্ট চলে যায়। নীল সবাই কে নিয়ে ডিনার করার জন্য চলে আসে। এক গাদা খাবার খেয়ে সবার অবস্থা নাজেহাল। বাজি ধরে ছিল কে কত বেশি খেতে পারে। অনিক তো চেয়ার থেকেই উঠতে পারছে না।
যা দেখে হাফসা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অনিক বেচারা মুখ গোমড়া করে থম মেরে বসে রইল।”

নীল সবার সাথে আলোচনা করে নিল। যেহেতু অনিকের ফ্যামেলি ও আছে তাই অনিক আর হাফসার এন্সগেসমেন্ট এর কথা এনাউন্স করে দেওয়া হবে। আর নীল আর পরির বিয়ের কথা ও। সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত হলো যে নীল আর পরির মেহেন্দির দিন ওদের এন্সগেসমেন্ট করা হবে।

হাফসার চোখে মুখে নিদারুন লজ্জার ছাপ। অনিক থেকে থেকে হাসছে। আর নীল আর পরি নিজেদের মাঝে দূরত্ব রেখে চোখের ভাষা বিলাশ করছে। তবে মনের দূরত্ব এক ইঞ্চি ও নেই । আর মাত্র কয়েক দিন। প্রতীক্ষার অবসান হলো বলে।

সবাই গ্রামে এসেছে আজ পাঁচ দিন হলো। কয়েক দিন পর ই বিয়ে। বিশাল আয়োজন। কত রকমের ঝামেলা ও রয়েছে। নীল আর পরির দেখা হচ্ছে না চার দিন ধরে। দু পরিবারের কড়া নির্দেশ শুভ কাজ সম্পূর্ণ হতে কয়েক দিন বাকি এখন কেউ দেখা সাক্ষাৎ করবে না। গ্রাম্য পরিবেশ বরাবর ই বড্ড সুন্দর। দীর্ঘ পনের বছর পরি তো গ্রামেই ছিল। অবশ্য পরির বিয়ের অনুষ্ঠান পরির দাদু বাড়িতেই হবে আর মেহেন্দির অনুষ্ঠান নানু বাড়ি তে। বাসার সবাই ব্যস্ত। এই টা সেই টা ঠিক করতে করতেই সবার অবস্থা নাজেহাল। বিকেলে নাস্তা বানিয়ে ট্রে হাতে আসছিল পরি।
নানার হাতে বিয়ের কার্ড দেখেই ট্রে টা টেবিলে রেখে ড্রয়িং রুমে চলে আসল। সবাই বিয়ের কার্ড দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বেচারি পরি কোনো চান্স ই পাচ্ছে না। আর আগ্রহ নিয়ে বলতে ও পারছে ন। বিষয়টা অত্যন্ত হতাশাজনক। পরি মুখ গোমড়া করে এক সাইডে দাঁড়িয়ে রইল। সবার দেখা শেষ হলে পরি নানা ভাইয়ের পাশের সোফা টা তে বসল। পরির নানা ভাই মুচকি হেসে পরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর কার্ড গুলো পরির হাতে দিয়ে চলে গেলেন। চার পাঁচ টা স্যাম্পল হিসেবে এনেছেন ওনি। কিছুক্ষণ পর এক গাদা কার্ড চলে আসবে। পরি আশে পাশে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ আছে না। বাড়ি ভর্তি মেহমানের সমাগম। পরি মন খুলে নিজের বিয়ের কার্ড উ দেখতে পারবে না। পরি একটা কার্ড নিয়ে বাইরে চলে আসল। পরির নানা বাড়ির পেছনে ছোট্ট একটা বাগান আর তার পর ই নদী। পরি ওড়না দিয়ে কার্ড টা আড়াল করে নদীর পাড়ে চলে আসল। নদীর পাড়ে ও মানুষ এর সমাগম। পরি আহত মনে চলে আসল। অবশেষে উপায় না পেয়ে পরি বাগানের এক কোণে চলে আসল। নদীর ঠান্ডা হাওয়া পরি কে মাতাল করে যাচ্ছে। পরির অধর কোণে লেগে আছে স্নিগ্ধ হাসি। লজ্জা মাখা এক অনুভূতি কাজ করছে। পরির গাল দুটো রাঙা হচ্ছে বারং বার। কাঁপা হাতে লাল রঙা কার্ড টা খাম থেকে খুলল পরি। মুহূর্তেই পরির গাল দুটো র ক্ত রঙা আকার ধারন করল।

কার্ডের উপরে বড়ো বড়ো করে লেখা,

Nil Wed’s Pori

এই ছোট্ট লেখাটা কারো মনে এতটা উতাল পাথাল ঝড় বয়ে দিতে পারে তা পরি কে না দেখলে বোঝাই যেত না। পরি অতি যত্নে পুরো কার্ড টা তে চোখ বুলিয়ে নিল। পুরো কার্ড টা পরির কাছে স্বপ্নের মতো। এই সেই স্বপ্ন যা সে ছয় বছর ধরে দেখছে। একটা সময় তো ভেবেই নিয়েছিল এই স্বপ্ন গুলো কখনো বাস্তবে রূপান্তর হবে না। এই সব ভাবতে ভাবতে পরির চোখ দিয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

চলবে……
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here